ফ্রিজে গরুর মাংস থাকলেও থাকতে পারে, এই সন্দেহে মহম্মদ আখলাককে যেদিন পিটিয়ে খুঁচিয়ে মারে তাঁরই দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী গ্রামবাসীরা, সেদিন থেকেই বোঝা গেছিল, এই সবে শুরু। আস্তে আস্তে এ হিংসার বৃত্ত বিস্তৃত হবে সারা দেশে, সংকুচিতও হবে। এসব ঘটবে ঘরের আরও কাছাকাছি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসাবে আখলাক, জুনেদ, তবরেজ, ইত্যাদি আরও শয়ে শয়ে নাম পেরিয়ে, নামকরা নিউজ মিডিয়ার প্রাইম টাইমের শো হয়ে, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির স্নাতক স্তর পেরিয়ে, আজ আমরা বলতে পারি অমৃতকালের ভারতে ঘৃণার রাজনীতি, পরজাতিবিদ্বেষের খোলাখুলি চর্চা মূল ধারায় প্রবেশ করল। একেবারে সংসদের ভিতরে, ভরা অধিবেশনের মাঝখানে।
দক্ষিণ দিল্লির সাংসদ রমেশ বিধুরীর ঘৃণাভাষণ এই প্রথমবার নয়। এর আগেও উনি শিরোনামে এসেছেন প্রায় একই কারণে এবং ঘৃণার চাষ করা সাংসদ হিসাবেও উনি একা নন। শাসক দলের বিভিন্ন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ঘুরেফিরে আসেন এই সংক্রান্ত খবরের শিরোনামে। হয় ভাষণের মাধ্যমে, নয় কাজের মাধ্যমে। আলাদা এটুকুই, এতদিন এসব হত সংসদের বাইরে সাধারণ মানুষের মাঝে, এইবারে ঘটনা ঘটেছে গণতন্ত্রের পীঠস্থানে।
গত ন বছরে দেশে যা কিছু ঘটে চলেছে, তার সঙ্গে গত শতকের তিনের দশকের নাজি জার্মানির তুলনা টানাও এখন আর নতুন কিছু নয়। পাতার পর পাতা ধরে ধরেই কপি করা হচ্ছে সেই সময়কে। দুনিয়ায় সর্বাধিক আলোচিত হলোকস্ট নিয়ে একটা কথা প্রায়ই সোশাল মিডিয়ায় ঘোরে – ‘মনে রেখো, হলোকস্ট একদিনে শুরু হয়নি। নিয়ম করে লালন পালন করা হয়েছিল।’ বীজ পোঁতাই ছিল। তাকে শুধু সার, জল দেওয়া হয়েছিল অন্তত দেড় দশক ধরে, বাড়তে দেওয়া হয়েছিল। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, সরাসরি নাজি জার্মানির সঙ্গে আজকের ভারতের তুলনা করা একরকমের অতিসরলীকরণ। সেদিনের নাজি পার্টির গভীরতা বা ব্যাপ্তি – কোনোটারই সমকক্ষ হবার ক্ষমতা, মেধা, যোগ্যতা বা পরিবেশ নেই আজকের ভারতের ফ্যাসিবাদীদের। তারা শুধু নকল করার চেষ্টা করে যেতে পারে। অমিল বিস্তর। সেদিনের জার্মানির প্রেক্ষাপট আর আজকের ভারতের প্রেক্ষাপটের, বিরোধিতার পরিসরের, বিশ্ব রাজনীতিতে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থানের। চাইলেই সেই ব্যাপ্তিতে ফ্যাসিবাদ বা গণসংহার চালানো সম্ভব নয়।
কিন্তু তবু নকল করার নিরন্তর প্রচেষ্টায় কিছু জিনিস তৈরি হয় যা সরাসরি সেইসময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
