লড়াইটা ছিল আদতে ক্ষমতা দখলের। যদিও খোলসটা ছিল পশ্চিমী দাপটের বিরোধিতা, ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা। সেইসঙ্গে পিছনে গুঞ্জন ছিল – স্বৈরাচারীর কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। সেই গুঞ্জন যেদিন কলরবে পরিণত হল, সেদিন আমেরিকার আশীর্বাদধন্য শাহ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। অবশ্য এমনও নয় যে শাহটি ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন। যাই হোক, মহা সমারোহে ক্ষমতার রাশ গেল খোমেইনির হাতে। ইসলামিক বিপ্লব, ১৯৭৯। তীব্র শ্রেণিবিভাজিত সমাজ, সবটুকু উন্নয়নের সুবিধা নিচুতলা অবধি এসে না পৌঁছনো, অপরিসীম দারিদ্র্য, বেকারত্বের সমস্যায় জর্জরিত ইরান সেদিন পশ্চিমী আধুনিকতাবিরোধী, সহি মুসলমান খোমেইনির মধ্যে মসীহা খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু তারপর কী হল? পৃথিবীর সব জায়গাতেই যা হয়, তাই। মেয়েরা হল বিপ্লবের সেবাদাসী, বিপ্লবের মুখ তো তারা নয়। অতএব সদ্যোজাত ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বেদিতে বলি হল মেয়েদের স্বাধীনতা। আঁটোসাটো ধর্মীয় বিধির ধারালো ছুরিতে মেয়েদের আগের জমানায় গজানো ডানাগুলি কুচ করে ছেঁটে দেওয়া হল। তাতে নিম্নবিত্ত পরিবারের পিতৃতান্ত্রিকতার চাপে হাঁসফাঁস করতে থাকা মেয়েদের অবস্থার বিশেষ তফাত হল না বটে, কিন্তু নতুন জমানা গলার ফাঁস হল উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের তুলনায় স্বাধীন মেয়েদের।
এই পুস্তক আলোচনার লেখকের মতন যারা আশির দশক চোখে দেখেছে, এই ইতিহাস তাদের অল্পবিস্তর জানা। সেই সঙ্গে এও জানা যে সামগ্রিক বিচারে ইসলামিক বিপ্লবের আগের কালের তুলনায় এখন জনজীবনের উন্নতি হয়েছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মুখ দেখেছেন। তবু আলোর পাশেই আঁধারও থাকে। শোনা যায়, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নিয়মের নিগড়ে মেয়েদের পিষে মারার গল্পও।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ইরানের মেয়েরা তাহলে সত্যি সত্যি কেমন আছেন? মধ্যপ্রাচ্যের মেয়েদের নিয়ে কিছু বইও আগে পড়া। ভাল লাগেনি। যেন সেখানকার মেয়েদের দুর্দশাকে রম্য মোড়কে মুড়ে বিশ্বের বাজারে বিক্রির চেষ্টা মাত্র। সহমর্মিতা নয়, বরং আরেক রকমের পণ্যায়নই বলা যায়। তাই সেই ধরণের বই নিয়ে কৌতূহলের গ্রাফ নিচের দিকে ছোটে।
কিন্তু এই বইয়ের প্রচ্ছদ টানল। দুই কৃষ্ণ পোষাকে আবৃত কন্যা খুব মন দিয়ে মাথা নিচু করে কী যেন দেখছে। তার উপরে ক্রিম রংয়ের প্রচ্ছদে লাল হরফে লেখা, Reading Lolita in Tehran। তলায় খুদে খুদে করে লেখা ‘A memoir in Books’। খোমেইনির তেহরানের মেয়েরা আর লোলিটা – এক আশ্চর্য বৈপরীত্যের শিহরণ বয়ে আনে, সেই সঙ্গে ‘মেমোয়ার ইন বুকস’ শব্দবন্ধ। সবমিলিয়ে বেশ একটা নিষিদ্ধ উত্তেজনা হাতছানি দিল কি?
