“করপাড়া গ্রামে সাহাপুর বাজারে একটা বহু পুরনো বট ও অশ্বত্থ গাছকে কালীগাছ বলা হত। কারণ সেখানে প্রতিবছর কালীপুজো হত। সাহাপুর বাজারে মুসলমানরা এই কালীগাছের ডাল কাটে। রাজেন্দ্রলাল রায় এই করপাড়া গ্রামের জমিদার ও প্রতাপশালী হিন্দু। ইনি হিন্দু মহাসভার নেতা। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের উপেন সাহা তাঁর আশ্রয়ে থেকে তাঁকে বাজারে যজ্ঞ করতে বলে। এই সন্ন্যাসী উপেন সাহা আমার ছোটবেলার সহপাঠী ছিল। সোনাইমুড়ির আলোকপাড়া গ্রামের ছেলে সে। যজ্ঞের দিন এই উপেন সাহা বহু আড়ম্বরে হাতের খড়্গ ঘুরিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে রায় পরিবার ও গ্রামের হিন্দুদের উত্তেজিত করেছিল। মুহূর্তে দলে দলে মুসলমান বাজারে জমে গেল। হাতে তাদের অস্ত্র ও লাঠি। হিন্দুরা ভয়ে পালাতে শুরু করল। হাজার হাজার মুসলমান রাজেন্দ্রলালের বাড়ি ঘিরে ফেলল।”

এই হল ১৯৪৬ সালের কুখ্যাত নোয়াখালির দাঙ্গা শুরুর বিবরণ। লিখেছেন রসময় মজুমদার। একটু অন্য দিক থেকে আজ এই ঘটনা ফিরে দেখলে অন্য প্রশ্ন জাগে। ইতিহাস জানে, নোয়াখালির গ্রামে গ্রামে গোলাম সারওয়ারের কৃষক সমিতির সংগঠিত উত্থান তার অনেক আগে থেকেই। সেখানে জমিদার/মহাজন ধ্বংসের জিগির তোলা হয়েছে অন্তত ১৯৩৯ সাল থেকেই। আর এই একটি এলাকা যেখানে ১৩ লক্ষ মুসলমানের মধ্যে তিন লক্ষের মত হিন্দুর বাস। অথচ জেলার সমস্ত জমিদার আর মহাজন হিন্দু। তারা অবশ্য মোট হিন্দুদের মাত্র ১০%। বাকি হিন্দুদের বেশিরভাগ ওই সাধারণ মুসলমানদের শ্রেণিরই। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের জনমত জমিদারের বিপক্ষে এবং জনসংখ্যাও তার পক্ষে নয়, কলকাতার দাঙ্গার স্মৃতি তখনো টাটকা, সেখানে “প্রজাপালক” জমিদারের এই ধরণের অবিমৃশ্যকারী আচরণ হয়ত নিজের ধর্মের প্রতি অচলা ভক্তি বোঝায় এবং পরকালে অনন্ত স্বর্গবাস নিশ্চিত করে, কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে অনিশ্চিত করে তোলে না কি? ধর্ম কি অন্তত পরিস্থিতি বিচারের বোধটুকুও গুলিয়ে দেয়? আত্মসংযমও ভুলিয়ে দেয়? রসময় আরও লিখেছেন, কীভাবে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত চেষ্টায় চালু হওয়া ত্রাণশিবিরে কলকাতা থেকে যাওয়া গেরুয়াধারীদের উপস্থিতি এলাকাকে আবার অশান্ত করে তোলে। “যে সমস্ত পার্টি বা সঙ্ঘ কোনদিন সাধারণ মানুষের সুখদুঃখের কাজ নিয়ে ও তাদের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেনি, তারা দাঙ্গা কী? কেন? কীভাবে হয় তা জানতে পারে না।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বইয়ের নাম দাঙ্গা থেকে দেশভাগ। দুটি খণ্ড – প্রথম খণ্ড ‘হিন্দু’ বাঙালির প্রতিক্রিয়া এবং দ্বিতীয় খণ্ড হল ‘মুসলমান’ বাঙালির প্রতিক্রিয়া। দুটি খণ্ডেরই সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন সৌম্য বসু। দুটো স্বয়ংসম্পূর্ণ খণ্ড হলেও মনে হয়েছে দুটো মিলিয়ে আসলে একটাই ছবি, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই দুটি খণ্ড নিয়েই আলোচনা একসঙ্গে থাক।

