সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল বাংলার রাজনীতিতে নতুন কোনও বাঁক বদলের সূচনা করবে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি। একটি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফল আদৌ কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রশ্নটিও রয়েছে। সাগরদীঘির পরাজয় রাজ্যের তৃণমূল সরকারের জন্য কোনো ধাক্কাও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই উপনির্বাচনের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এবং বিরোধী শিবিরের কাছে বেশ কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন তুলে ধরেছে। এই প্রশ্নগুলির মীমাংসা না করে আগামীদিনে রাজ্য রাজনীতিতে পথ চলা মুশকিল।
সাধারণভাবে উপনির্বাচনের ফলাফল শাসক দলের পক্ষেই যায়। যে আসনে দুবছর আগে শাসক দল ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে জিতেছে, সেখানে উপনির্বাচনে প্রায় ২৩,০০০ ভোটে হারতে হচ্ছে – এমন ছবি খুব সুলভ নয়। গত দুবছরের পশ্চিমবঙ্গে এমন কী ঘটল, যার ফলে বড় অংশের ভোটার তৃণমূলের থেকে মুখ ফেরালেন? মনে রাখতে হবে, এই ভোটারদের বড় অংশই মুসলমান। সাগরদীঘিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের ভোট ৬৫%।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
উপনির্বাচন হলেও সাগরদীঘি আসনটি ধরে রাখতে তৃণমূল কংগ্রেস সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল। বিধানসভা এলাকাটিকে অনেকগুলি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, প্রতিটি ভাগের দায়িত্বে ছিলেন এক বা একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ। মুসলমানপ্রধান সাগরদীঘির একাংশে আদিবাসী মানুষজনের বাস। তাঁদের ভোট নিশ্চিত করতে জঙ্গলমহলের সাংসদ বীরবাহা হাঁসদাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই নিবিড় প্রচারাভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিজস্ব ‘টিম অভিষেক’ মাটি কামড়ে পড়ে ছিল সাগরদীঘিতে। অভিষেক নিজে সাগরদীঘির জয় দেখতে কতটা মরিয়া ছিলেন তার প্রধান গত ১৯ ফেব্রুয়ারির ভাষণ। তৃণমূলের যুবরাজ সাগরদীঘিতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, যে বুথ তৃণমূলকে লিড দেবে না সেই বুথ মীরজাফরের বুথ।
এত কিছুর পরেও যে তৃণমূল বিপুল ব্যবধানে হারল, তার নেপথ্যে কেউ যদি ‘অধীর চৌধুরী ম্যাজিক’ বা ‘বাম-কংগ্রেসের দুরন্ত যুগলবন্দি’ খুঁজে পান, তাহলে তিনি পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করবেন না। নিঃসন্দেহে এই জয় অধীরকে রাজনৈতিক অক্সিজেন দেবে। যদিও সাগরদীঘি বহরমপুর লোকসভার অংশ নয়, জঙ্গীপুর লোকসভার মধ্যে পড়ে। কিন্তু ২০২৪ সালে জীবনের সবচেয়ে কঠিন লড়াইয়ের আগে আত্মবিশ্বাস পাবেন বহরমপুরের সাংসদ। একথাও ঠিক, যে সাগরদীঘিতে জিততে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। প্রথমেই বামপন্থীদের সক্রিয় সমর্থন নিশ্চিত করেছিলেন, তারপর নিজে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন এলাকায়। মুর্শিদাবাদ জেলার ভারত জোড়ো যাত্রাকে (পশ্চিমবঙ্গে নাম ছিল ‘সাগর থেকে পাহাড়’) নিজের লোকসভা আসন বহরমপুরের উপর দিয়ে খুব বেশি না নিয়ে গিয়ে মূলত সাগরদীঘির উপর দিয়ে হেঁটেছেন। একেবারে সাবেকি অধীরের কায়দায় জনসংযোগ করেছেন। কিন্তু তাঁর মাস্টারস্ট্রোক ছিল প্রার্থী নির্বাচন।
জেলার এক প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক বলছিলেন, তৃণমূলের সঙ্গে ভোটে লড়তে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। বায়রন বিশ্বাস একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। নির্বাচনে জিততে খরচে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি। তৃণমূলের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে টক্কর দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বায়রন এক অর্থে খুব একটা ‘রাজনৈতিক’ প্রার্থী নন। বরং সমাজসেবী হিসাবেই এলাকায় পরিচিত। তিনি এবং তাঁর বাবা বাবর বিশ্বাস গোটা মুর্শিদাবাদ জেলায় দীর্ঘদিন ধরেই সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজ করে আসছেন। গরিব মানুষের জন্য প্রচুর অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, পড়াশোনায় সাহায্য করার মত কাজ তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে নির্বাচনী রাজনীতির ময়দানে এগুলি তাঁকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। প্রচার পর্বে বায়রনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছে তৃণমূল, কিন্তু ভোটাররা পাত্তা দেননি।
