সৌভিক ঘোষ

পাঁচ হাজার ছশো বাষট্টি বর্গফুট জমি, ডেসিমেলের হিসাবে যার সাংখ্যমান ১৩। এই জমিকে কেন্দ্র করে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ দেশেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত নোবেল পুরস্কার প্রাপক অমর্ত্য সেনকে হেনস্থা করতে চাইছে। অধ্যাপক সেন নিজের ছেলেবেলার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন সেখানেই, শান্তিনিকেতনের গোড়া থেকে তাঁর পরিবার ওই এলাকারই বাসিন্দা।

আগাগোড়া বিচার-বিশ্লেষণ না করে যে কোনো ঘটনা নিয়ে তড়িৎগতিতে যা হোক কিছু একটা প্রতিক্রিয়া দেওয়া গত তিন দশকে মানবসমাজের প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশাল মিডিয়া সেই সুযোগকে আরও বিস্তৃতি দিয়েছে। উৎকর্ষের সন্ধানে যাঁরা ব্রতী এবং কিছুদূর অবধি সফল, একসময় মেধার জগৎ তাঁদেরই নাগালের মধ্যে থাকত। ব্যাপারটায় খানিক সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির ছোঁয়া ছিল নিশ্চিত, কিন্তু শূন্যগর্ভ অহমিকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা নির্বুদ্ধিতার আস্ফালন একেবারেই ছিল না। নয়া উদারবাদ শুধুমাত্র দেশের সীমানা পেরিয়ে পুঁজি সঞ্চলনের দ্বারটিই উন্মুক্ত করেনি, যোগ্যতার নিগড়ে অর্জিত আত্মপরিচয়ে যেটুকু শ্লাঘার অস্তিত্ব থাকা স্বাভাবিক – তাকেও ধ্বংস করেছে। যা ইচ্ছা তাই (কিংবা যাচ্ছেতাই) করাটা সেই জন্যই আজ আর শুধু ছ্যাঁচড়দের বৈশিষ্ট্য নয়, মেধার চামড়া গায়ে দাপিয়ে বেড়ানো লোকেদের মধ্যেও ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তাই লজ্জাজনক কাজটি করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, সেই অপমানের কথা গলার শিরা ফুলিয়ে প্রচারের বন্দোবস্ত অবধি করছেন। তাঁরা কি জানেন না, এতে বিদ্বৎসমাজ (যেটুকু যা পড়ে রয়েছে) বিরূপ হবেন? মান সম্পর্কে তিলমাত্র হুঁশ আছে যাঁদের, তাঁরা এতে বিরক্ত হবেন? জানেন। আসলে কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য অন্য। বিশ্বভারতীর দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন মেধার জগতকে অস্বীকার করাই তাঁদের সরকারি কর্তব্য। চাকরির অলিখিত শর্তই বলা চলে। তা না হলে নিজেদেরই ছাত্রছাত্রীর দিকে কেউ ঢিল-পাটকেল ছোড়ে না।

অধ্যাপক সেন শুধু মেধাবী নন, বিকল্প জীবনযাপনের রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানসম্মত অর্থশাস্ত্রে অসামান্য ব্যুৎপত্তির পরিচয় যেমন তাঁর রয়েছে, তেমনই এদেশের বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গেই যে তিনি ছিলেন, তাও সত্য। প্রথাগত দলীয় পরিচিতি তাঁর অপছন্দের হলেও প্রেসিডেন্সি কলেজে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন মাথা তোলার সময়ে তিনি যে তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছিলেন, এমনকি কিছুটা সক্রিয় ভূমিকাও পালন করেছিলেন তা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। প্রকৃত মেধার স্বরূপই অমন। অহেতুক ভান তার প্রবল অপছন্দের বিষয়, প্রকাশ্যে নিজের অবস্থান ঘোষণায় মেধা চিরকালই দ্ব্যর্থহীন। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের আচরণে তাই আশ্চর্যের কিছু নেই।

তাঁরা তো রীতিমত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই তাঁদের কথা ও কাজের মার্গ। মুশকিল হল, অধ্যাপক সেনের পরিচিতিকে কেটেকুটে মেধার জগতে আটকে রাখতে চাইলেও দেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে দ্বিমত হওয়ার উপায় নেই। ধামাধরা হলেও নেই। তাই ফিরে দেখতে হবে, এসব অসভ্যতা কি শুধু এখনই হচ্ছে নাকি এরও ঐতিহ্য আছে?

