গত ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর বীরভূম জেলার লাভপুরের হাঁসুলি কৃষি সংস্কৃতি পাঠশালায় ‘নদী বাঁচাও – জীবন বাঁচাও’ আন্দোলনের উদ্যোগে হয়ে গেল পরিবেশ রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ শিবির। ১০-২৪ সেপ্টেম্বর পক্ষকালব্যাপী নদী বাঁচাও অভিযানের অঙ্গ হিসাবেই এই প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন। সেখানে উঠে এল দেশের নানা প্রান্তে নদী দখল, পরিবেশ ধ্বংসের কথা। উঠে এল সংকটের আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক। যোশীমঠের ভয়াবহ বিপদ; ছত্তিসগড়ে নদী বেচে দেওয়া; ঝাড়খন্ড, ওড়িশায় নদীর বিপন্নতা থেকে শুরু করে এই রাজ্যের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা; আড্ডা, গানের মাধ্যমে মত বিনিময় করলেন শিবিরে অংশগ্রহণকারীরা। প্রকৃতি-পরিবেশকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে লোকসংস্কৃতি। কথা ও গানে সেই বার্তা দিলেন লোকশিল্পীরা। কোনো শিল্পী আবার তাঁর কাজে তুলে ধরলেন গঙ্গা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিচারিতা। নদী কর্মীরা দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা পরিবেশ আন্দোলন, সেগুলিতে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের কথা বললেন। মাঠেঘাটে কাজ করা কর্মীদের কথায় ছিল মাটির গন্ধ। শিবিরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল স্থানীয় গ্রামবাসীদের, বিশেষত মহিলাদের, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
শিবিরে পরিবেশ আন্দোলনের রাজনীতি নিয়ে নানা মত উঠে এল। কেউ মার্কসবাদের আলোকে ব্যক্তি মালিকানার বিকল্পে সামাজিক মালিকানার কথা বললেন। কেউ আবার বললেন মার্কসবাদও পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীন বা মার্কসবাদকে ইউরোপীয় সামাজিক বিবর্তনের স্তর কাঠামোয় আবদ্ধ বলে দুষলেন। তবে কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ, তাদের সহায়ক হিসাবে রাষ্ট্রের ভূমিকা, প্রাকৃতিক সম্পদের সামূহিক বা সামাজিক মালিকানা কেড়ে নেওয়ার বিরোধিতায় সকলেই সরব ছিলেন। সরব ছিলেন পুঁজিনির্দেশিত উন্নয়ন মডেলের বিরোধিতায়। এই বিরোধিতা আর বিকল্প পথ নির্মাণের জন্যই প্রয়োজন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির। ক্ষমতা দখল বা আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি নয়, প্রতিরোধের রাজনীতি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আরো পড়ুন আদানির বন্দর নির্মাণ: কমিউনিস্ট উন্নয়ন-ভাবনার সংকট
প্রশিক্ষণ শিবিরে দেশের নদী ও পরিবেশ আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বললেন যে, প্রাকৃতিক সম্পদকে সামূহিক বা সকলের সম্পদ বলে রাষ্ট্র মানে না। রাষ্ট্রের মতে এগুলি হয় ব্যক্তিগত সম্পদ, না হলে তার নিজের সম্পদ। যুগ যুগ ধরে গ্রামের জল, জমি, জঙ্গল, পাহাড়কে নিজেদের মনে করে যারা জীবনযাপন করে আসছিলেন তাঁরাই আজ বিপন্ন। কারণ সামূহিক সম্পদকে রাষ্ট্র তুলে দিচ্ছে বড় বড় কোম্পানির হাতে। আলোচনায় কেউ কেউ তুলে ধরলেন, উন্নয়নের রথের চাকায় পিষ্ট হওয়া আদিবাসী-মূলবাসী জনগোষ্ঠীর বিপন্নতার কথা। কোনো এক পেটোয়া কর্পোরেট সংস্থাকে কয়লা পুড়িয়ে বানানো বিদ্যুৎ বিদেশে রপ্তানি করে ব্যবসার সুযোগ করে দিতে ঝাড়খন্ডে আদিবাসীদের জমি কাড়া হয়, সেই বিদ্যুৎ রপ্তানি করার সংবহন লাইন নিয়ে যাওয়ার জন্যে পশ্চিমবঙ্গে আমবাগান ধ্বংস করা হয়। আবার সেই বিদ্যুতের জন্য কয়লা আনতে সুদূর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে খনি নির্মাণ করা হয়। পরিবেশ ধ্বংস আর মানুষকে উচ্ছেদ করার এই তথাকথিত উন্নয়ন মডেল আজ বিশ্বজনীন। পুঁজির এই বিশ্বজনীন চরিত্রকে অস্বীকার করে বিকল্প উন্নয়নের দিশা খুঁজতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বা রাষ্ট্রীয় সীমানার বিভাজন করলে প্রতিরোধের রাজনীতি গড়ে ওঠে না।
