আমাদের সংবিধানে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা রয়েছে ইতিবাচক অর্থে, ইউরোপের দেশগুলোর মত নেতিবাচক অর্থে নয়। ভারতের মত বিশাল দেশের বিভিন্নতার নিরিখে এই ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতাই কাম্য। নিজ নিজ ধর্ম পালন বা ধর্মীয় উৎসব উদযাপনে রাষ্ট্রের বাধা দেওয়ার কথা নয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলার শাসকরা কখনো তা করেননি। বরং বিভিন্ন ধর্মের উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নজির রয়েছে।
রামনবমীর ইতিহাস না ঘেঁটে যে বছর প্রথম গোটা বাংলা জুড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রামনবমী পালিত হল, তার স্মৃতি আমাদের মত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুর কাছে চরম ভয় ও আশঙ্কার। অস্ত্র নিয়ে উদ্দাম নৃত্য, ডিজে বাজিয়ে বিকৃত হিন্দি উচ্চারণে ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার, শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে মিছিল – এ সবের মধ্যে ধর্মপালনটা কোথায়? বোঝাই যাচ্ছিল, রামের নামকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের তথা বাংলার সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে আসলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে “ভারত মেঁ রহনা হোগা তো সবকো জয় শ্রীরাম কহনা হোগা”। বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির ইতিহাসে সেদিন কোথায় যেন সুর কেটে গেল।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
একথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট, যে ভারত তথা বাংলার শুকিয়ে যাওয়া বুনিয়াদি স্বপ্নগুলোকে ধর্মের আফিম খাইয়ে ভুলিয়ে রাখার কৌশল ছিল ওই আক্রমণাত্মক রামনবমী পালন। সেই পরিকল্পনায় বিজেপির সঙ্গে সঙ্গে সামিল হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস তথা রাজ্য সরকার। রামনবমীর নামে এই ভয় দেখানো অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ করতে কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা করেনি রাজ্য সরকার। কারণ সংখ্যালঘু মানুষ যত ভয় পাবেন, তৃণমূল তত শক্তিশালী হবে। সংখ্যালঘুর ত্রাতা হওয়ার অভিনয় করে নিজেদের পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত করতে পারবে। অন্যদিকে তৃণমূল প্রধান মমতা ব্যানার্জির মুসলিম এলাকায় গিয়ে আরবি ভাষায় সম্বোধন করা, মাথায় হিজাব পরা – এসব দেখিয়ে বিজেপিও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বার্তা ছড়াতে পারে, যে পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই গত কয়েক বছর ধরে চলছিল আরএসএস এবং আরএসএসের দুর্গার মধ্যে লোকদেখানো লড়াই।
তারপর একসময় সারদা, নারদা কাণ্ডের ফলে তৃণমূলের মুখোশ জনসাধারনের কাছে খুলে যেতে বসল। গরু পাচার, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, আবাস যোজনায় দুর্নীতি – সবেতে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বাড়িতে যেভাবে কোটি কোটি টাকা পাওয়া গেল তাতে দুর্নীতি শব্দটাও লজ্জা পাবে। এক-তৃতীয়াংশ মাইনে পাওয়া সরকারি কর্মচারী শিক্ষকদের ডিএর দাবিতে বামপন্থীদের আন্দোলন, টেট প্রার্থীদের জন্য বাম ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোর দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, রাজ্যজুড়ে সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে বামপন্থীদের আন্দোলন এবং এর মধ্যে সাগরদীঘির উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থীর জয় এটাই প্রমাণ করে যে সাধারণ মানুষ ভয় কাটিয়ে উঠেছে। তাই তো ডিএ, শূন্য পদে স্বচ্ছ নিয়োগ সমেত বিভিন্ন দাবি নিয়ে কর্মচারী ও শিক্ষকদের ১০ মার্চের ধর্মঘট নজিরবিহীনভাবে সফল হল।
আরো পড়ুন সাগরদীঘিতে তৃণমূলের ভরাডুবি যেসব প্রশ্ন তুলে দিল
ফলে এই সরকার নিজের শেষের শুরু দেখতে পাচ্ছে, সাধারণ মানুষও। সাগরদীঘিতে মুসলিম প্রবাসী শ্রমিকদের তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া একথাই প্রমাণ করছে যে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় যারা “দুধেল গাই”, তারা চাঁট মারা শুরু করছে। শিক্ষক, সরকারি কর্মচারীরা ভয় কাটিয়ে সোল্লাসে ধর্মঘটের সমর্থনে শোকজের উত্তর দিচ্ছেন। মাননীয়ার মুখোশ পুরোপুরি খুলে গেছে। মুসলিমদের মসীহা যে একজন মিথ্যাবাদী এবং আরএসএসের লোক তা আজ এ রাজ্যের মুসলমানদের কাছে স্পষ্ট। মুখোশের আড়াল থেকে যে মুখটা বেরিয়ে এসেছে তার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের কোনো তফাত নেই। তাই এ বছর রামনবমীর নামে (৩০ মার্চ) রাজ্যজুড়ে আরএসএস ও তাদের দুর্গার বাহিনীর যৌথ হিন্দুত্ববাদী তাণ্ডব দেখা গেল।
During a RamaNavami rally in Howrah, West Bengal, a Hindutva mob chanting "Jai Shri Ram" set fire to Muslim shops and vehicles.#HindutvaTerror #RamNavami pic.twitter.com/dSM06xAdy5
— Meer Faisal (@meerfaisal01) March 30, 2023
এবার আর রামনবমী নিয়ে বিজেপি-তৃণমূলের মিথ্যা কাজিয়া নয়, একেবারে ‘মিলে সুরে মেরা তুমহারা’। দুবরাজপুর, বোলপুর, মেদিনীপুর – সর্বত্র দুই ফুল একসঙ্গে রামের নাম নিয়ে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। এমনিতে যত দাঙ্গা যত সাম্প্রদায়িক বিভাজন হয় এ রাজ্যের শাসক দলের তত পোয়াবারো। কারণ সংখ্যালঘুদের ভয় দেখিয়ে ভোট আদায় করা যাবে। তবে ও জলে আর হয়ত চিঁড়ে ভিজবে না, কারণ বিজেপি-তৃণমূলের জোটের থেকেও বড় জোট তৈরী হয়েছে। সে হল মানুষের জোট।
– মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।