উম্মে রায়হানা

আমি যখন ছোট ছিলাম – আমাদের বাসায় একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। তাতে দেখা যেত কপিলদেব অনেক দূর থেকে দৌড়ে এসে একটা মগে চুমুক দিয়ে বলেন “বুস্ট ইজ দ্য সিক্রেট অফ মাই এনার্জি”। তখন বিজ্ঞাপনের বাজার এত চাঙ্গা ছিল না। কিন্তু বাজারে কোনো পণ্যের সঙ্গে কোনো অফার-টফার থাকলে সেটা কিভাবে কীভাবে যেন জানা যেত। জানা গেল, বুস্টের বয়ামের সঙ্গে বুস্ট লেখা একটা মেলামাইনের মগ ফ্রি দেওয়া হচ্ছে। আমার আব্বা ক্রিকেটপাগলা মানুষ ছিলেন, একই সঙ্গে ছিলেন মেয়ে-অন্তপ্রাণ। আমরা আবদার করলাম – ওই মগ চাই। তিনি পরিচিত দোকান থেকে বুস্ট কিনে মজা করে দোকানীকে বললেন, “কিন্তু আমার তো যমজ মেয়ে, একটা মগ নিয়ে আমি কী করব? আর এক বয়াম দাও।” দোকানী বললেন, “বাচ্চু ভাই, বয়াম কেনা লাগবে না, আপনি দুইটা মগ নিয়ে যান।”

আমি বলছি আশির দশকের গোড়ায় ঢাকার কাছের ছোট একটা মফস্বল শহর ময়মনসিংহের কথা। এখনও এই শহরের অনেক মানুষ আমাদের দুই বোনকে বাচ্চু ভাইয়ের মেয়ে বলে চেনে, যদিও তিনি চলে গেছেন ১৯৯৯ সালে, মানে গত শতাব্দীতে। তিনি পেশায় প্রকৌশলী হলেও নেশায় ছিলেন ক্রীড়া সংগঠক। এই শহরের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে সম্ভবত কেউ নেই যিনি আমাদের আব্বার সঙ্গে ক্রিকেটের সুবাদে যুক্ত ছিলেন না বা আমাদের ড্রইংরুমে বসে কোনো না কোনো ম্যাচ দেখেননি। আমার শ্বশুরও ক্রিকেট বলতে অজ্ঞান। তিনি কোনো ক্রিকেট ম্যাচ মিস করেন না।বাংলাদেশের ম্যাচ হলে তো অসম্ভব!

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বাবাদের এহেন ক্রিকেটপ্রেমের জন্যই নয় কেবল, আমি যে শহরে বড় হয়েছি সেখানে সমাজ খুব বদ্ধ ছিল। মেয়েদের মবিলিটি বলতে তেমন কিছু ছিলো না। স্কুল শেষে এসএসসি পরীক্ষার পর সময় কাটত ক্রিকেট ম্যাচ দেখে দেখে। ততদিনে আব্বা মরে গেছেন, ভাইয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চলে গেছে, বাসায় আর ক্রিকেটের ওয়ান ডে, ডে-নাইট ইত্যাদি ম্যাচে বা টানা টেস্ট ক্রিকেটে মজমা বসে না, ড্রইংরুমে ঘন্টায় ঘন্টায় ১৫-২০ জনের জন্য চা পাঠাতে হয় বলে আম্মা বিরক্ত হন না। শুনশান ড্রইংরুমে বসে শারজা কাপ, হ্যান কাপ ত্যান কাপ ম্যাচ দেখতে দেখতে আমি আর আমার যমজ বোন ক্রিকেটবোদ্ধা হয়ে উঠলাম প্রায়!