দাঙ্গা থেকে দেশভাগ

সুরঞ্জন দাস বলেছেন, ভারতের ইতিহাসে ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় চেতনা আর সাম্প্রদায়িকতা দুয়ের মধ্যে তফাত আছে। তিনি এও বলেছেন, অন্য সময় যে মানুষটা হয়ত একটা বিশেষ আর্থিক শ্রেণির অংশ বলেই নিজেকে ভাবে বা কোন এলাকার মানুষ এই পরিচয়টাই তার কাছে বড় হয়ে ওঠে, সেও দাঙ্গার প্রাক্কালে বা দাঙ্গা চলাকালীন নিজেকে মূলত হিন্দু বা মুসলমান বলেই ভাবে। ধর্মগত পরিচয়কেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তোলার এই ক্রমিক প্রক্রিয়াই সাম্প্রদায়িকতার উত্থান পর্ব। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগের সময়টা সাম্প্রদায়িকতার কালি মাখা। মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা, স্মৃতিকথার মাধ্যমে সম্পাদক সেই ১৯৪৬-৪৭ সালের হিন্দু, মুসলমান – দুই সম্প্রদায়ের তখনকার মানসিকতা ধরতে চেয়েছেন। তবে সেই মূল অংশে প্রবেশের আগে দুটি খণ্ডেই একখানা করে ভূমিকাও লিখেছেন সেই সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ধরে রাখার তাগিদে।

যাঁরা সরাসরি ইতিহাসের ছাত্র নন, এই ভূমিকা তাঁদের কাজে লাগবে। প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তৎকালীন বাংলায় সাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরির পিছনের আর্থিক, রাজনৈতিক কারণগুলোর সঙ্গে সঙ্গে উভয় পক্ষের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান, তৎকালীন শাসকের বিভেদনীতি, জাতীয়তাবাদী সংগঠনের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ইত্যাদি কারণগুলোও নিরপেক্ষভাবে ছুঁয়ে গেছেন। হিন্দু জমিদারের সঙ্গে মুসলমান প্রজার অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার লড়াই কেমন করে সময়ের চাপে সাম্প্রদায়িক চেহারা নেয় সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি। তবে সাম্প্রদায়িকতা তৈরির পিছনের সামাজিক কারণ নিয়ে তেমন আলোচনা এই খণ্ডে নেই। তবে সংবাদমাধ্যমের প্রত্যক্ষ মদতে কিভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির শেষ অবধি জয় হল আর দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী হল – সেই ইতিহাস ধরা আছে এই খণ্ডের ভূমিকায়।

এই বইয়ের একটা মূল্যবান দিক হল সম্পাদক কোনো সম্প্রদায়কেই রেয়াত করেননি। উভয়েরই ত্রুটি বিচ্যুতিকে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় খণ্ডের ভুমিকায় মুসলমান অভিজাত আর অনভিজাত শ্রেণির অবস্থানকে যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সেইসঙ্গে এও লক্ষ্য করেন যে “আশরাফ পরিচালিত মুসলিম রাজনীতি চরম সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে উগ্র হিন্দু-বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে এ শ্রেণী এবং গোটা মুসলমান সমাজকে সেই পথে পরিচালিত করতে সফল হয় তারা এবং যোগ্য সহায়তা প্রদান করে বর্ণ-হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান হিন্দু মহাসভা।” এই রাজনীতিই প্রকট হয় ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে, যখন বিপুল ক্ষমতাশালী মুসলিম লীগ ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে জিগির তোলে যে মুসলিম লীগকে ভোট না দেওয়ার অর্থ হল আল্লার ফরমান অগ্রাহ্য করা। হুগলির ফুরফুরা শরিফ থেকেও লীগকে ভোট দেওয়ার ডাক দেওয়া হয়। ধর্ম ও অর্থের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এত করেও মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না। তবু পরিস্থিতির চাপে শেষ অবধি ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সঙ্গেই হাত মেলাতে হয়। শুরু হয় বাংলার রাজনৈতিক আকাশে মুখে ইসলামি ভ্রাতৃত্বের জিগিরধারী, আদতে শুধুই অভিজাতদের স্বার্থরক্ষাকারী মুসলিম লীগের উত্থান। এই ঘটনারই শেষ পরিণতি ভারত ভাগে। এই ভূমিকা অংশে সৌম্য কলকাতা ময়দানে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের দ্রুত উত্থান এবং তাকে ঘিরে ময়দানেও কীভাবে রাজনীতির ছায়া পড়েছিল তার একটা সংক্ষিপ্ত ছবি এঁকেছেন। বহুস্তরীয় মুসলমান সমাজে সেদিন লীগ সমর্থকদের পাশাপাশি বড় সংখ্যক জাতীয়তাবাদী মুসলমানও ছিল। তাঁদের লীগ দেখেছে মীরজাফরের নাতি হিসাবে। তা সত্ত্বেও সেদিন তাঁরা ক্রমাগত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচার করে গেছেন – সেই কথাটাও সম্পাদক মনে করিয়ে দিয়েছেন।

