ছবি ভাঙল। মিনিটখানেক আগে থেকেই দর্শক উঠে দাঁড়ান। তাঁদের গল্পটা জানা হয়ে গেছে, নায়ক নায়িকার নাম তাঁরা জানেন, গান কে গেয়েছে তাঁরা জানেন। সুতরাং আর উৎসাহ নেই। সিনেমা যে যৌথ শিল্প, সেখানে যে আলোকচিত্রী, শব্দযন্ত্রী, সেট ডিজাইনার – সকলের ভূমিকা থাকে সে বিষয়ে আমাদের কোনো প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত নেই। আর ঠিক এইজন্যই হয়ত অনেকসময় মনে হয় আমাদের দর্শক ঠিকমত সিনেমা দেখতেই শেখেননি। উদাহরণস্বরূপ মনে করা যাক আমরা কী ধরনের ছবি দেখতাম শ খানেক বছর আগে, যখন দাদাসাহেব ফালকে রাজা হরিশ্চন্দ্র তৈরি করছেন অথবা দেবকীকুমার বসু চণ্ডীদাস তৈরি করছেন কিম্বা প্রমথেশ বড়ুয়া দেবদাস করছেন? সেখানে দৃশ্যসজ্জা অনেকটাই থিয়েটারের মত। ক্যামেরার সৌজন্যে নানাদিক থেকে, নানা কোণ থেকে নিসর্গ ও চরিত্রকে দেখা যায়। এছাড়া চিত্রকলার দ্বিমাত্রিক পট আর ছায়াছবির ত্রিমাত্রিকতা যে কখনোই এক নয় – একথাটা ভারতীয় সিনেমার বুঝতে অনেক বেলা গেল। যে বাগানে নায়ক নায়িকা প্রেম করবে সেখানে কালিকা স্টুডিওর চিত্রকরদের দিয়ে মেঘ ও গোলাপ আঁকালে দৃশ্যটি নিষ্প্রাণ, কথাবহুল হয়ে দাঁড়ায় – একথা বুঝতে বাংলা ছবিকে কাশ্মীরি যুবক বংশী চন্দ্রগুপ্তের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। হঠাৎ বংশীবাবুর কথা বলছি কেন? এইজন্য নয় যে তিনি সত্যজিৎ রায়ের বন্ধু। এইজন্যেও নয় যে আমরা শুধু সিনেমার সেট নিয়ে ভাবছি। আসলে বংশীবাবু বা তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী রবি চট্টোপাধ্যায়, যদি এই দুই বিশ্বকর্মা স্টুডিওতে না থাকতেন, তাহলেপথের পাঁচালী বা কোমল গান্ধার-এর মত ছবিগুলি হয়ত এতখানি জীবন্ত হয়ে উঠত না।
যেন এপিফ্যানি, যেন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। বংশীবাবু একজন অসামান্য উদ্ভাবক এই জন্যে যে তিনিই এই উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্রে স্থান বা স্পেসকে স্থাপত্যের অনুষঙ্গে ভাবলেন। ভাবুক পাঠক দয়া করে ভাবুন, বারাণসীর যে বাড়িটিতে হরিহর থাকত, তার কথা। সেখানে আলো আসে না। বংশীবাবুকে আকাশ সৃষ্টি করতে হল। ঘরদোরের দেয়াল, জানালা, দরজা সবই আসল আলোর মত করে বানাতে হল যাতে সুব্রত মিত্র তাঁর কিংবদন্তিসম বাউন্সড লাইটিংয়ের সূচনা করতে পারেন। অপুর সংসার-এ অপু যে দরিদ্র অথচ স্বপ্নাচ্ছন্ন লেখক – এই দৃশ্যের ‘মানুষী সত্যটুকু’ ধরার জন্য বংশী ঘরে স্প্রে গান ব্যবহার করেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই বংশী আমাদের ভগীরথ। এই বন্ধুটিকে না পেলে সুকুমারতনয়ের সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

মাঝে মাঝে মনে হয় কী অলৌকিক সমাপতন! সুবো ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগে বংশীর আকস্মিক কলকাতায় আগমন। তেমনভাবেই শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্র রবি চট্টোপাধ্যায় মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর নির্দেশে চিফ আর্ট ডিরেক্টর সৌরীন সেনের সূত্রে যোগ দিলেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। অনেক পরে নীতীশ রায়, মৃণাল সেনের ছেলের বিয়ের আসবাবপত্রের ডিজাইন করতে করতে মৃণালের চোখে পড়ে গেলেন। তৈরি হল খারিজ। আজকে যাঁরা মান্ডি বা তামস ছবিতে নীতীশবাবুর কাজ দেখে মুগ্ধ হন, তাঁরা মনেই রাখেন না মৃণাল-জায়া গীতা সেনের একটি টেলিফোন সংযোগে দৈবাৎ নীতীশের জন্য শিল্প নির্দেশনার দরজা খুলে যায়।