কিন্তু বড় হয়ে ক্রিকেট নিয়ে আমার মাথাব্যথা কমে যায়, তেমন কোন খবরাখবর আর রাখি না। তাহলে হঠাৎ ক্রিকেট নিয়ে লিখতে লাগলাম কেন? গুরুতর কারণ ঘটেছে লেখার। বাংলাদেশের একজন ক্রিকেটার, যার বয়স মাত্র বিশ বছর, বছরখানেক আগে তাঁর ফেসবুক পেজে নারীবিদ্বেষমূলক কিছু কথাবার্তা লেখেন। কথাগুলো যে বিদ্বেষমূলক, সেই বোধই তাঁর নেই। নেই যে তার প্রমাণ হচ্ছে, ইন্টারনেটে, সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর, খবর-টবর হওয়া শুরু করলে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) যখন চক্ষুলজ্জায় পড়ে কৈফিয়ত তলব করল, তানজিম সাকিব নামের সেই বালক বলেন কিনা “আমি কীভাবে নারীবিদ্বেষী হব, আমার মা-ও তো একজন নারী”!

বলতে দুঃখ হলেও কিছুই করার নেই, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নারী প্রসঙ্গে একেবারেই সংবেদনশীল নয়। এ দেশের মানুষও ক্রিকেটার প্রশ্নে অন্ধ! কেন বলছি? এর আগে রুবেল হোসেন নামের এক ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন নাজনীন আখতার হ্যাপি নামের এক মডেল ও অভিনেত্রী। হ্যাপি মামলা করার পর তাঁর চারিত্রিক সততা (পড়ুন যৌনজীবন ও প্রেমের সম্পর্কের ইতিহাস) নিয়ে উচ্চকিত আলোচনা চলে সর্বত্র। ফেসবুকে তো বটেই। সকলেই ‘পাবলিসিটি স্টান্ট’ বলে অভিহিত করে এই মামলাকে। তারপর প্রকাশিত হয় ফরেনসিক রিপোর্ট। আর এক দফা কলঙ্কিত করা হয় অভিযোগকারিণীকে। বলপ্রয়োগের আলামত পাওয়া না যাওয়ায় ক্রিকেটভক্ত জাতি উদ্বাহু নৃত্য করতে শুরু করে। সবাই ভুলে যায়, রুবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্মতি উৎপাদনের মাধ্যমে যৌন সংসর্গের (যা প্রকারান্তরে ধর্ষণ; প্রচলিত আইনে এর ভিত্তিতেই মামলা হয়), কোনোভাবেই বল প্রয়োগের নয়।

এর পর শাহাদাত হোসেন নামের এক ক্রিকেটতারকা ও তাঁর স্ত্রী গৃহকর্মী নির্যাতনে অভিযুক্ত হন। আশ্চর্যজনকভাবে দুর্ভাগা সেই শিশু শ্রমিকের নামও ছিল হ্যাপি। সেই মামলায় কোনো রায় বেরিয়েছে বা শাস্তি হয়েছে এমন খবর পাইনি। বিসিবি এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেছে বলেও শুনিনি।

রুবেলও প্রাক্তন প্রেমিকার করা ওই মামলায় শেষপর্যন্ত শাস্তি পাননি, কারণ হ্যাপি তাঁর অভিযোগ প্রত্যাহার করেন। রুবেল নতুন উদ্যমে ফিরে এলে এক কর্পোরেট কোম্পানি তাঁকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করে, যার ট্যাগলাইন – ‘ডাইরেক্ট ভাইঙ্গা দিবো’। সেখানে দেখা যায় রুবেল বিপুল বিক্রমে বল (প্রয়োগ???) করছেন,বলের শক্তিতে উড়ে যাচ্ছে স্টাম্প। আপাতদৃষ্টিতে এই বিজ্ঞাপনে নারীবিদ্বেষী কিছুই নেই। কিন্তু এই কনটেন্ট যে প্রসঙ্গে হাজির করা হয়েছে তাতে কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না, বিজ্ঞাপনটা যত না পণ্যের তার চেয়ে বেশি ধারণার (idea)। ব্যাটাগিরির জয়গান করে ওই বিজ্ঞাপন।

