কলকাতায় সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদের সময় রোজকার বিবিধ খবরের মাঝে একটি পত্রিকার হেডলাইন নজরে আসে- “Women at Kolkata’s Park Circus Prove the Indian Republic has Come of Age”. ঠিক তার নিচে ছোট হরফে লেখা – “As the land is endangered, so is the home. When the home itself is in danger, then women have to step out of the home to save the home.”

অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এই প্রতিবেদনটি জমি, বাসস্থান এবং দেশের সঙ্গে সম্পর্কের লিঙ্গভিত্তিক তাৎপর্য মনে করিয়ে দেয়। মেয়েদের বাড়ির বাইরে আসা এখনও প্রতিবাদের চরম মুহূর্ত হিসাবেই চিহ্নিত হয়। ঘর বাঁচাতেই ঘরের বাইরে আসা, এই ভাবনার ধারা এখনও নাকচ করা সম্ভব নয়, সে কথাও মনে করায়। সম্ভব নয়, কারণ মেয়েদের এই আন্দোলনকে এই ভাবনা নিঃসন্দেহে পুষ্ট করেছে। মেয়েরা তাঁদের গৃহকোণকে রক্ষা করতে, তাঁদের সন্তানদের নিরাপদ রাখতে পথে নেমেছেন, এই ধারণা একভাবে জনমানসে তাঁদের আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেয়।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই প্রতিবেদনে আছে জামিলের কথা যিনি পরিবারের ১৮ জন মহিলার সঙ্গে প্রতিবাদে অংশগ্রহন করেছেন। তিনি মনে করেছেন যে গৃহবধূরা যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন, তখন বুঝতে হবে গুরুতর কিছু ঘটেছে। এই বাইরে আসার ভাবনাতে অন্দরের একটি ছবি স্পষ্ট হয়। মেয়েদের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল সেই গৃহনির্মাণের কাজে লাগে, যেভাবে তা নেশন-নির্মাণেরও কাজে লাগে। তাঁদের রাজনীতি কি তাহলে শুধুই অন্দর-বাঁচানোর লড়াই? এই প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ এবং না, এই দুই অবস্থান হয়ত সম্পূর্ণ পৃথক নয়। নেশন কে যদি তার টুকরো (fragment) দিয়ে চেনা যায়, তাহলে মেয়েদের লড়াইকে শুধু নেশন- নির্মাণের অস্ত্র হিসাবে দেখা সম্ভব নয়। তার নিজস্ব গতি এবং প্রকৃতি অনুধাবন করা প্রয়োজন। এই রাজনীতির ভাষায় অন্দরের আলোচনা জোরালো, কিন্তু সেই রাজনীতি মঞ্চস্থ হয় জনপরিসরে। যে পরিসর পুনরুদ্ধার করা মেয়েদের কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

‘দেশ’ শব্দটির অনেক ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘Land’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষণীয় এবং হয়ত আকস্মিক নয়। মেয়েদের দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গৃহের অভ্যন্তরের অন্তরঙ্গ সম্পর্কেরই প্রসার হিসাবে আলোচিত হয়। মেয়েদের রাজনীতি এই অন্তরঙ্গতার প্রকাশ। জমির সঙ্গে ওতপ্রোত যোগাযোগ নাগরিক অধিকারের লড়াই কে একটি বিশেষ মাত্রা যোগায়, যেখানে জামিল খুব সহজেই এমন কথা বলতে পারেন, যার তর্জমা করলে দাঁড়ায় – “হিন্দুস্তান কি সরজমিন (হিন্দুস্তানের জমি), হিন্দুস্তান কি মিট্টি (হিন্দুস্তানের মাটি), তার দুঃখে আমাদের ডাকছে। মা হিসাবে আমরা জানি সেই মায়ের কষ্ট যাঁর সন্তানদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। ” মাটির সঙ্গে এই যোগ, এই ভাষায় শুধুমাত্র নাগরিক অধিকারের থেকে গভীরতর, এভাবেই প্রতীয়মান হয়।

আমরা অবগত আছি যে রাষ্ট্রের জনজীবন জঙ্গম করে তার নাগরিক। এবং নাগরিকতা যে সম অধিকারের ধারণার উপর বাসা বাঁধে, সেই ধারণা যে ফাঁপা এবং ছিন্নভিন্ন, সে কথাও আমাদের জানা। তাই নাগরিকতার অভিজ্ঞতাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। এই রকমফেরের কথা নিজেদের বারংবার মনে করিয়ে না দিলে মেয়েদের রাজনীতির পরিসর বোঝা হয়ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নাগরিকতা শুধুমাত্র একটি স্থির অবস্থান নয় যা অধিকার এবং দায়িত্বের বলয়ের উপর তৈরি হয়। নাগরিকতা একধরণের পরিচিতি যা অর্জন করতে হয় এবং যা প্রতিমুহূর্তে অবদমিত হওয়ার সম্ভাবনায় পূর্ণ। আজ যা পাওয়া গিয়েছে, কাল তা থেকে যাবে, এমন নাও হতে পারে। বরং নাগরিকতাকে রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কথোপকথনের ক্ষেত্র হিসাবে দেখা যেতে পারে। এবং নাগরিককে যেহেতু তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সম্ভাবনা থাকে, তাই মেয়েদের অধিকার হরণ করার প্রসঙ্গ নাগরিকতার gendering-এর ধারণার সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। এই কাজটি করতে ‘অন্দর’ এবং ‘বাহির’, ব্যক্তিগত এবং বহির্জগতের একটি ভাগাভাগি করা হয়। এই অন্দরটির চেহারা কেমন, তা বোঝা প্রয়োজন।

