তিয়াষা গুপ্ত
“নিউইয়র্কের নারীর কি আইনের চোখে পুরুষের সমান হওয়া উচিত? যদি তাই হয়, তাহলে আসুন আমরা নারীর জন্য নিরপেক্ষ ন্যায়বিচারের আবেদন করি। এই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পুরুষদের মত নিউইয়র্কের নারীদেরও অধিকার থাকা উচিত। আইন প্রণেতা এবং প্রশাসক নিয়োগে তাঁদেরও বক্তব্য আছে। যদি তাই হয়, আসুন নারীর ভোটাধিকারের জন্য আবেদন করি।”
সালটা ১৮৫৩। গর্জে উঠল একটি দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। সেই স্বর ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের দাবিতে আন্দোলনকারী ফ্রেডরিক ডগলাসের। তাঁর একের পর এক ঝাঁঝালো বক্তৃতা নাড়িয়ে দিল সমাজ, দেশ, সময়কে। অনেক লড়াই পেরিয়ে মার্কিন মুলুকে প্রতিষ্ঠিত হল নারীর ভোটাধিকার। কীভাবে?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
গৃহযুদ্ধের পরে এবং দেশ পুনর্গঠনের শুরুতে যাঁরা দাসপ্রথার বিলোপ চেয়েছিলেন তাঁরা সর্বজনীন ভোটাধিকারের যুক্তি মেনে নেন এবং তার পক্ষে সওয়াল করেন। ফ্রেডরিক ছিলেন তেমনই একজন যিনি নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন এবং বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন যে নারী, পুরুষের নাগরিক অধিকার সমান হওয়া উচিত।
ডগলাস ছিলেন অ্যাবলিশনিস্ট আন্দোলনের নেতা। তিনি একসময় নিজেও ক্রীতদাস ছিলেন। ১৮৪৮ সালের সেনেকা ফলস উইমেনস রাইটস কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন এবং আফ্রিকান আমেরিকানদের অধিকারের পাশাপাশি নারী অধিকারেরও পক্ষে দাঁড়ান। ১৮৯৫ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেনে ডগলাসের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
শেষপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলারা কীভাবে ভোটাধিকার পেলেন এবার সেই আলোচনায় আসা যাক।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নিউজিল্যান্ড (১৮৯৩), অস্ট্রেলিয়া (১৯০২), ফিনল্যান্ড (১৯০৬) এবং নরওয়ের (১৯১৩) মহিলারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের ভোটাধিকার আন্দোলন এর ফলে জোর পায়। ব্রিটেনে মহিলাদের ভোটাধিকার আন্দোলনও তখন খবরের শিরোনামে, কারণ এমেলিন প্যাঙ্কহার্স্ট ও অন্য আন্দোলনকারীরা কারাবাস করতে হওয়ার পরেও ভোটাধিকার আদায় করার আন্দোলন থেকে সরে আসেননি। বিক্ষোভ, প্রদর্শনী এবং মিছিল অব্যাহত থাকায় এই আন্দোলনের জনসমর্থন বৃদ্ধি পায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরের ঘটনা ইউরোপের দেশগুলিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যত্র নারীদের ভোটাধিকার নিয়ে আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দেয়। ১৯১৯ সালে মার্কিন কংগ্রেস সংবিধানের উনবিংশ সংশোধনী পাস করে, যা ১৯২০ সালে অনুমোদিত হয়। এর ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকৃতি পায়। যদিও এরপরেও কর, স্থানীয় আইন ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের ভোটাধিকার আটকানো যেত। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমেরিকান মহিলারা দেশের বিভিন্ন অংশে ভোটাধিকার অর্জন করার সঙ্গে সঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার ১৫% পর্যন্ত কমে যায়। অন্য এক সমীক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের ভোটাধিকারের সঙ্গে স্কুলে ব্যয় বৃদ্ধি এবং শিশুদের স্কুলে ভর্তির যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
নির্বাচনে মহিলারা ক্রমশ জয়লাভ করতেও শুরু করেন। ওয়াইমিংয়ের নেলি টেইলো রস ১৯২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা গভর্নর হয়েছিলেন এবং আরকানসাসের হ্যাটি ওফেলিয়া ক্যারাওয়ে ১৯৩২ সালে প্রথম মহিলা হিসাবে মার্কিন সেনেটে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে নেভাদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাজ্যে পরিণত হয়, যেখানে মহিলারা রাজ্যের আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয় করেন।
এবার আসা যাক অন্যান্য দেশের আলোচনায়, শেষে আসব ভারতের কথায়। কীভাবে ভোটাধিকার পেয়েছেন ব্রিটেনের মেয়েরা?