রাজনীতি বললেই মনে হয় কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা দখল বা আধিপত্য বিস্তারের কলাকৌশল। কিন্তু গণপরিসরে প্রতিরোধও যে আবশ্যিকভাবেই রাজনীতি এবং রাজনীতি নিরপেক্ষ বলে যে কিছু হয় না সেকথা আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কর্পোরেট ও তার তল্পিবাহক রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ না করে বা এড়িয়ে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কি আদৌ সম্ভব? পরিবেশের রাজনীতিকে এইসব প্রশ্নের সমাধান করেই এগিয়ে চলতে হয়। না হলে এনজিও রাজনীতির কানাগলিতে মাথা খুঁড়ে মরার আশঙ্কা থাকে। পরিবেশ আন্দোলন যেমন অরাজনৈতিক হতে পারে না, তেমন মতাদর্শ বা তত্ত্ব ছাড়াও রাজনীতি হতে পারে না। অরাজনীতির রাজনীতি আর মতাদর্শহীন বা উত্তর-মতাদর্শের রাজনীতি – কোনোটাই পরিবেশ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।
প্রাকৃতিক সম্পদকে পুঁজির অধীনে নিয়ে আসা পুঁজিবাদের লক্ষ্য। বিনিয়োগ ছাড়া পুঁজিবাদের চলে না। পুঁজি বিনিয়োগকে উন্নয়নের মাপকাঠি বলে আমাদের গেলানো হয়। পুঁজির পথকে বাধাহীন করাই রাষ্ট্রের উন্নয়ন নীতি। তারজন্য নদীকে বাঁধ দিয়ে অবরুদ্ধ করতে হবে; জলকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে হবে; খনির জন্য মানুষকে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনে দাঙ্গা লাগাতে হবে; পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্রতট – সব বেচে দেওয়া হবে। কৃষিতে অধিক ফলনের লোভ দেখিয়ে পেটেন্টেড বীজ, আরও বেশি বেশি করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং বাস্তুতন্ত্র বিনাশকারী কীটনাশকের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে কর্পোরেট দানবদের স্বার্থেই। হারিয়ে গিয়েছে ফসলের বৈচিত্র্য। ক্রমাগত কমে চলেছে জমির ফলনের ক্ষমতা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জলের চাহিদা। মাটির নিচের জল যত ব্যবহার করা হয়েছে, ততই সংকট বেড়েছে। জল হয়েছে দূষিত। জলাশয়, নদী দখল, পরিবেশের বিপন্নতা সংকট বাড়িয়েছে আরও। এ যেন এক দুষ্টচক্র। জৈব সার ব্যবহার, বীজ সংরক্ষণের অভ্যাস যত চলে যাবে ততই রাসায়নিক সার, কীটনাশক, কোম্পানির বীজের উপর নির্ভরতা বাড়বে। তত পরিবেশেরও ক্ষতি হবে। জীবের বর্জ্য সার হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভুলিয়ে দেওয়া হবে। উল্টে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে মানুষসহ তামাম জীবজগতের ক্ষতি হবে। জল আরও দূষিত হবে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কৃষি সরঞ্জামের ব্যবসা এখন বড় বড় কোম্পানির দখলে। সেই কোম্পানিগুলিই আবার এখন কৃষককে দিয়ে চুক্তি চাষ করাচ্ছে, সরাসরি ফসল কিনছে। ফসলের ব্যবসাতেও এরা দিব্যি ঢুকে পড়েছে। অধিক ফলনের লোভ দেখিয়ে এই পথে কৃষককে যেতে প্রলোভিত করেছে বা বলা ভালো বাধ্য করেছে রাষ্ট্র।
জলদূষণে মৎস্যজীবীদেরও পেটে টান পড়ে। এরপর জলাশয়, নদী ও সমুদ্র উপকূলীয় অর্থনৈতিক এলাকা সরাসরি কর্পোরেটের দখলে চলে গেলে তো কথাই নেই। জঙ্গলের সম্পদে কোনোক্রমে বেঁচে বর্তে থাকা প্রান্তিক মানুষকে হাতে ও ভাতে মেরে লুঠ হয় জঙ্গল। নদীর মাছ ধরে বা মাঠঘাটের শাক কুড়িয়ে খেয়ে দিন গুজরান করা মানুষের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়। রাষ্ট্রের কাছে এইসব মানুষের কোনো মূল্য নেই। একইভাবে শহর এলাকায় বস্তি উচ্ছেদ করে বা পর্দা দিয়ে ঢেকে ‘দৃশ্যদূষণ’ রোধ করাই আজ জাতীয়তাবাদী কাজ। গরিবরা যেন আবর্জনা। নাগরিকদের এই চূড়ান্ত অপমান আমরা মেনেও নিয়েছি। প্রান্তিক মানুষের এই অপমান আমাদের অনেককেই আদৌ বিচলিত করে না। রাষ্ট্রের ছকে দেওয়া উন্নয়ন মোহে আমরা আবিষ্ট। অথচ, প্রকৃতি-পরিবেশকে এই প্রান্তিক মানুষই বাঁচাতে পারেন। প্রতিরোধটা তাঁরাই গড়ে তোলেন।