আমার মনে হয় এই দুটো উদাহরণ যথেষ্ট। ময়মনসিংহ শহর নারীবান্ধব না হলেও ক্রিকেটবান্ধব তো বটেই। আমাদের পাশের পাড়ায় থাকতেন বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার রামচাঁদ গোয়ালা। আব্বার চেয়ে বয়সে একটু বড় হলেও বন্ধু ছিলেন তাঁরা। গোয়ালা কাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ শহর থেকে অনেক ভাল ভাল ক্রিকেটার বের হয়েছে। এই শহরের মাঠগুলোতে ছেলেরা সারাবছর ক্রিকেট প্র্যাকটিস করে। এই শহরের ছেলেদের জন্য ক্রিকেট একটা লোভনীয় কেরিয়ারও বটে। অনেকেই ক্রিকেট খেলে সংসার চালায়। ফলে আমি মোটা দাগে ক্রিকেটারদের নিয়ে ‘মুখরোচক’, ‘নারীঘটিত’, ‘অপরাধমূলক’ নানা গল্পই বলতে পারব। কিন্তু তার আর প্রয়োজন নেই।

ফিরে আসি মূল গল্পে। সাকিব ছেলেটাকে কেন এক বছর আগের পোস্টের জন্য এমন খেসারত দিতে হচ্ছে তা আমার জানা নেই। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করছে কিনা, টিম থেকে বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা কষছে কিনা তাও আমি জানি না। তাই বলে রাখছি, কোনোমতেই চাই না, ওঁকে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল থেকে বাদ দেওয়া হোক। তবে ওকে কিছু বিষয়ে ইলম বা জ্ঞান দেওয়া খুব জরুরি।

খবরে প্রকাশ, তানজিম বিসিবির কাছে তাঁর পোস্টের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন এবং সেই বিতর্কিত পোস্ট ডিলিট করে দিয়েছেন। সমর্থকদের মতে, সোশাল মিডিয়ার ‘মব ট্রায়াল’-ই তাঁকে বাধ্য করেছে এই ক্ষমাপ্রার্থনায়। সাধারণ বিবেক বুদ্ধি থেকে যা বুঝি, কেউ কারোর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করলে বা ভুলক্রমে কারোর অনুভূতিকে আহত করলে, ক্ষমাপ্রার্থনার অধিকার ও সুযোগ তার থাকা উচিত। কিন্তু তানজিমের ভুলটা কী আর তিনি ক্ষমা চাইলেন কার কাছে?

সম্ভাবনাময় এই বালক বছরখানেক আগে নিজের ফেসবুক পেজে নারীর অর্থ উপার্জন ও বিদ্যাশিক্ষার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।” ওই পোস্টে আরও লেখা ছিল, “আসলে স্ত্রী স্বামীর মর্যাদা বোঝেনি, স্ত্রী নিজের মর্যাদাও বোঝেনি। ঘর একটি জগৎ। অসংখ্য কাজ রয়েছে। আজ ছেলেদের বেকারত্বের বড় কারণ হচ্ছে, মেয়েরা এগিয়ে আসছে, ছেলেরা কোনো চাকরি পাচ্ছে না। একটি ছেলেকে চাকরি দিলে পুরো পরিবারের উপকার হয়।”

একই পোস্টের শেষে বলা হয়েছে, “অতএব মা-বোনেরা নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে স্বামীর আনুগত্য ও বাসায় অবস্থান করে রানির হালাতে অবস্থান করুন। অতএব মা-বোনেরা দুনিয়া কামাতে যেয়ে আখেরাত না হারিয়ে ঘরে অবস্থান করে স্বামী-সন্তানের খেদমত করে দুনিয়া ও আখেরাত দুটিই কামাই করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।”