আমি আগেই বললাম যে আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনায় শিল্প নির্দেশনার জন্য আলাদা করে কোনো সম্ভ্রম ছিল না। এমনকি বংশী তরুণ বয়সে ভারতবিখ্যাত নায়িকা কানন দেবীর সামনে ভুলক্রমে ধূমপান করেছিলেন বলে তাঁর চাকরি গিয়েছিল।
ভাগ্যিস সত্যজিৎ রায় এলেন। না হলে বড়লোকের বাড়ি বলতে ল্যান্সডাউন রোডের জাহাজ প্যাটার্নের বাড়ি, নয়ত গ্রাম বলতে আঁকাবাঁকা পথ, দু-একটি গাছই বংশীকে তৈরি করে যেতে হত। সত্যজিৎ পথের পাঁচালীর কাজ করার সময়েই প্রথম চলচ্চিত্রিত বাস্তবতা তৈরি হল। পথের পাঁচালীর সেই ভাঙা দরজাটির কথাই ধরুন। পাইনকাঠের একটা নতুন দরজা বানিয়ে সেটাকে বেশ খানিকটা পুড়িয়ে আর ব্রাশ করে সেটের উপযুক্ত করা হয়েছিল। সম্পূর্ণ নড়বড়ে চেহারা দেওয়ার জন্য দরজার নিচের অংশ বেশি করে পুড়িয়ে খসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গোটা দরজাটাকে কস্টিক সোডা দিয়ে ব্লিচ করে দেওয়ায় আজও সারা পৃথিবী বুঝতেই পারে না বংশীর কল্পনায় কী অসামান্য ম্যাজিক ছিল। তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন যে ইন্ডোর সেট থেকে আউটডোর লোকেশনে যাওয়ার সময়ে ক্যামেরার দৃষ্টিতে যে তারতম্য ঘটবে তাকে বিশ্বাস্য করা চাই। পথের পাঁচালীর রাত্রির দৃশ্যগুলোর জন্য স্টুডিওতে তিনি নকল বাড়ি বানিয়েছিলেন। অপরাজিত ছবির দিনের দৃশ্যগুলোও স্টুডিওর সেট। শতরঞ্জ কে খিলাড়ি-র নবার দরবার আর বাইরের রাজপথ কী সামঞ্জস্যে জুড়ে আছে! বস্তুত তিনি ছিলেন বলেই বাংলা ছবিতে ডিটেলের মহিমা প্রকাশিত হল।
বংশী যেমন সত্যজিতের সারথি, ঋত্বিকের কবচকুণ্ডল ছিলেন রবি চট্টোপাধ্যায়। আজ একথা বিশ্বাস করানো শক্ত যে অযান্ত্রিক ছবির বিখ্যাত ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আসলে ঋত্বিকের নির্দেশনায় রবিবাবুর সেট। অযান্ত্রিক থেকেই একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। যেখানে জগদ্দল বিগড়ে গেছে, বিমল বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই এনে গাড়িতে চড়াতে থাকে, সেই অংশের শুটিং সম্পূর্ণ হলে ঋত্বিক তাঁর স্বভাবসুলভ রসিকতায় রবিবাবু এবং অভিনেতা কালী ব্যানার্জিকে বলেন পাথরের চাঁইগুলোকে হাইওয়ের উপর ফেলে রাখতে। ফল যা হল, তা তো দুর্ধর্ষ! ট্রাক, লরি, গাড়ি সার বেঁধে জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে, প্রত্যেকেই সিনেমা কোম্পানির পিতা ও মাতার চরণ বন্দনা করছে! ঋত্বিক তো হেসে কুটিপাটি কারণ পাথরের চাঁইগুলো আসলে রবি পেপারম্যাট দিয়ে তৈরি করেছিলেন, যা নাড়াচাড়া করতে পাঁচ বছরের বাচ্চারও কোনো কষ্টই হবে না। লোকে ধরতে পারেনি, আমরাও পারিনি। আসলে রবি চাঁইগুলোর বিশালত্ব ও বক্রতা নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন বলেই অনুভূতির ওই বিরাট বিভ্রম ঘটে গেল। যখন রবি বেশ্যাপল্লী তৈরি করে দেন সংসার সীমান্তে, তরুণ মজুমদারের ছবিতে, তখন ওটা যে বাস্তব নয়, বানানো সেট, সেকথা জানতে পেরে আমাদের গর্বের অন্ত থাকে না। কী অনুপুঙ্খে তিনি তন্নতন্ন করে দেখতে পেয়েছিলেন গণিকাপল্লী!