নয়া উদারনীতির যুগে রাষ্ট্র আরও আগ্রাসী, আরও সভ্যতাবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশের দিকে তাকালেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। মধ্যভারতের বনাঞ্চল রক্ষায় আদিবাসী-মূলবাসীদের প্রতিরোধকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক বলা হয়। এক সময়ের অপারেশন গ্রীন হান্ট থেকে আজকে আকাশপথে হামলা – কর্পোরেট দালাল রাষ্ট্রের আক্রমণ বেড়েছে। সরকার বদলেছে, নীতি বদলায়নি। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিতে জীবন জীবিকা ধ্বংস করে, মানুষকে উচ্ছেদ করে উন্নয়নের রথ চালাতে রাষ্ট্র মরিয়া। জম্মু ও কাশ্মীরকে তিন টুকরো করে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে জাতপাত আর ধর্মের রাজনীতি, উত্তর-পূর্ব ভারতে জাতিগত বা ভাষাগত দাঙ্গা, এনআরসি-সিএএ নিয়ে অশান্তির রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য হল উচ্ছেদ। প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করার জন্য এসেছে একের পর এক আইন বা আইনের সংশোধনী। রাষ্ট্র এক আইনের সাহায্যে তারই রচিত অপর আইনকে দমন করেছে বা বাস্তবে লঘু করে দিয়েছে। বনাধিকার আইনকে গুরুত্বহীন করতে অরণ্য আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। সংসদের বাদল অধিবেশনেই অরণ্য আইন, জৈব বৈচিত্র্য আইন ও খনি আইন সংশোধন করে কর্পোরেট লুঠের পথ আরও মসৃণ করা হয়েছে। আইনগুলি সংশোধনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, স্থানীয় মানুষের মতামতকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া। জন শুনানি, গ্রামসভা ইত্যাদির গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া। পরিবেশ, সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদের উপর, সৎ সাংবাদিকতার উপর রাষ্ট্রের আক্রমণ সুতীব্র হয়েছে। ইউএপিএ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন প্রয়োগ করে তাঁদের কারাবন্দি করা হচ্ছে।
আক্রমণের সার্বিক রূপ, রাষ্ট্রের চরিত্র বা পুঁজির আগ্রাসনের প্রসঙ্গগুলিকে এড়িয়ে কখনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় না। অথচ সমস্যাগুলিকে সার্বিকভাবে না দেখে আলাদা আলাদা করে দেখার প্রবণতা অনেক পরিবেশ আন্দোলন কর্মীর মধ্যে এখনো রয়েছে, যা এনজিও রাজনীতির অঙ্গ। কখনো কখনো দেখা যায় অনেক এনজিও সরকারি প্রকল্পেই পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে। আবার কখনো উপর উপর সরকারের বিরোধিতা করলেও এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রশ্ন করছে না। অনেক এনজিওকেই ঘুরপথে অর্থ যোগাচ্ছে বড় বড় কোম্পানি। এর জন্য গড়ে উঠেছে বিদেশি এনজিও, কর্পোরেটের দাক্ষিণ্যে নানা নামের ফাউন্ডেশন। কোথাকার অর্থ কোথায় যাচ্ছে বোঝাই দায়। সরকারি বা আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার অর্থে চলা প্রকল্পগুলিকে একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা হয়। বিভিন্ন এনজিও সেইসব প্রকল্পের বরাত পায়।
আবার অনেক সময়ে দেখা যায়, নতুন পণ্যের বাজার দখল করতে বা বাজার নিয়ে সমীক্ষা করতে বিভিন্ন এনজিওকে অর্থ দেওয়া হয়। হয়ত কোনো এনজিও জলদূষণ নিয়ে দারুণ প্রচার করছে, স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করছে। আপাতদৃষ্টিতে আপত্তির কিছু নেই। এখন জলদূষণের কারণ যদি স্থানীয় মানুষের অজ্ঞতা বা অপরিসীম লোভ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দূষণরোধে কাজের কাজ কিছু হয় না। বরং জলদূষণ নিয়ে মানুষ সচেতন হলে বড় বড় কোম্পানির বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবসা জমে ওঠে। সেই ব্যবসার জন্য জলসংকট কমে না, বরং বাড়ে। কোম্পানিগুলি এখন চাহিদা অনুযায়ী জৈব চাষের ব্যবসাতেও নামছে। রাসায়নিক সার তৈরি করবে, আবার জৈব ফসলেরও ব্যবসা করবে। তাই সুস্থিত জৈব চাষের প্রচারেও কোম্পানিগুলির অর্থে বহু এনজিও আসরে হাজির হচ্ছে। এরা ক্ষমতার কাঠামোকে প্রশ্ন করে না, বরং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা কীভাবে পরিবেশ ধ্বংস করছে তা আড়াল করে। পরিবেশ আন্দোলনকে রাজনীতি নিরপেক্ষ বলে প্রচার করে। এভাবেই সামাজিক আন্দোলন বা পরিবেশ আন্দোলনের পরিসর দখল করছে এনজিও রাজনীতি।
