বিশ্বের ধনীতম কুড়িটি দেশের সংগঠন জি২০-র সভাপতির পদ এখন ভারতের দখলে৷ সেই সুবাদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২২-২৪ মে জি২০-র পর্যটন বৈঠকের জন্য বেছে নিয়েছিলেন কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরকে৷
বুঝতে অসুবিধা হয় না, ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার কাশ্মীরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা কায়েম করেছে– গর্বের সঙ্গে গোটা বিশ্বের কাছে এ কথা ঘোষণা করাই ছিল প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য৷ কিন্তু সত্যিই কি কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে? প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কের চাদরে মোড়া কাশ্মীরীদের জীবন কি সত্যিই এতদিন পরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে স্বস্তির শ্বাস নিতে পারছে?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বাস্তব কিন্তু বিপরীত কথাই বলছে৷ ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট আচমকা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে বিজেপি সরকার৷ কেড়ে নেয় তার বিশেষ মর্যাদা৷ কাশ্মীর চলে আসে সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায়৷ একদিকে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদী হামলা, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে বিধ্বস্ত কাশ্মীরে তার পর থেকে রাষ্ট্রশক্তির উৎপীড়ন মাত্রা ছাড়ায়৷ সন্দেহের বশে যাকে খুশি গ্রেফতার করা, পুলিশ বা সেনা হেফাজতে মৃত্যু, আচমকা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, বিনা বিচারে হত্যা, সংবাদমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা, যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে দিনের পর দিন ইন্টারনেট পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটানো, হয় কথায় নয় কথায় সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের ধরপাকড়, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের জেলবন্দি করে রাখা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপে বাধা দেওয়া সহ কাশ্মীরের মানুষের সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক অধিকারের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয় বিজেপি সরকার৷ এই দমবন্ধ পরিস্থিতিই আজও কাশ্মীরের বাস্তবতা৷
স্বাভাবিক ভাবেই এতে সন্ত্রাসবাদী হামলা বন্ধ হয়নি, রূপ পাল্টেছে মাত্র৷ এখন সন্ত্রাসী হানার শিকার মূলত সাধারণ নাগরিক এবং বাইরে থেকে নানা কাজে কাশ্মীরে আসা মানুষরা৷ এই বছরেই জম্মুতে সন্ত্রাসী হামলায় সাতজন নাগরিক ও দশজন সেনার মৃত্যু হয়েছে৷ এই অবস্থায় বৈঠকে যোগদানকারী বিদেশি প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে শ্রীনগরকে মুড়ে ফেলবে বিজেপি সরকার, সেটাই স্বাভাবিক৷ হয়েছেও তাই৷ বৈঠক শুরুর আগে রঙিন সাজে সাজিয়ে তুলে ঝকঝকে চেহারা দেওয়া হয় শ্রীনগরকে৷ ‘সব ঠিক হ্যায়’ ভাব আনতে এমনকি অস্থায়ী পুলিশ-স্ট্যান্ডগুলিকে আড়াল করা হয় জি২০-র ঝকঝকে ব্যানারে৷ পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক সেনা৷ বিমানবন্দর থেকে বদগামের বৈঠকস্থলে প্রতিনিধিদের যাতায়াতের জন্য ডজন ডজন বুলেটপ্রুফ গাড়ির ব্যবস্থা হয়৷ যাতায়াতের গোটা রাস্তাটিকে অন্য রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মুড়ে দেওয়া হয়৷ উপর থেকে নজরদারি চালাতে মাথার উপর পাক খাওয়ানো হয় ড্রোন ও শার্প–শুটারগুলিকে। আটকে দেওয়া হয় ছোট ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালাদেরও৷