সেই টানেই এই বই হাতে তুলে নেওয়া আর মুগ্ধ হয়ে পড়া। এই গল্প সাত কন্যার – মান্না (Manna), মাহশিদ (Mahshid), ইয়াসসি (Yassi), আজিন (Azin), মিত্রা (Mitra), সানায (Sanaz) আর নাসরিনের (Nassrin) গল্প। এরা একে অপরের থেকে আলাদা। প্রত্যেকের পারিবারিক পরিস্থিতি আলাদা। কেউ বিবাহিত, কেউ অবিবাহিত। কেউ ঘোর রক্ষণশীল বাড়ির মেয়ে, কেউ আবার প্রগতিপন্থী। মিল একটাই। এরা সাহিত্যের কারণেই সাহিত্য পাঠে তদ্গত। তবু মানুষের প্রতিটি অভিজ্ঞতার মূল্যায়নই তো তার আগের জানা বোঝার নিরিখে হয়। তাই সবার মনে ওঠা প্রশ্নগুলোও আলাদা, তাদের অনুভূতিও ভারি আলাদা ধাঁচের। তবে একটাই দুঃখ, যে বইটা উচ্চ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুবিধাভোগী মেয়েদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। নিম্নবিত্ত পরিবারের গৃহসহায়িকা গল্পের গতিতে পাঠকের মাঝখানে এসে পড়লেও, তার ভাষ্য অনুচ্চারিতই থাকে। তবে হয়ত সেটা এই কারণেই যে রচয়িতা আযার নাফিসির একমাত্র লক্ষ্য ছিল সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের যোগসূত্রের সন্ধান । অথচ সাহিত্যের আঙিনায় সেই পরিচারিকার পায়ের ছাপ না থাকারই কথা। সেটাই হয়ত তার অনুপস্থিতির কারণ।
ব্যক্তি নাফিসির সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখা যাক। এঁর পড়াশোনার বেশিরভাগটাই বিদেশে। রাজনৈতিকভাবে, ব্যক্তিগত কারণেও শাহতন্ত্রের বিরোধী। ১৯৭৯ সালে ইরানের প্রায় সব অভিজাতই যখন দেশত্যাগে ব্যস্ত, তখন উল্টো মুখে ইনি দেশে ফেরেন, তেহরান ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে শুরু করেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে এঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কারণ হিজাব পড়তে রাজি না হওয়া। ১৯৮৭ সালে আবার অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালের হেমন্তে রাষ্ট্রের নিরন্তর খবরদারি, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী উদ্ভট নিয়মকানুনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পদত্যাগ করেন।
চাকরি ছাড়ার পর তাঁর যখন বাইরের জগতের সঙ্গে একমাত্র সংযোগসূত্রটিও কেটে গেল, তখন সেই শূন্যতাকে জীবনের গান দিয়ে ভরে তুলতে চাইলেন, এই সাত কন্যাকে আমন্ত্রণ করলেন নিজের বাড়িতে। একটি সাপ্তাহিক পুস্তকালোচনার আসর বসালেন। মাত্র বছর দুয়েক সে আসরের মেয়াদ। তারপর নাফিসি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সে এক কঠিন সময়। মেয়েদের চলার পথ কবেই বা সুগম হয়েছে? আরেক সমসাময়িক ইরানী কন্যা শিরিন এবাদিরও একটি আত্মকথা আছে। সেখানেও ইরানি মেয়েদের জীবনের প্রতিফলন। ইসলামিক বিপ্লবের আগেও প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিকতার প্রেক্ষাপটে সদ্যজাগ্রত নারী স্বাধীনতাকে কতখানি সতর্ক হয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়েছে এবাদি সে কথা লিখেছেন। অবশ্য শুধু ইরান কেন, সে গল্প কি এ দেশেও অচেনা?
তবু বিপ্লবের পরে ইরানের মাটিতে ধর্মের ছায়ায় মেয়েদের জীবন আরও কঠিন। অথচ শাহ চলে যাবার পরে খোমেইনির হাতে ইরানকে তুলে দিতে নাফিসির মত অধিকাংশ শাহবিরোধীরই পূর্ণ সম্মতি ছিল। তাঁরা তখন পুরনোকে ভেঙেচুরে নতুন প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মশগুল, ফলাফল নিয়ে ভাবেননি। কিন্তু ১৯৭৯ সালের শরৎকাল থেকে ১৯৮০ সালের গ্রীষ্ম বহুদূর। এই সময়কালের মধ্যেই মেয়েদের বিভিন্ন অধিকার লোপ পেতে থাকল। ধর্মতন্ত্রের আওতায় নতুন করে মাথা চাড়া দিল নৈতিকতার প্রশ্ন। নিজের ক্লাসে নাফিসি ফিটজেরাল্ড পড়াতে গেলেন – দ্য গ্রেট গ্যাটসবি। বস্তুগত সম্পদ আর ক্ষমতালাভের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে বোনা