‘হিন্দু’ বাঙালির প্রতিক্রিয়া

এই খণ্ডে সম্পাদক লেখাগুলোকে তিনটে পর্বে সাজিয়েছেন। প্রথম পর্ব ছেচল্লিশের দাঙ্গা। সেখানে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, বিজয় সিং নাহার, কল্যাণ দত্ত, রেবা রায়, সুধাংশুকুমার মজুমদার, সজনীকান্ত দাসের লেখা থেকে দাঙ্গার স্মৃতিচারণ খুঁজে এনেছেন। সেই সঙ্গে রয়েছে সেইসময়ের কিছু কিছু সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, পাঠকের প্রকাশিত মতামত। ইতিহাসের সচেতন পাঠক মাত্রেই জানেন ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় মুসলিম লীগ তথা তাদের নেতা বঙ্গশাসক শহীদ সুরাওয়ার্দীর ন্যক্কারজনক ভূমিকার কথা। তবে এই বই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে সেইসময়ের বিশিষ্ট হিন্দু বাঙালিদের সবার স্মৃতিচারণ কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষমুক্ত নয়। এই লেখাগুলি পড়ার পরে জয়া চ্যাটার্জী তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড হিন্দু কমিউনালিজম অ্যান্ড পার্টিশন ১৯৩২-১৯৪৭ বইতে হিন্দু ভদ্রলোকের সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, নবজাগরণের উত্তরাধিকারী বাঙালি পরিচয় সত্তার নির্মাণ প্রকল্পের সংযোগের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে আরও প্রতীতি জন্মায়।

চিরকালই পুলিসের ভূমিকা নিয়ে যুযুধান সব তরফেরই অনেক বক্তব্য থাকে। তবু এন্টালি থানার সুধাংশু মজুমদারের স্মৃতিকথায় সুরাওয়ার্দী কীভাবে পুলিসকে নিষ্ক্রিয় রেখেছিলেন সেই বিবরণের পাশাপাশি ডিসি হীরেন সরকারের নির্দেশে, পাঠান পুলিশের কৃতকর্মের প্রতিবাদস্বরূপ মুসলমানদের বাড়িতে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া অস্বস্তি তৈরি করে। এই বিপদের মধ্যেও বাঙালি নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেও অন্তর্কলহ ছাড়তে পারেনি – সে প্রমাণও কি আর খুব আশ্বস্ত করে? রাম চ্যাটার্জীর হালকা উল্লেখ সুধাংশু মজুমদারের লেখায় এলেও বিধানচন্দ্র রায়ের ঘনিষ্ঠ গোপাল পাঁঠা ও অন্যান্য বিখ্যাত হিন্দু পরিত্রাতা গুন্ডাদের উত্থানের গল্প এই খণ্ডের লেখায় আসে না। তারই মধ্যে পতাকা পত্রিকার “উভয় সম্প্রদায়ের মহানুভবগণ” শীর্ষক প্রতিবেদন কিছুটা ভরসা জাগায়। ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার-এর প্রতিবেদন “These blood-thirsty religions”-এ হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মকেই নিন্দা করার পিছনের সূক্ষ্ম ভাবটা অনুধাবন করে একটু মজা লাগলেও এর একটা কথা কানে বাজে। “… religion, that has power to transform brutes into gods, can also degrade human beings far below the level of animals.”

