সিপিএম দলের কর্মী-সমর্থকরা মাঝেমধ্যেই রোষ প্রকাশ করে থাকেন, তাঁরা যদি ৭ শতাংশ, তাঁরা যদি ০ মাত্র, তাহলে তাঁদের নিয়ে এত সমালোচনা কেন! এ বক্তব্যের মাধ্যমে সিপিএম দরদীরা যে কথা বলতে চান, ৭ শতাংশ বা শূন্য আসন সংখ্যায় তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা কমেনি। কথাটা ঠিক। ডিজিটাল মিডিয়ায় যাঁরা কাজ করেছেন বা করেন, বাংলায়, তাঁরা জানেন, সিপিএম একটা খুব ভাল কিওয়ার্ড। ফলে ডিজিটাল মাধ্যমের লেখায় সিপিএম শব্দটা, কিওয়ার্ড হিসেবে কেবলমাত্র ব্যবহারযোগ্যই নয়, অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
এ লেখা সিপিএম নিয়ে নয়। প্রথম অনুচ্ছেদে বেশ কয়েকবার সিপিএম লেখার মাধ্যমে একটা চালু কিওয়ার্ডকে ব্যবহার করে নেওয়া, কিছু হিট নিশ্চিত করার জন্য। তবে এটা ঠিক ক্লিকবেটও নয়, কারণ লেখাটির একটা অংশ কিওয়ার্ড নিয়েও।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সম্প্রতি খ্যাতনামা সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে একটি পোস্টে তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সে বিরক্তি, বর্তমানে রিভিউ নামে চলতে থাকা একটি ধারা নিয়ে। সে ধারা সম্পর্কে নিজের সপাট বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন, সে সম্পর্কে এই লেখার অবতারণা। সঙ্গীতা ঠিক কী কী বলতে চেয়েছেন, তা জেনে ফেলা ও জানিয়ে দেওয়া নয়, সঙ্গীতার কথা থেকে যা যা মনে হয়েছে, সে সম্পর্কেই এই আলোচনা। এই মনে হওয়ার সঙ্গে যে কেউ সহমত হতে পারেন, সঙ্গীতা সহ যে কেউ দ্বিমতও হতে পারেন, স্বাভাবিকভাবেই।
কিওয়ার্ডের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। সঙ্গীতা একটি কিওয়ার্ডের ফাঁদে পড়েছেন, বা সচেতনেই সে ফাঁদ ব্যবহার করেছেন। রিভিউ। রিভিউ একটি কিওয়ার্ড। বাংলা হরফে লিখলেও, এখন। ফলে, রিভিউ বা হ্যাশট্যাগ রিভিউ ব্যবহার করে বহুজন বিভিন্ন রকম ও ধরনের লেখা লিখে থাকেন, তাতে কিছু হিট-টিটও নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। ফেসবুকে অবশ্য হিটের হিসেব নেই, সেখানে লাইক ও তৎসহ অন্যান্য রিঅ্যাকশন।
রিভিউ শব্দটার বাংলা ঠিক কী হতে পারে? বা রিভিউ শব্দটার ঠিক কী বাংলা হতে পারে? চট করে, ডিকশনারি চক্করে না পড়ে, গুগলের কাছে জানতে চেয়ে দেখছি বেশ কয়েকটা অপশন পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম হল, পুনঃমূল্যায়ন। তারপর আসছে পর্যালোচনা, পুনর্মূল্যায়ন, পুনঃসমীক্ষা, অবেক্ষণ, ইত্যাদি। ১২ নম্বরে গিয়ে পাচ্ছি, সমালোচনা। অর্থাৎ, গুগলের মত জায়গাতেও, রিভিউ মানে সমালোচনা নয়। রিভিউ শব্দটা আমাদের জীবনে এসেছিল, ব্যবহারিক জীবনে, পরীক্ষার খাতা রিভিউ প্রসঙ্গে। তখন খবরের কাগজে পুস্তক পর্যালোচনা ছাপা হত, চলচ্চিত্র-আলোচনা বা সমালোচনা। রিভিউ শব্দটা ইংরেজি, বাংলা মাধ্যম তখন যত্রতত্র ইংলিশ শব্দ ব্যবহার করত না, উপনিবেশ-সংস্কৃতি তখনও বাঙালি মানবমনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেতে ততটা শুরু করেনি। তবে এ-ও ঘটনা যে সমালোচনা শব্দটাকে তখন নিত্যদিনের জীবনে নিন্দার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হত। অমুক, তমুকের কী সমালোচনাটাই না করত, বাড়ি বয়ে এসে। সমালোচনাকে, সম যুক্ত আলোচনা হিসেবে দেখার অভ্যাস তৈরি হয়নি। ফলে, সাধারণ ধারণায়, সমালোচনা মানে খুঁত ধরা, এরকম একটা প্রতিবেশ মস্তিষ্কের মধ্যে তৈরিই থাকত।
