ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর সার্জিকাল স্ট্রাইক, নাকি বুলডোজার রাজ? রাহুল গান্ধীর দুবছরের জেল এবং সাংসদ পদ বাতিলের ঘটনাকে যা-ই বলা হোক না কেন, তা বোধহয় পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে সঠিকভাবে বোঝাতে পারবে না। প্রথমেই পরিষ্কার বলে নেওয়া ভাল, এই আক্রমণ কেবল রাহুল গান্ধী বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উপর নয়; সার্বিকভাবে দেশের গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতার উপর আক্রমণ। প্রধান বিরোধী দল এবং তার নেতার উপর হামলা দিয়ে যা শুরু হল, ধাপে ধাপে এই দেশের যাবতীয় শাসকবিরোধী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গকেই তা চাঁদমারি বানাবে – এই আশঙ্কা এখন দিনের আলোর মত সত্য। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ যারাই আরএসএস-বিজেপির বিরোধিতা করবে, তাদেরই গারদে পোরা হতে পারে।

সবচেয়ে ভয়ানক হল, এই গোটা দমনপীড়নের প্রক্রিয়াটিকে বৈধতা দিতে শুরু হয়েছে সম্মতি উৎপাদনের খেলা। এ জিনিস আমরা আগেও দেখেছি। কানহাইয়া কুমার, শার্জিল ইমাম বা উমর খালিদকে জেলে ভরার সময় দেশজুড়ে ঘৃণার চাষের মাধ্যমে জনসম্মতি উৎপাদন করা হয়েছিল। সরকারের সমালোচনাকেই রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে চিহ্নিত করে প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া হয়েছিল। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের যে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখনো সরকারবিরোধিতায় সোচ্চার, তাদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। মূলধারার মিডিয়ার পাশাপাশি সোশাল মিডিয়াকেও ব্যবহার করা হয়েছে এই কাজে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

দুঃখজনকভাবে, শাসকরা তামিলনাড়ু, কেরলের মতো দু-একটি রাজ্য বাদে সর্বত্র এ কাজে সফল হয়েছে। রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রেও এই সম্মতি উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ক্রমশ তা শক্তিশালী হচ্ছে। রাহুলের বিকৃত ছবিতে ছেয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়া। দেশের প্রধান বিরোধী নেতাকে ‘উচিত সাজা’ দেওয়ার ঘটনায় যদি সরকার আগের ঘটনাগুলির মতই জনসম্মতি উৎপাদন করতে পারে, তাহলে ভারতীয় গণতন্ত্রের সমূহ বিপদ। জরুরি অবস্থা বাদ দিলে এমন দুর্দিন এই দেশে আগে কখনো আসেনি। এতখানি হিংস্র আক্রমণের মুখে ভারতীয় গণতন্ত্র আগে পড়েনি।

গত কয়েক বছরের রাহুল গান্ধীকে ভয় না পেয়েও অবশ্য সরকারের উপায় নেই। এই রাহুল আগের চেয়ে অনেকখানি পরিণত, অনেক বেশি সক্রিয়। তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রা একদিকে যেমন কংগ্রেসের কর্মীদের চাঙ্গা করে তুলেছে, তেমনই দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে সমস্ত বিরোধী শক্তিকে যাত্রার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলছেন, “ভারত আরএসএসের জায়গীর নয়”। এই রাহুল গান্ধী যেন ঠিক সাবেকি কংগ্রেস নেতা নন। গান্ধী পরিবারের আভিজাত্য দিয়েও তাঁকে পুরোপুরি ধরা যায় না। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি যে তীব্রতায় গৌতম আদানি এবং মুকেশ আম্বানির মত দুই বিরাট কর্পোরেটকে আক্রমণ করেছেন, তা সত্যিই নাড়িয়ে দেওয়ার মত। ভারতীয় গণতন্ত্র যখন প্রায় পুরোপুরি কর্পোরেটনিয়ন্ত্রিত খেলাধূলার আসরে পরিণত হয়েছে, কর্পোরেটের টাকা বাদে যখন নির্বাচনের দরিয়া পার করা প্রায় অসম্ভব, তখন রাহুলের এই খোলাখুলি কর্পোরেটবিরোধিতা সমীহ না জাগিয়ে পারে না।

