‘মুখে যদি রক্ত ওঠে/সে-কথা এখন বলা পাপ।/এখন চারদিকে শত্রু, মন্ত্রীদের চোখে ঘুম নেই’ – বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির রাষ্ট্রীয় উৎসবের পাশাপাশি চলতে থাকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে নাগরিকের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নতুন নতুন ফন্দি। স্বাধীনতা আর দেশভাগের বয়স তো এক। স্বাধীনতা দিয়েছে অবিভক্ত ভারতের বুক চিরে কাঁটাতারের সীমান্ত, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, সীমান্ত রক্ষার নামে ক্ষমতার আস্ফালন। আর সেই কাঁটাতারে শুয়ে থাকে, ঝুলে থাকে ফেলানি খাতুনের মৃতদেহ। ঘন্টার পর ঘন্টা। চোদ্দ বছরের কিশোরীর মৃতদেহ নিয়ে চলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বৈঠক। ফেলানিরা মানুষ নয়, দুই দেশের ক্ষমতার আস্ফালনের দাবা খেলার বোড়ে। দেশের নিরাপত্তার নামে এভাবেই চলে নির্বিচারে নরহত্যা। দেশরক্ষায় নাগরিককে হত্যা করাও পাপ নয়। প্রশ্ন তোলাই পাপ। সীমান্তরক্ষী বাহিনী, সামরিক বাহিনী, ইউএপিএ, এনআইএ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন। জীবন-জীবিকার সংকট যত বাড়ে, তত বাড়ে রাষ্ট্রের আস্ফালন।
গত বছরের অক্টোবর মাসে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব ও আসামে বিএসএফের আওতাধীন এলাকা বৃদ্ধি করেছে। তিন রাজ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে দেশের ভিতর পঞ্চাশ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চল তাদের এক্তিয়ারে চলে এল। এই এলাকার মধ্যে বিএসএফ তল্লাশি, দ্রব্য বাজেয়াপ্ত এবং যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। এতদিন এই তিনটি রাজ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে পনেরো কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা বিএসএফের অধিকারে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের ২,২১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। নতুন নিয়মে উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জেলা, নদীয়া ও উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বড় অংশ সমেত রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা বিএসএফের আওতাধীন হয়েছে। রাজ্যের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরও আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত। স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। যদিও কেন্দ্রের যুক্তি, রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই বিএসএফ কাজ করে। তাই আধাসামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য বৃদ্ধির আশঙ্কা নেই। এই যুক্তি যে সর্বৈব মিথ্যা, তা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ জানেন। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিএসএফের অত্যাচারের অভিযোগ অতি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চোরাচালান বা অনুপ্রবেশের অভিযোগে দেশের নাগরিকদের উপর অত্যাচার, নারী নির্যাতন, গ্রেপ্তার করা, এমনকি হত্যার ঘটনাও বিরল নয়। এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে চলেছে মানবাধিকার সংগঠন – বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ। তারা বিএসএফের নির্যাতন, বিএসএফ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ ব্যক্তি ও নিহত ব্যক্তিদের তথ্য একাধিকবার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, কাশ্মীরের মত এ রাজ্যেও বিএসএফ নাগরিকদের উপর পেলেট গান ব্যবহার করে। অনেকেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। নির্যাতিত মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা মনোবিদ মোহিত রণদীপ জানান, নির্যাতিতরা আতঙ্কে ভোগেন। উদ্বেগ, হতাশা অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। নির্যাতিতা নারীরা ভয়ে সব কথা জানাতেও পারেন না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায় ১০০০ জন বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন।
রাজ্য পুলিসকে সব ঘটনা কার্যত জানানোও হয় না। রাজ্য সরকারগুলিও এসব বিষয়ে নীরব থাকতেই অভ্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গেই সীমান্তবর্তী এলাকায় জেলা প্রশাসন যথেচ্ছভাবে ১৪৪ ধারা জারি করে। বিএসএফের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি নিয়েও তারা সক্রিয় নয়। কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক তরজার মাঝেই দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৪৪ ধারা লাগুর প্রচারে নামছে বিএসএফ। অতি সম্প্রতি উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ থানা এলাকায় সে ঘটনা দেখা গেছে। কেন্দ্র বা রাজ্যে যে সরকারই আসুক না কেন, দেশভাগের পর থেকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বিশালসংখ্যক মানুষ কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে গেছেন।
