পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে আজ প্রহসন বললেও কম বলা হয়। দুর্নীতির পাঁকে গলা অবধি ডুবে থাকা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বসছেন ধর্নায়, তাঁর দলের প্রধান মুখপাত্র এই সরকারের দুর্নীতি থেকে সকলের দৃষ্টি ঘোরাতে আগের সরকারের দুর্নীতির পর্দাফাঁস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সম্প্রতি তিনি এক বিরোধী দলের তরুণ তুর্কির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হয়ে দুবছরে ২২ লাখ টাকার গাড়ি কী করে তিনি কিনতে পেরেছেন। প্রত্যুত্তরে সেই তরুণ নেতা তাঁর উচ্চবিত্তসুলভ জীবনযাপনের সমর্থনে “তোর বাপের কী? তুই কি টেস্ট টিউব বেবি?” মার্কা অপ্রয়োজনীয় ও কদর্য বিবৃতি দিয়েছেন (পরে নিন্দার মুখোমুখি হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন) এবং তাঁর গুণমুগ্ধ অনুগামী আর দরদীরা “কী দিলেন দাদা” গোছের মন্তব্য করে ব্যাপক হারে সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন। এঁরা সবাই বাংলার রাজনীতিকে সার্কাসে পরিণত করে অতি সুচারুভাবে মূল রাজনৈতিক বিষয়বস্তু থেকে আলোচনা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। বিতৃষ্ণা আর চিন্তা থেকে এই লেখার সূত্রপাত।

শাসক দলের দুর্নীতি নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জ্বলন্ত শ্রেণি ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজ, স্কুল সার্ভিস কমিশন, টেট সমেত প্রায় সমস্ত সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির প্রধান ভুক্তভোগী গ্রাম-শহরের গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। একজন খেটে খাওয়া মানুষের বাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শিখে নিরাপদ সরকারি চাকরির আশায় বুক বেঁধে থাকে। তার সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প স্থায়ী সম্পদ তৈরির কাজ করে, যা গরিব মানুষকে ভবিষ্যতের ভিত তৈরির কাজে সাহায্য করে। কিন্তু সরকারি চাকরির সম্ভাবনাকে শিকেয় তুলে দিয়ে অন্যায্যভাবে টাকা নিয়ে সরকারি সুবিধা নিজেদের লোককে পাইয়ে দিয়ে গরিব মানুষের আর্থিক বিকাশকে স্তব্ধ করছে এই সরকার। স্থায়ী চাকরি আর আর্থিক নিরাপত্তার অভাবে বেশিরভাগ মানুষকেই আরও কম মজুরিতে অস্থায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করতে হয়। এতে আখেরে লাভ হয় আম্বানি-আদানির মত বড় কর্পোরেটের। বালি খাদান, ইঁট, কাঠ, পাথর ইত্যাদির সিন্ডিকেট ব্যবস্থাও এক ক্ষয়ে যাওয়া ব্যবস্থাকে কিছুটা ঠেকনা দিয়ে রাখার মত কাজ করছে। একটা গোটা প্রজন্মকে অস্থায়ী কাজের উপর নির্ভরশীল বানিয়ে হয়ত সরকার এখন ভোট পাচ্ছে, কিন্তু বাংলার মানুষকে পিছিয়ে দিচ্ছে প্রায় তিন-চার দশক।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কিন্তু এই আলোচনা সাধারণ রাজনৈতিক কথাবার্তায় কই? আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে শাসক দল যে ব্যাকফুটে, একথা স্বীকার করবেন তাদের সবচেয়ে অন্ধ সমর্থকও। প্রতিটা পঞ্চায়েতে মানুষ শাসক দলের অকাজ-কুকাজ নিয়ে বীতশ্রদ্ধ – বিভিন্ন গ্রামে দিদির দূতদের উপর স্বতঃস্ফূর্ত হামলাই তা প্রমাণ করে। এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একজোট করার দায়িত্ব যে বিরোধী দলের, তাঁরা কী করছেন? বলতে গেলে ফিরে আসতে হয় আগের প্রসঙ্গে। শাসক দলের মুখপাত্র বনাম বিরোধী দলের তরুণ তুর্কি। দুপক্ষের লড়াই আসলে কে কতটা প্রচারের আলোয় থাকতে পারেন তা নিয়ে। আগেও বলেছি, মুখপাত্রমশাই তাঁর দলের দুর্নীতি থেকে সকলের দৃষ্টি ঘোরাতেই ২২ লাখ টাকার গাড়ির কথা তোলেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাঁর অমনই করার কথা। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় সিপিএমের তরুণ নেতার বক্তব্যে। গাড়ি কেনার ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট দেখালেন, প্রমাণ দেখালেন নিজের আয়ের – সবই ঠিক আছে। কিন্তু তার সঙ্গে যে ব্যক্তিগত আক্রমণ তিনি করলেন তা অত্যন্ত আপত্তিকর।

