রাজ্য শিক্ষানীতির তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে কোভিড পরবর্তী সময়ে স্কুল, কলেজগুলির উপর বিপুল ছাত্রছাত্রীর চাপ আছে। স্কুলে এই চাপ সামলাতে এই মুহূর্তে ৫০,৬১১টি অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন। মুর্শিদাবাদ জেলায় ৭,০৩৬, দক্ষিণ ২৪ পরগনা – ৩,৯১৮, উত্তর ২৪ পরগনা – ৩,৮৫৮, মালদা – ৩,৭২৫, পুরুলিয়া – ৩,৬১৪, উত্তর দিনাজপুর – ২,৭১৯, কলকাতা – ৪৫১। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন জানিয়েছে বাস্তবে প্রয়োজন নাকি আরও বেশি। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। ১৯৬৮ সালে কোঠারি কমিশন শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬% এবং কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০% ব্যয় বরাদ্দ করার কথা বলেছিল। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তেও সেই জিডিপির ৬% ব্যয় বরাদ্দের কথাই বলা হয়েছে, অর্থাৎ বরাদ্দ বাড়েনি। ২০১০ সালে শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হয়, তখন ওই আইন কার্যকর করতে প্রয়োজন ছিল প্রায় ১,৪০,০০০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ইউপিএ-২ সরকার খরচ করে মাত্র ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সাল থেকে মোদী জমানায় শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে কমছে। সরকার বদল হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ২০১৪ সালে মোট জাতীয় আয় বা জিডিপির ১.০৪% বরাদ্দ হয়েছিল। বর্তমান সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.৫ শতাংশে। কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪.৪৩ শতাংশের মত খরচ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষক অভিযানে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের ভাগ ৭৮% থেকে কমে ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এইসব পরিসংখ্যান থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, কেন আমাদের রাজ্যে প্রায় ৫০,০০০ অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন। বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ যথেষ্ট হলে হঠাৎ অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন হত না।

রাজ্য শিক্ষানীতিতে শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতার কথা বলা হলেও কোথাও বলা হয়নি যে আমাদের রাজ্যে প্রায় ৮,০০০ স্কুল বন্ধ হওয়ার মুখে। ২২৬টির মত প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্রশূন্য। আমাদের রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় অধিকাংশ স্কুল যে শিক্ষকের অপ্রতুলতায় ভুগছে, রাজ্য শিক্ষানীতিতে তা স্বীকার করা হয়নি। সারা দেশেই বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ২০১৯ সালে ইউনেস্কোর (UNESCO Institute of Statistics: Monitoring Global needs for 2015; released in June 2019) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে স্কুলশিক্ষকের সংখ্যা আশ্চর্যরকম কম। ২০১৫ সালে ২০ লক্ষ স্কুলশিক্ষকের ঘাটতির কথা উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বর্তমানে সেই সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে। আমাদের রাজ্যেই কয়েক লক্ষ শিক্ষকের অভাবে স্কুলগুলি ধুঁকছে। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকা এই অপ্রতুলতার প্রধান কারণ। এছাড়া উৎসশ্রী প্রকল্পে বহু শিক্ষক, শিক্ষিকা গ্রামীণ এলাকা থেকে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। নিয়োগহীন গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলি থেকে শিক্ষক, শিক্ষিকাদের চলে যাওয়া এই সমস্যাকে আরও প্রবল করে তুলেছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

উত্তর দিনাজপুরের করণদীঘি ব্লকের অন্তর্গত একটি অঞ্চলে ১৯৯৬ সালে একটি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০২ সালে বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়। ২০০৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয় এবং ২০০৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগে পঠনপাঠন আরম্ভ হয়। বর্তমানে শিক্ষকের অভাবে বিজ্ঞান বিভাগ তুলে দেওয়া হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে ভূগোল পড়ানো বন্ধ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরও কোনো শিক্ষক নেই। উচ্চ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকের অভাবে ক্লাস হয় না বললেই চলে। গ্রামীণ অংশের ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ এমনিতেই কম। যেটুকু ছিল, রাজ্যের কর্পোরেটমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তাও কেড়ে নিচ্ছে। এর ফলে বিজ্ঞানচর্চা ও প্রসারে চূড়ান্ত ব্যাঘাত ঘটছে। এই স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষক উৎসশ্রী প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে স্কুল ছেড়ে চলে গেছেন। তিনজন পার্শ্বশিক্ষক ও চারজন আংশিক সময়ের শিক্ষক (পরিচালন সমিতি নিযুক্ত) দিয়ে বিভাগ সংখ্যা কমিয়ে কোনোক্রমে পঠনপাঠন চলছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা গতবছর ছিল ২৮০০, এবছর কমে দাঁড়িয়েছে ২৫০০। প্রায় ৩০০ জন ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট। এই স্কুলের নয় কিলোমিটার দূরে একটি মাত্র উচ্চ প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই স্কুলে আরম্ভের সময়ে তিনজন শিক্ষিকা ছিলেন, এখন একজনও নেই। স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা নিজেদের উদ্যোগে স্কুলটি টিকিয়ে রেখেছেন। বর্তমানে একজন অতিথি শিক্ষিকা স্কুল চালাচ্ছেন।

আরো পড়ুন কলেজ সংকট: ছাত্রছাত্রী সব গেল কোথায়?

