প্রারম্ভেই বলে রাখা শ্রেয়, তাপস সেনকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে যে ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, বর্তমান নিবন্ধকারের ক্ষেত্রে সেটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কারণ, নাটক নিয়ে আমার জ্ঞান যেমন শূন্যের কোঠায়, মঞ্চের আলোকসজ্জা নিয়েও তথৈবচ। কিন্তু তবুও, এই অসামান্য আলোকশিল্পীর ৯৭তম জন্মদিবসে তাঁকে নিয়ে লিখতে বসার কারণ প্রধানত দুটি। প্রথমত, যে কোনো বিষয়ে না জেনে কথা বলতে নেই — এই আপ্তবাক্য বর্তমান যুগে ক্রমশ অচল, বিশেষ করে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। “যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ/চোখে দেখে তারা”। সুতরাং আমিও সেই পথই অনুসরণ করতে মনস্থ করলাম। দ্বিতীয়ত, অর্থ অথবা নারী-হৃদয়ের মতই স্মৃতিও বড় চঞ্চলা, বহু কিছু ধূসর হয়ে যাবার আগেই বলে রাখা ভাল।
তাপস সেনের পেশাগত দিক নিয়ে আলোচনা করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়; তাঁকে নিয়ে আমার যাবতীয় স্মৃতিই নিতান্ত ব্যক্তিগত। তাপস সেন ছিলেন আমার পিতৃবন্ধু, দিল্লির সুপরিচিত রাইসিনা বেঙ্গলি স্কুলের একেবারে নিচু ক্লাস থেকে শুরু করে ২০০০ সালে আমার বাবার মৃত্যুদিন অবধি তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। বাবার মৃত্যুর পরেও বছর ছয়েক বেঁচে ছিলেন তাপস সেন, নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে আমার মায়ের সঙ্গে। আমার কাছে তিনি বাল্যকাল থেকে তাপসকাকু নামেই পরিচিত, অন্য কোনোভাবে তাঁকে ভাবতেই পারতাম না। বলতে দ্বিধা নেই, বহু সময় মনে হয়েছে ব্যক্তি তাপস সেন আদতে নাটকের কিংবদন্তী তাপস সেনের আলোর চাইতে অনেক বেশি উজ্জ্বল; যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, আমি নিশ্চিত, তাঁরা সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সত্যি বলতে কি, নিজে একটা বয়সে পৌঁছবার পর, আমার পিতৃদেবের সঙ্গে তাপস সেনের সম্পর্ক নিয়ে অনেককিছুই আমাকে বেশ খানিকটা অবাক করেছে। আমার বাবা ছিলেন সাধারণ সরকারি কর্মচারী, তার উপর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে থাকবার ফলে কর্মক্ষেত্রে তাঁর সেভাবে কোনোদিন পদোন্নতি হয়নি। পাশাপাশি তাপস সেন নাট্যজগতের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, খুব অল্পবয়সেই একজন বিখ্যাত মানুষ, শিল্প সংস্কৃতির দুনিয়ায় এক বিস্তৃত ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ। অথচ দুজনের বন্ধুত্বে কোনোদিন ফাটল ধরেনি, বরং যত দিন গেছে, তত দৃঢ় হয়েছে তাঁদের বন্ধন। এর জন্য সিংহভাগ কৃতিত্ব আমি দেব তাপসকাকুকেই, খ্যাতির চূড়ায় উঠেও নিজের অতীতকে তিনি কোনোদিন অস্বীকার করার কোনো চেষ্টা করেননি।