পরিবেশ আন্দোলন সাধারণ মানুষের তাগিদ, যন্ত্রণা থেকে উঠে এলেই সার্থক রূপ পায়। স্থানীয় মানুষের ভূমিকা এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশে আদিবাসী মূলবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে এভাবেই পরিবেশ আন্দোলন উঠে আসছে। তাঁরা অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া প্রকল্প বা আন্দোলন নয়, আন্দোলন উঠে আসছে নিচুতলা থেকে। সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আইনি অধিকারগুলি বড় হাতিয়ার। আইন সংশোধন করে রাষ্ট্র জনশুনানি বা গ্রামসভার গুরুত্ব লঘু করলে পরিবেশ আন্দোলনকে প্রতিবাদ করতে হয়। পাশাপাশি আইনি সুযোগগুলিকেও কাজে লাগাতে হয়। যেমন পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামোন্নয়নে সাধারণ মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, সাধারণ মানুষ পঞ্চায়েতের উন্নয়ন পরিকল্পনায় মূল কর্মকর্তা। নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সরকারি কর্তারা কেবল সহযোগী হিসাবে থাকবেন। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত আইনে পাড়া বৈঠক, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভার মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনায় মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে জনশুনানির ব্যবস্থাও রয়েছে। বনাধিকার আইনে গ্রামসভা, জনশুনানির গুরুত্ব আরও বেশি। রাজ্যে সরকারি নানা প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গ্রামসভার মতামত নেওয়ার দাবি উঠেও আসছে।
সাধারণ মানুষ যদি উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল কর্মকর্তা হতে পারেন, তাহলে উন্নয়নের দিশা বদলের দাবি উঠতে পারে। একশো দিনের কাজে পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি নেওয়া, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে সেই কাজে সাহায্য করা, কৃষি ব্যবস্থাকে সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত করার কর্মসূচি নেওয়া যায়। উপসমিতিগুলিকে দিয়ে পঞ্চায়েতকে সেই পরিকল্পনা গ্রহণে বাধ্য করা যায়।
দেশের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল বা জনজাতি গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে পূর্ণ বা আংশিক স্বশাসিত পরিষদ রয়েছে। এই পরিষদগুলির অনেক অধিকার রয়েছে। ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত এলাকার অধিবাসীদেরও নানা অধিকার দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল স্তরের এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে মানুষ বিকল্প উন্নয়নের পথে এগোতে বাধ্য করতে পারে।
পঞ্চায়েত ব্যবস্থাই হোক বা স্বশাসিত পরিষদ – ক্ষমতার কাঠামো কিন্তু বাস্তবে মানুষকে সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়নি। আবার এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নানা প্রকল্পের অর্থে কাজ করতে হয়। যে প্রকল্পগুলি আবার বহুক্ষেত্রেই বিশ্বব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মত নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে ও নির্দেশে চলে। কার্যত পঞ্চায়েতগুলির বিকল্প উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়ার সুযোগ কমে চলেছে। মানুষের অধিকার ভিক্ষায় পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের উন্নয়ন পরিকল্পনার কর্মকর্তা হওয়া কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং আমলারাই ক্ষমতা ভোগ করে। পঞ্চায়েতে মানুষের অংশগ্রহণের আইনি অধিকার বাস্তবায়নের দাবি পরিবেশ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হতে পারে।