২০১৪ সালের জুন মাসে বাংলায় তখন তৃণমূল শাসনের তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেছে, তেহট্টে এক জনসভায় তৃণমূলের সাংসদ তাপস পাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকদের বাড়ির মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দেন। “ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব” কথাটা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায়। তা নিয়ে বিক্ষোভ এবং মিম বানানো – দুইই চলতে থাকে লাগাতার। তাপস ক্ষমা চাননি, ক্ষমা চান তাঁর স্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সংবাদমাধ্যমকে জানান, তাপস একটা বড় ভুল করে ফেলেছে, আমি ওকে বকে দিয়েছি। তাপসের সাংসদ পদ খারিজ হয়নি, দলের মধ্যেও আলাদা করে কোনো শাস্তি হয়নি তাঁর। আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে ঘটনাটা জনমানসে ফিকে হয়ে যায়।
ক্ষমতার ভাষ্য কীভাবে বদলে যায়, একজন আপাত নিরীহ, নম্র মানুষকেও তা কীভাবে বদলে দেয়, তাপস ছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু আমরা কেন তাঁর কথা বলছি এখানে? আসলে তাপস বিষয় নন।
তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ওই ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছিলেন, সামনে বসা সমবেত জনতা উল্লাসে চীৎকার করে উঠেছিল, হাততালিতে ভরে গেছিল তেহট্টের মাঠ। সেইসময়ের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমালোচক তাপসের বক্তব্য নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছিলেন, নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু সেই দিন, এবং তারপরেও, খুব খুব কম লোক বলেছিলেন যে আসলে তাপসের ধর্ষণ মন্তব্যের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল সামনের ওই হাজারখানেক লোকের সমবেত উল্লাস। ওই কয়েক হাজার লোক তাপসের মন্তব্যে মজা পেয়েছিল, বিরুদ্ধ রাজনীতি করা কারোর বাড়ির মেয়েদের ধর্ষিত হতে দেখার কল্পনায় অতগুলো লোক ‘মজা’ পেয়েছিল।
চেতনা নির্মাণ একটা প্রক্রিয়া। নিরন্তর প্রক্রিয়া। বিষের মত একটু একটু করে সইয়ে নিতে হয়। আস্তে আস্তে অনেক বিষাক্ত জিনিসই বৃহত্তর জনতার চোখে স্বাভাবিক লাগে, গা-সওয়া লাগে। গত বৃহস্পতিবার রমেশ বিধুরীর করা কটূক্তি ভয়ানক আপত্তিকর। বিভিন্ন মহলে, বিভিন্ন স্তরে প্রতিবাদ উঠছে, সবই ঠিক। কিন্তু খুব খুব কম লোক যা নিয়ে কথা বলছে তা হল ওই কুরুচিকর মন্তব্য শুনে বিজেপির বাকি সাংসদদের টেবিল চাপড়ে অট্টহাসি। এমনকি রমেশের ঠিক পিছনে বসা বিজেপি সাংসদ ডাক্তার হর্ষ বর্ধনের দাঁত বের করা হাসিও ক্যামেরায় দেখা গেছে। তিনি অবশ্য পরে বলেছেন, রমেশ কী বলেছেন তা তিনি ঠিকমত শুনতে পাননি। না শুনেই কী করে একদম মোক্ষম জায়গায় হেসে উঠেছিলেন তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। হয় দিতে চাননি, নয় কেউ জানতে চায়নি।
চেতনা নির্মাণের এই প্রক্রিয়া এক ধরণের সম্পূর্ণতা লাভ করে যখন সংসদ ভবনের ভিতর একজন নির্বাচিত সাংসদ আরেকজন নির্বাচিত সাংসদকে ধর্মের ভিত্তিতে করা সাম্প্রদায়িক কটূক্তি দিয়ে থামিয়ে দিতে চান এবং শাসক দলের অন্য সাংসদরা তাতে ‘মজা’ পান।