রাহুল বারবার বলছেন, তাঁর লড়াই কেবল কংগ্রেসের জন্য নয়, এই দেশের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। একে কেবল নির্বাচনী পাটিগণিতে পড়া যাবে না। ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন যেসব রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, রাহুল সেগুলিতে মনোযোগ দেননি। তা কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে সমালোচিত হয়েছে, কিন্তু রাহুল সম্ভবত তাঁর পাখির চোখটি দেখতে পাচ্ছেন। তিনি সম্ভবত উপলব্ধি করতে পারছেন, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করা না গেলে কংগ্রেসকেও পুনরুজ্জীবিত করা যাবে না। গত প্রায় এক দশকে এই দেশের রাজনীতি এবং সমাজে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, তার মূলে না পৌঁছতে পারলে নির্বাচনী সাফল্যও প্রায় অসম্ভব, অথবা সাফল্য এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া মুশকিল।

রাহুল গান্ধীকে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার ভয় পাচ্ছে, কারণ বিভাজনের রাজনীতি ছাড়া তাদের হাতে আর খুব বেশি অস্ত্র নেই৷ চাকরিবাকরির অবস্থা শোচনীয়, মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া। গালওয়ান সঙ্কট দেখিয়ে দিয়েছে বাগাড়ম্বর ছাড়া বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও মোদী সরকার ঠুঁটো জগন্নাথ। আদানি টলোমলো হওয়ার পরে পরিস্থিতি আরও সঙ্কটজনক। এই অবস্থায় অনেক পিছন থেকে শুরু করেও দ্রুত উঠে আসছেন রাহুল। তিনি কথা বলছেন জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে। কথা বলছেন বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান হিংসা নিয়ে। এমনকি রাহুলের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের তাসও আগের মত কাজ করছে না। কারণ একদিকে যেমন জয় শাহের উদাহরণ রয়েছে, অন্যদিকে ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল স্পষ্ট করেই বলেছেন, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা বা রাজীব তাঁদের যা করণীয় ছিল করেছেন। কিন্তু ২০২৩ সালের ভারতে কেবল তাঁদের কথা বললে চলবে না, বলতে হবে এই সময়ের কথা। এই ধরনের বক্তব্য, রাহুলের মাটির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা নিঃসন্দেহে যুবসমাজের কাছে তাঁর আবেদন বাড়িয়ে তুলছে।

রাহুলকে সংসদ থেকে সরিয়ে দেওয়া বিজেপির জন্য জরুরি। কারণ সংসদের ভিতরে রাহুল যদি বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের অকর্মণ্যতা তুলে ধরেন, সংসদের বাইরে তার প্রভাব পড়বে বিপুল। সংসদের ভিতরে সাম্প্রতিক অতীতে রাহুল বিদ্বেষের রাজনীতি, বেকারত্ব, চীনের কাছে পর্যদুস্ত হওয়ার মতো বিষয় নিয়ে সরব হয়েছেন। আগুনে ঘি ঢেলেছে আদানির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সখ্য নিয়ে তোলা প্রশ্ন। এরপরই সুরাটের মানহানির মামলা ফাস্ট ট্র্যাকে চলে যায়। অবশেষে রাহুলকে দুবছরের জেল দেওয়া হল। তার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই খারিজ করা হল সাংসদ পদ।

আরো পড়ুন রাহুল গান্ধীর স্মরণীয় বক্তৃতায় উঠে এসেছে গোটা দেশের স্বার্থ

ঘটনা হল, আইনি দিক থেকে বিচার করলে অতিসক্রিয়তা নজরে পড়বে ঠিকই, তবে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ করাকে বেআইনি বলা যাবে না। গুজরাটের সুরাটের জেলা আদালতের বিচারক এইচ এইচ বর্মা রাহুলকে ১০,০০০ টাকার জামিনে মুক্তি দিয়েছেন। পাশাপাশি ৩০ দিনের মধ্যে উচ্চতর আদালতে আবেদন করার অনুমতিও দিয়েছেন। আপাতত যা পরিস্থিতি, রাহুল অন্তত আগামী আট বছর (দুবছর জেল এবং সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে আরও ছ বছর) কোনো ভোটে লড়তে পারবেন না। আইনি দিক থেকে বিচার করলে রাহুলকে অবিলম্বে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতে হবে।