আগেই বলেছি, কথাগুলো যে বিদ্বেষমূলক সেই বোধই তাঁর নেই। তাঁর কথায় ধর্মীয় অন্ধত্ব এবং নারীর দ্বিতীয় শ্রেণির অবস্থানে বিশ্বাস তো রয়েছেই, এ ছাড়াও আছে মধ্যবিত্ত একপেশে মানসিকতা। নারীর কর্ম ও জীবিকা বলতে তিনি বোঝেন চাকরি করা। তাঁর মনেও পড়ে না বা পড়েনি যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। তিনি চাকরি নয়, পুরো দেশ চালাচ্ছেন এবং তাঁর স্বামী ও দুই সন্তান প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে সফল ও বিখ্যাত। শ্রমজীবী নারীদের কথাও তাঁর মনে নেই। যে নারীর কোনো বিকল্প নেই, স্বামী-সন্তান কেউ নেই, সে ঘরে বসে না থেকে জীবিকা অর্জনের জন্য বাইরে না বেরিয়ে অন্য কী করবে তাই নিয়েও তানজিমের নেই কোনো সচেতনতা। বলতে বাধ্য হচ্ছি, নিজের রুটিরুজির এবং খ্যাতির খেয়াল কিন্তু তাঁর ঠিকই আছে! রয়েছে ক্ষমা চেয়ে নিজের পদ ঠিক রাখার তাগিদও।

তানজিমের অপরাধ বা ভুল কিন্তু রুবেল বা শাহাদাতের তুলনায় কিছুই নয়। তিনি কারোর সঙ্গে প্রতারণা করেননি, কাউকে নির্যাতনও করেননি। তিনি তাঁর ধর্মীয় আদর্শ বা বিশ্বাস সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন মাত্র। তাও আবার সেটা পুরানো ঘটনা। তাহলে এতদিন পর তাঁর বিরুদ্ধে দেশসুদ্ধ লোক ক্ষেপে গেল কেন! গেল কারণ তিনি যা করেছেন, না বুঝে করলেও, তা ভয়াবহ। নতুন প্রজন্মের কাছে ক্রিকেটাররাই রোল মডেল। তরুণ ক্রিকেটার যদি এমন পশ্চাদপদ ধ্যানধারণা রাখেন তাহলে তো খুবই ভয়ের কথা। ধর্মের ভুলভাল ব্যাখ্যা শিখে তিনি রুবেল বা শাহাদাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধ করে বসতে পারেন। মনে করা যাক, তিনি বড় হয়ে আর একজন সাকিব আল হাসান হয়ে উঠলেন, বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেলেন। বললে খারাপ শোনালেও কিছু করার নেই, সংসারে যে ছেলে টাকাপয়সা বেশি দেয় তার কথার দাম থাকে বেশি। ধরা যাক তানজিমের বোন মেডিকাল কলেজে পড়তে চাইল বা বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করতে চাইল। তানজিম যে তখন পাকিস্তানের মতন অনার কিলিংও করে বসবেন না তার নিশ্চয়তা কী? অনার কিলিংও তো ধর্মের নামেই চলে!

নারীর শ্রম কী করে দুনিয়ার অর্থনীতির চাকার অনেক অদৃশ্য নাটবল্টু ঘুরিয়ে চলছে, সে সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। পুরো পদ্ধতিই পুরুষতান্ত্রিক, অর্থনীতিতে নারীর অবদান কে-ই বা স্বীকার করে? ‘জেন্ডার সেনসিটিভিটি’ এখনো লোককে হাতে ধরে ধরে শেখাতে হয়, নারীবাদ তো আরও দূরের বিষয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই ছেলের তো ইসলাম সম্পর্কেও যথাযথ জানাশোনা নেই। কেন ব্যাখ্যা করছি।

তানজিমের পোস্টগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তিনি কুরআন বা হাদিসের বইপত্র তেমন একটা পড়েননি। কুরআনের কোন আয়াতে বা কার বর্ণিত কোন হাদিসে তিনি এই সমস্ত কথা পড়েছেন বা পেয়েছেন তার কোনো রেফারেন্স তিনি দেননি বা দিতে পারেননি। কুরআন পড়ে যদি তিনি এই সব লিখতেন তাহলে তো সুরার নাম আর আয়াতের নম্বরও লিখে দিতে পারতেন।