আছে।

কেমব্রিজে নিজের থিসিস জমা করে অধ্যাপক সেন ভারতে ফিরে এসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসাবে কাজ শুরু করেন। তখনই যুগবাণী পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে খেউড় শুরু হয়। আগ্রহীরা খুঁজে দেখতে পারেন সেই পত্রিকা আসলে কাদের স্বার্থরক্ষা করতে চেয়েছিল। বোঝাই যায়, সেবার তারা ততটা সফল হয়নি, কেননা অধ্যাপক সেনকে ওই কারণে চাকরি ছাড়তে হয়নি। গত শতকের পাঁচের দশকে এই রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাথায় কেবল বামপন্থীরা ছিলেন – একথা বামবিরোধীরাও (আরএসএসের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র, তারা নিজেদের তৈরি ইতিহাস ব্যতীত অন্য কিছুই মানে না) মানবেন না। কিন্তু ওই সময়ে যাঁরা দায়িত্ব সামলাতেন তাঁদের জ্ঞান ও গরিমা সম্পর্কে অনুভবটুকু ছিল। তাই যুগবাণীতে প্রকাশিত লেখাজোখা সেই যুগের বাণী হয়ে উঠতে পারেনি।

কিন্তু এখন হাওয়া বদলেছে। সোশাল মিডিয়া আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর যে এক নয় – একথা এখন অনেকেই ভুলে যান। সেই ফারাক ভুলিয়ে দিতে রীতিমত মাইনে করা ‘সেল’ চলে। দেশের মাথায় বসা রাজনৈতিক দলের দর্শন আর অধ্যাপক সেনের দৃষ্টিভঙ্গি যে আলাদা, তাঁকে অপমান করার কেন্দ্রীয় অপচেষ্টা যে হঠাৎ শুরু হয়নি, সেকথা বুঝতে বছর সাতেক পিছিয়ে গেলেই চলবে।

পাঠকের মনে রাখা উচিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ফা হিয়েনের সময়কার নয়, ২০০৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের পরিকল্পনায় বিহারে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্মিত হয়) ঘটনা। ভারতী জৈনকে হয়ত এখন সেভাবে আর কেউ মনে রাখেননি। তিনি তখন একটি ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিক। একের পর এক টুইট করে এক অদ্ভুত প্রচার চালিয়েছিলেন। অধ্যাপক সেন নাকি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের সূত্রে (পূর্বতন ইউপিএ সরকারের তাঁকে নালন্দার মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছিল) প্রতি মাসে পাঁচ লক্ষ টাকা বেতন নিয়েছেন, বছরের পর বছর পাঁচতারা হোটেলে থাকার খরচ পেয়েছেন, সরকারি অর্থে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন ইত্যাদি ছাইপাঁশ। পরে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হলে প্রথমে ভারতী বলেন এসব নাকি সরকারি তথ্য। পরে প্রমাণিত হয় সবই হোয়াটস্যাপে ঘুরতে থাকা ভাইরাল মেসেজের বয়ান। চাপের মুখে ভারতী সেইসব টুইট মুছে দিলেও, আজও বিভিন্ন সূত্র থেকে হোয়াটস্যাপে মেসেজ হিসাবে সেসব মিথ্যা প্রচারিত হয়ে চলেছে।

যাঁরা কিছু অন্তত জানেন বোঝেন তাঁদের কথা ভেবে এসব মেসেজ পাঠানো হয় না। সরকারি তথ্যই বলছে, এ দেশে উচ্চশিক্ষা তো দূরের কথা, বুনিয়াদি শিক্ষাই বেশিরভাগের কাছে পৌঁছচ্ছে না। আইটি সেল তাদেরই মাথার দখল নিতে মেসেজ ভাইরাল করে। ঘরে ঘরে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব নেই, কিন্তু যেভাবেই হোক একটি স্মার্টফোন কেনার তাগিদ আছে। সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে গালগপ্পো ইতিহাস নামে চালিয়ে দেওয়া হয়, হচ্ছে।

সমস্যা হল অধ্যাপক সেন এখনও কথা বলছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যা কিছু হচ্ছে, সেসবের জবাবে এখনো তিনি প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। যেমন সেবার ভারতীর টুইটে পাঁচতারা হোটেলের কথা বলা হলে তিনি উত্তরে জানিয়েছিলেন “এমন অভিযোগে আশ্চর্য হতে হয়! এতে যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কেই পাঁচতারা হোটেল বলে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে!”

