সুমিত দাস

অধুনালুপ্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের অভিযোগটি মারাত্মক ছিল। তিনি বলেছিলেন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে যেদিন পুলওয়ামায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়, সেদিন জিম করবেট জাতীয় উদ্যানে শুটিং করতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সত্যপালকে বলেছিলেন তাঁদের মৃত্যুর আসল কারণ যে সরকারি গাফিলতি তা নিয়ে মুখ না খুলতে। উদ্দেশ্য বোঝা শক্ত নয়। ঘটনাটিকে নির্বাচনের আগে একটি ইভেন্টে পরিণত করা এবং সেনাদের মৃত্যুকে ভোটের ইস্যুতে বদলে ফেলা, যাতে রাজনৈতিক মুনাফা হয়। তা করতে বিজেপির সময়ও লাগেনি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এবারের ছবিটা একেবারে উল্টো। বুধবার নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার ঘনিষ্ঠ আরেক নিষিদ্ধ সংগঠন দ্য রেজিস্টেন্স ফ্রন্টের (TRF) সঙ্গে সংঘর্ষে দুই সেনা জওয়ান ও এক পুলিসকর্মী প্রথমে আহত হন, পরে চিকিৎসা চলাকালীন তাঁদের মৃত্যু হয়। কর্নেল মনপ্রীত সিং, মেজর আশিস ধোনচাক এক জওয়ান ও জম্মু-কাশ্মীরের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ হুমায়ুন মুজামিল ভাট নিহত হলেন। রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট ঘটনার দায় স্বীকার করল। এমন ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখবে, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা ঘটল না। কারণ জি২০ শীর্ষ বৈঠকের সাফল্য উদযাপনে ব্যস্ত রইলেন মোদী এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

তাহলে কি অতীতের “দেশ কি সুরক্ষা খতরে মে হ্যায়” জিগির তোলার রাস্তা থেকে সরে এসে স্রেফ মোদীর সাফল্য দিয়েই আসন্ন ভোটে জেতার পথটুকু ডিজাইন করে ফেলেছে বিজেপি? আর সে ডিজাইনে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যু ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়? নাকি ঘটনার আকস্মিকতাকে স্রেফ পাত্তা দিল না বিজেপি? সাফল্যের জি-২০ থেকে বিশ্বগুরু তকমা পাওয়ার, অন্তত প্রচারটুকু পাওয়ার শুভক্ষণটিতে ‘পাকিস্তান’ বা ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ ইত্যাদি পরিচিত রাজনৈতিক শব্দ বা শব্দবন্ধ সরিয়ে রেখে মোদীর নয়া ভাবমূর্তি নির্মাণকেই গুরুত্ব দিল বিজেপি!

স্বাভাবিকভাবে এই অপ্রত্যাশিত, বিসদৃশ আচরণে বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি প্রাক্তন সেনাকর্তারা রীতিমত ক্ষিপ্ত। সোশাল মিডিয়াতেও তীব্র সমালোচনা দেখা গেল। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের রাজ্যসভার সাংসদ মনোজ ঝা সোজাসুজি প্রধানমন্ত্রীকে “অসংবেদনশীল” বললেন। মিডিয়ায় জওয়ানদের মৃত্যুর খবর এবং মোদীর জি-২০ উদযাপন পাশাপাশি দেখে তাঁর বক্তব্য, “দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রীর উৎসব অন্যদিন হতে পারত না?” সোশাল মিডিয়ায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর পবন কুমার প্রশ্ন তুললেন, “এঁরা কী করে নিজেদের দেশপ্রেমিক বলেন?” বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত মিস্টার মোদীর এক্স হ্যান্ডেলটি ছত্তিসগড় ও মধ্যপ্রদেশের ভোটপ্রচারের ভিডিওতে ভরে রয়েছে, কিন্তু জওয়ান মৃত্যু নিয়ে একটি বাক্যও দেখা গেল না। শৌর্যচক্র পাওয়া মেজর কুমার লিখেছেন, “রাজনীতিবিদ মারা গেলে জাতীয় শোক ঘোষিত হয়। কাল আমরা একজন কর্নেল, একজন মেজর এবং একজন পুলিস অফিসারকে হারিয়েছি আর বিজেপির হেডকোয়ার্টারে আনন্দ উদযাপন চলছিল। এটা বিরক্তিকর এবং অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।” তিনি পুলওয়ামার ঘটনাও উল্লেখ করেছেন।

