মনুসংহিতা-য় ‘রাজধর্ম’ অংশে মনু রাজধর্ম বিষয়ে অনেক বিধান দিয়ে গিয়েছেন বটে, তবে যুদ্ধনীতিই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে একথাও বলেছেন, যে প্রাচীন ভারতের যুদ্ধনীতি কেবলমাত্র যেনতেনপ্রকারেণ শত্রু ধ্বংস করার নীতিই নয়, তা এক ধর্মবিশেষ। তাই রাজাকে হতে হবে অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ। মজা হল, মোগল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবর কিন্তু মনুসংহিতা পড়েননি। এমনকি ইতিহাসে লেখা আছে তিনি মোটেও লেখাপড়া জানতেন না। তবু নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শেখার ব্যাপারে। সম্রাট বুঝেছিলেন, নিজের রাজত্ব রক্ষা করার জন্য এবং অবশ্যই সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য একদিকে যেমন যুদ্ধনীতি গ্রহণ করতে হবে, তেমনই ভারতের মত বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা এবং উপজাতির দেশে প্রবল সাবধানতা অবলম্বন করে শাসনকার্য চালাতে হবে। এইসব মাথায় রেখে তিনি উত্তর, মধ্য এবং পশ্চিম ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চল শাসন করেছিলেন। আকবরের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি তাঁকে অনেক হিন্দু নেতার সমর্থন পেতে সাহায্য করেছিল।
বাবর তাঁর আত্মজীবনী বাবরনামা গ্রন্থে পুত্র হুমায়ুনকে পরামর্শ দিয়েছেন, ভারত শাসন করতে গেলে কোনোরকম ভেদাভেদ ছাড়াই সব ধর্মকে সম্মান করতে হবে এবং কখনোই ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ব্যাপারে কারোর অনুভূতিতে আঘাত করা চলবে না। কোমলপ্রাণ, স্বল্পায়ু হুমায়ুন এই নির্দেশ সম্পূর্ণ করতে না পারলেও তাঁর পুত্র, দীন- ই ইলাহি ধর্মের প্রবর্তক আকবর কিন্তু ঠাকুরদাদার এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সম্রাট আকবর প্রতিটি ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষাকে নিজে বোঝার চেষ্টা করেন এবং এগুলিকে বজায় রাখতে বিভিন্ন উপায়ও গ্রহণ করেন। তাঁর অনুসন্ধিৎসু প্রকৃতি তাঁকে সংস্কৃতি, ভাষা প্রভৃতিকে একত্র করতে, প্রতিটি বিষয়কে স্বীকৃতি দিতে অনেক ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা এবং প্রকল্প শুরু করার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। প্রজারা বহুভাষিক হওয়ায় শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আকবর তাঁর রাজত্বে একটি সাধারণ ভাষা চেয়েছিলেন। মধ্য এশিয়া থেকে আসা বংশের লোক হিসাবে এ কাজের জন্য তাঁর পছন্দ ছিল ফারসী। প্রকৃতপক্ষে অনেক হিন্দু ছাত্র সেইসময় ফারসী ভাষা শেখার জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিল। কারণ তারা জানত যে মাদ্রাসার মত স্কুলে ভর্তি হওয়া সরকারি চাকরি নিশ্চিত করার জন্য সুবিধাজনক। অন্যদিকে সম্রাট বুঝলেন, মহাভারত বা রামায়ণের মত গ্রন্থগুলিকে ফারসী ভাষায় অনুবাদ করে সেগুলিকে সরকারি সংস্কৃতির অংশ করা হলে হিন্দু জনগণ আরও উদ্বুদ্ধ হবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এসব করতে সম্রাট ফতেপুর সিক্রিতে বানালেন এক মক্তবখানা (অনুবাদ কক্ষ)। একদিকে কিছু ফারসী বই সংস্কৃতে অনূদিত হল, অন্যদিকে বেশকিছু প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসীতে অনুবাদ করা হল। এর মধ্যে যে দুটি গ্রন্থ সেইসময় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল, সেগুলি হল রামায়ণ ও মহাভারত।