এই সাফল্য তাঁর পক্ষেই সম্ভব যিনি নন্দলাল, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এবং সর্বোপরি রামকিঙ্কর বেইজের সান্নিধ্য পান যৌবনে। রবি এফেক্ট স্টাডি, স্থাপত্যকলা, স্কেচিং আয়ত্ত করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। তাই তিনিও আমাদের ছবিতে এক না দেখা জগতের উন্মোচন ঘটাতে পারেন।
ঘটনা হয়েছিল এই, একবার বুদ্ধদেব বসু সপরিবারে শান্তিনিকেতন বেড়াতে গেলে নিউ থিয়েটার্সের সৌরীন সেন তাঁদের সঙ্গী হন। তিনি চেয়েছিলেন স্টুডিওর শিল্প বিভাগের আধুনিকীকরণ। সেই সূত্রে তিনি নন্দলালকে বলেন যে অন্তত তিনটি ছাত্র তাঁকে দিলে সিনেমার সেটকে যান্ত্রিকতামুক্ত করে বাস্তবানুগ করে তুলতে পারবেন। সুতরাং রবিকে নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিতে হল। প্রথমে তাঁর আদৌ ভাল লাগেনি। কোথায় শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্করের সান্নিধ্য আর কোথায় স্টুডিওপাড়ার আজব লোকজন! কিন্তু আস্তে আস্তে রবি সিনেমার প্রেমে পড়ে গেলেন আর ধরতে পারলেন সিনেমার আসল রহস্যটা কোথায়। যেহেতু মঞ্চ তিনটি কৌণিক অবস্থান পায় – ০, ৯০, ১৮০ ডিগ্রি – দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি আগে থেকেই স্থিরীকৃত থাকে। মঞ্চে দর্শকের একটিই দৃষ্টিপথ। সেহেতু মঞ্চ নির্দেশককে মাথায় রাখতে হয় যেখানেই বসুন না কেন, দর্শক যেন সবকটি দৃশ্য উপকরণ দেখতে পান। মঞ্চ নির্মিতির উপকরণ সাধারণত হালকা হয় কারণ এক দৃশ্যে যা ভগ্ন কুটীর তা পরের দৃশ্যেই হয়ত পালটে জমিদারের ঘর হয়ে যাবে। আর মঞ্চে যেহেতু বাস্তবের যথাযথ নির্মাণ সম্ভব নয় তাই সেট অনেকটাই ইঙ্গিতধর্মী হয়। যেমন শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী বা রাজা অয়দিপাউস-এর সেট।
আরো পড়ুন তাপস সেন: আলো মানুষ, ভাল মানুষ
চলচ্চিত্র ঠিক তার উলটো। সেখানে বাস্তবের অনুপুঙ্খ নির্মাণ প্রয়োজন। তার ফলে চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। কোথায় লং শট আছে, কোনো ক্লোজ শট আছে কিনা, ট্র্যাকিং শট আছে কিনা, সবচেয়ে বড় কথা লোকেশনকে ভালভাবে পরীক্ষা করে অজস্র স্কেচ করতে হয়। বিশেষত ঋত্বিকের ক্ষেত্রে যদি লেন্স ডায়াগ্রাম না জানা থাকত, তাহলে রবিবাবু অযান্ত্রিক কেন, যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো বাদে অন্য ছবিগুলোতে এত সফল হতেন না। সংসার সীমান্ত নিয়ে স্বয়ং সত্যজিৎ খুব উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। কেন না নিম্নশ্রেণির দেহ পসারিনীদের আবাসস্থল হাড়ে মাংসে জানা না থাকলে এমন সেট তৈরি করা যায় না। খুবই আক্ষেপ হয় যে রবিবাবুকে আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তিনি কিন্তু ঋত্বিক ও সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করায় দুই স্রষ্টার কুষ্ঠি ঠিকুজি জেনে ফেলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, নন্দলাল আর রামকিঙ্কর যেমন ছবির দুনিয়ায় দুজন আলাদা আলাদা মানুষ, তেমনই চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় সত্যজিৎ ও ঋত্বিক। প্রথম দুজন – নন্দলাল ও সত্যজিৎ – শান্ত, নিপুণ, সমাহিত। আর অন্য দুজন – রামকিঙ্কর ও ঋত্বিক – যেন অন্তর্গত তাড়নায় ফেটে পড়তে চাইছেন। অন্তরমথিত যন্ত্রণায় ছারখার করে দিতে চাইছেন সবকিছু। রবি সেই আগুনটুকু ব্যবহার করেছিলেন সুবর্ণরেখা, কোমল গান্ধার-এ। মেঘে ঢাকা তারা-র উদ্বাস্তু কলোনির সামান্য অংশই আসল ঘর, বাকিটা যে বিশ্বকর্মাপ্রতিম রবি নির্মাণ করেছিলেন তা কজন ধরতে পারেন?
বংশী যখন সেট করেন তখন কে ধরতে পারেন যে বাস্তব থেকে অনেকখানি আলাদা হয়ে গিয়ে সত্যজিৎ অবাস্তবতার ভাস্কর্য খুঁজে পাচ্ছেন? আমরা ধরতে পারি না, দর্শক ধরতে পারেন না। হয়ত ঈশ্বর পারেন, ইতিহাস পারে। সেইজন্যই রবি চট্টোপাধ্যায় এবং বংশী চন্দ্রগুপ্তকে ভুলে থাকা পাপের নামান্তর।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।