“পাগল নাকি, ভাই! মিষ্টি-টিষ্টি কিছু নিয়ে আসতে পারি। বিরিয়ানি পারব না। গোস্তের কথা তো ভুলেই যান। শেষে জান দিয়ে দেব নাকি!”
বছর কয়েক আগে বিহারের এক মুসলমান বন্ধুর কাছে আবদার করেছিলাম যে ঈদের পরে যখন ও বাড়ি থেকে আসবে, তখন যেন ওর মায়ের হাতে তৈরি বিরিয়ানি ও গোস্ত নিয়ে আসে। সেই আবদারের এই ছিল উত্তর।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তার কয়েক বছর আগে ট্রেনের মধ্যে গোমাংস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে জুনেইদ নামে হরিয়ানার এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তার সঙ্গী দুজন আহত হয়েছিলেন। বন্ধুর এই উত্তরে সেদিন বুঝেছিলাম, গোমাংস সন্দেহে হত্যার ঘটনার ঘা এ দেশের বহু মুসলমান নাগরিকের মনে কেমন দগদগে হয়ে রয়েছে। কতখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তাঁরা। এটা বাইরে থেকে সবসময় বোঝা যায় না। অন্ধ হিন্দুত্ববাদীরা এই নিরাপত্তাহীনতার কথা বললে ফুৎকারে উড়িয়ে দেন। কিন্তু কারোর অভিজ্ঞতাকে মিথ্যে বলব কীভাবে?
জানি না ২০২৩ সালের ১ অগাস্টের পরে সেই বন্ধু ট্রেনে রান্না করা মাংস নিয়ে আসা দূরে থাক, এমনি যাতায়াত করতে ভয় পাবে কিনা। কারণ ভারতবর্ষের অধিকাংশ জায়গায় তাকে কার্যতই জান হাতে করেই ঘুরতে হয় এবং হবে। মাথায় ফেজ টুপি পরলে আর গালে দাড়ি রাখলে তো আর কথাই নেই। জয়পুর থেকে মুম্বাইগামী ট্রেনে যাত্রীদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা যাদের, সেই রেল সুরক্ষা বাহিনীর এক জওয়ান গত ৩১ জুলাই ভোররাতে চারজনকে ট্রেনের মধ্যেই গুলি করে খুন করেছে।
আপাতদৃষ্টিতে জওয়ানদের নিজেদের সার্ভিস রিভলভার বা বন্দুক থেকে গুলি চালানোর ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু চেতন সিং নামে এই আরপিএফ জওয়ান যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। প্রথমে সে তার ঊর্ধ্বতন কর্তাকে গুলি করে মেরেছে, তার পরে বেছে বেছে তিনজন যাত্রীকে মেরেছে, যাঁরা ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান।
অনেকেই বলতে পারেন, মৃতদের ধর্মীয় পরিচয় টেনে এনে ঘটনাটাকে কলুষিত করার কী দরকার! কখনো কখনো বোধহয় ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে ঘটনার বিচার করা দরকার পড়ে। যতই আরপিএফের তরফে এবং পরবর্তী সময়ে মিডিয়া রিপোর্টে চেতনের মানসিক স্বাস্থ্য, ছুটি না পাওয়ার কথা বারবার করে বলা হোক। যতই এই গুলি চালানোর পিছনে তার মানসিক অস্থিরতার কথা তুলে ধরার চেষ্টা হোক, গভীরে গেলে বোঝা যায় ঘটনাটা কেন ভয়ঙ্কর। সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনেই প্রকাশ পেয়েছে, চেতন শুধুই যে তার ঊর্ধ্বতন অফিসারের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজের বসসমেত আশেপাশের সবাইকে গুলি করে মেরেছে তা নয়। সে বিভিন্ন বগিতে গিয়ে বাছাই করে তিনজনকে গুলি মেরেছে।
গুলি চালানোর পর চেতন মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার সামনে কিছু কথা বলে। সেখানে সে বলে, পাকিস্তান থেকেই এদের (এ দেশের মুসলমানদের) পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের মিডিয়া এটাই দেখাচ্ছে। ওরা সব জানতে পারছে। ওদের বস ওখানেই বসে। যদি ভারতে থাকতে হয়, তাহলে আমি বলব, মোদি আর যোগী দুজন আছে, আর আপনাদের (অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের) ঠাকরে।
সরকারি নির্দেশে এই ভিডিও ইন্টারনেট থেকে গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। তা ভালই হয়েছে। এমন ঘৃণার বার্তা ভাইরাল হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাতে মূল ঘটনাটাকে ধামা চাপা দেওয়া যায় না। আরপিএফ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই চেতনের ঠিক কী মানসিক অসুস্থতা ছিল তা বলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। প্রেস বিবৃতির বয়ান পাল্টাচ্ছে। মুসলমানবিদ্বেষ থেকে কী হতে পারে তা এই ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে। রোজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিউজ চ্যানেলগুলোতে যে বিদ্বেষ ছড়ানো চলতে থাকে বা যে বিদ্বেষমূলক সংবাদ পরিবেশন হয়, চেতন তার পরিণতি দেখিয়েছে। সোশাল মিডিয়া জুড়ে যে হিংসার বীজ পোঁতা হয় পোস্টে পোস্টে, তার কী পরিণতি হতে পারে, দেখিয়ে দিল চেতন।