একেবারে বাল্যকালের কথা খুব আবছা মনে পড়ে — সরকারি চাকরিতে কিছুদিনের জন্য কলকাতা বদলি হয়েছেন আমার বাবা, আমাদের নিয়ে তৎকালীন টলিগঞ্জে একটি ছোট বাড়ি ভাড়া করেছেন, কারণ তাঁর অফিসটা সেখান থেকে হাঁটাপথ। তাপস তখন সদ্য নাকতলায় বাড়ি করেছেন কিংবা করবেন বলে তোড়জোড় করছেন, সপ্তাহে অন্তত বার তিনেক দিনের কোনো একটা সময়ে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হবেন আড্ডা মারতে। আমাদের বাড়ির কাছেই তখন থাকেন অভিনেতা দিলীপ রায় ও অভিনেত্রী মঞ্জু দে, রাস্তায় দেখতে পেয়ে বেশ কয়েকবার তাপসকে তাঁদের বাড়ি যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, প্রতিবারই এড়িয়ে গেছেন তিনি। এখন এক বাল্যবন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, পরে কোনোদিন আসব, এই ধরণের কোনো উত্তর দিয়ে।
অথচ তাপস সেন তখন খ্যাতির শীর্ষে, ততদিনে সেতু নাটকে তাঁর আলোর জাদুতে স্টেজের ওপর আস্ত রেলগাড়ি চলছে, অঙ্গার নাটকে দর্শক দমবন্ধ করে দেখছেন খনি শ্রমিকরা কিভাবে জীবন্ত সমাধিস্থ হচ্ছেন জলের তলায়। নাট্যজগতে একা হাতে তখন আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন তাপস সেন।
মনে পড়ে, বালক আমাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন উত্তর কলকাতায় সুকিয়া স্ট্রিটে তাঁর পৈতৃক বাসভবনের কাছে ট্রামে চড়েছেন আমার মা। কোনো বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে কামরার আলোগুলি বারবার জ্বলছে ও নিবছে। একজন যাত্রী চেঁচিয়ে বলেছেন “এই যে কন্ডাক্টর ভায়া, বলি হচ্ছেটা কি, এটা কি তাপস সেনের আলোকসম্পাত পেয়েছেন নাকি?” পরদিন তাপসকাকু আসবার পর মা এই গল্পটি বেশ রসিয়ে রসিয়ে করাতে, কাকু শুধু হো হো করে হাসলেন, তারপরেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
পরে উপলব্ধি করেছি, মাত্র বছর তিরিশেক বয়সেই এক অতীব প্রতিভাবান শিল্পী হিসাবে সুনাম অর্জন করে ফেলায় খ্যাতি নামক বস্তুটি সম্বন্ধে তাপস সেন অনেকটাই মোহমুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি শক্ত জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর বামপন্থী মনোভাবও তাঁকে নিরন্তর বিরত রেখেছে যাবতীয় বুর্জোয়া আচরণের বশবর্তী হতে। মায়ের কাছেই শোনা গল্প — তাঁর বিয়ের দিন বরযাত্রী এসেছেন তাপস; রাতে আমার বাবার পাশে বসে খাচ্ছেন, পাড়া থেকে বহু কৌতুহলী মানুষ ভিড় করে এসেছেন এই আলোকশিল্পীকে একবার চোখের দেখা দেখতে; কাকু কিন্তু হেলদোলহীন, সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে নির্বিকার ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছেন।
আসলে দিল্লির প্রবাসী বাঙালি তাপস সেন পাকা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বোম্বাই পাড়ি দেন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, কয়েক বছর বাদে সেখান থেকে চলে আসেন কলকাতায়। এখানেই শুরু হয় তাঁর বিস্ময়কর উত্থান, যাঁর অনেকটাই আজ আর উৎসাহী নাট্যপ্রেমীদের কাছে অজানা নয়। কিন্তু দিল্লি ও বোম্বাই শহরে নিজ শিল্পে প্রতিষ্ঠা পাবার চেষ্টায় কী অসম্ভব পরিশ্রম তাঁকে একটা সময় করতে হয়েছে, সেই সম্বন্ধে খুব বেশি মানুষ অবহিত নন, সেই লড়াইয়ের বহুলাংশে সাক্ষী ছিলেন আমার পিতৃদেব।