এমন অজস্র উদাহরণ তুলে ধরা যাবে। U-Dise তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালে আমাদের দেশে অন্তত এক লক্ষ স্কুল ছিল যেখানে মাত্র একজন শিক্ষক। ওই স্কুলগুলির অধিকাংশই একজন শিক্ষক এবং পাঁচটি শ্রেণি নিয়ে চলে। আমাদের রাজ্য ব্যতিক্রম নয়, বরং এখানে সংকট আরও বেশি। আমাদের রাজ্যে শিক্ষক সমস্যার অন্য একটি দিক হল, কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষক প্রয়োজনের অতিরিক্ত, কিন্তু ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম। রাজ্যে এমন প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে যেখানে ১৫ জন শিক্ষক শিক্ষিকা, কিন্তু ছাত্রছাত্রী মাত্র ১০০। সরকারের পরিকল্পনাহীন নিয়োগ এই সমস্যার বড় কারণ।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে বলা হয়েছে, আমাদের দেশের বহু স্কুলে ছাত্রসংখ্যা তিরিশের নিচে। এই স্কুলগুলিতে পরিকাঠামো দুর্বল, শিক্ষকসংখ্যা কম। এই ছোট ছোট স্কুলগুলি সরকারের কাম্য মানের নয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই স্কুলগুলিকে মিলিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে। অর্থাৎ কয়েকটি স্কুল মিলিয়ে একটি স্কুল। আমাদের রাজ্যেও পরিস্থিতি একইরকম। বহু স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কম, দুর্বল পরিকাঠামো, শিক্ষকের অভাব প্রভৃতি কারণে রাজ্যের প্রায় ৮,০০০ স্কুল সরকার বন্ধ করে দিতে চাইছে। অথচ সরকারের উচিত ছিল পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়ে, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করে, পুষ্টিকর মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থার মাধ্যমে স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের ফিরিয়ে এনে স্কুলগুলির মানোন্নয়ন করা। সরকার সেসব না করে প্রায় ছাত্রশূন্য বিদ্যালয়গুলিকে তুলে দিতে চাইছে। অথচ শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার। একজন শিশুও যেন শিক্ষার আলো থেকে দূরে না থাকে, তা দেখা সরকারের দায়িত্ব। রাজ্য সেই দায়িত্ব অস্বীকার করছে।

আমাদের দেশ ও রাজ্যে সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা রমরমিয়ে চলছে, সরকারের প্রশ্রয়েই চলছে। রাজ্যে বেসরকারি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দারুণ বাজার। কেন্দ্র ও রাজ্যের মদতে শিক্ষা আমাদের রাজ্যে মুনাফার মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সরকার শিক্ষার দায়ভার নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলতে চায়। সরকার চায় শিক্ষায় বেসরকারিকরণ, পুঁজির প্রবেশ। সরকারের পরিকল্পিত ঔদাসীন্যে শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে, স্কুলছুট পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। স্কুলে বিভিন্ন প্রকল্প চালু থাকলেও গ্রামাঞ্চলে ছাত্রীদের পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সমাজের অর্ধেক অংশ গ্রামীণ বাংলায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আশঙ্কা হয়, আগামী দিনে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা বলে আদৌ কিছু থাকবে না। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ যে সাহস দেখায়নি, রাজ্য শিক্ষানীতি ২০২৩ সেই সাহস দেখিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলের কথা বলেছে। আগামীদিনে রাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা আদানি, আম্বানি, আজিম প্রেমজি গ্রুপ, বিদ্যানিধি ট্রাস্ট্রের মত প্রতিষ্ঠানগুলি বাণিজ্যিকভাবে চালাবে। শিক্ষা ক্রমশ প্রান্তিক মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যার সামর্থ্য আছে তার সন্তান স্কুলে পড়বে; যার নেই, তার সন্তান পড়বে না – এমন ব্যবস্থা কায়েম করতে সরকারি পরিকল্পনায় হাজার হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হবে। স্কুলবাড়ি, অন্যান্য পরিকাঠামো চলে যাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে। তখন আর অতিরিক্ত ছাত্রছাত্রীর চাপে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন হবে না।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.