আমেরিকান স্বপ্ন। ছুঁয়ে ফেললেই যে স্বপ্নের শেষ। কিন্তু সবার সাহিত্য দেখার চোখ, মন একইরকম পরিণত হয় না। সাহিত্য কাউকে কাউকে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেয় না। তাদের মন আটকে থাকে শুধুই বহিরঙ্গে। তর্ক শুরু হয়, সদ্যোজাত ইসলামিক নীতিবোধ অনুসারে এই বই কি অনৈতিক? অবশ্য শুধু এই বই নয়, বস্তুতান্ত্রিক পশ্চিমী সাহিত্যকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়। পশ্চিমী দুনিয়া সেসময় ইরানের শত্রু। পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাদের নিজস্বতাকে ধ্বংস করছে। সেই কথারই রেশ টেনে বলা হয়, যে মেয়েরা নতুন ইরানের বিধান অনুযায়ী পর্দা প্রথা মানে না, তারা বেশ্যা, শয়তানের সহচর। মেয়েরা কিন্তু চুপচাপ মেনে নেয় না। অকাট্য যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করে এই স্বৈরাচারী নিয়মের। তবু শেষরক্ষা হয় না। মেয়েদের পর্দা মানা বাধ্যতামূলক হয়। নিজস্ব পছন্দের স্বাধীনতা কথাটা উড়ে যায় জানলা দিয়ে। নাফিসি পর্দা মানতে রাজি হতে পারেন না। নিজের চাকরির বিনিময়ে এই সিদ্ধান্তের দাম চোকাতে হয় তাঁকে।
তারপর তো ইরানের সরকার গায়ের জোরে সবাইকে নীতি মানানোর চেষ্টা করে। নীতি পুলিসবাহিনী তৈরি হয়, রাস্তায় রাস্তায় টহল দেওয়া শুরু করে তারা। মেয়েদের জন্য হরেকরকম নিষেধের তালিকা। বেচাল দেখলেই জরিমানা, বেত্রাঘাত বা জেল। নাফিসিও সেই সব আইন মেনে নিতে বাধ্য হন। নাফিসির জাদুকরের সঙ্গে পরিচয় হয় পাঠকের। এই মানুষটি একটি প্রহেলিকা। নামহীন, বিশদ পরিচয়হীন। আমরা তাঁকে পাই নাফিসির ভাবনাচিন্তার দোসর হিসাবে। নিজের চারপাশে কড়া গণ্ডি টেনে রাখেন মানুষটি। অনেকটা যেন নাফিসির দ্বিতীয় সত্তা। বহু বছর পরে নাফিসি আবার পড়ানোর কাজে ফিরে যান। ১৯৮৭ সালে। তবে সে পর্ব ক্ষণস্থায়ী।
নাফিসি বলেছেন “our world under the mullah’s rule was shaped by the colorless lenses of the blind censor”। সেই অসহ্য টুঁটি টিপে ধরা বাস্তব থেকে পালানোর পথ তো নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। বই নিয়ে আলোচনার আসর হয়ে উঠল মেয়েদের সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তির জায়গা। ভার্জিনিয়া উলফের কথা ধার করলে বলা যায় “a space of their own”। নাফিসির বাড়িতে অন্য কোনো পুরুষ নেই। সেই সুযোগে মেয়েরা বাধ্যতামূলক কালো বোরখা-হিজাব খুলে ফেলতে পারে। রাষ্ট্রের দায় নেই মেয়েদের ব্যক্তি পরিচয় মনে রাখার। বোরখা তাকে শুধু মেয়ে বলেই দাগিয়ে দেয়। তারা প্রকাশ্যে মাথা নিচু করে, নিজেকে লোকচক্ষুর কাছে অপ্রকাশিত রেখে চলতে বাধ্য হয়। পুরুষহীন ঘরের সীমিত প্রশ্রয়ী পরিসরে মেয়েরা বোরখা খুলে ফেলে। গুটি থেকে প্রজাপতি বেরনোর মতন একেকজন স্বাতন্ত্র্যে ভরপুর ব্যক্তিমানুষের দেখা মেলে। আমরাও ধীরে ধীরে চিনে ফেলি তাদের চিন্তাভাবনা, জানতে থাকি তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা, আঁচ পাই তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার। সাহিত্যালোচনার আসর ছেড়ে গল্প ঢুকে পড়ে তাদের ব্যক্তিগত কথামালার, গোপন অনুভূতির অন্দরে। মেয়েদের চোখ দিয়ে খোমেইনির ইরান দেখতে থাকে পাঠক। ততদিনে সে দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স আগের আঠারো থেকে কমে নয় হয়েছে। আইনের চোখে মেয়েদের দাম ছেলেদের অর্ধেক বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। শরিয়তি বিধান আইন হয়ে উঠেছে।