আবার রাষ্ট্র স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বা শাসনকাঠামোর পাশাপাশি নানা পরম্পরাগত সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রথা রয়েছে। যেমন আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলিতে রয়েছে মাঞ্জহি পরগণা, পড়হা, মানকি, কূলম, কূট, আখিং, জুমসা ইত্যাদি নামের পরম্পরাগত স্বশাসন ব্যবস্থাগুলি। কোথাও আবার সরকারি ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি টিকে রয়েছে গ্রামীণ ষোলো আনা বা পল্লী পঞ্চায়েত ব্যবস্থা।
অভিযোগ ওঠে যে, সরকারি ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা এই সামাজিক কাঠামোগুলিকে অনেকাংশে গুরুত্বহীন করে দিয়েছে। অনেক সময়ে বিভিন্ন শাসক দল অথবা অসংসদীয় পথে বিশ্বাসী দলগুলি এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দখল করে বা নিজেদের অনুগত পালটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এভাবেও অনেক স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন বা পরিবেশ আন্দোলনকে কর্পোরেটবান্ধব সরকার এবং সরকারবিরোধী সংসদীয় রাজনীতিবিরোধী অসরকারি ঘটকেরা স্তিমিত করে দিচ্ছে। পরিবেশ আন্দোলনকে বিকল্প উন্নয়নের পথ হিসাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে তৃণমূল স্তরের এই কৌম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে পাশে পাওয়া দরকার। যা অবশ্যই রাজনৈতিক কাজ। দাবি তুলতে তুলতেই মানুষ বুঝতে পারবেন আইন, শাসনকাঠামোর সীমাবদ্ধতা।
পরিবেশ আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকার দিকটি অনেক সময়ে গুরুত্ব পায় না। পরিবেশের সঙ্গে তাঁদের জীবনযাত্রা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। আজও এই দেশের মহিলাদের জল নিতে বহু পথ হেঁটে যেতে হয়। প্রকৃতি-জীবজগৎ-মানুষের পারস্পরিক মেলবন্ধনে তাঁদের ভূমিকা অপরিসীম। তাই দেখা যায়, নিচুতলা থেকে উঠে আসা পরিবেশ আন্দোলনে মহিলারা থাকেন সামনের সারিতে। মহিলাদের মতামত পরিবেশ আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিকল্প উন্নয়নে প্রয়োজন যৌথভাবে কাজের অনুশীলন। ব্যক্তিগত উন্নয়নের পরিবর্তে সর্বজনীন উন্নয়ন। প্রাকৃতিক সম্পদে সমষ্টি বা সকলের অধিকার। এখনো বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে এই যূথবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করার, জীবিকানির্বাহ করার ব্যবস্থা টিকে রয়েছে, যা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনায় পিছিয়ে থাকার লক্ষণ। অথচ সেই কৌম যূথবদ্ধ অনুশীলন আমাদের শেখায় প্রকৃতি-পরিবেশ-জীবজগৎকে নিয়ে সবাই মিলে বেঁচে থাকার পথ। প্রকৃতি-পরিবেশকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে লোকসংস্কৃতি। লোকগীতি বা লোকসাহিত্যে তাই এত বৈচিত্র্য। উন্নয়নের একমাত্রিকতায় সেই সংস্কৃতিও আজ বিপন্ন। এক আর্থিক নীতি- শাসনরীতি-ভাষা-রুচি-সংস্কৃতি ছাড়া নয়া উদারনীতির চলে না। বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করতে হয়। তাই পুঁজিবাদ আর মৌলবাদের রাজনীতি মিলেমিশে একমাত্রিক এক শাসনকাঠামো গড়ে তুলতে চায়। সেই কাঠামোয় পরিবেশের বৈচিত্র্য, জৈব বৈচিত্র্য, জনবিন্যাসগত বৈচিত্র্য টিকে থাকতে পারে না। যৌথতার সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে বা তার প্রতি উদাসীন থেকে পরিবেশ রক্ষা করা যায় না।
আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে যৌথ জীবনযাপনের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিবেশ আন্দোলন এগোতে পারে না। সেই রাজনীতি যৌথ বা সামাজিক মালিকানার দাবি তোলে। পরিবেশ আন্দোলন তাই ব্যক্তি মালিকানা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় উত্তরণের লড়াইয়ের অঙ্গ। আর এখানেই মার্কসবাদ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।