বিরোধী, প্রাক্তন সেনাকর্তাদের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। ঘটনা পরম্পরায় সাযুজ্য নেই, আবার তা কাকতালীয়ও নয়। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে সশস্ত্র বাহিনীর লোকেদের মর্মান্তিক মৃত্যু আর নয়া খ্যাতির উদযাপনের দিনে স্পিকটি নট প্রধানমন্ত্রী জঙ্গি হামলার বিষয়টিকে একেবারেই সরিয়ে রাখলেন নাকি খানিক সময় নিলেন? নাকি মৃত্যুর ভর ও ভার উদযাপনের ওজনকে টপকাতে যথেষ্ট নয়? বিজেপি সদুত্তর দেবে কিনা তা সময় বলবে। তবে গোটা ব্যবস্থাটি যে কৌশলগত তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

আরো পড়ুন ট্রেন থেকে হরিয়ানা: জান হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে নাকি?

আপাতত এই অচেনা ও নতুন বিতর্কের মাঝে একটি তথ্য ভাসছে। এখন থেকে জওয়ানদের দিয়ে সরকারি প্রকল্পের প্রচার করাবে কেন্দ্র। এ বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী নির্দেশিকাও জারি করেছে। সমাজে, ট্রেনে-বাসে, মহল্লায় সেনা জওয়ানদের আলাদা গুরুত্ব তো আছেই। সেই গুরুত্বও বিজেপি সরকার ব্যবহার করতে চায়। ষাট দিনের সবেতন ছুটিতে সেনাকর্মীরা প্রচারে নামলেন বলে। কেউ কেউ বলছেন, মহাজোট ইন্ডিয়ার চাপে কেন্দ্রের বকলমে বিজেপির প্রচার করতে নামানো হচ্ছে জওয়ানদের। এতে সেনাবাহিনী নিয়ে জনতার আবেগও কাজে লাগানো যাবে। সিপিএম সহ নানা দল এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলছে ওয়াকিবহাল মহল। কিন্তু তাতে কী? ২০২৪ সালের ভোটের পথ সাংবিধানিক রীতিনীতি ভেঙেই তৈরি করছে বিজেপি। সেনাবাহিনী সরকার বা বিজেপির গুণগান গাইছে – এই দৃশ্য অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য। কিন্তু ভোট বাজারে কার্যকরী করতে কসুর করবে না মোদী সরকার।

একথা পরিষ্কার যে সেনাবাহিনীকে এবার গণতান্ত্রিক ভারতে নতুনভাবে ব্যবহার করা হবে। চন্দ্রযান মিশন ও জি-২০ শীর্ষ বৈঠকের সাফল্যের পর বিশ্বগুরু মোদীই তুরুপের তাস। নতুন সংসদ ভবন, ন্যায় সংহিতার রূপকার মোদী – এই ভাবমূর্তিরই পাকাপাকি নির্মাণ চলছে। সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষে পাকিস্তানের হাত থাকবে তা প্রতিষ্ঠিত। অতএব সময় নষ্ট নয়। বরং এতে সীমান্ত পেরিয়ে আক্রমণ বা নিরাপত্তার বিষয়টিতে জবাব দিতে গেলে ভাবমূর্তি নির্মাণ ব্যাহত হতে পারে।

