বিশ্বজিৎ দাস

ত্রিপুরায় বিজেপির নজিরবিহীন সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্য বিরোধী সিপিএম। তবে এখন সাধারণ মানুষও বিজেপির লুম্পেন বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। গত তিনদিন ধরে উত্তরপূর্বের ছোট্ট রাজ্যটি কার্যত জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে বাড়ি-গাড়ি-দোকান। বুধবার খোদ রাজধানী আগরতলার বুকে দিনদুপুরে সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়, সিপিএম দলের অফিস বাড়ি জ্বালিয়ে কীভাবে উল্লাসে মেতে উঠেছে বিজেপি কর্মীরা, তা গোটা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। ত্রিপুরায় বিজেপি কর্মীদের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদও রাজ্যে রাজ্যে হচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিংবা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখে কুলুপ। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবও এখনো পর্যন্ত কোনো বিবৃতি দেননি। রাজ্যের পুলিশ কার্যত অসহায়।

প্রতিবাদী কলম নামের দৈনিক পত্রিকা দফতরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চার বিজেপি কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। অথচ, বুধবার ওই পত্রিকা দফতরে হামলার পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রাজ্যের সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক এবং রাজ্যের তথ্য ও জনসংযোগ মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী সমবেদনা জানাতে রাতে পত্রিকা দফতরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় বলেছিলেন, আক্রমণকারীদের শীঘ্রই গ্রেফতার করা হবে। আক্রমণকারীদের চিহ্নিত করতে পত্রিকা দফতরের সিসি ক্যামেরায় বন্দি ভিডিও ফুটেজ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবু কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। পত্রিকার দপ্তরে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারির দাবিতে বৃহস্পতিবার আগরতলায় রাজ্যের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ধরনায় বসেছিলেন সাংবাদিকরা। অন্য দিকে হামলা চালু রাখতে প্রকাশ্যে উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা। বিজেপির প্রদেশ কমিটির মুখপাত্র নবেন্দু ভট্টাচার্য বুধবার রাতে সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, “আগরতলা, বিশালগড়,উদয়পুরের ঘটনা ট্রেলার মাত্র।” আরও হামলা হবে বলে তিনি প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এদিকে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেছেন “শারীরিক আক্রমণ করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সিপিএমকে আটকানো যাবে না। রাজ্যের শান্তি সম্প্রীতি রক্ষা করতে ও জনগণের রুটিরুজির অধিকার আদায়ে সিপিএম ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে যে সংগ্রাম চলছে, তা অব্যাহত থাকবে।” বিজেপির বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র প্রতিবাদ মিছিল সংঘটিত হচ্ছে, বিভিন্ন মানুষ তাতে সামিল হচ্ছেন।

বিজেপিও কিন্তু স্বস্তিতে নেই। একের পর এক কর্মী দল থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। ইস্তফাপত্র ঊর্ধ্বতন নেতাদের কাছে পাঠানোর পাশাপাশি সোশাল মিডিয়াতেও পোস্টও করে দিচ্ছেন অনেকে। বিজেপি গোটা ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিক সরাসরি সাম্প্রদায়িক উসকানি দিচ্ছেন। গত সোমবার ধনপুর বিধানসভা এলাকার কাঁঠালিয়ায় বিজেপি কর্মীদের সাথে নাকি মারপিট করেছে একদল “বিশেষ সম্প্রদায়ের” লোক। ইঙ্গিত মুসলমানদের দিকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই কৌশলে ফল হয়নি। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামছেন। কোথাও কোথাও বিজেপি কর্মী, সমর্থকদের একাংশও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

২০১৮ সালে রাজ্যে বিপ্লব কুমার দেবের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিরোধীদের উপর আক্রমণ চলছিল। মূলত সিপিএম ও বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের উপর আক্রমণ হচ্ছিল। সাম্প্রতিককালে শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতিকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। গত ৪১ মাসে রাজ্যে ২১ জন বামপন্থী কর্মী বিজেপির বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন, কয়েকশো ঘরছাড়া। সিপিএমের অনেক বিধায়ক নিজের নির্বাচনী এলাকায় ঢুকতে পারছেন না। মানিক সরকার, বিরোধী দলের উপনেতা এবং প্রাক্তন মন্ত্রী বাদল চৌধুরীর উপর একাধিকবার শারীরিক আক্রমণ হয়েছে, তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার।

৬ই সেপ্টেম্বর মানিক সরকারের নির্বাচনী এলাকার কাঁঠালিয়া ব্লকে সিপিএমের গণ ডেপুটেশন কর্মসূচি ছিল। সেই কর্মসূচিতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় তাঁর পথ আগলে দাঁড়ায় কয়েকজন বিজেপি কর্মী। তারা টায়ার জ্বালিয়ে মানিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করে, উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। গত কয়েক দিনের হিংসার সেই সূচনা। স্থানীয় মানুষ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে পালিয়ে যায় বিজেপি কর্মীরা। তারপর মানিক সরকার হেঁটে কাঁঠালিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলে আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশ বাধা দেয়। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে উপর মহলের নির্দেশেই মানিক সরকারকে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তিনি পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে কাঁঠালিয়ায় দলীয় কর্মসূচিতে পৌঁছে যান। পরদিন উদয়পুরে বামপন্থী যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের একটি কর্মসূচি ছিল। সেই কর্মসূচি আটকানোর চেষ্টা করে পুলিশ ও বিজেপি। সেখানেও ক্ষোভের মুখে পড়ে বিজেপি আশ্রিত গুন্ডাবাহিনী শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায়।