“তুমি যে হাসপাতালে সেটা শুনে খুব খুশি হলাম। কামনা করি আমৃত্যু যেন তুমি যন্ত্রণা ভোগ করো। নির্বোধ কোথাকার!” এটি একটি চিঠির লাইন। নিচে সই ‘একজন ইংলিশম্যান’। অর্থাৎ প্রেরক কে তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে এবং হত্যার অভিপ্রায়েই যে একজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে তা বোঝার জন্যও খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। ১৯১৩ সালের জুন মাসে এমিলি উইল্ডিং ডেভিসন যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তাঁর কাছে এই চিঠি আসে। এমিলি ছিলেন মেয়েদের ভোটাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। এর কয়েকদিন আগে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা এপসম ডার্বিতে ভোটাধিকার চেয়ে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিলেন এমিলি। তিনি সেখানে রাজার ঘোড়ার সামনে লাফিয়ে পড়েন এবং তাঁর উপর দিয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত এমিলিকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর জ্ঞান আর ফেরেনি। সেখানেই ৮ জুন তিনি মারা যান। মেয়েদের ভোটাধিকারের আন্দোলন এক নতুন বাঁক নিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর ঘটনায়।
এমিলি হাসপাতালের বিছানায় যেসব অভিশাপে বিদ্ধ চিঠি পেয়েছিলেন, তা থেকে বোঝা যায় কতখানি ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং হুমকির মোকাবিলা করতে হচ্ছিল ভোটাধিকারের আন্দোলনে সামিল মেয়েদের। বিশ শতকের শুরুতেও ব্রিটেনে মেয়েরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পুরুষদের তুলনায় তাদের স্বাধীনতা এবং অধিকার ছিল সীমিত। ভোটাধিকার পেতে মহিলারা একের পর এক দরখাস্ত লিখেছিলেন, সভা করছিলেন। আলাপ আলোচনায় যে চিড়ে ভিজবে না তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগল না। ঘুরল আন্দোলনের অভিমুখ। তাঁরা সরাসরি রাস্তায় নামলেন। তাঁদের নেত্রী ছিলেন এমিলি প্যাঙ্কহার্স্ট। ব্রিটেনের ডেইলি মেল পত্রিকা মেয়েদের ভোটাধিকার আদায়ের এই গোষ্ঠীটির নাম দিয়েছিল ‘সাফ্রাজেটস’। সেই নামেই তাঁরা পরিচিত হয়ে উঠলেন এবং ইতিহাস বদলে দিলেন।
ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাঁরা দুঃসাহসিক সব কাজ করতেন। বাড়িঘরের উপর হামলা চালাতেন, নিজেদের শিকল দিয়ে বাড়ির রেলিংয়ের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। ব্রিটেনের পত্রপত্রিকা এবং জনমত তাঁদের বিপক্ষে চলে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। সাফ্রাজেটরা লোকের বাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙতেন, টেলিগ্রাফের তার কেটে দিতেন, লেটার বক্সের ভিতর বোমা রেখে দিয়ে আসতেন। ফলে পুলিস ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। জেলে তাঁরা অনশন করলে জোর করে খাওয়ানো হত। শেষ পর্যন্ত ১৯১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলনের জয় হল, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে নারীদের ভোটাধিকার দিল। শর্ত হল বয়স হতে হবে তিরিশের বেশি এবং বাড়ির মালিক হতে হবে। সর্বজনীন ভোটাধিকারের জন্য মেয়েদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯২৮ সাল পর্যন্ত। অবশ্য ১৯১৯ সালে হাউস অব কমন্সে প্রথম মহিলা সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হন ন্যান্সি অ্যাস্টর।