তাপস সেনের সঙ্গে আমার বাবার বয়সের তফাৎ ঠিক চোদ্দ দিনের। ১৯৪১ সালে দিল্লি থেকে ম্যাট্রিক পাশ করবার পর স্থানীয় কলেজে প্রবেশ করেন দুজনেই, ইন্টারমিডিয়েট পাশও করেন; যদিও দুজনেই তখন সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন ওতপ্রোতভাবে। পাশাপাশি তাপস সেন তখনই মঞ্চের আলোকসজ্জ্বায় একদিন দিগন্ত উন্মোচন করবেন, এমনই এক স্বপ্নে মশগুল, যা তাঁকে পরিচিতদের কাছে করে তুলেছে নেহাত পরিহাসের পাত্র। ওদিকে যুদ্ধের বাজারে তখন চাকরি সহজলভ্য — তাপস একটি স্থানীয় সরকারি সংস্থায় ঢুকে পড়েছেন, বাবা আর্থিক কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে।
তবে এই ব্যবস্থা ছিল একেবারেই সাময়িক। কিছুদিনের মধ্যেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে তাপস পাড়ি দিয়েছেন বোম্বাই। বাবাও ছিলেন একই শহরে, কিন্তু ততদিনে নৌবিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণের অপরাধে গ্রেপ্তার হয়ে চালান হয়ে গেছেন সুদূর দক্ষিণের একটি কারাগারে। বহুদিন বাদে মুক্তি পেয়ে বাবা বোম্বাই ফিরে কেঁচে গণ্ডূষ করে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং তাপসের সঙ্গে যৌথভাবে শহরতলিতে সস্তায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
আর্থিক দিক থেকে দুজনের অবস্থাই তখন শোচনীয়। তাপস তখন চাকরি করছেন একটি সিনেমা প্রোডাকশন হাউসে, যার মালিক তৎকালীন হিন্দি ছবির এক বিখ্যাত বাঙালি অভিনেত্রী। কিন্তু তিনি কাজ করিয়ে নিলেও মাইনে দিতে অপরাগ, দিলেও সেটা দেন নিতান্ত অনিয়মিতভাবে। তাপসকাকু নিজেই একবার গল্প করেছিলেন, একদিন নাকি কাকভোরে বাবার কাছ থেকে আট আনা পয়সা ধার করে, বগলে এমিল জোলার একটি বই নিয়ে সেই অভিনেত্রীর অফিসে ধর্না দিয়েছিলেন, উদ্দেশ্য, যেনতেনপ্রকারেণ মাইনে আদায়। কিন্তু বৃথা আশা — সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এলেন; জোলার বইটা পড়ে শেষ করে ফেলেছেন, কিন্তু মাইনে পাওয়া যায়নি।
এরপর পট পরিবর্তন; তাপস বোম্বাই ছেড়ে চলে গেলেন কলকাতা এবং ক্রমশ প্রকাশ্য হলেন এক অন্য তাপস সেন, যিনি আজও, মৃত্যুর এত বছর পরেও ভারতীয় নাট্য আন্দোলনের এক অনন্য পুরুষ বলে পরিচিত। কিন্তু সেইসব কথা নিয়ে লেখবার যোগ্যতর ব্যক্তির অভাব নেই, আমার আলোচ্য বিষয় শুধু আমার দেখা মানুষ তাপস সেন।
তাপসের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল — তাঁকে আমি সহজে বিচলিত হতে দেখেছি বলে খুব একটা মনে পড়ে না। কল্লোল কিংবা পরবর্তীকালে দুঃস্বপ্নের নগরী নাটক দুটি নিয়ে যখন কলকাতা তোলপাড়, কংগ্রেসী গুন্ডারা নিয়মিত খুনের হুমকি দিচ্ছে পিএলটি এবং তার যাবতীয় সদস্যদের, প্রকাশ্য সরকারি মদতে বিধান সরণির ট্রাম লাইনের ওপর ফেলে রড, সাইকেলের চেন ইত্যাদি দিয়ে নাট্যকর্মীদের মেরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছেন নব কংগ্রেসের বীরপুঙ্গবরা, তখনও তাপস