সাগরদীঘিতে কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত করেছেন সংখ্যালঘু ভোটাররা। পঁয়ষট্টি শতাংশ মুসলমান ভোটারের কেন্দ্রে কেন মমতা ব্যানার্জি একজন মুসলমানকে প্রার্থী করলেন না, তা নিয়ে ক্ষোভ ছিল। প্রচার চলাকালীন বারবার উঠে এসেছে এই প্রশ্ন। দক্ষ রাজনীতিবিদ অধীর এই বিষয়টাকে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছেন।
২০২১ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের ভোট এককাট্টা হয়ে তৃণমূলের দিকে গিয়েছিল। বিজেপিকে রোখার তাগিদে গড়ে ওঠা এই সংহতিকে তৃণমূলের পক্ষে সদর্থক ভোট হিসাবে চিহ্নিত করলে ভুল হবে। দুর্বল বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে বিজেপিকে হারানো সম্ভব নয়, তাই রাজ্যের বিভিন্ন সমস্যা খানিকটা ভুলে থেকেই জোড়া ফুলে বোতাম টিপেছিলেন সংখ্যালঘু মানুষ। কিন্তু নির্বাচনের পর পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আনিস খানের মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির উপর হওয়া নির্যাতনও তাঁদের ব্যথিত করেছে। মুর্শিদাবাদে ফুরফুরা শরিফের প্রাধান্য নেই ঠিকই, কিন্তু সাগরদীঘির সাধারণ মুসলিম ভোটার প্রচার পর্বে নওশাদের গ্রেপ্তারি নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। এর সঙ্গে ছিল শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারের মত বিষয়গুলোও।
সাগরদীঘি কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেস জোটের জয় আরও একটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। এই আসনে ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রধান বিরোধী হিসাবে উঠে এসেছিল বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী খলিলুর রহমান পেয়েছিলেন ৭৫,৩৭৪ ভোট। বিজেপির মাফুজা খাতুন ৪১,৯৬৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। মাফুজা নিজে মুসলমান হলেও মুসলমানপ্রধান এই বিধানসভা এলাকায় বিজেপির উত্থান ছিল চমকপ্রদ। কংগ্রেসের অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ৪০,৬২৬ ভোট, সিপিএমের জুলফিকার আলি লড়াইতেই ছিলেন না। পেয়েছিলেন মাত্র ১২,২৯১ ভোট। ২০২১ সালের বিধানসভায় ভোট আরও বাড়ায় তৃণমূল। তাদের অমুসলমান প্রার্থী সুব্রত সাহা পান ৯৫,১৮৯ ভোট (৫১%)। বিজেপির মাফুজা এবারও লড়েন এবং দ্বিতীয় হন। তিনি পান ৪৪,৯৮৩ ভোট (২৪%)। বাম-কংগ্রেস জোটের কংগ্রেস প্রার্থী হাসানুজ্জামান পান ৩৬,৩৪৪ ভোট (১৯%)।
ফলে অনেকখানি পিছিয়ে থেকেই এই উপনির্বাচনে লড়াই শুরু করেছিল কংগ্রেস। বায়রনের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং মমতা সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু জনতার বাড়তে থাকা ক্ষোভ কংগ্রেসকেই প্রধান বিরোধীতে পরিণত করে। প্রচারের মাঝেই সাগরদীঘির পুলিশ কংগ্রেসের যুবনেতা সাইদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। এই পদক্ষেপও ভালভাবে নেননি ভোটাররা। নির্বাচন কমিশন ভোটের আগে সাগরদীঘি থানার ওসিকে সরিয়ে দেয়। সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান বিরোধীরা।
আরো পড়ুন মমতা ও পশ্চিমবঙ্গ: মাঝির হাতেই নৌকাডুবি?
মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, বিজেপি-বাম-কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধভাবে ভোট করেছে। এই বক্তব্যের সারবত্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। মমতা যা বলেননি তা হল, তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার দুবছরের মধ্যে সাগরদীঘি কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট ৫১% থেকে কমে ৩৪.৯৪% (৬৪,৬৮১) দাঁড়িয়েছে। বিজেপির ভোটও ৯% কমে হয়েছে ১৩.৯৪% (২৫,৮১৫)। বিজেপি, তৃণমূলের বড় অংশের সমর্থন সরে গিয়েছে বাম-কংগ্রেস জোটের দিকে। তাদের ভোট ১৯% থেকে বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে ৪৭.৩৫ শতাংশে (৮৭,৬৬৭)।
সাগরদীঘি বিধানসভার প্রভাব অন্যত্র পড়বে কিনা তার উত্তর সময়ই দেবে। তবে নিঃসন্দেহে এই ফল তৃণমূলের জন্য অশনিসংকেত। মমতার “দুধেল গাই” মন্তব্যে সঙ্গত কারণেই বহু সংখ্যালঘু মানুষ অপমানিত বোধ করেছিলেন। এবার তাঁর প্রার্থী মুসলমানপ্রধান এলাকায় হেরে যেতেই বলে বসেছেন, “কমিউনাল কার্ড” খেলে হারানো হয়েছে। এ কথার অর্থ কী? তৃণমূলকে না জেতালেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক? তাহলে কি প্রকারান্তরে বিজেপির অভিযোগেরই পুনরাবৃত্তি করা হল না, যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান তোষণ চলে? মমতা গতকালের সাংবাদিক সম্মেলনে আরও একটি লক্ষ করার মন্তব্য করেছেন। বলেছেন তাঁর দল কোনো বিজেপিবিরোধী জোটে যাবে না। একলাই লড়বে। এতে বিজেপিবিরোধী হিসাবে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা কোথাও ধাক্কা খাবে না তো? প্রশ্নগুলো সহজ নয়, উত্তরও সম্ভবত তৃণমূলের কাছে নেই।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।