চালু বাংলা সামাজিক মাধ্যমগুলিতে, যাঁরা এই রিভিউসমূহ লেখেন, তাঁদের সাধারণত কোনও রকম প্রশিক্ষণজনিত দায়বদ্ধতা বা সম্পাদিত হবার অভ্যাস নেই। তাঁরা, স্বাধীন। এবং তাঁদের, সামাজিক মাধ্যমের নিয়ম মেনে, তাড়া আছে। দ্রুততার সঙ্গে নিজ বক্তব্য পেশ করে ফেলার। সাহিত্য-আলোচনা পাঠের অভ্যাস তৈরি করা, পাঠ-কে নিজের মধ্যে মজতে দেওয়া, এবং সে নিয়ে ভাবা, এসবই ওই প্রশিক্ষণজনিত দায়বদ্ধতা, যা কেবলমাত্র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই, থাকেও না।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই ধারাটি সম্পর্কে রুষ্ট হয়েছেন? তাঁর ফেসবুক পোস্টে কিন্তু তেমনটা প্রতিভাত হয়নি। তিনি বিরক্ত হয়েছেন ও প্রকাশ করেছেন, রিভিউয়ের নামে গল্পটাই প্রকাশ্যে এনে দেওয়ায়। এখনকার চালু ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলে স্পয়েলার দেওয়া। আমরা স্পয়েলার প্রসঙ্গে পরে আসব, তার আগে দেখে নিই, সঙ্গীতা এই নিয়ে বলতে গিয়ে আরও কী কী জরুরি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। সাধারণ পাঠক, শারদীয়া সংখ্যার দাম ২০০ টাকা হওয়া নিয়ে যে ক্ষোভ ব্যক্ত করছেন, সঙ্গীতার অসন্তুষ্টি সে নিয়েও। তিনি বলেছেন, পত্রিকার দাম ৫০০০ টাকা করে দেওয়া উচিত। তাঁর এই যুক্তি নিয়ে কিছুদূর আলোচনা সম্ভব। একটি শিল্পসামগ্রীর দাম, ঠিক কিসের ভিত্তিতে নির্ণীত হবে, তা শ্রম-সময় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল, সম্ভবত, বাজারের উপর। যাঁরা সাহিত্য ব্যবসায়ী, তাঁরা বাজার না জেনে ব্যবসা করতে নামেন না। ফলে, ৫০০০ টাকা, অসম্ভব হিসেবেই সঙ্গীতা বলেছেন, কিন্তু তিনি সম্ভবত ভাবেননি, যে তেমন বাজার যদি থাকত, তাহলে পাঁচ হাজারেই বিকোন হত শারদীয় পত্রিকা। কিন্তু সঙ্গীতা তো সাহিত্য-ব্যবসায়ী নন, তিনি সাহিত্যিক। পাঁচ হাজার টাকা দামের কথা তিনি সম্ভবত রোষবশতই বলেছেন, এমনটা নিশ্চয়ই ভাবেননি, ৫০০০ টাকা শারদ পত্রিকার দাম হলে, সেই পত্রিকায় একটি গল্প মনোনীত হলে, তার পারিশ্রমিকের অর্থমূল্য, ২০০ টাকার পত্রিকায় লিখে যে পারিশ্রমিক পাওয়া যায়, তার তুলনায় বেশি হবে। এই প্রসঙ্গটা যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে এ কথা আরও স্পষ্ট বোঝা যাবে, সঙ্গীতা প্রসঙ্গটা ঠিক দেনা-পাওনার হিসেবে বলেননি, কারণ, তাঁর গল্পের গল্পটা জেনে নিয়ে যদি আর কেউ পত্রিকা না-কেনেন, তাহলেও সে গল্পের জন্য তাঁর প্রাপ্য পারিশ্রমিক, পত্রিকামালিকসমুদয় আটকাতে পারবেন না। ফলে, এখানে, প্রসঙ্গটা তাঁর টাকার নয়, সঙ্গীতা সম্ভবত চেয়েছেন, এত বেশি দাম করা হোক, যাতে অনধিকারীরা শারদীয় সাহিত্য না ছুঁতে পারে, প্রবেশাধিকার যেন যতদূর সম্ভব পৌঁছের বাইরে রাখা হয়। এই অধিকারীভেদের ধারণাটিকে আরও সম্প্রসারিত করা যায়। কলকাতা পুস্তকমেলা প্রবেশমূল্যহীন করে দেওয়ার ফলে অপাঠক-অক্রেতার ভিড় হচ্ছে, পাঠক-ক্রেতারা অসুবিধায় পড়ছেন, এমন আলোচনা, শেষ বইমেলাতেও শোনা গিয়েছে, এমনকী ক্রেতা-পাঠক-প্রকাশকদের কাছ থেকেও। ফলে, অর্থমূল্যের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের সপক্ষে সঙ্গীতা প্রথম মত দিলেন, এমন নয়। তাহলে, সঙ্গীতা কাদের অনধিকারী ভাবছেন? সেই পাঠকদের, যাঁরা ২০০ টাকায় পত্রিকা কিনে ভাগাভাগি করে পড়েন, এবং মাথাপিছু পাঠের মূল্য, ৪০ বা ৫০ টাকার মত, তার কিছু কম-বেশিও হতে পারে।
