সংসদীয় রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল বিকল্পের নির্মাণ। প্রবল ক্ষমতাশালী শাসকের দাপটে দেশবাসীর যখন নাভিশ্বাস ওঠে, তখন নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজন একটি বিকল্প চরিত্রের। এমন একজন নেতা, যিনি ধারণ করতে পারবেন শাসকবিরোধিতার মূল স্রোতগুলিকে, হয়ে উঠবেন প্রতিস্পর্ধার প্রতীক। এই প্রশ্ন অবশ্য উঠতে পারে, রাজনীতি মানে কি তাহলে কেবলই নেতাকেন্দ্রিক অনুশীলন? মুখ্য নেতার নাম ছাড়াই যদি লড়াই হয়, তাহলে কি পরাজয় অবশ্যম্ভাবী? দুঃখজনক হলেও সত্যি, ভারতের মত দেশে এটাই সত্যি। অন্তত এই মুহূর্তে। একজন প্রবল ক্ষমতাশালী নেতার বিপরীতে সমস্ত বিরোধী শক্তিকে জোটবদ্ধ করার জন্য একজন নেতাকে প্রয়োজন। কোনো গোলগোল কথা নয়, ‘নির্বাচনের পর নেতা ঠিক হবে’ গোছের ধোঁয়াশা নয়। বিরোধীদের স্পষ্ট করে বলতে হবে নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প কে? এনডিএ সরকারের পতনের পর কে হবেন দেশের কর্ণধার? ‘ইফ নট মোদী দেন হু’ – এই জিজ্ঞাসার উত্তরে দেশজুড়ে এই মুহূর্তে একটাই নাম উঠে আসছে – রাহুল গান্ধী।

সাংসদ পদ বাতিল হওয়ার পরে গতকালের সাংবাদিক সম্মেলনে নির্ভীকতা যেন রাহুলের প্রত্যেক শব্দ থেকে চুঁইয়ে পড়ছিল। আত্মবিশ্বাসী, অকুতোভয় এই রাহুল নিঃসন্দেহে গোটা দেশের বিরোধী রাজনীতির প্রধান মুখ। দেশের সবচেয়ে বড় উগ্রবাদী শক্তি, যারা ১০০ বছর ধরে দেশে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে, সরাসরি ভারতকে তার সাংবিধানিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করে যারা হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার ঘোষিত নীতি নিয়ে চলে, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন রাহুল গান্ধী। দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই ধনকুবেরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা এই রাহুলের তীক্ষ্ণতা, তীব্রতা যেন দিন দিন বাড়ছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এখানেই বোধহয় তিনি মমতা ব্যানার্জি, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অখিলেশ যাদব, কে চন্দ্রশেখর রাও বা পিনারাই বিজয়নদের থেকে আলাদা। রাহুল একমাত্র নেতা, যিনি স্পষ্টভাবে বলছেন, ২০২৪ সালের লড়াইটা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং অনেক বেশি করে আদর্শের। একদিকে মহাত্মা গান্ধী, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদের আদর্শ আর অন্যদিকে বিনায়ক দামোদর সাভারকর, মনু গোলওয়ালকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নব্য নাজিবাদের এক পরিবর্তিত রূপ – হিন্দুত্ব। এই লড়াইকে নির্বাচনী পাটিগণিতে দেখলে চলবে না, দেখতে হবে ভারতের অন্তরাত্মাকে বাঁচানোর লড়াই হিসাবে। ঠিক এই নীতি থেকেই রাহুল হয়ত বলেন “আমার মাথা কেটে নিলেও আমি আরএসএসের দপ্তরে যাব না”। যেখানে মমতা ব্যানার্জিকে মোহন ভাগবতকে খুশি করতে বলতে হয়, “আরএসএস অতটা খারাপ বলে আমি মনে করি না”।

বড় প্রশ্ন হল, রাহুল কি আজ হঠাৎ করে এমন হয়েছেন, নাকি তিনি প্রথম থেকেই এই আদর্শগত লড়াইতে আছেন, যেখানে দেশের বড় বড় ধনকুবেরকে দৃপ্ত কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ছোড়া যায়? সেইসব ধনকুবের, যারা সম্ভাব্য মুসলমান গণহত্যার স্পনসর?