এখানে বলে রাখা ভাল, ইসলামের ইতিহাস আমার আগ্রহের বিষয় নয়, বিদ্যায়তনিক পড়াশোনাও করিনি এ বিষয়ে। জন্মগতভাবে মুসলিম হওয়ায় পারিবারিক আলোচনা থেকে আমি যতদূর জানি, নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর আরও ৪০০ বছর পর থেকে হাদিস সংকলন শুরু হয়। হাদিস অর্থ মুহাম্মদের জীবন ও যাপন থেকে পাওয়া রেফারেন্স যা কুরআনে লেখা নেই। একজন পরলোকে চলে যাওয়ার ৪০০ বছর পরে তাঁর সম্পর্কে মুখে মুখে ফেরা গল্পগুলো পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াই সবচেয়ে স্বাভাবিক। সুতরাং হাদিসের বিষয়টা আরও গুলিয়ে দেওয়ার মত। একের ধরনের মুসলিম একের ধরনের হাদিস মানে। যেমন শিয়া মুসলিমরা আলীর অনুসারী, তাঁদের ট্র্যাজেডি হচ্ছে কারবালার ঘটনা। তাঁরা মুহম্মদের স্ত্রী আয়েশা বর্ণিত কোন হাদিস মানেন না, আয়েশাকে ভিলেন বা ভ্যাম্প মনে করেন। তাঁদের নামাজ পড়ার মসজিদও আলাদা হয়। কিন্তু আমাদের তানজিম মনে করেন পৃথিবীতে ইসলাম একরকমেরই হয়, তিনি যেটা জানেন। ইসলামের যে নানা রকম স্কুল বা মাজহাব হয় সে সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন বা জানলেও তা নিয়ে তাঁর তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।

মৌলিক ইসলামেও কোথাও নেই মেয়েরা বিদ্যাশিক্ষা করতে পারবে না বা বাইরে কাজ করতে পারবে না। হ্যাঁ, বোরখা দিয়ে শরীর ঢাকার বিধান রয়েছে। তাতেই তো বুঝতে পারা যায় যে, নারীর মবিলিটিও ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। বাইরে যাওয়া নিষেধ হলে তো আর শরীর ঢাকার প্রশ্ন আসত না। ঘরের মধ্যে তো আর কেউ আলখাল্লা পরে বসে থাকবে না! এমন অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী আছেন যাঁরা মাথায় কাপড় দেন, কিন্তু আলখাল্লার মতন বোরখা পরেন না। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, ওই সময় আরব বর্বর মানুষদের সমাজ ছিল, সেখানে মুসলিম নারীর নিরাপত্তা বিধান করবার জন্যই গায়ে বোরখা পরতে হত, মাথায় হিজাব চাপাতে হত। তা ছাড়া আরব মরুভূমির দেশ, ওখানে নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই আলখাল্লা পরে। দিনে প্রচণ্ড গরম আর রাতে ভয়াবহ শীতের জন্য ওরকম পোশাক তাদের পরতে হয়।

বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই মুসলিম নারীরা নিকাব দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন। কিন্তু আমার জানা মতে, নিকাব সাধারণ মুসলিম নারীর জন্য নয়, ওটা কেবল নবীর স্ত্রীদের জন্য,কারণ তাঁরা উম্মুল মুমেনিন বা মুসলিম জাতির মা। সব মুসলিম মেয়ে স্বামী মরে গেলে তিনমাসের মধ্যে বিয়ে করতে পারলেও নবীর স্ত্রীরা থাকবেন চিরবিধবা। কাজেই নিকাব, বোরখা – কোনোটাই বাধ্যতামূলক নয়, মাথায় হিজাব পরলেই যথেষ্ট। দুনিয়া জুড়ে মুসলিম নারীরা মাথায় কাপড় দিয়েই এমন কোনো কাজ নেই যা করছেন না। আমাদের দেশেই তো নারী চিকিৎসকরা রোজ মানুষের পেট কেটে শিশুদের বের করছেন, গৃহিণীরা বাইক চালিয়ে সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, রাজনীতিবিদ নারীরা সংসদে বক্তৃতা করছেন – মাথায় কাপড় দিয়েই, ইসলাম মেনেই। তানজিমের মতে তাঁরা সবাই স্বামী সন্তানকে বঞ্চিত করছেন! কী ভয়াবহ কথা!