নির্দিষ্ট একটা ধর্মের মানুষদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ছড়ানো এবং তাতে সরব বা নীরব সমর্থন করে শাসক দলের নেতারা যে সমাজ তৈরি করছেন, চেতন তার পরিণতি দেখিয়ে দিয়েছে। বিশেষ ধর্মের সমর্থন আদায়ের নামে কয়েকটা রাজনৈতিক দলের কিছু প্রতীকি তোষণকারী নীতি ও আচরণ পালন সেই ধর্মের সাধারণ মানুষের কী হাল করে, চেতন তার কার্যকলাপ দিয়ে তাই প্রমাণ করল।
কিছু পূর্বপুরুষ এবং কিছু মৌলবাদীর কৃতকর্মের ফল কেন একটা গোটা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পোহাতে হবে – তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা কারোর কাছে আছে কি? এই ঘটনায় মৃত আব্দুল কাদার মহম্মদ হোসেন ভানপুরওয়ালা, আসগর আব্বাস আলি বা সইফুদ্দিন মঈনুদ্দিনদের কি কোনো জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত থাকার প্রমাণ ছিল? নাকি তাঁরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন? তাঁরা আমার আপনার মত সাধারণ নাগরিকই ছিলেন। তবু চেতনের বন্দুকের গুলিতে জান দিতে বাধ্য হলেন।
যদিও এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েসি এই ঘটনাকে জঙ্গি হানার সঙ্গে তুলনা করেছেন, এখানে কিন্তু সংগঠিত কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে চেতনের যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। চেতন এককভাবেই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। সেটাই আরও ভয়ঙ্কর। এর আভাস কি আমরা পাইনি? অনেকের মনে থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। কারণ আমাদের স্মৃতি খুবই দুর্বল।
বছর দেড়েক আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বিশাল ঝা, শ্বেতা সিং, মায়াঙ্ক রাওয়াত, ওমকারেশ্বর ঠাকুর, নীরজ বিষ্ণোই নামে কয়েকজন যুবক-যুবতীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘বুল্লি বাই’ নামে একখানা অ্যাপ তৈরি করে দেশের বিভিন্ন মুসলমান মহিলাদের (মূলত নাগরিক সমাজে পরিচিত মুখ যাঁরা) ছবি দিয়ে তাঁদের নিলামে তোলার।
আরো পড়ুন বুল্লি বাই — শুধু সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগুরু মানুষেরও অপমান
এরাও কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিল না। কোনো সংগঠনের সঙ্গেও নয়। এরা এক জায়গাতেও থাকত না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। এদের মধ্যে পূর্বপরিচয়ও ছিল না। কিন্তু তীব্র মুসলমানবিদ্বেষ থেকে তারা এই অ্যাপ চালু করে বা এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এদের একজনের বাবা-মায়ের বয়ানেই সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, সেই অভিযুক্ত জাতীয় টিভি চ্যানেলে প্রাইম টাইমের বিতর্কসভা দেখতে ভালবাসত।
সেটা ছিল মুসলমান মহিলাদের প্রতি অনলাইন হামলা। সেই খবরের সূত্রেই জানা গিয়েছিল এই সংবাদ, যে এই ধরনের প্রবণতাকে পুলিস ও প্রশাসন আগেও অবহেলা করেছিল। কারণ তার বছরখানেক আগে মুসলমান মহিলাদের ছবি দিয়ে তাদের নিলামে তোলার জন্য একই রকমের অ্যাপ এই অভিযুক্তদের মধ্যেই কয়েক জন তৈরি করেছিল, যার নাম ‘সুল্লি ডীলস’। তখনই আশঙ্কা ছিল, এই বিদ্বেষ যদি অনলাইন থেকে অফলাইনে চলে এলে কী হবে? ঘৃণার প্রকাশ যদি রাস্তাঘাটে দেখা যায়! সেই আশঙ্কা আজ বাস্তব।
একক হামলাবাজরা এবার অনলাইন থেকে অফলাইনে চলে এসেছে। তাতে মানুষের প্রাণও যেতে বসেছে। কারণ এই সংকেতগুলো নিয়ে আমরা বিশেষ ভাবনাচিন্তা করিনি, কোনো ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নিইনি। এদের কোনো সংগঠনের সাহচর্যের দরকার পড়ছে না। উগ্র সংগঠনগুলোর নেতাদের আস্ফালন, জ্বালাময়ী বক্তৃতাই এদের উদ্বুদ্ধ করছে এবং তারা এবার অস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমে পড়ছে। এখনো যাঁরা ভাবছেন এই চিন্তা ও যোগসূত্র বাড়াবাড়ি, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। তাঁরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এগুলোকে অবহেলা করতে চাইছেন শুধু।