ব্যক্তিগত আক্রমণ করা ভাল না খারাপ – সে তর্কে যাচ্ছি না, কারণ সে তর্ক অবান্তর। ব্যক্তিগত আক্রমণ অনেক সময়ে পচা গলা সমাজের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষা। কোনটা শালীন, কোনটা অশালীন তার মানদণ্ডও অনেক সময়ে সমাজের উপরের স্তরের মানুষেরই ঠিক করা। কিন্তু একজন অর্বাচীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অভিযোগের উত্তর যদি স্কুলের শিশুর মত হাত-পা ছুড়ে দিতে হয়, তাহলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক রাজনৈতিক নেতার লজ্জা হওয়া উচিত। উনি চাইলেই ওঁর ব্যক্তিগত আক্রমণের মধ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য ঢুকিয়ে দিতে পারতেন। চাইলেই মেহনতি মানুষের রোজকার রুজিরুটির সংগ্রামের কথা তুলে ধরতে পারতেন, তুলে ধরতে পারতেন শাসক দলের দুর্নীতির কথা। মানুষকে কীভাবে দিনের পর দিন বোকা বানানো হচ্ছে, পিছিয়ে রাখা হচ্ছে, সেকথাও একজন বামপন্থী নেতার মুখে সহজেই উঠে আসতে পারত। কিন্তু সোশাল মিডিয়াখ্যাত এই নেতা সেসব না করে কিছু কুৎসিত পিতৃতান্ত্রিক মন্তব্য করলেন। এতে বাজার কিছুটা গরম হল বটে, কাজের কাজ কিছুই হল না। নেতা তা বুঝেছেন কি?

আরো পড়ুন পার্থ চাঁদমারি হবেন আর বেঁচে যাবে দুর্নীতির দুষ্টচক্র?

সাধারণ মানুষের থেকে এই বিরোধী দল কতটা বিচ্ছিন্ন, তা বোঝা যায় তরুণ নেতার বক্তব্য নিয়ে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস দেখে। একটা বামপন্থী দলের কর্মীর অবশ্যই শখ আহ্লাদ থাকতে পারে, তবে এত দামি গাড়ি কেনা নিয়ে এমন অশ্লীল উদ্দীপনা অসহ্য। “বাপের টাকায় গাড়ি কিনেছে বেশ করেছে” বলা যে কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীর শোভা পায় না – এই ন্যূনতম চেতনাটুকুও এই ফেসবুকিয় সমর্থকদের নেই। ছোটবেলায় কেউ কোনো অপ্রিয় সম্বোধন করলে “যে বলে সেই হয়” বলে আমরা অনেকেই খানিক আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছি। অনেকটা সেইভাবেই “কেমন দিলাম” ভাব এই নেতা-পাগল সমর্থককুলের। কোনো রাজনৈতিক আলোচনা না করে কোন তৃণমূল কাউন্সিলরের অ্যাস্টন মার্টিন গাড়ি আছে, বামপন্থীদের গাড়ি কেনা উচিত কিনা ইত্যাদি নানা বিষয়ে লাইনের পর লাইন নষ্ট করে চলেছেন। তাঁরা বুঝতেই পারছেন না, এতে শাসক দলের লাভই হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে ক্ষোভের জল ঘোলা করে দিয়ে মুখপাত্রমশাই পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। এদিকে বামপন্থী ভক্তকুল সেই জলে সাঁতার কেটে চলেছেন। সবচেয়ে জরুরি কথা, শাসক দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আলোচনা যদি “আমাদের নেতারা খুব সৎ, তোমরা সবাই চোর” – এই মর্মে আটকে থাকে, তাহলে বাংলার মানুষ কতটা মুখ তুলে চাইবেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছেন। মানুষ বিকল্প রাজনীতির খোঁজ করছেন, কার ধুতি কত সাদা তা নিয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তাঁদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত করে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম না করে শুধুমাত্র কোন নেতা কত বেশি সৎ সেই ফিরিস্তি দেওয়ার চেষ্টা করলে হাসির খোরাক হতে হবে। পুরনো কাসুন্দি বেশি ঘাঁটলে তেতো হয়ে যায়, একথা আমাদের ফেসবুকিয় বিপ্লবীরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন তত মঙ্গল।

ওই বামপন্থী দলটির সমর্থক হিসাবে আমি চাই তারা পঞ্চায়েত ভোটে সফল হোক এবং আগামীদিনে মানুষকে শ্রেণিসংগ্রামের পথে চালিত করুক। কিন্তু তার জন্য কর্মী-সমর্থকদের সার্বিক রাজনৈতিক চেতনার উন্নতি প্রয়োজন। যতদিন এই দল ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতি করে গরিব মানুষের রোজকার রুজিরুটির লড়াই থেকে নিজেদের দূরে রাখবে, ততদিন শাসক দল আর বিধানসভার মেকি বিরোধী দল লাভের গুড় খেতে থাকবে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.