অন্দরটি একটি সংস্কৃতির ক্ষেত্র হিসাবে নির্ধারিত হয় যেখানে রাজনীতির স্থান নেই। সেখানে প্রধান বিচার্য ভাবনা যার বলে যেকোনো ঘটনা নৈতিক অথবা অনৈতিক হয়ে উঠবে, তা হল ঐতিহ্য। সর্বজনীন আধুনিকতার জগতে সহজেই স্থান করে নেয় বিশেষ ভারতীয় ঐতিহ্যের জগত। অন্দরে মেয়েদের অবস্থান ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক হয়ে ওঠে। মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই আধুনিক রাষ্ট্রের পরিসরে নাগরিক অধিকারের লড়াই হয়ে উঠতে পারে না। অন্দরের নিরাপত্তা বজায় রাখার প্রচেষ্টা হয়ে থেকে যায়।  উনিশ শতকের সমাজ সংস্কারের ভাবনায় মেয়েদের অবস্থান নিয়ে আলোচনার যে শোরগোল উঠেছিল, তাতে মেয়েদের ‘অধিকারের’ কথা জাতীয়তাবাদ প্রকল্পের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।

ঔপনিবেশিকতার প্রত্যুত্তরে মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ভারতীয় পুরুষের দায়ভার হয়ে উঠেছিল, এবং জাতীয়তাবাদের কাজে লেগেছিল। স্ত্রীশিক্ষার একটি বিশেষ লক্ষ্য হয়ে ওঠে আধুনিক জীবনে ‘সঠিক’ ভূমিকা পালন। রাজনৈতিক কার্যকলাপ মেয়েদের এই বিশেষ ভূমিকা ভুলে যেতে দেয়নি। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি তে যোগদান একভাবে ঘর বাঁচানোর লড়াই হিসাবেই গণ্য হয়। স্বাধীনতার পরের দশকগুলিতে এই অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৭৪-এর Towards Equality রিপোর্ট পরিকাঠামোগত লিঙ্গভিত্তিক শোষণের প্রসঙ্গ নতুন করে তুলে ধরল। মেয়েরা নানাভাবে সম্পদ এবং বিভিন্ন অধিকার থেকে যে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হন, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে মেয়েদের শরীরের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বিভিন্নভাবে উঠল। পণ- মৃত্যুর মত বিষয় যে বড় প্রশ্ন তুলেছিল, তা হল মেয়েদের mobility-র নিয়ন্ত্রক যে পারিবারিক যোগসূত্র, যার কেন্দ্রে সেই ঐতিহ্যের প্রশ্নই থেকে গিয়েছে, সেই বিষয়টি শুধু ওই ‘বাহির’ -এর রাজনীতি, রাষ্ট্রের নিয়মবিধি এবং নাগরিক অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে কি বোঝা সম্ভব? ব্যক্তি-অধিকার, যা নাগরিকতার ধারণার কেন্দ্রে এবং পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কারের বলয়ের বাইরে ভাবলে ভুল হবে, ভুল হয়। হয়, তার কারণ ঔপনিবেশিকতার সংস্কৃতির হাত ধরে আমরা আইনের শাসনের উপর সম্পূর্ণ ভরসা করতে শিখেছি। আইনের শাসন আমাদের সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে, সে সম্বন্ধে খুব একটা সন্দেহ নেই। তাই অধিকারের লড়াই আমরা ‘বাহির’-এর রাষ্ট্রের পরিসরে রাজনৈতিক লড়াই হিসাবেই বুঝি। কিন্তু এই লড়াইয়ের যে বিভিন্ন ক্ষেত্র আছে, অধিকার হরণের নানান পারিবারিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা আছে, তা ভুলে থাকি। কিন্তু ভাষার ব্যবহার এই বিভিন্নতার ছবি এঁকে চলে প্রতিমুহূর্তে, যেখানে ‘গৃহবধূর’ লড়াই একটি বিশেষ মানে বহন করে।

নাগরিকতা প্রমাণ করতে মেয়েরা বিশেষ সমস্যায় পড়েন কারণ অনেকের কাছেই কাগজ থাকে না, থাকে বাড়ির পুরুষদের কাছে। তাঁদের লড়াইও শুধু নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসাবে স্বীকৃতি পায় না। সেটি হয়ে ওঠে পারিবারিক। তাঁদের বসবাস ও দিনযাপন ব্যক্তিগত অধিকার এবং পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের পরিসরের মাঝামাঝি কোথাও।

~মতামত ব্যক্তিগত।

আরো পড়ুন:

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.