৯/১১-র পর ২০ বছর পেরিয়ে গেল। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া শ্মশান হয়ে গেল। কী ভাবে দেখব ৯/১১-কে? নাগরিকের সঙ্গে কথা বললেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাক্তন NSG কমান্ডো এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ দীপাঞ্জন চক্রবর্তী

নাইন ইলেভেনের পরে আমেরিকা শুরু করেছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। দু’দশক পর সেই যুদ্ধকে কীভাবে দেখেন?

আমি নাইন ইলেভেনকে একটু অন্যভাবে দেখি। এটা নিঃসন্দেহে একটা ঐতিহাসিক তারিখ। বিশ্বের ইতিহাসের মোড় বদল হয়েছিল এই তারিখে। কিন্তু সেটা কেবল সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে নয়। এর আরো অনেকগুলো তাৎপর্য রয়েছে। পৃথিবীতে এখন যে ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদী’ আগ্রাসন কায়েম হয়েছে, যে সাম্রাজ্যবাদে রাজা-রাজড়া নেই, রয়েছে অনেকগুলি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, নাইন ইলেভেন তাদের দখলদারি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুব বেশি করে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এই বিষয়টিকে বাদ দিয়ে যদি আমরা কেবলমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বিমান হানা নিয়ে কথা বলি, তাহলে কিন্তু ভুল হবে। ওটা খণ্ডিত ইতিহাসচর্চা।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

একটু বিশদে বলুন…

আমি মনে করি, আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী দেশ। এই নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তারা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারে। বিশ্বের অন্য দেশগুলির মানুষের স্বার্থকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। আমেরিকার ইতিহাসই এর প্রমাণ। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিতে পারে।

আমরা যদি একবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ভাবি, তাহলে কী দেখব? আইনস্টাইনের মতো মহান বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমা তৈরিতে যুক্ত হয়েছিলেন। এক গভীর মানবিক আবেগে তাঁরা চেয়েছিলেন, হিটলারের মত যুদ্ধোন্মাদ যদি পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলে, তাহলে মানবসভ্যতার সমূহ বিপদ। তাই আত্মরক্ষার্থে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা। সেই বোমা যখন তৈরি হল, ততদিনে যুদ্ধের গতি বদলে গিয়েছে। জার্মানি ধ্বংস, অক্ষশক্তি পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে রুজভেল্ট প্রয়াত, মার্কিন মসনদে বসেছেন ট্রুম্যান। আবারও আইনস্টাইন সহ বিজ্ঞানীরা ট্রুম্যানের কাছে গেলেন। তাঁরা জানালেন, জার্মানির কাছে পরমাণু বোমা তৈরির কোনো উপায়ই যে আর নেই, তা প্রমাণিত। ফলে যে বোমাটি তৈরি হয়েছে, তা যেন ব্যবহৃত না হয়। বিশ্ব মানবতার উপর এত বড় আঘাত যেন আমেরিকা না করে।

তারপর কী হয়েছিল আমরা জানি। ট্রুম্যান এই বিজ্ঞানীদের কথায় আমলই দেননি। কেবলমাত্র আমেরিকা পয়সাকড়ি খরচ করে বোমাটা তৈরি করেছে বলে হিরোশিমা হল, নাগাসাকি হল। আমেরিকা বিপুল ডলার খরচ করে বোমা তৈরি যাতে ‘বিফলে’ না যায়, তার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মাল। পৃথিবী অভূতপূর্ব এবং অহেতুক হিংসার সাক্ষী থাকল। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে তারাই যে সর্বশক্তিমান, সেটা প্রমাণ করতেই এই নির্বিচার গণহত্যা।

আপনি যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসার কথা বলছিলেন।

অবশ্যই। আমেরিকার অর্থনীতি যাতে চাঙ্গা হয়, বড় বড় বিজনেস হাউজ এবং যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থে তারা ভিয়েতনামে যাবতীয় মারণাস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। জর্জ বুশ সিনিয়র এবং জর্জ বুশ — দুজনেই এই ধরনের বিজনেস হাউজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এই কথাগুলো ভুলে গেলে চলবে না।