রবীন্দ্রনাথ বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই দীনেশচন্দ্র সেনের রামায়ণী কথা-র ভূমিকায় এক জায়গায় লিখেছিলেন “… রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। …ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্ম্যের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান”।
আবার আর এক জায়গায় লিখেছেন “রামায়ণ এবং মহাভারতকেও, আমি বিশেষতঃ এইভাবে দেখি। ইহার সরল অনুষ্টুপ ছন্দে ভারতবর্ষের সহস্র বৎসরের হৃৎপিন্ড স্পন্দিত হইয়া আসিয়াছে।” (৫ই পৌষ ১৩১০ বঙ্গাব্দ প্রথম প্রকাশ; পরবর্তীকালে প্রাচীন সাহিত্য গ্রন্থে ১৯০৭ সালে প্রকাশিত)
সম্রাট আকবর ভারতবর্ষের হৃৎপিন্ডটি চিনতে পেরেছিলেন এরও বেশ কয়েক শতাব্দী আগেই। বাল্মীকির রামায়ণ মূলত ৫০০-৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, কোশল অঞ্চলে স্থানীয় মৌখিক ঐতিহ্য থেকে সংকলিত হয়েছিল। এটি ছিল প্রাচীন ভারতের কাব্যিক ঐতিহ্যের এক প্রামাণ্য উদাহরণ। কিংবদন্তিতে প্রদর্শিত হয়েছিল রামের মানসিক এবং আধ্যাত্মিক গভীরতা, বীরত্ব, প্রেম, মমতা, আত্মত্যাগ, পিতৃভক্তি প্রজাদের প্রতি করুণা। রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে রাষ্ট্রের আদর্শ মডেলের ধারণা। সেইসঙ্গে রামকে সর্বজনীন রাজা হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। এই দিকটি মোগল সম্রাট এবং তাঁর দরবারের কাছে রামায়ণকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
১৫৮০-র দশকে আকবরের রাজত্বকালে যে সাহিত্যসম্ভার অনুবাদ হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ফারসী থেকে সংস্কৃতে অনূদিত হামজানামা আর সংস্কৃত থেকে ফারসীতে অনুদিত রজমনামা, যা মহাভারতের অনুবাদ। রজম শব্দের অর্থ যুদ্ধ, নামা বলতে বৃত্তান্ত। যুদ্ধ করে সাম্রাজ্য আর রাজধর্ম রক্ষা করাই ছিল সম্রাটের উদ্দেশ্য। তাই এই গল্পগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি পরিবার ও সভাসদদের কিছু শেখাতে চেয়েছিলেন। এসবের সাক্ষী ফতেপুর সিক্রির ইবাদতখানা, যেখানে আকবর সব ধর্মের পণ্ডিত ও জ্ঞানীদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করতেন। হিন্দুধর্ম কিংবা ইসলাম ধর্মের পণ্ডিত ছাড়াও সেখানে জরাথুস্ট্রীয়, খ্রিস্টান, এমনকি নাস্তিকদেরও আমন্ত্রণ জানাতেন। বিতর্ক হত প্রচুর। এঁদের দিয়েই আকবর রামায়ণ মহাভারতের ব্যাখ্যা করাতেন এবং তাঁর দরবারের সবচেয়ে প্রতিভাবান লেখক ও সচিবদের দিয়েছিলেন অনুবাদের দায়িত্ব।