এই হল দ্বিতীয় পর্বের কথা। সেবারেও তাঁকে কাবু করা গেল না, কেননা অভিযোগকারিণী নিজেই সেসব মুছে দিলেন।

এখন তৃতীয় দফার হইচই চলছে। হট্টগোলের হেতু ১৩ ডেসিমেল জমি, যা নাকি অধ্যাপক সেন দখল করে রেখেছেন। জমির মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য যেটুকু জানা গেছে, তাতে স্পষ্ট যে এ অভিযোগ ধোপে টিকবে না। প্রসঙ্গ জমির মালিকানা নয়। যদি জট কিছু থেকেও থাকে সেটুকু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক সেনের সঙ্গে কথা বলে মেটাতে পারতেন। সে পথে না যাওয়াই আসল রাজনীতি। ও পথে গেলে খেউড় হত না, অসভ্যতা করা যেত না। যুগবাণীর প্রতিবেদনের পরে ৫০ বছরেরও বেশি কেটে গেছে, আজ অবধি একটিবারও সাফল্য আসেনি।

আরো পড়ুন অমর্ত্য সেন, ক্লিকটোপ আর মাদাম তুসো

আসলে খেউড় করতে চাইছেন যাঁরা, তাঁদের একটি সহজ কথা বুঝতে অসুবিধা আছে। খেউড় জনপ্রিয় হয়, সফল হয় যদি প্রতিপক্ষও সেই একই পথে চলে। বাংলায় এ ঘটনা নতুন নয়। সহমরণের বিরোধিতায় রামমোহন রায়, বিধবাবিবাহ প্রচলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এমনকি বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ থেকে রেহাই পাননি। ইতিহাস বলছে প্রতিবারই সংগঠিত খেউড়ের উল্টোদিকে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই জিতেছেন।

কিন্তু দালালি করতে বসা লোকেদের ইতিহাসের শিক্ষা মাথায় রাখলে চলে না। তাতে চাকরি হারানোর ভয় থাকে। অর্থাৎ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যা করছেন তা করতেই তাঁদের বসানো হয়েছে।

এতে কী লাভ? কার লাভ?

লিবারাল ডেমোক্র্যাটরা এমন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন ধরে নিলাম।

লাভ এই, যে এসব চললে সমাজে মেধা সম্পর্কে, মেধাবীদের সম্পর্কে এবং মেধাচর্চার জায়গা সম্পর্কে অনাসক্তি, নির্লিপ্তি তৈরি হয়। বেশিরভাগের চেতনায় থিতু হতে থাকা সেই অনাসক্তি, নির্লিপ্তিকে কাজে লাগিয়ে মেধাচর্চার যেটুকু সুযোগ এখনো আছে তাকে ধ্বংস করতে না পারলে যেমন সাম্প্রদায়িক শক্তির চলছে না, লুটেরা পুঁজিরও চলছে না।

অধ্যাপক সেন যে যে কারণে আমাদের কাছে শ্রদ্ধেয়, তার গোড়ায় রয়েছে অসাম্যের বিরুদ্ধে চেতনার ভূমিকা। পুঁজিই হোক বা সাম্প্রদায়িক শক্তিই হোক – দুয়েরই শিকড় অসাম্যের ভিতরে লুকিয়ে আছে। এই অবস্থায় বিকল্প যাপনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছেন এমন একজন মেধাবী মানুষকে অপদস্থ, সন্ত্রস্ত করতে চাওয়া ওই দুই শক্তিরই সচেতন কর্মসূচি।

রইল বাকি আমাদের কথা। আমরা মানে যারা এসব দেখে শুনে জেনে পড়ে অস্বস্তি অনুভব করি তারা। আমাদের অভিশাপ এই যে আমরা ভুলতে চেয়েছি আমাদের ঐতিহ্য, আমরা ভুলতে থেকেছি আমাদের অতীত। বাজারে ঘুরে আরও শস্তায় জীবন চালানোর উপকরণ খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে থাকতে আমরা এসব ভুলতে বাধ্য হয়েছি তা যেমন ঠিক, তেমনই এও ঠিক যে ওই জীবনযাপনে বাধ্য করে দিতেই যে “মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়” বলা হয়েছিল তা আমরা বুঝিনি।

সেই আত্মবিস্মৃতির মূল্য চোকাতেই হবে। আজ হোক, কাল হোক হবেই। তখনই নিজেদের দেশের মান-সম্মান, ভারতীয় হিসাবে যাঁদের অস্তিত্ব আমাদের অহঙ্কার তাঁদের অপমানের বদলা নেওয়া সম্ভব হবে। এতে শুধু ভুল শুধরে নেওয়া হবে তাই নয়, মেধাবীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যও অর্পণ করা যাবে।

নিবন্ধকার সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.