আসলে রাজ্যের পরিস্থিতি এখন আর আগের মত নেই। বাধা দিলেই লড়াই বাধছে। আক্রান্ত মানুষ বুঝতে পারছেন, বিজেপির ভয়ে ঘরে বসে থাকলে কেউ এসে বাঁচাবে না, তাই নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। নির্বাচনের সময় যারা ভুল বুঝে বা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাঁরা ফের লাল ঝান্ডা হাতে তুলে নিচ্ছেন। প্রতিদিন রাজ্যের কোনো না কোনো জায়গায় বিজেপি ছেড়ে সিপিএমে যোগদানের ঘটনা ঘটছে। বামেদের বহু দলীয় অফিস উদ্ধার হয়েছে। অনেকদিন বাড়িছাড়া বহু বাম নেতা, কর্মী ঘরে ফিরতে পেরেছেন। বিজেপির যে পায়ের নীচে মাটি সরে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছেন তাঁরা। বিজেপির দলীয় কোন্দল মাথা চাড়া দিয়েছে। নিজের লবি শক্ত করতে মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতেও অন্তর্কলহ সামলানো যাচ্ছে না। গত সপ্তাহে বিধানসভার অধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, বিজেপিতে তত ভাঙন ধরবে বলে অনেকের আশঙ্কা। ঘরে বাইরে কোণঠাসা হয়ে এখন সন্ত্রাসের রাজনীতিই বিপ্লব দেবদের পথ।

সকলেই জানেন ত্রিপুরায় জায়গা খুঁজছে তৃণমূল কংগ্রেসও। এই দলের কোনো জনভিত্তি নেই এই রাজ্যে। মূলত দল ভাঙিয়ে কিছু বড় নামকে নিয়ে এগোনোই তাদের উদ্দেশ্য। সিপিএম আমলে একবার বিরোধী দল কংগ্রেসের বিধায়কদের নিজেদের দলে নিয়েছিল তৃণমূল। সেদিন দল ভাঙাতে এসেছিলেন মুকুল রায়। তবে কংগ্রেসের সেই বিধায়করা বেশিদিন তৃণমূলের ঘর করেননি। তাঁদের তৃণমূলের ঘর থেকে তুলে নিয়ে যান অমিত শাহ। আগের মতো এবারও বিজেপির কয়েকজন বিধায়ককে ভাঙিয়ে রাজ্যে দল তৈরির চেষ্টা করছে মমতা ব্যানার্জি। এবার মুকুল রায়ের বদলে দল ভাঙানোর দায়িত্ব পেয়েছেন আসামের মেয়ে সুস্মিতা দেব।

তিনি কিছুদিন আগে পর্যন্ত সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন। একবার আসামের শিলচর কেন্দ্র থেকে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ত্রিপুরায় তাঁর অন্য পরিচয় রয়েছে। তিনি প্রয়াত কংগ্রেস নেতা সন্তোষমোহন দেবের কন্যা। সন্তোষমোহন সম্পর্কে ত্রিপুরাবাসীর মধ্যে বিরূপ মনোভাব রয়েছে। ১৯৮৮ সালে গুন্ডাবাহিনী নামিয়ে বুথ দখল করে রিগিং করে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। সেই রিগিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সন্তোষমোহন। একসময় ত্রিপুরায় তাঁকে সন্ত্রাসমোহন দেব বলা হত। পরবর্তীকালে আর রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ত্রিপুরায় ঢুকতে পারেননি। বাবার এই ইমেজ কাটিয়ে উঠে ত্রিপুরায় মাটি পাওয়া সুস্মিতার জন্য কঠিন।

রাজ্যে ২০২৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঝেমধ্যে কলকাতা থেকে কিছু নেতা, কর্মীকে ত্রিপুরায় পাঠাবেন মমতা, একথা নিশ্চিত। বিজেপিও তা জানে। তাদের আসল মাথাব্যথা সিপিএম। এজন্যই সিপিএম নেতা, কর্মীদের উপর আক্রমণ বীভৎস থেকে বীভৎসতর হচ্ছে। বামপন্থীদের অফিস হয় বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, নয়ত পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

তবে বিজেপির এই ফ্যাসিস্টসুলভ আক্রমণের মুখে বামপন্থীরা ঘরে বসে নেই। মানিক সরকার বলেছেন, ১৯৮৮-৯৩, এই কয়েক বছরের কংগ্রেস জোট শাসনে আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের মোকাবিলা সেদিন বামপন্থীরা করেছেন। সেদিনও দলের রাজ্য দফতর আক্রান্ত হয়েছিল, শীর্ষ নেতাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল, বহু কর্মী খুন হয়েছিলেন। আজকের আক্রমণ আরও ভয়াবহ। কিন্তু এতে পিছু হঠার প্রশ্ন নেই। কমিউনিস্টরা বরাবরই ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে জানকবুল লড়াই করেছে এবং জয়ী হয়েছে। আজকের ত্রিপুরাকেও সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে মুক্ত করবে কমিউনিস্টরাই।

নিবন্ধকার পেশায় সাংবাদিক, বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত। মতামত ব্যক্তিগত।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.