সাত কন্যা একসঙ্গে ভ্লাদিমির নাবোকভ পড়ে, জেন অস্টেন পড়ে। সাহিত্য যেন নাফিসির বসার চেয়ারের উল্টোদিকের দেওয়াল-আয়না, দূরের তুষারকিরীটধারী পর্বতশীর্ষের টুকরো ছবি বুকে ধরে রাখে – জীবনের টুকরো টুকরো ছবিও ধরা থাকে সাহিত্যে। নাফিসির ব্যাখ্যায় পরতে পরতে উন্মোচিত হয় সাহিত্য-কল্পনার জগত। সেই সব ব্যাখ্যায় সাহিত্যের প্রথাগত দীক্ষাহীন পাঠকের কেমন চমক লাগে। মনে হয়, এভাবে তো আগে ভাবা হয়নি! নিজের অজান্তেই ওইসব ব্যাখ্যা শোনার লোভে সেও ওই পুস্তকালোচনার দলে ভিড়ে যায়। বিস্মিত হয়ে শোনে, লোলিটা উপন্যাসের মূল কথা অপার যৌনতা নয়, একের ফ্যান্টাসির খাঁচায় অন্যের জীবন আটকে যাওয়া। লোলিটার কেন্দ্রীয় চরিত্র হুম্বার্টের মধ্যে নাফিসি খুঁজে পান খোমেইনির ছায়া। দুজনেই নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা দিয়ে অন্যের জীবন চালাতে চান। পাঠক চিন্তায় পড়ে, দেশে দেশে যুগে যুগে ব্যক্তিমানুষের আড়ালে থেকে পিতৃতন্ত্রও কি ঠিক এইভাবেই মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়নি? আবার অন্যের জীবন চালাতে চাওয়ার দোষে দুষ্ট খোমেইনির মত পিতারা নিজেদের কর্তা ভাবছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরা কি সত্যিই স্বাধীন কর্তা, নাকি তাঁরাও আসলে প্রজন্মবাহিত ধর্মনীতি আর নিয়মতান্ত্রিকতার হাতের পুতুল? সে প্রশ্নও অবশ্য অমীমাংসিত রয়ে যায়।
আরো পড়ুন আমাদের যা জীবন: চোমান হার্দির কবিতা
তবু সাহিত্য শুধু অসাড় দর্পণ নয়, সে জীবনকে গভীরভাবে দেখতেও শেখায়। নাফিসি বলেন, উপন্যাস রূপক মাত্র নয় – উপন্যাসের কাল্পনিক জগতের পাত্র-পাত্রীদের সঙ্গে একাত্ম হতে না পারলে, তাদের সহমর্মী হয়ে উঠতে না পারলে, তাদের অভিজ্ঞতা আত্মবৎ ভাবতে না পারলে উপন্যাস পাঠ অসমাপ্ত রয়ে যাবে।
এক সময় গল্প ফুরোয়। কিন্তু ফুরিয়ে যেতে যেতে সে ছড়িয়ে দিয়ে যায় দেশের প্রতি, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারানোর যন্ত্রণা। নাফিসিও পাড়ি দেন আমেরিকায়। দেশ ছাড়েন, দেশের স্মৃতি তাঁকে ছাড়ে না। সেই স্মৃতির টুকরোকে কল্পনার মিশেলে নেড়েচেড়ে কাগজে বন্দি করেন ২০০৩ সালে। বই হয়ে বেরোলে প্রতীচ্যে তুমুল সমাদর পায় এই বই। যে ব্যক্তিস্বাধীনতা পশ্চিমের দেশগুলির নয়নমণি, এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে সেই ব্যক্তিস্বাধীনতা হারানোর বেদনা মিশে আছে। সেই সঙ্গে আছে পশ্চিমী চিন্তাধারার প্রতি সমর্থন।
কিন্তু সমাদরের সঙ্গে সঙ্গে কাঁটার মুকুটও মাথায় ওঠে। কেউ বলেন নাফিসির কলমে নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মেয়েদের বা বিভিন্নভাবে প্রান্তিক মেয়েদের কথা জায়গা পায়নি। দ্বিতীয় অভিযোগটি আরও গুরুতর। আরেক দল বলেন ইরানে বহুল প্রচলিত ইসলামিক নারীবাদ বিষয়ে নাফিসি নীরব। অথচ তাদের আন্দোলনেরও নারী অধিকার আদায়ে অবদান আছে। ইসলামিক নারীবাদীরা কোরানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে মেয়েদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেন। পুরুষদের সঙ্গে সমতা তাঁদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য নয়। নাফিসি এই মত মানেন না। তাঁর মা একদা সরকারের উচ্চ পদে আসীন ছিলেন। তাঁর কাছে স্বাধীনতা মানে আগে লিঙ্গসাম্য। ইসলামিক নারীবাদ তা মানে না।
সময় বদলায়, মানুষও বদলায়। শুধু বদলায় না মেয়েদের জীবনের দৈনন্দিনতা। তবু একদিন একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। সরকারি বিধি মেনে হিজাব না পরার অপরাধে মাহসা আমিনিকে নীতি পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং পুলিসি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। তারপর গোটা দেশে আগুন লাগে, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ইরানের মেয়েদের ভবিষ্যৎ কি পাল্টাবে? সময়ের হাতে আছে সেই উত্তর।
Reading Lolita in Tehran
Writer: Azar Nafisi
Publisher: Random House
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।