বহুচর্চিত নাজি জার্মানির সঙ্গে টানা তুলনায় ফিরে যাই একবার। গ্যাস চেম্বার আর এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্প বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প একদিনেই তৈরি হয়নি। দীর্ঘ কিন্তু সুনিশ্চিত সফল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওসবের জন্যে তৈরি করে নেওয়া হয়েছিল। ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’, ইহুদী, কমিউনিস্ট, সমকামী, এমনকি নাজি পার্টির ভিতরেও সামান্যতম সন্দেহের উদ্রেক ঘটানো সদস্যদের ‘এক্সক্লুড’ করার সরকারি প্রক্রিয়া ১৯৩৩ সালের আগে শুরু হয়নি কিন্তু। প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটিও ১৯৩৩ সালের আগে চালু হয়নি। ততদিন পর্যন্ত চলেছিল এই চেতনা তৈরির প্রক্রিয়া। ন্যাশনাল সোশালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা নাজি পার্টির সমর্থনের ভিত্তি ১৯২৮ সালে ছিল মাত্র ২%। সেই সংখ্যা ১৯৩২ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশে। তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল, পৃথিবী অন্যরকম ছিল। জার্মানির ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের লজ্জা, গ্লানি, দৈন্য আর উঠে দাঁড়াবার অদম্য প্রচেষ্টা। আরও একটা জিনিস ছিল – বিদ্বেষের বীজ।
অ্যাডলফ হিটলার সেটাকেই মাত্র চার বছরে প্রয়োজনমত সার, জল দিয়ে মহীরুহে পরিণত করতে পেরেছিলেন। সেইসময় তা সম্ভব ছিল। প্রতিবাদ বলতে কিছু ছিল না। যে কজন প্রতিবাদ করতেন এই বিষের বিরুদ্ধে, বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, তাঁদের হয় খুন হতে হত অথবা দেশ ছেড়ে পালাতে হত।
আজকের পৃথিবী একটু অন্যরকম। আজকের ভারতও। ভারতে সম্পূর্ণভাবে সেই পরিস্থিতি আসেনি, আসবেও না আশা করি। হ্যাঁ, প্রতিবাদী অনেক কণ্ঠকে বিনা বিচারে জেলখানায় আটকে রাখা গেছে, অনেককে চুপ করিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু সাড়ে ন বছরে প্রতিবাদ একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়নি। সেই কারণেই ক্ষীণ আশা রয়ে যায়, হয়ত আমরা এই অন্ধকার থেকে বেরোতে পারব একদিন।
শাসক বদলালেও এই বিষ রাতারাতি উধাও হবে না, একথাও জানা। বহুজন সমাজ পার্টির নির্বাচিত সাংসদ দানিশ আলি যে সমাজের যে স্তরের মানুষ, তাতে হয়ত এর আগে তাঁকে এভাবে সাম্প্রদায়িক কটূক্তি শুনতে হয়নি। এই ঘটনা স্বাধীনোত্তর ভারতে ব্যতিক্রমই বলা চলে। আমরা যারা দলিত নই, অচ্ছুত নই, সংখ্যালঘু নই, তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত নই, প্রান্তিক জনজাতি নই; আমরা যারা উচ্চবর্গীয়, উচ্চকোটির মানুষ, তারা এই চোরা বিষের সঙ্গে পরিচিত নই। এটা আমাদের মধ্যেই ছিল। চিরদিন। শুধু প্রকাশ্যে এই বিষ উগরে দিতে করতে কেউ সাহস পেত না অমৃতকালের আগে, এখন পাচ্ছে। যাই হোক, ক্যামেরার সামনে দানিশের প্রতিক্রিয়াকে আমার মেকি বলে মনে হয়নি।
