সূর্যশেখর রায়
গত এক-দেড় দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম সফল রাজনৈতিক প্রকল্প হল ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দখল করে নেওয়া। রাজনৈতিক অনুশীলনে যাঁরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একেবারে ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা ছিলেন, তাঁদেরও উগ্র জাতীয়তাবাদী রঙে রাঙিয়ে প্রচার করছেন হিন্দুত্ববাদীরা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিং বা চন্দ্রশেখর আজাদের মতো বিপ্লবীরা এর উদাহরণ। রাজনৈতিক অনুশীলন এবং জীবনযাপনের দিক থেকে বিচার করলে এই বিপ্লবীদের সঙ্গে সাভারকরের অনুগামীদের দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনো মিল নেই। অথচ তাঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে সংঘের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে। সুভাষচন্দ্র বসু ব্যক্তিজীবনে ছিলেন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে আদ্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ একজন মানুষ। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজে সাম্প্রদায়িকতার কোনো জায়গা ছিল না। অথচ সাম্প্রতিক অতীতে সুভাষচন্দ্রকে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরার যে চেষ্টা চলছে, সেখানে নেতাজির চরিত্রের অসাম্প্রদায়িক দিকটি মুছে ফেলার অপচেষ্টা নজরে আসে। একইভাবে গোটা উত্তর ভারতে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদদের অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে চায় সংঘ পরিবার।
তাই ভগৎ সিংদের রাজনীতি চর্চার পরিবর্তে তাঁদের দেবতা তৈরি করার চেষ্টা চলছে পুরোদমে। শুরু হয়েছে ‘বীর’ ভগৎ সিংয়ের নির্মাণ, যা মুছে ফেলতে চায় একজন অসাধারণ রাজনৈতিক চিন্তক ভগৎ সিংকে, তরুণ বয়সেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন বামপন্থী বিপ্লবী। তাঁর রাজনীতি নিয়ে চর্চা হলে শাসকের বিপদ। কারণ কারাগারের ভিতরে ফাঁসির রজ্জুর জন্য অপেক্ষারত ভগৎ দ্রুত নিছক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে হয়ে উঠছিলেন একজন মার্কসবাদী। জেলের বাইরে থাকার সময়েই তিনি ক্রমশ নিজেকে গড়ে তুলছিলেন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী হিসাবে। স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন তাঁদের লক্ষ্য কেবল স্বাধীনতা নয়, তাঁরা চান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, চান শোষণমুক্ত ভারত। ভগৎ সিংয়ের রাজনীতি নিয়ে চর্চা হলে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর প্রবল আস্থাও চর্চিত হবে। চর্চিত হবে তাঁর নাস্তিকতা। এর কোনোটাই ভারতের বর্তমান শাসকের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে ভগৎ সিং এবং তাঁর কমরেডরা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এই বিবৃতিতে তাঁরা স্পষ্টভাবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন “আমরা পরিবর্তন চাই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে তাকে আমূল বদলে ফেলে এমন এক নবীন সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা থাকবে না এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা মনে করি, গোটা সমাজব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যদি না যায়, তবে মানবসভ্যতার পরিণতি বড় ভয়ানক।”
