একটি বিষয় আমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি নিয়ে সচরাচর মন্তব্য করেন না। তিনি তাঁর নিজের মত করে আলেখ্য তৈরি করেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁকে দিয়ে সংসদে মণিপুর নিয়ে দুকথা বলানো গেছে। অথচ ভারত যে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে প্রথম তিনের মধ্যে চলে আসবে, তা নিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত কথা বলেন। মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে তিনি কিছু বলেন না। মুসলিমপ্রধান দেশে গিয়ে সেখানকার ধর্মগুরুদের সঙ্গে দেখা করে আসেন, কিন্তু দেশের সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হলে তা নিয়ে মুখ খোলেন না।

এর একটিই কারণ। মোদী দেশের সাধারণ সমস্যার ঊর্ধ্বে নিজেকে নিয়ে যেতে চান। তিনি আরও একজন সাধারণ রাজনীতিক নন, নিজেকে ‘স্টেটসম্যান’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এমন একজন যিনি রাষ্ট্রকে এক নতুন দিশা দেখাতে পারেন। নিছক রাজনৈতিক লড়াই বা আকচা-আকচিতে নিজেকে জড়াতে চান না (নির্বাচনী প্রচারের সময়টুকু ছাড়া)।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি ভারতীয়ত্বকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের একজন স্বয়ংসেবক হিসাবেই তিনি সেই পথে এগিয়ে চলেছেন। সে উপনিবেশের পুরনো সংসদ ভবন ছেড়ে নতুন সংসদ ভবনে উঠে যাওয়াই হোক আর ইংরেজ আমলের ভারতীয় দণ্ডবিধি ছেড়ে ন্যায় সংহিতা হোক বা ‘ইন্ডিয়া’ ছেড়ে ‘ভারত’ নামটি ব্যবহার করাই হোক।

যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, কেউই দেশের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের বিরোধিতা জোর গলায় করতে পারবে না। কেউ যদি বলে আমি ঔপনিবেশিকতার জাল ছিঁড়ে ভারতের আসল গরিমা তুলে ধরতে চাই, তাতে কে বিরোধিতা করবে? হ্যাঁ, ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক ইতিহাস বা তারও আগের বিদেশি শক্তির রাজত্বের ইতিহাস অস্বীকার করলে, বিকৃত করলে বা মুছে দেওয়ার চেষ্টা হলে তা ইতিহাসচর্চার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করবে। সেখানে আপত্তি রয়েছে এবং থাকবে।

কিন্তু এখন ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’-র যাত্রা শুরু হয়েছে। জি-২০ অধিবেশনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই যাত্রার পথ আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন। জি-২০ বা গ্রুপ-২০ বিশ্বের কুড়িটি দেশের একটি সংগঠন। প্রতি বছর পালা করে একটি দেশ সভাপতিত্ব করে এই গ্রুপের। ভারতের সভাপতি হওয়াও একটি রুটিন ব্যাপার। কিন্তু সেই সভাপতিত্বকালে দেশজুড়ে এবং বিশ্বমঞ্চে ভারতের গুরুত্বকে তুলে ধরতে কোনো চেষ্টার খামতি রাখেননি নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর পার্ষদরা। ভারতই পুরো বিশ্বকে পথ দেখাবে – এরকম একটি আবহ তৈরি করা হয়েছে। জি-২০-র দিল্লি অধিবেশন থেকে জৈব জ্বালানি নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক জোট তৈরি হয়েছে। এই অধিবেশন থেকে আফ্রিকান ইউনিয়নকে ২১তম সদস্য হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে জি-২০ তে।

এই অধিবেশনের সময়কালে আরও কয়েকটি ঘটনা বিশ্বস্তরে ভারতের স্থানকে একটি অন্য মাত্রা দিয়েছে। যেমন বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসাবে ভারত চাঁদে পা রেখেছে, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে উঠে এসেছে, সম্প্রতি চীনকে ছাপিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হয়েছে ভারত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমী দেশগুলির মত ইউক্রেনের পক্ষ না নিয়ে স্বতন্ত্র বিদেশনীতি স্পষ্ট করেছে।