রাহুল বর্তমানে সেশনস কোর্টে আবেদন করতে পারেন। তাতে কাজ না হলে তিনি হাইকোর্টে যেতে পারেন। পাশাপাশি এই রায়ের উপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশও চাইতে পারেন। মানহানির মামলায় এমন সাজা সাধারণত দেওয়া হয় না। অবশ্য অযোধ্যার রামমন্দির যদি বাবরি মসজিদের জমিতে গড়ে উঠতে পারে, তাহলে এ আর এমন কী ব্যাপার?

আইন নিয়ে আরও দু-চার কথা বলে রাখা ভালো। ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে এই বিষয়টি নিয়ে দুরকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ওই আইনের ৮(৩) ধারা বলছে, কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধে দুবছরের বেশি কারাদণ্ড পেলে রায় ঘোষণার দিন থেকেই তাঁর আর জনপ্রতিনিধি থাকার অধিকার থাকবে না। ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, জেল থেকে মুক্তির পর ছ বছর পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। কিন্তু ওই আইনেরই ৮(৪) ধারায় আবার বলা হয়েছে, রায় ঘোষণার সময় যদি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি থাকেন, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সদস্যপদ খারিজ করা যাবে না। সাজা ঘোষণার পরবর্তী তিনমাস বা উচ্চতর আদালতে রায় পুনর্বিবেচনা না হওয়া পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি থাকতে পারবেন তিনি।

রাহুলের সমস্যা হল, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের এই ৮(৪) নম্বর ধারার বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন লিলি টমাস ও এসএন শুক্লা। ২০১৩ সালে এ নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রায় দেয় বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক এবং বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়ের বেঞ্চ। তাতে ওই ধারাকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেওয়া হয়। বলা হয়, নিম্ন আদালতে রায় কার্যকর হওয়ার দিন থেকেই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি থাকার অধিকার হারাবেন। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের প্রভাব আটকাতে অধ্যাদেশ আনার পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন ইউপিএ সরকার। তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন রাহুল নিজেই। অধ্যাদেশের খসড়া বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন তিনি। সেইসময় কার্যত তাঁর চাপেই অধ্যাদেশ ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

অনেকে বলছেন রাহুলের উচিৎ বীরের মত জেলে যাওয়া। তাতে নাকি তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হবে। একেবারে ভুল ধারণা। রাহুলকে জেলে ঢোকাতে পারলে বিজেপি কংগ্রেসকে নেতৃত্বহীন করে দিতে পারবে। লোকসভার আগে কার্যত ফাঁকা মাঠে ফুটবল খেলবে মোদী-শাহ জুটি। শুধু তাই নয়, এই ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এরপর যে কোনো বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, প্রতিবাদী সমাজকর্মী বা সাংবাদিককে জেলে ঢোকাবে এই সরকার। রাহুলের মত বিরাট মাপের নেতার সঙ্গে যদি এমন করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের হাল কী হতে পারে?

অঘোষিত জরুরি অবস্থায় দাঁড়িয়ে মনে পড়ছে খাতায় কলমে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা ইন্দিরার কথা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন তিনি। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার হতেই লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি হয় কংগ্রেসের। কেন্দ্রে সরকার গঠন করে জনতা পার্টি। দেশের প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন মোরারজি দেশাই। মাত্র কয়েক মাস বাদেই গ্রেপ্তার করা হয় ইন্দিরাকে। একদিন পরই অবশ্য নিঃশর্ত মুক্তি পান তিনি। কিন্তু সেই গ্রেপ্তারির ফল হয় সুদূরপ্রসারী। ভারতীয় রাজনীতি সাক্ষী থাকে ইন্দিরার দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনের।

রাহুল কী করবেন? উত্তর দেবে সময়। তবে রাহুল একা নন। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.