আইন-ই আকবরী গ্রন্থে আকবরের জীবনীকার আবুল ফজল ইবনে মুবারক রামায়ণ প্রকল্প সম্পন্ন করার তারিখ এবং অনুবাদকদের নাম উল্লেখ করেছেন। সেই অনুসারে মোল্লা আব্দুল কাদির বদাউনীকে সম্রাট নকীব খানের সাথে যুগ্মভাবে প্রধান অনুবাদক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। বিদগ্ধ হিন্দু পণ্ডিত দেব মিশ্রের নির্দেশনায়, হিন্দু পাঠের ব্যাখ্যা করে সারমর্মটি তুলে ধরা হত অনুবাদকদের সামনে। বদাউনী একজন তাঁর মুনতাখাব-আল-তাওয়ারিখ-এ উল্লেখ করেছেন যে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে রামায়ণের ফারসী অনুবাদ করতে তাঁর অস্বস্তি ছিল। তিনি এই সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদে অংশ নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং সে কারণে শাস্তির ভয়ও পেয়েছিলেন। অন্যদিকে আবুল ফজল কিন্তু এই মহাকাব্যগুলির প্রশংসা করেছেন। তাঁর অনুবাদ করতে কোনো সমস্যা ছিল না।
১৫৮২-৮৪ সালের মধ্যে এক লক্ষ শ্লোকের সমন্বয়ে মহাভারতের ফারসী অনুবাদের কাজ হয়। সাতকাণ্ড রামায়ণ মহাকাব্যের প্রায় ২৪,০০০ সংস্কৃত শ্লোককেও একইভাবে ফারসীতে অনুবাদ করার কাজ শুরু হয়। শোনা যায়, অনুবাদকের দল কাজটিকে সহজ করার জন্য প্রথমে সংস্কৃত থেকে অওধী অথবা হিন্দুস্তানী ভাষায় এবং পরে ফারসীতে অনুবাদ করতেন। রজমনামাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সম্রাট তাঁর দরবারের চিত্রশিল্পীদের এই কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি এঁকে গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। এর আরেকটি কারণও থাকতে পারে। সম্রাট নিজে পড়তে জানতেন না, তাই হয়ত ছবি দেখে রসাস্বাদন করতে ভালোবাসতেন। রজমনামার আঠারোটি পর্বের শেষে পরিশিষ্ট ও হরিবংশও ছিল। বদাউনীর মতে, চার বছরের মধ্যে বইটি চারটি বিশাল খণ্ডে সংকলিত হয়।
মহাকাব্যগুলি মূল বাল্মীকি রামায়ণ এবং বেদব্যাস রচিত সংস্কৃত মহাভারত থেকেই অনুবাদ করা হয়। তবে অশ্বমেধ পর্বটি অনূদিত হয় জৈমিনিয়াশ্বমেধ (একটি বিকল্প সংস্কৃত পুনঃকথন)-এর উপর ভিত্তি করে।
মহাভারতের বিভিন্ন পর্বের অনুবাদ এবং সেগুলিকে একত্রিত করে একটি পাণ্ডুলিপির চেহারা দেওয়ার মত জটিল কাজে সম্রাট বহু অনুবাদককে এই কাজে যুক্ত করেন। দোভাষী পণ্ডিতরা, যাঁদের ‘মুঅব্বিরান’ বলা হয়, তাঁরা তাঁদের জ্ঞান অনুযায়ী প্রথমে মৌখিকভাবে ছত্রগুলি আওড়াতেন। এই দলে যাঁদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন দেব মিশ্র, মধুসূদন মিশ্র, শতবদন, চতুর্ভূজ প্রমুখ। তারপরে এগুলি বুঝে নিয়ে ফারসী অনুবাদকের দল, যাঁদের বলা হয় ‘মুতারজিমান’, তাঁরা সেগুলি ফারসীতে অনুবাদ করতেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন নকিব খান, মুল্লাহ শেরি, সুলতান থানিসিরি প্রমুখ। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বিখ্যাত নাম অবশ্যই বদাউনীর।
১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে আবুল ফজলকে সম্রাট আকবর রজমনামার একটি প্রস্তাবনা বা ‘মুকদ্দমা’ লিখতে নির্দেশ দেন। কেন বাদশা সংস্কৃত থেকে ফারসীতে মহাভারত অনুবাদ করছেন, তা এই মুকদ্দমার মূল উপজীব্য। আবুল ফজল লিখছেন মহাভারতের গল্প এবং দর্শনকে সহজলভ্য করে তোলা এবং হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মানুষকে ঐতিহ্যগত বিশ্বাস সম্পর্কে আত্মদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানানোই ছিল এই গ্রন্থ অনুবাদ করার উদ্দেশ্য। তাই বলা যায় রজমনামা আকবরের রাজত্বকালে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরিবেশের অমূল্য