ভ্রুক্ষেপহীন, তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আশঙ্কার কথা বললে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন। কল্লোল নাটকটির সঙ্গে কিছুটা আমার বাবাও জড়িত ছিলেন, নৌবিদ্রোহের একজন অন্যতম অংশগ্রহণকারী হিসাবে; সুতরাং সরকারি উষ্মা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, তার অনেক ব্যাপারেই আমরা ছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী।
তাপস সেনের মত এমন বন্ধুবৎসল ও আদর্শবান মানুষ আজকের দুনিয়ায় বিরল। একেবারে ষাটের দশকের শেষ দিকের কথা; আমার পিতৃদেবের সংস্থায় সারা ভারতব্যাপী স্ট্রাইক ডাকা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তখন রাষ্ট্রপতির শাসন বলবৎ, ইন্দিরা গান্ধীর পুলিশ আন্দোলনকারীদের যথেচ্ছ গ্রেপ্তার করছে, এবং মর্মান্তিকভাবে পেটাচ্ছে। এক আন্দোলনকারীর বাড়িতে ঢুকে তাঁর শিশুপুত্রকে নির্দয়ভাবে দেওয়ালে আছড়ে ফেলল পুলিশ, শিশুটির তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হল। গ্রেপ্তার এড়াতে বাবা ও তাঁর এক সহকর্মী সাময়িক আশ্রয় খুঁজছিলেন, তাপসের মত নামী ব্যক্তি ব্যাপারটায় যথেষ্ট ঝুঁকি আছে জেনেও নির্দ্বিধায় দুজনকেই নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললেন।
তাপস সেনের আর একটি দিক একেবারেই অনালোচিত থেকে গেছে — সেটি তাঁর গভীর সাহিত্যপ্রীতি। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ পড়ুয়া মানুষ; বাংলা সাহিত্যের সাম্প্রতিকতম গল্প, কবিতা, উপন্যাস থেকে অতীতের যাবতীয় উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ছিল তাঁর নখদর্পণে। আশির দশকের শেষদিকে একবার কোনো বেসরকারি সংস্থার কাজ নিয়ে দিল্লি এসেছেন, থাকছেন শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এক নামী হোটেলে। সংস্থাটির পক্ষ থেকেই তাঁকে একটি সারাক্ষণ ব্যবহারের গাড়িও দেওয়া হয়েছে। সন্ধায় কাজের শেষে একদিন আমাদের বাড়ি এসেছেন, একেবারে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরবেন। গাড়িটি ছেড়ে দিয়েছেন, কারণ অল্পবয়সী ড্রাইভারটিকে শীতের রাত্রে অতটা সময় আটকে রাখতে তাঁর মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু খেয়েদেয়ে আড্ডা মেরে যখন আমাদের বাড়ি থেকে বের হলেন, তখন প্রায় রাত এগারোটা, প্রচন্ড শীতে ঘনীভূত কুয়াশায় কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না, কোনো ট্যাক্সি কিংবা অটো কারুরই দেখা নেই। শেষ অবধি একটি ফাঁকা বাস আসায় তাতেই উঠে পড়লেন তাপসকাকু। বিশাল কোট, মাফলার ও টুপিতে সর্বাঙ্গ ঢাকা প্রায় আধাভৌতিক চেহারার ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরকে বাদ দিলে তিনিই একমাত্র যাত্রী। বাস ছাড়বার সময় জানালা দিয়ে বাবার প্রতি তাপসের সহাস্য মন্তব্য: “ইস্কুলে থাকতে পড়া হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সেই গল্পটা মনে পড়ে? কঙ্কাল সারথি? আমি বোধহয় এবার সেই পাল্লায় পড়লাম”। বয়সের নিরিখে দুজনেই তখন ষাট পেরিয়ে গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে।