দেশে একদিকে যেমন একক হামলার ঘটনা ঘটছে, যুগপৎ সংগঠিত উস্কানি এবং হামলার ঘটনাও ঘটছে। দুদিক দিয়ে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্বকেই দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে। অস্তিত্বের লড়াইয়ে ফাঁদে পা দিচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একাংশ।
সংগঠিত সাম্প্রদায়িক উস্কানির সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হরিয়ানার মেওয়াত অঞ্চলে বা নুহতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। বজরং দলের জলাভিষেক যাত্রা থেকে সেই সংঘর্ষের শুরু। এর আগেও তিন বছর ধরে একই জায়গা দিয়ে ব্রজমণ্ডল যাত্রা গেছে, কিন্তু কোনো সংঘর্ষের ঘটনার কথা শোনা যায়নি। এবার হিংসা হয়েছে দুপক্ষের তরফেই এবং হরিয়ানার বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি দিল্লির খুব কাছেই গুরুগ্রামের কয়েকটা জায়গাতেও সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানেও উঠে এসেছে প্রশাসনের অবহেলার কাহিনী।
এই যাত্রার আগে মনু মানেসর নামে হিন্দুত্ব ব্রিগেডের এক নেতা সোশাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। সেই ভিডিওতে তিনি তাঁর অনুগামীদের এই ব্রজমণ্ডল যাত্রায় যোগ দিতে বলেন। তিনি নিজেও সেখানে উপস্থিত থাকবেন বলেন জানান। কে এই মনু?
গত বছর এই মেওয়াত অঞ্চলেই গোরক্ষকদের হাতে নাসির ও জুনেইদ নামে দুই রাজস্থানের বাসিন্দাকে মরতে হয়েছে। সেই হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত মনু। খাতায় কলমে তিনি ফেরার, কিন্তু বিদ্বেষমূলক ভিডিও পোস্ট করতে ওস্তাদ। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরে তিনি জানান যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের নেতাদের অনুরোধে তিনি সেই যাত্রায় যাননি। কিন্তু ভিডিও পোস্ট করেই তিনি যা করার করে দিয়েছেন।
শুধু এই ঘটনার আগেই নয়, মনু ফেরার হয়েও একইভাবে বিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছেন অনবরত। কেউ তাঁকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। তাঁর অনুগামী ও সহযোগীরাও কম বিদ্বেষ ছড়ান না। নাসির ও জুনেইদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টা সামনে আসার পরে হিন্দুত্ব ব্রিগেডের নেতারা হরিয়ানায় নানা জায়গায় মহাপঞ্চায়েত বসান। সেখানে যে ভয়ঙ্কর মুসলমানবিরোধী বক্তব্য রাখা হয়, সেসব শুনলে শিউরে উঠতে হয়। সেখানেও তলোয়ার দেখিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সবক শেখানোর ডাক উঠেছিল।
পাল্টা অভিযোগ যে স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক মামান খান মনুকে পেঁয়াজের খোসার মতো ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। এহসান মেওয়াতি নামে এক পাকিস্তানি ইউটিউবারও নাকি ভিডিও করে বলেছিলেন, ভাইসব, মনু মানেসর আসছে। হয় মারো নয় মরো।
গত কয়েক বছর ধরেই মেওয়াতে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। এ সব পুলিস, প্রশাসন এবং রাজনীতিকদের জানাও ছিল। তবু এমন একটা যাত্রার সময়ে জেলার এসএসপি ছুটি নিয়েছিলেন। পাশের জেলার পুলিসকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংঘর্ষের ঘটনার পরে হরিয়ানার উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্মন্ত চৌতালা বলছেন, মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা কোন রাস্তা দিয়ে মিছিল যাবে সে বিষয়ে প্রশাসনকে ঠিকভাবে জানায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ বলছেন, হিংসা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর বলছেন, সবাইকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