বাংলা সাহিত্যে, এরকমই হয়। শারদীয় পত্রিকা, সঙ্গীতা জানেন, এখন মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেকগুলি কেনা হলেও, এক সময়ে, যখন সঙ্গীতা লিখতে শুরু করেছেন, সে সময়ে এক একটি পরিবারগুচ্ছে, প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের মধ্যে, এক এক বাড়িতে এক এক শারদীয় সংখ্যা কেনা হত, এক বাড়িতে পড়া শেষ হলে, তা পৌঁছে যেত অন্য বাড়িতে। তখনও, এক একজন সাহিত্যিকের গল্পের বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হত, কথা হত, প্রথমজনের পড়ার পরেই, বাকি ৫-১০-১৫ জন জেনে যেতেন, এবারে কে কী নিয়ে গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন। তাতে কি লেখকের অসুবিধা হত? হত না, কারণ, এ বলাবলিগুলি সম্পর্কে লেখক অবহিত থাকতেন না। সে বলাবলির মধ্যে নিন্দাই থাকুক বা স্তুতি, তা লেখকের কাছে পৌঁছত না। অতি-সংযোগের এই সময়ে, সেসব দ্রুত পৌঁছে যায়, এবং তা লেখককে, অন্তত বেশ কিছু লেখককে বশ করতে পারে। সঙ্গীতা, বশবর্তী হয়েছেন।
এতক্ষণ আমরা সাহিত্য নিয়ে কোনও কথাই বলিনি। একটু সে দিকে যাওয়া যাক। একটি গল্পে কী থাকে? একটা কাহিনি, একটা চমক, কোনও একটা ঘটমানতা? এরকমই কিছু। এরকমই কিছু, এবং। এরকমই কিছু, প্লাস। ওই এবং অথবা প্লাসটাই, সাহিত্য। গল্প, কাহিনি, তার পূর্বাপরতা, এসবের একটা নির্মাণ থাকে। তাকে কেউ শৈলী বলে ভাবতে পারেন বটে, কিন্তু গল্প, ওই শৈলীটাই। দ্রবময়ীর কাশীবাসের গল্পটা ঠিক কী, বা প্রাগৈতিহাসিকের, বা অশ্বমেধের ঘোড়ার, কিংবা ছুটি বা দেনাপাওনার, বা অভাগীর স্বর্গের, এ আমি, বা সঙ্গীতা বা যে কেউ বলে দিতে পারব সম্ভবত। তাতে গল্পটা না-পড়ার কারণ তৈরি হয় না। কারণ, এসব গল্পে, বাংলা ভাষার অজস্র এরকম গল্পে, গল্পটা, গল্পের কাহিনিতে থাকে না। গল্পটা আড্ডায় বসে বলে দিলে, তা ফুরিয়ে যায় না। আড্ডায় বসে, ফেসবুকে শুয়ে, গল্পের বিষয় বলে দিলে যে গল্প ফুরিয়ে যায়, সে গল্প, সঙ্গীতা নিশ্চয়ই জানবেন, গল্প হয়েই ওঠেনি। উঠতে পারে না। এমন গল্পই লিখতে হবে, যে গল্প ফুরোয় না, গল্প জেনে গেলে তো নয়ই, পড়া হয়ে গেলেও নয়। একজন পাঠক হিসেবে, তেমন গল্প পড়ার জন্যই অপেক্ষা করে থাকা, না-ফুরোনো গল্প।
আমরা কিওয়ার্ড দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। সঙ্গীতা, না চাইতেও তাঁর ফেসবুক পোস্টে একটা কিওয়ার্ড তৈরি করে দিয়েছেন। স্বল্পকালীন হলেও, স্থানিক হলেও। চানাচুর। এই কিওয়ার্ডটা, ফেসবুক সার্চে, কিছুদিন হয়ত থাকবে। কিওয়ার্ড দিয়ে ডিজিটাল মার্কেটিং হয়, সাহিত্য হয় না। পাঠক হিসেবে, সাহিত্যের জন্যই অপেক্ষা করে থাকা, তা ডিজিটাল হতেও পারে। কিন্তু, কিওয়ার্ড? নাঃ!
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] চানাচুরের কিওয়ার্ড প্রাপ্তি […]