দ্বিতীয় পর্ব নোয়াখালি। সেখানে আছে দাঙ্গা চলাকালীন কমিউনিস্টদের সমন্বয়ী ভূমিকার কথা। তবে এই পর্বের বৃহদংশ জুড়ে কানাই বসু সম্পাদিত নোয়াখালির পটভুমিকায় গান্ধীজী-র অংশ বিশেষ তুলে ধরা হয়েছে। এই লেখায় মহাত্মা গান্ধীর বক্তব্যের সুন্দর পরিচয় মিললেও, তদানীন্তন হিন্দু বাঙালির বক্তব্য অনেকটা অধরা থাকে। বিশেষত স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দাঙ্গার আগের ও পরের বক্তব্য জানার বিশেষ সুযোগ থাকে না। জানা যায় না অরাজনৈতিক স্থানীয় মানুষদের বক্তব্যও। বোম্বের সাংবাদিক জগদীশ চন্দ্র মৈত্রের লেখায় গোলাম সারওয়ারের ভূমিকার উল্লেখ মেলে। কিন্তু ঠিক কীভাবে গোলাম সারওয়ার অতখানি প্রভাব তৈরি করতে পেরেছিলেন এবং কেনই বা দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করা স্বগ্রামের ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ সবরকম হিন্দুদের বিরুদ্ধে এতখানি ক্রোধ মুসলমানদের মনে জমে উঠতে পেরেছিল তার কোনো ব্যাখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে এই বইতে গ্রন্থিত কোনো হিন্দুর লেখায় মেলে না। বরং ভাল লাগে ফুলরেণু গুহের লেখায় ছোট ছোট ক্যাম্প জীবনের অভিজ্ঞতার বিবরণ। সর্বস্ব হারালেও জাতিগত বিভেদ-সংস্কার যায় না। এই পর্বের শেষতম লেখা ‘মুসলমান ও তফশিল সম্প্রদায়ের প্রতি’। সেখানে তফশিল সম্প্রদায়ের নেতারা এবং মুসলিম লীগ নেতারা একযোগে শান্তিরক্ষার আবেদন জানাচ্ছেন। সেটা পড়লে অস্বস্তি আরও বাড়ে। যোগেন মন্ডল সমেত বাংলার তফশিলি সম্প্রদায়ের উত্থান, তাঁদের বর্ণহিন্দুদের থেকে দূরত্ব তৈরি যেমন বাস্তব, তেমন এ প্রশ্নও জাগে, যে অর্থনৈতিক শ্রেণির ভিত্তিতে তফশিলি-মুসলমানের যে সৌহার্দ্য নেতারা কল্পনা করেছিলেন, তাও কি সেদিন সত্যিই ছিল? তাহলে কেন বিভিন্ন দাঙ্গায় তফশিলি হিন্দুরাও বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন? কেনই বা পরবর্তীকালে পাকিস্তানে, বাংলাদেশে তফলিশিদের উপর খড়্গ নেমে এল? তাছাড়া নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও তো মুসলমানদের সঙ্গে যথেষ্ট ছোঁয়াছুয়ির বাছবিচার ইত্যাদি মেনে চলতেন। তারপরেও এই সৌহার্দ্যের ভাবনা কি আকাশকুসুম কল্পনা নয়?

এই খণ্ডের শেষ পর্ব দেশভাগ। ১৯৪৬ সালের শেষ থেকে ১৯৪৭ অবধি সময়কাল ধরা আছে। এই সময়ে হিন্দু মহাসভার তরফ থেকে হিন্দুদের জন্য আলাদা প্রদেশের দাবি ওঠে। অন্যদিকে শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায়, শহীদ সুরাওয়ার্দী ডাক দেন স্বাধীন বাংলা গঠনের। মুসলিম লীগের পৃথক রাজ্যের দাবি তো ছিলই। বিভিন্ন বিপরীতমুখী দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি, প্রতিযুক্তিতে হাওয়া গরম হয়ে ওঠে। প্রবাসী, মাসিক বসুমতী, স্বাধীনতা, দ্য স্টেটসম্যান, দ্য নেশন, হিন্দুস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন মারফত টুকরো টুকরো বিভিন্ন পক্ষের মতামতের ছবি তুলে ধরেছেন সম্পাদক। তারই মধ্যে তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাম্প্রদায়িক দুর্যোগের নানা দিক’ লেখাটা খানিকটা আমজনতার বিরল যুক্তিবোধের পরিচয় দেয়। সব পক্ষের রাজনৈতিক নেতাদের তুলো ধুনে তিনি পরিষ্কার বলেন, “এইসব নেতারা সাম্প্রদায়িক বিরোধকে মূলধন করে নিজেদের নাম-যশ-টাকা-কড়ি বাগাতে চান”। তবু আমরা জানি যে শেষ অবধি বঙ্গবিভাগ ঠেকানো যায়নি। ধর্মের ভিত্তিতে বাঁটোয়ারা হয়ে স্বাধীন ভারতের যাত্রা শুরু হয়। আগেকার অভিন্ন বাঙালি জাতির আর অস্তিত্ব থাকে না। তবে এই পর্বে মূলত রাজনৈতিক প্রবাহের কথাই কেন্দ্রে থেকেছে। সাধারণ মানুষের জীবন বা বক্তব্য ততটা জায়গা পায়নি এই পর্বে।