পূর্বপরিকল্পিত তো বটেই। কারণ এই সাম্প্রদায়িক হিংসা সংগঠিত করা হয়েছে। এমনটাই হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কখনো কখনো ঠিক নির্বাচনের আগে। সামনেই রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচন, হরিয়ানার মেওয়াত রাজস্থান লাগোয়া অঞ্চল। হিন্দুত্ববাদীরা এই দাঙ্গায় মেরুকরণের ফায়দা তুলতে উদ্যোগী হবেই। কিন্তু যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সবাইকে রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন বুঝে নিতে হবে তিনি ও তাঁর সরকার অপদার্থ। নয়ত এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে তাঁর সমর্থন রয়েছে। সময় থাকতে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
আসল কথা হল, হিন্দুত্ববাদীরা চায় মুসলমান সম্প্রদায় এ দেশে থাকুক, কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে। চুপ করে থাকতে হবে। এতদিন একদল রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনে মাথা উঁচু করে ছিল, এবার মাথা নিচু করে থাকুক। যদি গোটা দেশের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন মুসলমান সংগঠন হোক বা আম জনতা, কেউ আর জোরালো প্রতিবাদ করছে না। ওই ওয়েসির মত কেউ কেউ গলা তুলছেন। তবে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েও অনেকে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
গোটা দেশের রাজনীতিই এখন একমুখী, বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশের জ্ঞানবাপী মসজিদের পুরাতাত্ত্বিক সার্ভের আগেই ঘোষণা করে দেন যে এটাকে মসজিদ বলা ভুল হবে, এর ভিতরে ত্রিশূলের ছবি কীভাবে এল? সেখানে জ্যোর্তিলিঙ্গ রয়েছে, মূর্তি রয়েছে। কাজেই তিনি চান মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষই প্রস্তাব নিয়ে আসুক, বলুক যে ঐতিহাসিক ভুল হয়ে গেছে এবং সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা হবে। সেখানে তাঁর অনুগামীরা মনে বল তো পাবেনই।
দেশের সর্বোচ্চ নেতা যেখানে এই সব সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নিয়ে মাথাই ঘামান না, কোনো মন্তব্য করেন না এবং বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন প্রশ্ন শোনেন, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ, কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলেন যে সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। তাঁর সরকার মুসলমানদের নাগরিক অধিকার নিয়ে কী করছে? তিনি আশ্চর্য হন। তিনি বলেন গণতন্ত্র আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে। আমাদের সরকার সংবিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। সেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতের বিচারে কারোর সঙ্গে কোনোরকম বৈষম্য করা হয় না। শুনিয়ে দেন, তাঁর সরকার ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ তত্ত্ব মেনে চলে। সেখানে সরকারি সুযোগসুবিধায় সবার সমান অধিকার রয়েছে।
কিন্তু ফলিত স্তরে সেই অধিকারের প্রয়োগ কোথায়? বরং বিদ্বেষের পরিবেশই গ্রাস করছে ভারতীয় সমাজকে। গত নয় বছরে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’-র মত জাতীয় সংহতির প্রচার কোথাও হয়েছে কি? জাতীয় সংহতি নিয়ে জোরালো আলোচনা হয়েছে সরকারের তরফে?
তার বদলে আমরা দেখছি এককভাবে কেউ অস্ত্র তুলে নিচ্ছে মুসলমানদের মারার জন্য, কেউ আবার সংগঠিত সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। দেশ আরও বিভক্ত হচ্ছে দিনে দিনে। অবিশ্বাস বাড়ছে।
আমি শুধু ভাবছি এই সেদিনও রমজান মাসে এক নামকরা মসজিদের সামনে দিয়ে নামাজ পড়তে আসা মুসলমান নাগরিকদের মাঝখান দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু উত্তর ভারতে শিবের মাথায় জল ঢালতে যাওয়া হিন্দু নাগরিকদের মাঝখান দিয়ে এক ফেজ টুপিধারী নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারবেন তো? আমিও কি মসজিদের সামনে দিয়ে নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারব অদূর ভবিষ্যতে? নাকি এই বিদ্বেষের পরিবেশে আমাকেও আমার বন্ধুর মতো ‘জান হাতে’ করে ঘুরতে হবে?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
অসাধারণ, অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো
[…] আরো পড়ুন ট্রেন থেকে হরিয়ানা: জান হাতে নিয়ে ঘুরত… […]