প্রতিদিন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করে তাঁদের বাঁচতে হয়। কোচবিহার জেলার ছিটমহলের পনেরো হাজার বাসিন্দার অবস্থা আরও করুণ। তাঁরা ভারত-বাংলাদেশ দুই সরকারেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হেনস্থার শিকার হন। কেন্দ্রের বিজ্ঞপ্তি জারির পর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিএসএফের নির্যাতন বেড়েছে। ভারতীয় নাগরিককে হত্যার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় কৃষকদের চাষের কাজেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই উত্তর-পূর্ব ভারত, জম্মু-কাশ্মীরসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এভাবেই আফস্পা ও নানা অগণতান্ত্রিক আইনের বলে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিএসএফের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সামরিক আধিপত্যের মাধ্যমে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আরও সংকুচিত করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আরো পড়ুন দেশদ্রোহ-বিরোধী আইন সংক্রান্ত ধারা বাতিল হলেও লাভ নেই
মোদি সরকারের আমলে সেই আশঙ্কা আরও বেশি। আট বছরের অভিজ্ঞতা তাই বলে। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে সামরিক আধিপত্য বাড়ানো হয়েছে। আসামে দেশভাগের পর থেকে চলে আসা ভাষাগত পরিচয়সত্তার রাজনীতিকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে রূপান্তরিত করতে বিজেপি অনেকখানি সফল। এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীকে অস্ত্র করে চলছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অনুশীলন। একদিকে এনআরসির জুজু দেখিয়ে, অন্যদিকে সিএএ-র টোপ দিয়ে হিন্দু বাংলাভাষীদের একাংশের সমর্থন আদায়ে তারা সফল। রাজ্যের ক্ষমতা কমিয়ে, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করাই তাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে এগোতে কেবল আন্তর্জাতিক সীমান্তই নয়, আন্তরাজ্য সীমান্তেও বিজেপি অশান্তি পাকাতে চায়। গত বছরের জুলাই মাসে আসাম-মিজোরামের সীমান্তে দুই রাজ্য পুলিসের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সামরিক বাহিনীর আধিপত্য বেড়েছে। দুটি রাজ্যই বিজেপি শাসনাধীন। আসামে সীমান্ত থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা আধাসামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এলে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম হবে।
পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি ও সংঘ পরিবার সেই পরিবেশই চায়। নানা জনজাতি অধ্যুষিত বৈচিত্র্যময় উত্তরবঙ্গে পরিচয় সত্তার রাজনীতিকে অস্ত্র করে তারা অশান্তি সৃষ্টি করতে বহুদিন সচেষ্ট। পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসও পরিচয়সত্তার রাজনীতিকে প্রাধান্য দেওয়ায় আখেরে আরএসএসের লক্ষ্যই পূরণ হচ্ছে। দুই দলের পরিচয়সত্তার রাজনীতি গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে অন্য ইস্যুগুলিকে অনেকখানি গৌণ করে দিয়েছিল। সন্দেহ নেই, বিএসএফের আওতাধীন এলাকা বাড়িয়ে সেই রাজনীতিকেই ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে। নতুন নিয়মে নাকি রাজ্যের বিয়াল্লিশটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে একুশটি কেন্দ্রের কোনো না কোনো অঞ্চল বিএসএফের আওতায় চলে এসেছে। আধাসামরিক বাহিনীর মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করে রাজ্যের অর্ধেক লোকসভা কেন্দ্রের ভোটকে প্রভাবিত করার আশঙ্কা থাকছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে শীতলকুচিতে হত্যার ঘটনা এখনো রাজ্যবাসীর স্মৃতিতে অমলিন। সংঘ পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে আধাসামরিক বাহিনীকে দিয়েও ভোটে লাভের ঘুঁটি সাজাচ্ছে বিজেপি। আসাম ও পাঞ্জাবে আধাসামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি তারই অঙ্গ। পাঞ্জাবে ছটি জেলা পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী। সে রাজ্যে মাদক পাচার সামাজিক সমস্যার আকার ধারণ করেছে। রাজ্যের যুবসমাজের বড় অংশ মাদকাসক্ত। অনেকের আশঙ্কা, নতুন নিয়মের সুযোগ নিয়ে মাদক পাচার রোধের বদলে নতুন নীতিতে বিরোধী পক্ষের লোকেদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হবে।
বিগত আট বছরে মোদী সরকার রাজ্যগুলির প্রশাসনিক ক্ষমতা খর্ব করতে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ তুলে দিয়ে রাজ্যটিকে তিন টুকরো করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয়েছে। জঙ্গি দমন করা না গেলেও সামরিক শাসন কায়েম করা গেছে। আইন সংশোধন করে দিল্লি সরকারের ক্ষমতাও খর্ব করা হয়েছে। এনআইএ আইন সংশোধন করে রাজ্যগুলির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এনআইএকে ব্যবহার করে সীমান্তবর্তী এলাকায় সংখ্যালঘুদের আক্রমণের লক্ষ্যও করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপিবিরোধীদের গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করার ঘটনা তো আছেই। এনআইএ আইন সংশোধন আর বিএসএফের ক্ষমতাবৃদ্ধি তাই আলাদা কিছু নয়।
রাজ্যগুলির ক্ষমতা কমিয়ে, নির্বাচিত বিরোধী দলের সরকারগুলিকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত না করতে পারলে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী বিজেপি তথা সংঘ পরিবার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা গণতন্ত্র নয়, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী। এভাবেই বিরোধীমুক্ত ভারতের নামে সামরিক শাসন বলবৎ করাই তাদের লক্ষ্য।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
লড়ছিনা আমরা আমাদের জন্য, পাচ্ছিনা আমরা ন্যায্যর বিচার, হাটবো আমরা সংবিধানের পথে, ছিনিয়ে নিব আমাদের প্রাপ্য অধিকার।