জম্মু-কাশ্মীরে বুধবারের ঘটনার পর শুক্রবার মণিপুর পুলিস জানাল, চারমাসের সংঘর্ষে সেখানে ১৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, ১১০৮ জন আহত, ৩২ জন নিখোঁজ, ৪৭৮৬টি বাড়ি ভেঙেছে, ৩৮৬টি ধর্মস্থান ধূলিসাৎ হয়েছে। এক্ষেত্রেও বিরোধীদের লাগাতার সমালোচনার পর নমো নমো করে মুখ খুলেছিলেন মোদী। ঘটনা পরম্পরা ও মোদী সহ বিজেপির অবস্থান হয়ত ইঙ্গিত করছে যে দাঙ্গা, মৃত্যু, সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষ যা-ই ঘটুক না কেন, উগ্র জাতীয়তাবাদ বাদ দিয়ে এক দশক ক্ষমতায় থাকা বিজেপি-আরএসএসের সরকার রূপকার মোদীর খ্যাতি সামনে রেখেই নির্বাচনে আসছে। ধরেই নিচ্ছে, মুসলমানবিদ্বেষ এবং পাকিস্তানবিদ্বেষের ফলাফল তারা এমনিতেই পাবে। এটাও মোদীর ক্যারিশমা। এই কৌশল বিজেপির জন্য বড্ড ঝুঁকির নয় কি? হয়ত তাই। তবে তা সময়ে বোঝা যাবে। আপাতত ইন্ডিয়া জোটের জন্য রইল সেনা মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ না করার জন্য তীব্র বিরোধিতার খোলা মাঠ। জঙ্গি হামলা সবদিক থেকেই ব্যর্থতার, তিনজনের মৃত্যু সে ব্যর্থতাকে বহুগুণ করে। জি-২০ সম্মেলনের সাফল্য উদযাপন দিয়ে এ ব্যর্থতাকে যদি বিন্দুমাত্র ঢাকা যায় বা সরিয়ে রাখা যায় – তাতে দেশজুড়ে জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের লাভই হবে।

কিন্তু খুব কি সহজ বিষয়টি? তাছাড়া বিশ্বগুরু নির্মিত ‘শান্তিপূর্ণ’ জম্মু-কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদ ভ্যানিশ হলেও পরিস্থিতি বিজেপির পক্ষে যাবে, না হলেও? এখানেই ইন্ডিয়া জোটকে বিরোধিতার কাজটা করতে হবে।

একটি কথা বড় বেশি পরিষ্কার। শোকের চেয়ে উৎসব বেশি করে দেখাতে চায় বিজেপি। পুলওয়ামার ষড়যন্ত্র বহু মানুষের কাছে সত্য। সত্য মণিপুরের দাঙ্গা, সত্য গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘু নিধন, দলিতদের উপর অত্যাচার, সংবিধান বদলে ফেলার মতলব, এক দেশ এক নির্বাচনের নামে নানা রাজ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার হরণের চেষ্টা। তালিকা দীর্ঘ। পাকাপাকি হিন্দুত্ববাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে থাকা একদা আরএসএস প্রচারক প্রধানমন্ত্রী ফেলে আসা দশটা বছরের রিপোর্ট কার্ড স্বয়ং দেবেন। শোক নয়, উৎসব চাই, উৎসব। “চন্দ্রযান হামনে কিয়া কি নেহি কিয়া” বা “জি -২০ হামনে কিয়া কি নেহি কিয়া” – রাজার প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ না বললে সমস্যা। কিন্তু এসবে কি ভুলবেন শহিদ হওয়া জওয়ান আর পুলিসকর্মীর সহনাগরিকরা? আসন্ন উৎসবের পেরিয়ে ঘনিয়ে আসবে ভোট, উত্তর পাওয়া যাবে তার পরে। ততদিন বহু পথ পার করা ভারতের সব সাফল্য মিস্টার মোদীর। ব্যর্থতা তো অভিযোগমাত্র, তুচ্ছ বিষয়। যেমন জঙ্গি হামলায় সেনা, পুলিসকর্মীর মৃত্যু। সনাতনী রাজতন্ত্রে পেয়াদা মরবেই, মরেই থাকে।

নিবন্ধকার সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। প্রায় ২৫ বছর ধরে লেখালিখি করছেন। পেশাদার জীবনে অধিকাংশ সময় টিভি নিউজে কাজ করেছেন। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.