Watch | BSP MP Danish Ali breaks down during an interview to NDTV's @saurabh_unmute over BJP MP's communal slurs pic.twitter.com/mQx8ompNVI
— NDTV (@ndtv) September 22, 2023
আমি মন দিয়ে শুনছিলাম তাঁর কথাগুলো। উনি বলছিলেন, সংসদের ভিতরে একজন নির্বাচিত সাংসদকে যখন এই ভাষায় আক্রমণ করা যেতে পারে “কেয়া চল রহা হ্যায় ইস দেশ মে!” তাঁর সৎ প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে দেয়, একজন নির্বাচিত সাংসদ হিসাবে উনি সত্যিই জানতেন না এই দেশে কী চলছে। ব্যক্তিগত অপমানের থেকেও একজন নির্বাচিত সাংসদ এই কটূক্তির শিকার – এটাই তাঁকে অনেক বেশি পীড়া দিয়েছে। দেশজুড়ে যা চলছে, তা সেভাবে তাঁকে কষ্ট দিয়েছে কিনা আমরা জানি না। আসলে ওই বিষ সইয়ে নেবার প্রক্রিয়া আমাদের সবার চোখে অনেক কিছুকে স্বাভাবিক বলে স্বীকার করিয়ে নেয়। সেভাবেই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় প্রান্তিক মুসলমানকে নির্মমভাবে পেটানো, দলিত হত্যা, অচ্ছুতের অপমান। যতক্ষণ না সে অপমান আমার গায়ে এসে লাগছে, যতক্ষণ না আগুনের আঁচ আমাকে পোড়াচ্ছে, ততক্ষণ অবধি আমার জানাই হয় না – “কেয়া চল রহা হ্যায় ইস দেশ মে”। দেরিতে হলেও তিনি জানতে পেরেছেন, এইটুকুই আমাদের প্রাপ্তি।
আরো পড়ুন ট্রেন থেকে হরিয়ানা: জান হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে নাকি?
আমরা জানতে পারি কারা কারা এগিয়ে এসেছেন তাঁর সমর্থনে, সহমর্মিতায়। দানিশ বহুজন সমাজ পার্টির একজন নির্বাচিত সাংসদ। তাঁর পার্টির সুপ্রিমো কুমারী মায়াবতী। তাঁর তরফ থেকে ঘটনার নিন্দা করে একটা টুইট এসেছে শুধু। সে টুইটের ভাষা স্পিকার ওম বিড়লার থেকেও মোলায়েম। এর বাইরে বিএসপি দলের পক্ষ থেকে কোনো বিক্ষোভ, কোনো মিছিল, কোনো অবস্থানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। বিএসপি দলটা ইন্ডিয়া জোটে নেই, তারা আপাতত ‘একলা চলো’ নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু দানিশের পাশে দাঁড়িয়েছেন একের পর এক ইন্ডিয়া জোটের মুখ। এসেছেন রাহুল গান্ধী, মুখ খুলেছেন মহুয়া মৈত্র – তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আগুনঝরা ভাষ্যে। সহমর্মিতা জানিয়েছে সমাজবাদী পার্টিও।
সংসদের বিশেষ অধিবেশন শুক্রবারই শেষ হয়ে গেছে। স্পিকার ওম বিড়লা শেষ দুদিনে দানিশের সঙ্গে দেখা করার সময় পাননি। তিনি কেবল রমেশকে সতর্ক করেছেন, সংসদের রেকর্ড থেকে কটূক্তিগুলি সরিয়ে দিয়েছেন (যাকে ইংরেজিতে বলে ‘এক্সপাঞ্জ’ করা) আর রমেশকে শোকজ নোটিস ধরিয়েছেন। এর পর ডিসেম্বরে শীতকালীন অধিবেশনের আগে আর সংসদের ঘুম ভাঙবে না। ততদিনে আমরা নতুন কোনো বিষয় পেয়ে যাব, এটা ভুলে যাব, বিষ সয়ে যাবে। গণতন্ত্রের পীঠস্থানে স্বচ্ছন্দে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চাষ হতে আর বাধা থাকবে না।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।