ভগৎ সিংকে বুঝতে হলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আপোসহীন ধারার মধ্যে বয়ে চলা বামপন্থী স্রোতটিকে বোঝা দরকার। অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা উত্তর ভারতে হিন্দুস্তান রিপাব্লিকান অ্যাসোসিয়েশন বা এইচআরএ নামে সক্রিয় ছিলেন। লাহোরে ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল বিপ্লবী শচীন সান্যালের। শচীন সান্যালই তাঁকে বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে কানপুরে পাঠান। ভগৎ সিংয়ের বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর। কানপুরে ভগৎ সিং যাঁর নেতৃত্বে কাজ করতেন তাঁর নাম যোগেশ চ্যাটার্জি। পরবর্তীকালে যোগেশ চ্যাটার্জি বামপন্থী বিপ্লবী সমাজবাদী দল বা আরএসপির শীর্ষ নেতৃত্বে আসবেন। এইচআরএ প্রথম থেকেই বামপন্থী দিশায় কাজ করতে থাকে। ওই সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ভগৎ, শচীন, যোগেশ, রামপ্রসাদ বিসমিল, যতীন দাস, আশফাকউল্লা খান, চন্দ্রশেখর আজাদ, বটুকেশ্বর দত্তরা। সমাজতান্ত্রিক আদর্শই যে দলের ভিত্তি তা স্পষ্ট করতে দলের নামের সঙ্গে যোগ করা হয় সোশালিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক শব্দটি। দুঃখের বিষয়, ভগৎ চর্চায় অনেকসময়েই এই বিষয়গুলি উঠে আসে না।
আরো পড়ুন ইতিহাস নিয়ে অমিত শাহের হুমকি ফাঁকা আওয়াজ নয়
ভগতের জন্ম হয়েছিল এক বিপ্লবী পরিবারে। তাঁর জন্মের সময়ে বাবা কিষাণ সিং এবং কাকা শরণ সিং ছিলেন কারাগারে। ভগতের আর এক কাকা বিপ্লবী অজিত সিংকে ইংরেজ সরকার দেশান্তরে পাঠিয়েছিল। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীনই স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘূর্ণিপাকে জড়িয়ে পড়েন ভগৎ। সরকার পরিচালিত স্কুল ছেড়ে তিনি ভর্তি হন লালা লাজপত রাই কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই তাঁর পথ চলা শুরু হয়েছিল বিপ্লবী সংগ্রামের আবহে।
চৌরিচৌরার ঘটনার পর আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় গান্ধীবাদী নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ভারতের যুব সম্প্রদায়ের অনেকেই। আপোসহীন বিপ্লববাদের নদীতে জোয়ার উঠতে শুরু করে এর পর থেকেই। উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলা, যুক্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব। বিপ্লবী ভগৎ ছিলেন এই আলোড়নের সন্তান। তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন গদর পার্টির বিপ্লবী কর্তার সিংয়ের আত্মবলিদান। মনে রাখা জরুরি, এই গদর পার্টি রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট হয়েছিল। কানপুরে ১৯২৪ সালে যে এইচআরএ গঠিত হয়, তার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ফেডারেল রিপাবলিক অফ স্টেটস প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ কেন্দ্রীভূত শাসনের বিপরীতে বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা। আজকের দিল্লির শাসকরা ঠিক এর উল্টো পথের যাত্রী।
কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় বড় ধাক্কার মুখে পড়ে এইচআরএ। আশফাকউল্লা, বিসমিল, রোশন সিং, রাজেন লাহিড়ীর ফাঁসি হয়। অনেকের দ্বীপান্তর হয়। এর অভিঘাতে ভগৎরা প্রকাশ্য সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করেন। ১৯২৬ সালে তৈরি হয় নওজওয়ান ভারত সভা, ১৯২৮ সালে তৈরি হয় লাহোর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। যে কথাটি খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার তা হল, ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে নওজওয়ান ভারত সভা সপ্তাহকালব্যাপী রুশ বান্ধব সপ্তাহ পালন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সংহতি জানিয়ে। ১৯২৮ সালের সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন, পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্স হত্যা, ১৯২৯ সালের আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হল ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি ভগৎ ও তাঁর সহযোদ্ধাদের জেলের ভিতরে লেনিন দিবস পালন। সোভিয়েত জনতাকে পাঠিয়েছিলেন শুভেচ্ছা বার্তা। ভগৎ সিংয়ের রাজনীতি বুঝতে হলে এই বিষয়গুলিকে বাদ দেওয়া যায় না। প্রথমে অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে তাঁর পথ চলা শুরু, সেই হাঁটা শেষ হয় একজন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক যোদ্ধা হিসাবে শহিদের মৃত্যুতে।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।