তবু, আজ এতদিন বাদে, অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটা ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট — আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, সাহিত্য, রাজনীতি, এমনকি তাঁর সারা জীবনের সঙ্গী নাটককেও ছাড়িয়ে একটা জায়গায় তাপস ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে সম্পূর্ণ একাকী একজন মানুষ, সেখানে তিনি নিজের শিল্পীসত্তার কাছে নিবেদিতপ্রাণ, আপসহীন, সেখানে তাঁর শিল্পের দাবির কাছে জীবনের যাবতীয় উত্থান পতন মাথা নিচু করতে বাধ্য। শেষ জীবনে একের পর এক পারিবারিক বিপর্যয়ে তীব্র আঘাত পেয়েছেন, কোনো নিভৃত মুহূর্তে আমার বাবা অথবা কোনো ঘনিষ্ঠজনের কাছে উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর হৃদয়াবেগ; কিন্তু কোনোভাবেই থামিয়ে দেওয়া যায়নি আলোকশিল্পী তাপস সেনকে, ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুর দিন অবধি কাজ করে গেছেন একই উজ্জীবিত প্রেরণায়।
নব্বইয়ের দশকের কথা। তাপস মার্কিন দেশে গেছেন, নিউ জার্সি শহরে কয়েক দিনের জন্য আমার কনিষ্ঠা ভগ্নীর গৃহে আতিথ্য স্বীকার করেছেন। খুব ইচ্ছা আলোর বাল্বের স্রষ্টা টমাস এডিসনের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত মেনলো পার্কের টমাস এডিসন সেন্টার দেখতে যাবেন। যাওয়া তো হল, কিন্তু সেখানে ঢোকবার পর তাঁর সম্পূর্ণ অন্য মূর্তি। অতি নিকটজনকেও যেন চিনতে পারছেন না, কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, দেখলে মনে হয় একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন। একটি থেকে আর একটি দ্রষ্টব্য বস্তুর দিকে ছুটে যাচ্ছেন, আবার ফিরে আসছেন আগেরটির কাছে। আমার ছোট বোনের কথায়, কী এক তীব্র উত্তেজনা যেন গ্রাস করেছে তাঁকে।
ঘটনাটা আসলে সম্পূর্ণ অন্য। বাকি সব দর্শক তো এসেছেন একটি মিউজিয়াম দেখতে, তাঁরা কি বুঝবেন যে তাপস সেন আদতে এসেছেন আলোর বাল্বের আবিষ্কারকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে? যে আলো তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা, যে আলোর মাধ্যমে বছরের পর বছর মঞ্চের ওপর সৃষ্টি করে এসেছেন এক শিল্পিত বিস্ময়, সেই আলো বস্তুটিকে যে মানুষ প্রথম কৃত্রিমরূপে উজ্জ্বল করে তোলেন, আজ তাঁর দুয়ারে তিনি পৌঁছেছেন — তাই তিনি আজ নতজানু, বাকি পৃথিবী তাঁর কাছে তুচ্ছ, তাই আজ তাঁর চোখের তারায় এক অদ্ভুত উন্মাদনা।
তাপসকাকুকে আমি অবশ্যই চিনতাম, কিন্তু এই তাপস সেনকে উপলব্ধি করবার ক্ষমতা আমার কোনোদিনই ছিল না।
আরো পড়ুন:
- খেউড় নয়, শাঁওলী মিত্রের আরও তীব্র অথচ মেধাবী সমালোচনা প্রাপ্য
- শাঁওলীদির থেকে কত শিখেছি তার হিসাব নেই
- বিশিষ্ট বিজন: যিনি ‘হারতে জানতেন না’
- টিনের তলোয়ারের ৫০ ও ‘প্রোপাগ্যান্ডিস্ট’ উৎপল দত্ত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।