সাক্ষ্য। বদাউনী খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যে আকবর এই সচিত্র গ্রন্থের অনুলিপি বিভিন্ন অভিজাত ব্যক্তিদের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেইসব আমির ওমরাহদের উপর আদেশ ছিল, তাঁরা যেন এই পাণ্ডুলিপিগুলি ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন। সেইসময় ইউরেশিয় অঞ্চলের ইসলাম ও খ্রিস্টান শাসকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের ঈশ্বর নির্ধারিত শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, যাকে ইংরেজিতে ‘divine kingship’ বলা হয়ে থাকে। এভাবে তাঁরা নিজেদের শাসনকে বৈধতা প্রদান করতেন। আকবরও সেই কাজই করছিলেন।
আরো পড়ুন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: গতায়াতের ভুবন
রজমনামাকে মোগল চিত্রকলার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অসংখ্য শীর্ষস্থানীয় চিত্রশিল্পী ছিলেন, যাঁদের ওস্তাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মীর সৈয়দ আলি এমনই একজন ‘তাবরিজি’ শিল্পী, যিনি বাবরনামা এবং রজমনামা ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে ছবি এঁকেছেন অনন্য ‘সাফাভিদ’ শৈলীতে। রজমনামায় ছবি আঁকার জন্য বাদশা তাঁর দরবারের দুই বিখ্যাত চিত্রকর দশবন্ত ও বশবন্তকেও নিয়োগ করেন। এর অনেকগুলি অনুলিপিও তৈরি করা হয়। মূল গ্রন্থটি আকবর নিজের জন্য তৈরি করান। বিখ্যাত ইংরেজ শিল্পী ডঃ রবার্ট স্কেলটন এই চিত্রগুলি নিয়ে গবেষণা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যে এই চিত্রগুলিতে ফারসী প্রভাব রয়েছে। তবে এগুলি মোগল আমলের ভারতের সামাজিক চরিত্রও তুলে করে এবং এই দেশের বৈচিত্র্যের নিদর্শন। এমনকি এই ছবিগুলিতে রাজপুত চিত্রকলারও ছাপ দেখা যায়।
রজমনামার নিজস্ব লিপি ছাড়াও আকবরের আমলে মূল পাঠের বেশ কিছু নকল তৈরি করা হয়েছিল। অনূদিত গ্রন্থের একাধিক অনুলিপি তৈরির প্রথাটি মুঘল আমলে জনপ্রিয় হয়েছিল। আকবরের মা হামিদা বানুর জন্য ১৫৯৩ সালে নাকি রামায়ণের একটি কপি তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও আকবরের দরবার-শিল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, আবদুর রহিম খান খানান, যিনি সেই সময়ের একজন বিশিষ্ট অভিজাত এবং আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন, সম্রাটের অনুমতি নিয়ে রামায়ণের একটি ব্যক্তিগত অনুলিপি তৈরি করান। তিনি ছিলেন একজন কবি এবং শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তিনি বহু ক্যালিগ্রাফার, বুকবাইন্ডার, ইলুমিনেটর এবং শিল্পীদের সমন্বয়ে একটি পৃথক কিতাবখানা এবং চিত্রকর্ম কর্মশালা তৈরি করেন।
আকবরের রামায়ণে ১৭৬টি ছবি আছে। এর প্রধান শিল্পীরা ছিলেন বাসওয়ান, কেশব, লাল এবং মিসকিন। অনুবাদ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ছবি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল এবং সম্ভবত তা ১৫৮৬ বা ১৫৮৭ সালের প্রথম দিকে রজমনামা প্রস্তুত হওয়ার পরপরই। তবে জন সেলারের মতে, ফোলিওগুলির মধ্যে AH 1000/AD 1591-92 সালের যে তারিখ পাওয়া যায়, সেটি ইঙ্গিত করে যে অনুবাদের পর অন্তত তিন বছর কাজ চলেছিল। চমৎকারভাবে চিত্রিত আকবরের রামায়ণ লিপি আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও প্রাধান্য পেয়েছিল। এর ছবিগুলি আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতা এবং আধ্যাত্মিক গভীরতার রূপক হিসাবেও কাজ করেছিল।