এই বইতে মূলত যা গ্রন্থিত আছে তা উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দুর ভাষ্য। সেদিনের গ্রামবাংলার তৃণমূল স্তরের শ্রেণিবিভক্ত, জাতিবিভক্ত অশিক্ষিত হিন্দু সমাজের মনোভাব অধরাই থেকে গেছে। কতটা সাম্প্রদায়িকতার বিষ তার শিরায় শিরায় বইছিল, কতটাই বা শুভ চিন্তা ছিল তা পুরোপুরি বোঝা যায় না। যেহেতু এই বই দাঙ্গা দিয়ে শুরু, তাই হয়ত কেন হিন্দু সমাজে তথাকথিত শিক্ষার বিস্তার সত্ত্বেও সংখ্যাগুরুবাদী চিন্তার অবসান হল না, কেন হিন্দু মহাসভা জাতীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলো সেখানে ঘাঁটি গাড়তে পারল – সেই বিশ্লেষণের জায়গা ছিল না। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে রাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদ ততটা পাত্তা না পেলেও মননে যে হিন্দুত্ববাদ জায়গা করে নিয়েছিল বিশেষত ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পরে – একথা অবশ্য সম্পাদক ভূমিকা অংশে বলেছেন।

বইয়ের তথ্যসমূহ কালানুক্রমিক হলে বুঝতে আরও সুবিধা হত। বিশেষত প্রায় ৭৫ বছর পরে যে ইতিহাস ফিরে দেখা হচ্ছে সেই ইতিহাসের ঘটনা, ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে এই প্রজন্মের পাঠকের সামান্য পরিচয় করিয়ে দিলে বইয়ের মূল্য আরও বাড়ত বলেই মনে হয়। বিশেষত, পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে, অনেক লেখার সঙ্গেই সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ও পাদটীকা থাকলে বুঝতে আরও সুবিধা হত। জায়গায় জায়গায় ছাপার ভুলও পড়ার অসুবিধা ঘটায়। পরবর্তী সংস্করণে এসব দিকে নজর দিলে ভাল হয়।

‘মুসলমান’ বাঙালির প্রতিক্রিয়া

এই খণ্ডটি চারটি পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্বে রয়েছে সেইসময় পাকিস্তান দাবির সপক্ষে পাঁচটি লেখা। তার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ছড়ানোর অভিযোগে বাজেয়াপ্ত ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত পুস্তিকা মুসলিম লীগ গজল। “স্বরাজ লওয়া মিথ্যাকথা; হিন্দু হবে ভারতরাজা। মুসলমান তো অবোধ চাষা; চির নিদ্রায় অচেতন। …হিন্দুদিগের সব চালাকি; মুসলমানে দিবে ফাঁকি। ভারতবর্ষের চাবিকাঠি; দুহাতে লিবে হিন্দুগণ” – এই পংক্তিগুলো পড়লে বোঝা যায় কোন লাইনে লোক ক্ষ্যাপানো হচ্ছিল। অথচ এই সমস্যা অনেকদিন আগেই বুঝেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তাই বেঙ্গল প্যাক্ট করেছিলেন। কেন সেটা গণঅনুমোদন পায়নি? আমরা আজকের দিনে যখন বর্ণহিন্দুদের তরফ থেকে বিভিন্ন তীব্র সংরক্ষণবিরোধী মতামত শুনি, তখন বুঝি সেদিন কেন বেঙ্গল প্যাক্ট সফল হয়নি। আবার উল্টোদিকে শাসক আর শাসিত যে সম্পূর্ণ আলাদা শ্রেণি এবং ধর্ম-জাত দিয়ে এই বিভাজনকে ব্যাখ্যা করা যায় না – এই রাজনৈতিক চেতনাও তখন গ্রামদেশে সার্বিক প্রতিষ্ঠা পায়নি। মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহের লেখায় কিন্তু সেইসময়ের উর্দুভাষী অভিজাত বনাম বাংলাভাষী অনভিজাতের সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বের দিকটা ধরা পড়ে। মনে পড়ে যায় গৌরকিশোর ঘোষের প্রতিবেশী উপন্যাসের কথা – “ইসলাম বিপন্ন হবার ধুয়ো তুলে বাংলার মুসলিম নেতারা যেভাবে দিন দিন নতুন করে তেড়ে ফুঁড়ে মুসলমান হতে শুরু করেছেন, ভাষাটাকে পর্যন্ত হিন্দু আর মুসলমানে ভাগ করে ফেলতে চাইছেন, তাতে ভয় হয় শামিম, কাকাতুয়াকে আর বেশি দিন বোধ হয় কাকাতুয়া বলতে দেবেন না ওঁরা। এর পর তাকে চাচাতুয়া বলতে হবে।” ভাষার ধর্মীয় বিভাগ বিষয়টা আজকের দিনেও খুব চেনা চেনা লাগছে না? আবার সরদার ফজলুল করিম ‘পাকিস্তান আন্দোলন ও ঢাকার ছাত্রসমাজ’ প্রবন্ধেও দেখিয়েছেন যে মুসলিম লীগই তখন পূববাংলার একমাত্র রাজনৈতিক দল ছিল না। ছাত্রসমাজে হক সাহেবের বা কমিউনিস্ট ভাববাধারও বেশ প্রভাব ছিল। মুসলিম লীগের সমর্থকদের সঙ্গে তাদের মাঝে মাঝেই লেগে যেত। সৈয়দ আবদুল মাকসুদ লিখেছেন পাকিস্তান গঠনে মওলানা ভাসানির ক্যারিশম্যাটিক ভূমিকা নিয়ে। যদিও এই দুটি খণ্ডে কীভাবে গ্রামীণ সমাজে ধর্মীয় নেতাদের প্রতিপত্তি এতটা বেড়ে গেল তা নিয়ে সরাসরি বিশ্লেষণ নেই, তবু ভাসানির উপর এই লেখাটা পড়লে ভক্তিবাদী গুরুমুখী গ্রামবাংলার চরিত্র কিছুটা ফুটে ওঠে।