নাইন ইলেভেনের ঘটনাটা নিঃসন্দেহে একটা ঘৃণ্য সন্ত্রাসবাদী ঘটনা। এতে হাজার তিনেক আমেরিকান মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজ কীভাবে এটাকে ব্যবহার করেছিল? ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান — তিনটি দেশকে ধ্বংস করে দিল তারা। তাদের পেট্রোল থেকে শুরু করে যাবতীয় খনিজ পদার্থ দখল করল। যে তিন হাজার আমেরিকানের প্রাণ গিয়েছিল, তার জবাবে আমেরিকা অনেক অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছিল। কর্পোরেট জায়েন্টদের জন্য সীমাহীন লুঠ চালিয়েছিল। আমরা ছোটবেলায় পড়তাম, বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ। বস্তুত, নাইন ইলেভেন এক ঝাঁক মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। অস্ত্র এবং তেলের ব্যবসায় বিপুল লাভ হল।

ওরা বলেছিল, ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র আছে। সেই অভিযোগে সাদ্দাম হুসেনকে উৎখাত করল। কিছু প্রমাণ করতে পেরেছে? আফগানিস্তানকে লুটেপুটে শেষ করল। লিবিয়াকেও তাই।

কিন্তু সমস্যা হল, একটা নাইন ইলেভেন অনেকগুলো নাইন ইলেভেনের জন্ম দেয়। ভারতের ক্ষেত্রেও তাই। একটি সংখ্যাগুরু মৌলবাদী হামলা একাধিক সংখ্যালঘু মৌলবাদী ঘটনার জন্ম দেয়।

ভিয়েতনাম বা আফগানিস্তান — শেষ অবধি তো আমেরিকা সরতে হল। একে কী ভাবে দেখেন?

এই দুটো দেশ তো শুধু নয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও তো আমেরিকা সরাসরি মদত দিয়েছে পাকিস্তানকে। কিচ্ছু করতে পারেনি। ভিয়েতনামে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেও হেরেছে। ভিয়েতনামের কী ছিল? আমরা মজা করে বলতাম, হো চি মিনের কী আছে? একটা পাঁচ ফুট তিন-চার ইঞ্চির শরীর আর কয়েকটা দাড়ি। তা-ও তো আমেরিকা পারল না। মার খেয়ে ধ্বংস হল। ওরা এর জবাবে সিলভার স্ট্যালোনকে দিয়ে র‍্যাম্বো তৈরি করল। আমি নিজে ভিয়েতনামে গিয়েছি। গেরিলাদের প্রধান দফতরে গিয়েছি। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমি দেখেছি কেবল কোদাল, বেলচা দিয়ে ওরা মাটির নিচে আস্ত শহর গড়ে তুলেছিল। অবিশ্বাস্য! ওদের কাছে উন্নত যুদ্ধাস্ত্র ছিল না, অর্থ ছিল না, কিন্তু আমেরিকাকে দুরমুশ করে দিয়েছিল। এরও আগে, কঙ্গো বা জাইরেতেও আমেরিকা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। প্রতিরোধ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়। লম্বা প্রতিরোধে দখলদার শক্তি নাস্তানাবুদ হয়।

কেন আজকের দুনিয়াকে বুঝতে নাইন ইলেভেন জরুরি?

আমাদের পুরাণে ছিল না, দেবতারাই অসুর তৈরি করে? ঠিক তেমন আমেরিকার নয়া সাম্রাজ্যবাদই জেহাদ তৈরি করছে। ওদের দমন, ওদের অত্যাচার, ওদের লুঠপাটের ফল হচ্ছে জেহাদ। আমি জেহাদকে সমর্থন করছি না, করার প্রশ্নই নেই। কিন্তু তার বাড়বাড়ন্তের কারণগুলোকে না চিনলে হবে না। তাই ২০২১ সালের পৃথিবীতে যদি সন্ত্রাসবাদকে বুঝতে হয়, তাহলে তার উৎসকে বুঝতে হবে। একইভাবে, নাইন ইলেভেনকে বুঝতে হলে তার পরের বছরগুলোর বীভৎসতাকে বুঝতে হবে। ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান সেই নির্মম বীভৎসতার সাক্ষী। সেটাও কিন্তু সন্ত্রাসবাদই।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.