সালটা ২০১০। ওড়িশার নিয়মগিরিতে বক্সাইট খনন করতে লন্ডন থেকে এলো বেদান্ত। এই বেদান্ত গ্রুপ কার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তা নিশ্চয়ই পাঠককে খুলে বলতে হবে না। নিয়মগিরির গরীব আদিবাসীদের উৎখাত করে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের সব ব্যবস্থা যখন পাকা, তখন হঠাৎ বাহুবলীর মত একা রুখে দাঁড়ান যুবক রাহুল, আটকে দেন বেদান্তের প্রোজেক্ট। সেই প্রথম বোধহয় দেশের বৃহৎ পুঁজিপতিদের কুনজরে এসেছিলেন রাহুল। তারপর উত্তরপ্রদেশের ভাট্টা পারসৌলে গরীব কৃষকদের জন্য কথা বলা, সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কম খেসারত দিতে হয়নি রাজীবতনয়কে। কিন্তু তিনি যেন জেদি, যত কষ্টই হোক না কেন, সংঘের কাছে মাথা নত করবেন না। হয়ত সেই জেদ থেকেই ছুটে গিয়েছিলেন গণপিটুনিতে নিহত আখলাক আহমেদের বাড়িতে। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ, যার সামনে বড় বড় রাজনৈতিক পালোয়ানদের বুক কাঁপে, তাদের ঠেলে সরিয়ে যখন রাহুল হাথরাসের ধর্ষিতার বাড়ির দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ যেন আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল।

ঠিক এখানেই বাকিদের থেকে তিনি আলাদা। যখন দিল্লি দাঙ্গা থেকে শুরু করে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃশংসতা, তাহির হুসেনের উপর অত্যাচার, শাহীনবাগে বিজেপির মুহুর্মুহু আক্রমণের পরেও কেজরিওয়াল চুপ থেকে নরম হিন্দুত্বের তাস খেলেন, তখন রাহুল ছুটে যান ক্ষতবিক্ষত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে – নেহরুর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। তাতে তাঁকে টুকড়ে টুকড়ে গ্যাঙের নেতা বলা হলেও তোয়াক্কা করেন না।

আরো পড়ুন কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?

একদিকে রাজ্যের ৩০% মুসলমানের ভোট পকেটে পুরে তৃতীয়বারের জন্য মসনদে বসা মমতা যখন ভাগবতকে ফুল, মিষ্টি পাঠাতে ভোলেন না। অন্যদিকে কর্ণাটকে যখন মুসলমান মেয়েদের হিজাবকে অজুহাত করে শিক্ষায়তন থেকে বার করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছিল, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে একটা টুইট অবধি করতে ভুলে যান। এই অবস্থায় দেশের গণতান্ত্রিক আকাশে যখন প্রশ্ন ওঠে “ইফ নট আরএসএস, দেন হু?” তখন উত্তর আসে “গান্ধী গান্ধী”। কারণ রাহুল কোনো রাখঢাক না রেখেই লিখতে পারেন

কেজরিওয়ালের মত ঠগ যখন দেশের নোটে দেবতার ছবি লাগানোর দাবি তুলে মোদীকে হিন্দুত্বের লড়াইয়ে ছাপিয়ে যেতে চান, তখনই দেশজুড়ে চলা এই বিপুল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে রাহুল হিন্দুধর্ম এবং সাভারকরের হিন্দুত্বের তফাত খুব স্পষ্ট ভাষায় মাইকে বলেন।

খোলাখুলি সাংবাদিক সম্মেলনে ব্রিটিশদের গোলাম সাভারকরের মাফিনামা দেখানোর সাহস যাঁর রয়েছে, তাঁকে নিয়ে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ; বিশেষত অত্যাচারিত, অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষ স্বপ্ন দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই দেশের মুসলমান, দলিত, আদিবাসী, এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ রাহুলের অদম্য সাহস আর জেদের মধ্যে আশার ফুলকি দেখতে পেয়েছেন। সেই ফুলকি সংঘের হিন্দুত্বের প্রাসাদে আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে কিনা সেটা সময় বলবে।

তবে এটুকু বলা যায়, এই মুহূর্তে প্রত্যেক ভারতীয়ের কানে একটা লাইন বারবার বাজছে “মাই নেম ইজ গান্ধী, নট সাভারকর”। এই কথাটা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন বলেই রাহুলের নেতৃত্বকে ভয় বিজেপির। সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াইয়ের নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন রাহুল। তাই সবচেয়ে বেশি আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁকে, অন্য কোনো বিরোধী নেতাকে নয়।

অতএব যেসব ‘বিরোধী’ নেতা এখনো রাহুলের নেতৃত্বে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাঁদের বিজেপিবিরোধিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। রাহুলের বিরোধিতা (সমালোচনা নয়, বিরোধিতা) আর বিজেপির পক্ষাবলম্বন ২০২৩ সালের ভারতে প্রায় সমার্থক।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.