ভারতের পক্ষে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ছড়ি ঘোরানোর পথ সুগম হয়েছে আরও কয়েকটি কারণে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার আমলের শেষ দিকে থেকেই আমেরিকা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাত গোটাতে আরম্ভ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও নিজের দেশের দিকে বেশি নজর দিতে শুরু করেন। বাইডেনও কিন্তু অন্য কোনো দেশের যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুক্ত করেননি। ইউক্রেন যুদ্ধেও শুধুই অস্ত্র সরবরাহ করছেন। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনও নিজের মসনদ ঠিক রাখতে ব্যস্ত। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে পশ্চিমী আগ্রাসন রুখতে চান তিনি। চীন কোনোদিনই অন্য কোনো দেশের যুদ্ধে নিজেদের জড়ায়নি। নিজেদের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে যতটা সামরিক শক্তি প্রদর্শন দরকার ততটুকুই করেছে। ইউরোপের দেশগুলিও অন্যের দেশে নাক গলানোর থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতেই বেশি তৎপর। মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশগুলি বা আফ্রিকার দেশগুলিও নিজেদের সমস্যায় জর্জরিত।

ফলে বিশ্বের রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘুচে গিয়ে একটি বহুমাত্রিক রাজনীতির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। সেখানে আমেরিকা বা রাশিয়া অথবা চীন — কেউই আর এককভাবে দাদাগিরি করছে না। ফলে ভারতের নিজের শক্তি দেখানোর অবকাশ তৈরি হয়েছে। আমেরিকা বরাবরই চায় চীনকে ঠেকাতে ভারত শক্তিশালী হোক। রাশিয়া খুশি এই কারণে যে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চাপ সত্ত্বেও ভারত তাদের বিরুদ্ধে যায়নি, বরং দুঃসময়ে তেল কিনে সাহায্যই করেছে। চীন ভারতের সীমানাগুলিতে আগ্রাসন জারি রেখে চাপ তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই।

নরেন্দ্র মোদী ‘আমি কারও পক্ষে নই, আমি সবার বন্ধু’ – এমন একটি বিদেশনীতি নিয়ে দাদাগিরির শূন্যস্থানটি পূরণ করছেন। ভারতের স্বার্থে তা একদম ঠিক পদক্ষেপ। সুযোগের সঠিক ব্যবহার করছেন প্রধানমন্ত্রী। এমন নয় যে এর আগে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী বিদেশনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনেননি। স্বাধীনতার পরে জওহরলাল নেহরু বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শে ভারতের বিদেশনীতি পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু তখন সদ্যস্বাধীন দেশের উন্নয়নই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে (নন-অ্যালায়েন্স মুভমেন্ট বা ন্যাম) নেতৃত্ব দিয়েছেন। যেসব দেশ না সোভিয়েত, না আমেরিকার পক্ষে তারা ন্যামের ছাতার তলায় এসেছে। ১৯৯১ সালে নরসিমা রাও সরকার অর্থনৈতিক সংস্কার করে ভারতের বাজার বিশ্বের জন্য খুলে দিয়ে নতুন বিদেশনীতির সূচনা করেছে।

মোদীর বিশেষত্ব এই যে তিনি ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার আসল ফায়দা দেশের রাজনীতি থেকে তুলতে চান। এর আগে বিশ্বের ছোট ছোট দেশগুলি থেকে শুরু করে বড় দেশগুলি ঘুরে প্রবাসী ভারতীয়দের মন জয় করেছেন। তাঁদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন বিজেপির কাজে এসেছে, দেশের বিদেশনীতি স্পষ্ট হয়েছে। আর দেশের রাজনীতি তিনি করেন ৫৬ ইঞ্চি ছাতি দেখিয়েই। একজন শক্তিশালী নেতা যাঁকে বিশ্বের সবাই সম্মান জানাচ্ছেন, এ দেশে এসে হাত মেলাচ্ছেন — এই ছবিটি দেশের রাজনীতিতে বিকোয় ভাল।