এতেই শেষ নয়। বৈঠক শুরু হওয়ার আগে বেশ কয়েকদিন ধরে চলে ব্যাপক ধরপাকড়৷ মর্জিমাফিক তরুণ–যুবকদের তুলে নিয়ে বন্দি করে রাখার ক্ষমতা নির্বিচারে প্রয়োগ করে কাশ্মীর পুলিশ৷ নিরুপায় কাশ্মীরবাসীকে মুখ বুজে সয়ে যেতে হয় এই অত্যাচার৷
বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি দু’পায়ে পিষে চলেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা লোপ করে তাকে কেন্দ্রের শাসনাধীন অঞ্চলে পরিণত করে সেখানকার নাগরিকদের আত্মমর্যাদায় ঘা দিতেও তারা দ্বিধা করেনি৷ হাজারো বিধিনিষেধ আরোপ করা সত্ত্বেও কাশ্মীরের মানুষের দুরবস্থা যখন বিশ্বের কাছ থেকে কিছুতেই গোপন করা যাচ্ছে না, মানুষ যখন কাশ্মীরের গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে নানা প্রশ্ণ তুলছে তখনই শ্রীনগরে জি২০-র বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপি সরকার৷
কিন্তু নাগরিকদের শ্বাসরুদ্ধকর দিনযাপনের উপর রঙিন পর্দা টেনে রেখে বিশ্বের চোখে কাশ্মীরকে স্বাভাবিক হিসাবে তুলে ধরার এই নির্লজ্জ অপচেষ্টা বিনাবাক্যে মেনে নেয়নি মানুষ৷ বিশ্বজুড়ে বুদ্ধিজীবীরা এর নিন্দায় বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন৷ প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কি এর তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, পর্যটন–বৈঠক তো দূর, কাশ্মীরে কোনও বৈঠক করাই অযৌক্তিক৷ তিনি বলেছেন, ‘‘সম্ভবত কাশ্মীরই বিশ্বের সবচেয়ে সেনাঅধ্যুষিত অঞ্চল৷ এখানকার মানুষ নিয়নিত জেলবন্দি হওয়া, অত্যাচারের শিকার বা প্রায়শই একদম নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকারই শুধু নন, তাঁরা এমনকি বুনিয়াদী অধিকারগুলি থেকেও বঞ্চিত৷’’
চমস্কি একা নন, রাষ্ট্রসংঘের সংখ্যালঘু সংক্রান্ত বিশেষ সংবাদদাতাও কাশ্মীরে জি২০-র বৈঠকের সমালোচনা করে বলেছেন, কাশ্মীরে যখন মানবাধিকার ব্যাপক ভাবে লংঘিত হচ্ছে, যখন তখন বেআইনি গ্রেফতারি, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীদের উপর দমন-পীড়ন চলছে, তখন জি২০-র বৈঠকের মধ্য দিয়ে এলাকার ‘স্বাভাবিকতা’ তুলে ধরা হচ্ছে৷ কাশ্মীরের এক তরুণ নাম গোপন রাখার শর্তে এক সাংবাদিককে বলেছেন, “বিজেপি সরকার এভাবে আমাদের যন্ত্রণাগুলোকে বোতলবন্দি করে ছিপি লাগানোর চেষ্টা করছে৷”
বিশ্বের চোখে নিজেদের কাশ্মীরে শান্তিস্থাপনকারী হিসাবে প্রতিপন্ন করার বিজেপি সরকারের এই অপকৌশল নিয়ে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে৷ ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন জনগণ জানতে চান, কাশ্মীরে যদি গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেই থাকেন নরেন্দ্র মোদীরা, তাহলে ২০১৮ থেকে আজ পর্যন্ত সেখানে বিধানসভা নির্বাচন হল না কেন৷ কেনই বা এখনও কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের উপর সেনার নির্মম গা–জোয়ারি চলছে৷ কেন আজও রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীরা সহ হাজার হাজার মানুষ জেলবন্দি অথবা গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন৷ কেন কাশ্মীরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অলীক কল্পনার সামিল৷ কেনই বা একের পর এক সাংবাদিককে ইউএপিএ–র মতো কঠোর আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে৷ জি২০ বৈঠকের চাকচিক্যের আড়ালে প্রধানমন্ত্রী এসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে পারেন না৷
~মতামত ব্যক্তিগত৷
আরো পড়ুন:
- হায়দরপোরা এনকাউন্টার: পিতৃহারা মেয়ের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ছেটানো রাষ্ট্র, আর কত লজ্জা দেবে?
- গণতান্ত্রিক থেকে সামরিক রাষ্ট্রের পথে এক বছর
- ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ শিল্প তো নয়ই, প্রচারও নয়
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।