আরো পড়ুন স্বাগত প্রিমিয়ার লিগ, কিন্তু লিঙ্গসাম্য এত সহজ নয়

ইসলামে নারীকে ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, ‘গনিমতের মাল’ ইত্যাদি যা বলা হয় সেসব প্রাক-ইসলামিক আরবের ধারণা। যুক্তি দিচ্ছি। আরবে উপঢৌকন হিসাবে এক গোত্র অন্য গোত্রকে পাঠাতে পারত একপাল উট অথবা একদল নারী। ইসলাম আসার পর নারী সম্পত্তিতে অধিকার পায়। কন্যাসন্তানের জন্য পিতার সম্পত্তিতে ভাইয়ের অর্ধেক অধিকার সামান্য নয়। নিজের মোহরের টাকা বা বাড়ি বা সোনা নিজের ইচ্ছেমত খরচ করতে পারার অধিকারও ফেলে দেওয়ার মতন নয়। সবচেয়ে জরুরি কথা হচ্ছে, সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদেহ বা নারী নিজে আর সম্পত্তির আওতায় থাকে না। যে নিজে সম্পদের মালিক হতে পারে সে আবার বস্তু বা পণ্য হয় কী করে? সে তো ব্যক্তি।

সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান যে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল, সেটা পৃথিবীর আর যে কোনো যুদ্ধের মতনই যুদ্ধাপরাধ, ইসলামের আদর্শ নয় কোনোমতেই। ইসলামের সঙ্গে অবশ্য এর একটা সম্পর্ক আছে। তা হচ্ছে পাকিস্তান ইসলামকে ব্যবহার করেছে এই বীভৎস যুদ্ধাপরাধকে জায়েজ করতে, গনিমত শব্দটা ব্যবহার করে, নারীকে জয়ী পুরুষের ভোগ্য বানিয়ে দিয়ে।

ইসলাম নিয়ে ভুলভাল ধারণা অনেক দেশেই প্রচলিত রয়েছে। অনেক দেশের মানুষ জানেই না যে মুসলিম মেয়েরা স্বামী নির্যাতনকারী বা পুরুষত্বহীন হলে সহজেই তালাক দিতে পারে। আফ্রিকার অনেক জায়গায় মেয়েদের ভগাঙ্কুর কেটে দেওয়া হয় ইসলামের নামে, খৎনার নামে। অথচ ওটা আফ্রিকার একটা বিশেষ জাতির সংস্কৃতি, ইসলামের বেঁধে দেওয়া রীতি নয়। পাকিস্তানে যেমন অনেকে মনে করে, মা-বোন পারিবারিক অনুশাসন না মানলে বাপ-ভাই তাদের মেরে ফেলতে পারে, তাতে দোষ হয় না। পাকিস্তানের ইসলাম আর আফ্রিকার ইসলাম এক নয়, আরবের ইসলাম আর ভারতের ইসলামও আলাদা। তানজিম বাংলাদেশে জন্মেও নারী সম্পর্কে, ইসলাম সম্পর্কে এমন ভুলভাল ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছেন এটা খুবই দুঃখের কথা। তিনি যেভাবে ইসলামকে অস্ত্র বানিয়ে নারীর দ্বিতীয় শ্রেণির অবস্থান ঘোষণা করছেন তা শুধু নারীর জন্য নয়, ইসলামের জন্যও অবমাননাকর।

তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হোক এই কামনা করি। বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটারদের আদর করে টাইগার বলে ডাকে। টাইগারদের কি এমন অবোধ হলে মানায়? আমি আশা করছি কোনো না কোনোভাবে তানজিমের কাছে এই লেখাটা পৌঁছাবে, তিনি এটা পড়বেন এবং তাঁর মগজে-মননে থাকা একপেশে ধ্যানধারণাগুলো পুনর্বিবেচনা করতে চাইবেন।

নিবন্ধকার কবি ও সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.