আরো পড়ুন জি-২০ বৈঠক শ্রীনগরে: রঙিন পর্দায় রক্তঝরা ক্ষত আড়ালের চেষ্টা

খেয়াল করে দেখবেন, রাহুল গান্ধীও একই কায়দায় বিদেশে ছোট ছোট সভা করে বেড়াচ্ছেন আর ওদেশের উদারবাদীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু মোদীর বিশ্বগুরু হয়ে ওঠার পথে বাধা অনেক। তিনি যখন বিশ্বগুরু হওয়ার কথা বলেন, তখন নিশ্চয়ই চান না যে ভারত একটি ‘ব্যালান্সিং পাওয়ার’ বা ভারসাম্য রক্ষার শক্তি হয়ে থাকুক। অর্থাৎ চিনকে ঠেকাতে ভারত, রাশিয়াকে বাগে রাখতে ভারত — এমন হোক তা তিনি অবশ্যই চান না। তিনি চান ভারত বিশ্বরাজনীতির নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠুক, বিশ্বের রাজনীতি পরিচালনা করুক। কিন্তু সারা বিশ্বের সম্মান পেতে গেলে দেশের ঘরোয়া রাজনীতিতেও যে অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। সংখ্যালঘুদের নিয়ে দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে যে সমস্যা রয়েছে তার সমাধান শুধুই ‘হিন্দুত্ব’ ও ‘ভারতীয়ত্ব’ দিয়ে খুঁজতে গেলে হবে না। বিশ্বগুরু হতে গেলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে এগোলেও চলবে না। যদিও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির প্রধানদের নিজের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ডেকে বা হঠাৎ করে নওয়াজ শরিফের বাড়িতে গিয়ে তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তা বিশেষ ফলপ্রসু হয়নি। পাকিস্তান, বা নেপাল বা চীন — কারোর সঙ্গেই মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়নি ভারতের। এটি এক ধরনের কূটনৈতিক ব্যর্থতাই।

খেয়াল রাখতে হবে, চীন সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। সৌদি আরবের হাতেও অনেক টাকা রয়েছে। তুরস্কও বিশ্বরাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বর অধিকারী। ইজরায়েলের প্রযুক্তিরও বিশ্ব বাজারে বিপুল চাহিদা। কিন্তু এই সব দেশগুলি ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে উঠতে পারেনি তাদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশের জন্যই। পশ্চিমী দেশগুলি চিনকে রুখতে ভারতকে যতই মদত দিক, একটি ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’ তাদের উপর ছড়ি ঘোরাবে – এমনটি সহজে হতে দেবে না।

যেদিন মোদী ভারতের নতুন সংসদ ভবনে মহিলাদের জন্য সংসদ ও বিধানসভায় আসন সংরক্ষণের বিল আনছেন, সেদিনই বিলেতে বসে দেখছি বিবিসির প্রাইম টাইম খবর বা ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রথম পাতায় খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা নিয়ে ভারত-কানাডার কূটনৈতিক টানাপোড়েন সম্পর্কে আলোচনা চলছে। মহিলা সংরক্ষণ বিলের কোনো উল্লেখ নেই।

২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গা থেকে ২০২৩-এর জি-২০ সভাপতিত্ব — এই ২০ বছরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন মোদী। নিজের এবং দেশের ভাবমূর্তিকে বিশ্বের দরবারে নতুন প্যাকেজে পরিবেশন করেছেন, সাফল্যও পেয়েছেন। কিন্তু শুধুই শক্তিশালী নেতৃত্ব, জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্বের ধারক হয়ে বিশ্বগুরু হওয়ার পথে হাঁটা কঠিন।

অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দেশকে আরও শক্তিশালী করা; সামাজিক স্তরে ভারতের বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মকে ভাগ না করে বিবিধের মাঝে মিলন মহান ঘটিয়ে সব নাগরিককে সমান অধিকার দেওয়ার কাজ তাঁকে করতে হবে। শুধুই পুনরুজ্জীবন বা ভারসাম্যের বিশ্বরাজনীতি নয়, নতুন পথে পরিবর্তনের দিশা দেখিয়ে নেতৃত্ব দিতে পারলেই সত্যিকারের বিশ্বগুরু হয়ে উঠবে ভারত। বিশ্বগুরু হবেন প্রধানমন্ত্রীও।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.