অন্যদিকে রজমনামায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের জরাসন্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, রাজাদের সমাবেশে কৃষ্ণের সিংহাসনে আরোহণ, রাজসভায় ভীষ্মের কৃষ্ণকে অভ্যর্থনা করা, পারিজাত হারানো, শিশুপাল বধ, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর, বলরামের দেহত্যাগের মতো ঘটনার ছবি পাওয়া যায়।
রজমনামার প্রথম প্রতিলিপ, যা ১৫৮০-র দশকে তৈরি হয়েছিল, তা বর্তমানে জয়পুরের সওয়াই মান সিং মিউজিয়ামে রাখা আছে। সেখানে রজমনামার সঙ্গেই আছে ফারসী ভাষায় অনুদিত রামায়ণও। ১৬৯০ সাল থেকে এই দুটি বই ওই প্রাসাদে রয়েছে। রাজপরিবারের পারিবারিক বিবাদের জেরে রজমনামার মূল পাণ্ডুলিপি ইতিহাসবিদদের কাছে এখনো অধরা। ১৬১টি চিত্রসহ দ্বিতীয় লিপিটির ছবিগুলি আরো বিশদে চিত্রিত করা। এর শেষ পাঁচটি পর্ব সম্বলিত অংশ ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এই অনুলিপি এন বি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) সংগ্রহ করেছিলেন। এগুলি নিয়ে তিনি ১৭৮৫ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৮৩০ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে ব্রিটিশ মিউজিয়াম এগুলি কিনে নেয়। তৃতীয় অনুলিপি, যা ১৬০৫ সালে তৈরি হয়েছিল, তা এখন কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচারে রাখা আছে। চতুর্থ অনুলিপিটি একটি বিক্ষিপ্ত অনুলিপি, যাতে বর্তমানে আমাদের জানা দুটি মাত্র তারিখের পৃষ্ঠা রয়েছে। এই রজমনামা এক ঐতিহাসিক দলিল, যা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির পাশাপাশি ভারতসম্রাট আকবরের রাজধর্ম পালনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
গ্রন্থপঞ্জি
১. রজমনামা; ব্রিটিশ গ্রন্থাগার। (Or 12076)
২. এ পার্সিয়ান মহাভারত: দ্য ১৫৯৮-১৫৯৯ রজমনামা; এ বি রাইস, ইয়েল
৩. এ সাব ইমপিরিয়াল মুঘল ম্যানুস্ক্রিপ্ট – দ্য রামায়না অব আওধ – আল – রহিম খানেখানান; সেলার, জন
৪. মডেল অ্যান্ড কপি: দি ইলাস্ট্রেশন অব থ্রি ‘রজমনামা’ ম্যানুস্ক্রিপ্টস; আর্কাইভ অব এশিয়ান আর্ট, ভলিউম ৩৮ (১৯৮৫): (৩৭-৬৬), ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই প্রেস।
৫. আকবর দ্য গ্রেট মুঘল; মুখোটি, ইরা; আলেফ বুক কোম্পানি, ২০২০
৬. কালচার এন্ড সার্কুলেশন; ব্রুজিন, থমাস দি ও অ্যালিশন বুশ; লেইডেন, বস্টন: ব্রিল, ২০১৪।
৭. মুঘল পেন্টিং, পেট্রনস অ্যান্ড পেন্টারস; ভার্মা, এস পি; প্রসিডিং অব দ্য ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস, ২০০০-২০০১ , ভলিউম ৬১।
৮. পেন্টিংস অব দ্য রজমনামা দ্য বুক অব ওয়ার; দাস, অশোক কুমার; ম্যাপিন পাবলিশিং, ২০০৫।
৯. অ্যাডভেঞ্চার্স অব রাম; বিচ, ক্লিভল্যান্ড মাইলো; গ্রন্থ কর্পোরেশন , ২০১১।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।