পাকিস্তান দাবির বিপক্ষের লেখাগুলো গ্রন্থিত হয়েছে দ্বিতীয় পর্বে। আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী পাকিস্তানের দাবি যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে বলেছেন, “হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ জাগাইলে উভয়েরই ক্ষতি হইবে।” আরও বলেছেন, আজকে ইসলাম বিপন্ন নয়, বিপন্ন একশ্রেণির মুসলমানের কায়েমী স্বার্থ। ধর্ম বিপন্ন – এই মিথ্যা জিগির তুলিয়া দরিদ্র মুসলমানের খাওয়া পরা ও বাঁচিয়া থাকিবার আসল সমস্যা ধামাচাপা দিতেছে।” ঘোর কংগ্রেসি মওলানা আবুল কালাম আজাদ তো লীগের বিপরীতে দাঁড়াবেনই, পাকিস্তানের বিরোধিতা করেন আরেক কংগ্রেসি অক্সফোর্ড-শিক্ষিত, চাকুরিজীবী পরিবারের সন্তান, হুমায়ুন কবীর। তাঁর লেখায় লাহোর রেজলিউশনের বিশ্লেষণ পড়তে ভাল লাগে। কিন্তু কেন যে বাংলার কংগ্রেসসহ কোনো পার্টিই সেদিনের বাংলার রায়তদের আর্থিক দুর্দশা বুঝতে চায়নি এবং তার পরিবর্তনের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে চায়নি, এমনকি সেই প্রচেষ্টার যথাসাধ্য বিরোধিতা করেছে – সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের কংগ্রেসি শিক্ষামন্ত্রীর লেখায় অধরা থাকে।

তৃতীয় পর্বে রয়েছে ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গার স্মৃতি নিয়ে হামিদা খানম, মোঃ আবদুল মোহাইমেন, আনিসুজ্জামান, সাইদুর রহমানের লেখা। কামরুদ্দীন আহমদ লিখলেন ঢাকার দাঙ্গার কথা। হিন্দুদের লেখার মতই এইসব লেখাও কোথাও কোথাও এমনই একচোখো এবং অতিসরল যে সাম্প্রদায়িক বলেই মনে হয়। তবু তারই মধ্যে দু-একটা স্বীকারোক্তি চোখ টানে। “পার্কসার্কাসেও আমরা অপর সম্প্রদায়ের বড়লোকদেরই বাঁচাতে সাহায্য করেছি। গরিব ঠেলাওয়ালা, রিক্সাওয়ালাকে বাঁচাবার কথা ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। বড়লোকেরা হিন্দু হোক, মুসলমান হোক এ সুবিধাটা পায়” (‘কলকাতার দাঙ্গা’; মোঃ আবদুল মোহাইমেন)। আবার কামরুদ্দীন আহমদের লেখায় যখন পড়া যায় ঢাকায় দাঙ্গা বাধার আগেই হিন্দু রাজনৈতিক নেতাদের হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা, হাজার চেষ্টা করলেও তাঁরা দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে পারবেন না এই বিশ্বাসের কথা, তখন কোথায় যেন একটা রাজনৈতিক জনবিচ্ছিন্নতার সুর বাজে। শেষ লেখাটি ১৯৩৯ সালে লেখা ‘Hindu-Moslem Relations at Noakhali’। এই লেখা থেকে বোঝা যায়, ইংরেজ সরকার কীভাবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি প্রয়োগ করে সারওয়ারকে তৈরি করেছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে এও বোঝা যায়, হিন্দুরা মুসলমানদের অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু বলে চিরকাল দাগিয়ে গেলেও, নিজেদের অসহিষ্ণুতাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই মনে করত। এই রিপোর্ট নোয়াখালি ডিসট্রিক্ট কংগ্রেস কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্টের লেখা তা জানা থাকলেও, অনেক জায়গাতেই কেমন যেন হিন্দুত্ববাদী চিন্তার আভাস পাওয়া যায়।