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে নারীর ভোটাধিকারের পক্ষে বিভিন্ন দেশে আন্দোলন শুরু হয়। মহিলাদের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৬১ সালে। কালক্রমে এই আন্দোলন গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেয়েদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় ১৯২০ সালে। ফ্রান্স ও ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং জাপানে ১৯৪৭ সালে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। সুইটজারল্যান্ডের মত দেশে মহিলারা ভোটাধিকার পান মাত্র পাঁচ দশক আগে – ১৯৭১ সালে। কিন্তু অ্যাপেনজেল ইনেরহোডেন নামে ক্যান্টনটিতে সম্পূর্ণ ভোটাধিকার পেতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯০ সালের একটি রায় পর্যন্ত।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তবে সব দেশে মেয়েদের অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত, তা কি বাজি রেখে বলা যায়? অন্তত আমার দেশে তো টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যায় গার্হস্থ্য হিংসা, গণধর্ষণ এবং মণিপুরে নগ্ন করে গোটা গ্রাম ঘোরানো মত ঘটনা।
আরো পড়ুন ধর্ষণ তো রাজনৈতিক অস্ত্র, বিলকিস বানোর মুক্তি কোথায়?
এ দেশের মেয়েদের ভোটাধিকার পাওয়ার ইতিহাসটি কীরকম? ভারতে মহিলাদের ভোটদানের প্রক্রিয়া ব্রিটিশ শাসনেই শুরু হলেও তার ব্যাপ্তি ছিল খুবই সীমিত। ১৯২০ সালে সংস্কারের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হলেও ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান লাগু হওয়ার আগে সব নারীর ভোটাধিকার ছিল না। ১৯৫১ সালের আগে পর্যন্ত সেই মহিলারাই ভোট দিতে পারতেন যাঁদের জমির মালিকানা ছিল অথবা যাঁরা বিবাহসূত্রে জমির মালিকানা লাভ করেছিলেন। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশরা মহিলাদের ভোটাধিকার দিলেও অন্যান্য ব্রিটিশ অধিগৃহীত জায়গায় নারীদের সেই অধিকার ছিল না। ১৯১৯ সালে ভারতের নারীর ভোটাধিকারের আইন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস না হলেও প্রভিন্সিয়াল সরকারগুলিকে তা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
১৯৪৬ সালে ভারতের সংবিধান সভায় ১৫ জন মহিলা নির্বাচিত হন। তাঁরা পরবর্তীকালে ভারতের সংবিধান প্রণয়নেও অংশগ্রহণ করেন। সংবিধান মহিলাদের ভোটাধিকার দেয়। গত শতকের নয়ের দশকে পুরুষ এবং মহিলা ভোটারের ভোটদানের পার্থক্য প্রায় ১০% ছিল, কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে তা প্রায় সমান হয়ে গেছে।
মোদ্দা কথা, কয়েক জায়গায় অন্যরকম হলেও বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মেয়েদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে। বড়দাস্থানীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনেও এই অধিকার সহজে পায়নি মেয়েরা। তবে এত করেও নারী কি আজ ঘরে-বাইরে নিরাপদ? এ দেশে আমরা কি আজও জোর গলায় বলতে পারি, “নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেন নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?” মণিপুরের মত ঘটনা যখন ঘটে, তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়, এ কার রাষ্ট্র? কার সংবিধান? মেয়েদের কি?
নিবন্ধকার অভিজ্ঞ সাংবাদিক। টিভি, কাগজ, ওয়েবসাইটে মূলত সম্পাদনার কাজে যুক্ত থেকেছেন। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।