চতুর্থ পর্বে রয়েছে দেশভাগের কথা। মহম্মদ তোয়াহার লেখা ‘স্মৃতিকথায় আবদুল হালিম’ স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ভরা। তাঁর সব বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হয়েও কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থানের তত্ত্বগত বিশ্লেষণ পড়তে ভাল লাগে। সেইসঙ্গে সেই লেখায় বাঙালি মুসলমানের একাংশের যে মনোভাব ধরা পড়েছে, যেমন ধরা যাক আবদুল হাশেমের সঙ্গে জিন্নার কথোপকথনের এই অংশ “If you [Jinnah] do not like to be exploited by Tatas and Birlas, Muslim Bengal also have the same right to refuse to be exploited by Ispahanis and Dosanies”, তা থেকে বোঝা যায়, এরপর ১৯৭১ শুধু সময়ের অপেক্ষা। ‘তাজউদ্দিন আহমেদের ডায়েরি থেকে’ অংশ তুলে সম্পাদক ঢাকায় প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের বিবরণ দিয়েছেন। আবুল মনসুর আহমেদের ‘স্পিরিট অফ পার্টিশন’ প্রবন্ধের অনেকাংশই স্বপ্ন-কল্পনা মনে হলেও বাস্তু ত্যাগ সমস্যার বিশ্লেষণ ভাল লাগে। আর স্বাধীনোত্তর উপমহাদেশে দুই দেশের সরকারই যে নিজ নিজ নীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সমস্যা জিইয়ে রেখেছে এও তো জানা সত্য। সুরাওয়ার্দীর লিয়াকত আলি খানকে লেখা ২১ মে ১৯৪৭ সালের চিঠি বাংলাকে অখণ্ড রাখার শেষ মরিয়া চেষ্টা তুলে ধরে। ততদিনে অবশ্য জিন্না ঘোষণা করেছেন, যে হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করার অধিকার তিনি সুরাওয়ার্দীকে দেননি। এই পর্বের সব থেকে মানবিক দুটি লেখা – হাশেম খানের ‘মধু’র স্মৃতি’ আর আব্দুল্লাহ আবু সয়ীদের ‘দেশত্যাগ’। বিশেষত পরের লেখাটিতে সঙ্গী-বিচ্ছেদের করুণ সুরের সঙ্গে জুড়েছে বিশ্লেষণী সমাজ-পর্যবেক্ষণের গুণ। তবে এই পর্বের সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক লেখা হল মোহাম্মদ মোদাব্বেরের “দেশভাগ: এক বাঙালি সাংবাদিকের রোজনামচা”।  ইনি ১৯২৭ সালের বরিশালে যে দাঙ্গা হয় তার প্রেক্ষিতে ইংরেজ শাসকের নিন্দা করে খোদ টেগার্টের কাছে বলে এসেছেন, সন্ধ্যাবেলা মুসলমানরা মসজিদে নমাজ পড়তে জড়ো হলে আর সেখান দিয়ে হিন্দুরা বাজনা বাজিয়ে গেলে, পুলিশের উচিত ছিল বাদ্য কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা। কিন্তু তা না করে নির্বিচারে নিরস্ত্র মুসলমানের উপর গুলি চালানো কি উচিত কাজ? আবার অন্য দিকে ইনি হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সম্বন্ধে জানান “বাস্তবক্ষেত্রে তিনি মুসলিম-বিদ্বেষী ছিলেন না”। মৌলবী মুজীবর রহমান তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। শ্যামাপ্রসাদ একটি দরিদ্র অথচ মেধাবী মুসলমান ছেলের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। এঁর লেখায় আসে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কথাও। তিনি বলেন “ধার্মিক ও ধর্মান্ধতা এক জিনিস নয়। আমি যে সমাজতন্ত্র চাই, আমার কাছে এটাও একটা ধর্ম। কিন্তু ধর্মের নাম করে মানুষের অকল্যাণ করাকেই আমি অধর্ম মনে করি এবং এর উপর প্রচন্ড আঘাত আসবেই।” হায়, মানবেন্দ্রনাথ রায়ের যে স্বপ্ন ছিল সারা উপমহাদেশের রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক মুক্তির জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে একদিন ধর্মান্ধতা তিরোহিত হবে, তা স্বাধীন ভারতে অন্তত সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

আরো পড়ুন বুল্লি বাই — শুধু সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগুরু মানুষেরও অপমান

প্রথম খণ্ডে কোনো লেখক পরিচিতি না থাকলেও দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে একটা পরিচিতি যোগ করা হয়েছে। কিন্তু নিতান্ত অগোছালোভাবে প্রস্তুত পরিচিতিগুলো পাঠককে খুব একটা সাহায্য করে না। সব লেখার অন্তর্ভুক্তির কারণও খুব পরিষ্কার নয়। তাজউদ্দিন আহমদের লেখা পূর্ববাংলার রাজনীতির ব্যক্তিত্বদের না চেনার দরুন বুঝতে একটু অসুবিধাই হয়। দুটো খণ্ডেরই ভূমিকার পরে একখানা গ্রন্থপঞ্জি আছে বটে, কিন্তু ভূমিকায় তার কোনো উল্লেখ না থাকায় তথ্যগত সত্যতা যাচাই করা দুষ্কর। আর দ্বিতীয় খণ্ডের মূল অংশের শুরুতে একখানা গ্রন্থপঞ্জি আছে। কিন্তু প্রত্যেক লেখার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে উদ্ধৃত সেটা থাকলে পড়তে সুবিধা হত।

দেশভাগ ভাল হয়েছে কি খারাপ হয়েছে, জার্মানির মত ফের সংযুক্তিকরণ হওয়া সম্ভব কি সম্ভব নয়, হলে তা ভাল কি খারাপ – সেসব অন্য আলোচনার বিষয়। কিন্তু দেশভাগের আগে কী কী কারণে এই দেশে সাম্প্রদায়িকতা এত তীব্র চেহারা ধারণ করল সেকথা সমস্ত সচেতন পাঠকের জানা দরকার। কারণটা সহজ। বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে অতীতের উপর ভর দিয়ে। যতই সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বর্তমানের চেহারাকে ক্রমাগত পাল্টে নবকলেবর দান করুক, অনেকটা দূর থেকে দেখলে কালপ্রবাহের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে যোগসূত্রটা দিব্যি ধরা পড়ে। আজকের বর্তমানও তো অতীত-বিচ্ছিন্ন নয়। তাকেও হয়ত কিছুটা পরিষ্কার করে বোঝা যায় অতীতকে ভাল করে জানা থাকলে। ইতিহাস চর্চার অন্যতম কাজই হল আমাদের সামনে দর্পণ হওয়া। আজও যদি আমরা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের স্বরূপ না বুঝি, অন্যদের কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করতে নিজেদের কামানের মুখের খড়কুটোর মত এগিয়ে দিই, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বুঝতে না শিখি যে কে কেন কাকে আদতে বিপন্ন করছে, উল্টে নেতাদের কথায় নেচে সব কিছুতেই ধর্ম বিপন্ন বলে দাঙ্গা করতে নেমে পড়ি, নিজের এবং প্রতিবেশীর আজকের মঙ্গল, সুদূর ভবিষ্যতের অলীক সুখস্বপ্নে মশগুল জনের ভাবনার বাইরে থাকে, তাহলে আর ইতিহাস আমাদের কী শেখাল?

দাঙ্গা থেকে দেশভাগ: ‘হিন্দু’ বাঙালির প্রতিক্রিয়া
দাঙ্গা থেকে দেশভাগ: ‘মুসলমান’ বাঙালির প্রতিক্রিয়া
সংকলন ও সম্পাদনা: সৌম্য বসু
প্রচ্ছদ: রোচিষ্ণু সান্যাল
প্রকাশক: খড়ি প্রকাশনী
দাম: যথাক্রমে ৪৫০ ও ৫৫০ টাকা

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.