দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের গণআন্দোলনের শূন্যতায় ভুগছে পশ্চিমবঙ্গ। অথচ লাগাতার শোষণ আর লুঠতরাজের ঘটনার কমতি নেই। এ রাজ্যে গত কয়েকদিনে হঠাৎই সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে রেল হকারদের সঙ্গে রেলওয়ে পুলিস ফোর্সের (আরপিএফ) সংঘর্ষের ঘটনা। কিন্তু এই সংঘাত আচমকা ঘটছে না। দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র আরপিএফ বাহিনী রেল হকারদের উপর জোরজুলুম খাটিয়ে চলেছে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি এবং তাদের শ্রমিক সংগঠনগুলি অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই বড়সংখ্যক গ্রামীণ শ্রমজীবীদের দিকে নজর না দেওয়ায় এই সমস্যা একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে। হয়ত এভাবে প্রকাশ্যে আরপিএফের হাতে তুমুল মার না খেলে হকারদের নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যম খবরও করত না। এখানে সমস্যা রয়ে গিয়েছে অনেকগুলি। প্রথমত, ইউপিএ সরকারের শেষ বছরে ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর The street vendors (protection of livelihood and regulation of street vending) Bill লোকসভায় পাস হয়। তাতে শহরের পথব্যবসায়ী হকাররা স্বীকৃতি পেলেও রেলস্টেশনে কর্মরত হকাররা এই আইনের অন্তর্ভুক্ত হননি।
দ্বিতীয়ত, রেল হকারদের রোজগার বর্তমানে নতুন বিপদের সম্মুখীন, কারণ স্টেশনে কিছু নতুন নতুন বড় আইআরসিটিসির স্টল গজিয়ে উঠছে। সেই স্টলগুলি অন্যায়ভাবে অনেক লোককে নিযুক্ত করছে শুধু স্টেশনে নয়, রেলগাড়িতে উঠে হকারি করার জন্য। এই সব বড় স্টলের বরাত পাচ্ছে বাইরে থেকে আসা কিছু অবাঙালি ব্যবসায়ী, যাদের সঙ্গে আরপিএফ ও আইআরসিটিসির আঁতাত রয়েছে। অন্তত তেমনটাই দাবি করছেন দীর্ঘদিনের রেল হকাররা। আরপিএফের মদতে যেসব বড় বড় স্টল স্টেশনে গজিয়ে উঠছে, তারা ব্যাপক পুঁজি এবং শস্তার কর্মচারী থাকার সুবাদে রেলেও পণ্য বিক্রি করাচ্ছে। এটি মূলত কর্পোরেট আওতায় থাকা ব্যবসা, কারণ যে নামেই স্টল হোক, তার পণ্যের সরবরাহ মাধ্যম, জোগানদার বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাই। ফলে ঘুরপথে খুচরো ব্যবসায় কর্পোরেটের অনুপ্রবেশও ঘটে যাচ্ছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তৃতীয়ত, রেলে হকারি বেআইনি – এই মর্মে ১৪৪ ধারায় হকারদের কেস দেওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মাসে দুই থেকে তিন বার ১,৪৫০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। খাতায় কলমে যদি দুজন হকারকে কেস দেওয়া হয়, তাহলে অলিখিতভাবে বাকি আটজনকে ঘুষ দিয়ে বাঁচতে হয়। অর্থাৎ একজন হকারের মাসে কম করে ৬,০০০ টাকা জরিমানা দিতেই বেরিয়ে যায়। তবে কেস যে শুধু একটি ধারাতেই দেওয়া হয় তাও নয়। লেডিস কম্পার্টমেন্টে ওঠার মিথ্যে কেস থেকে আরম্ভ করে আরও নানা বেআইনি কার্যকলাপের ধারায় আরপিএফ হকারদের কেস দিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ। রেলপুলিসের হাত থেকে পালাতে গিয়ে হকার রেললাইনে কাটা পড়েছেন, এমন হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটেছে।
চতুর্থত, ‘অমৃতভারত’ স্টেশন গঠন ও কর্পোরেটিয় উন্নয়নের জন্য যে মেট্রো প্রকল্পের কাজ চলছে তাতে অনেক ক্ষতি হচ্ছে হকারদের। রেললাইন সংলগ্ন অঞ্চলে চলছে দেদার বস্তি উচ্ছেদ।

দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের খড়্গপুর ডিভিশনের রেল হকারদের সমীক্ষা করতে গিয়ে সাংগঠনিকভাবে জেনেছি তাঁদের রুজি রোজগার, আর্থসামাজিক অবস্থানের প্রসঙ্গে। তাঁদের মতে, জাতীয় বাংলা সম্মেলন ও বঙ্গীয় হকার সম্মেলনের ব্যানারে তাঁরা সংগঠিত হওয়ার পর আরপিএফের অত্যাচার অনেক কমেছে। আগে ধরলেই কম করে ১,৫০০ টাকা ‘বিট’ (রেললাইনের পরিভাষা), অর্থাৎ জরিমানা দিতে হত। এরকম মাসে তিন থেকে চারবার দিতে হত। রেল পুলিসের অত্যাচার বন্ধ হোক, রেলে হকারিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হোক – এটাই তাঁদের সকলের দাবি। কারণ এখনো রেলওয়ে আইন অনুসারে ট্রেনের ভিতরে হকারি বেআইনি। যে পেশার সামাজিক স্বীকৃতি এত প্রবল তার আইনি স্বীকৃতি নেই আজও। এই রেল হকারদের মাল সরবরাহ করেন এলাকার ছোট ব্যবসায়ী-মহাজনরা। উল্লেখযোগ্যভাবে, তাঁরা রেল হকারদের আন্দোলনের পাশে থেকেছেন সবসময়। এখানে মহাজনেরা চিরকালীন রক্তপিপাসু সুদখোর পরিচয় প্রযোজ্য নয়। হকার-মহাজন-স্থানীয় উৎপাদন এক ত্রিশঙ্কু। এই ত্রিশঙ্কু বিকেন্দ্রীভূত ক্ষুদ্র পুঁজির আকারে মিথোজীবিতার অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্র সৃষ্টি করেছে। যেভাবে একদা অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘হকার বাঁচাও’ আন্দোলনের পরিধি বিস্তৃত করে একে ‘হকার আর্থব্যবস্থা বাঁচাও’ আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।১ সেই উপদেশ স্মরণে রাখা দরকার।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর হাওড়ায় রেল হকারদের উপর আরপিএফের বর্বর আক্রমণ এবং যুব নেতৃত্ব হিমাদ্রি বটব্যাল ও দেবারতি সরকারের গ্রেফতারির প্রতিবাদে, সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও অন্যান্য গণসংগঠন এবং সমাজকর্মীদের উপস্থিতিতে, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক বৈঠকের ডাক দিয়েছে জাতীয় বাংলা সম্মেলন। আন্দোলনরত রেল হকারদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন জাতীয় বাংলা সম্মেলনের সভাপতি সিদ্ধব্রত দাস। সংগঠনের কর্ণধার হিসাবে তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং তাঁকে আরপিএফ কীভাবে শারীরিক হেনস্থা করেছে তা ইতিমধ্যেই সোশাল মিডিয়ায় দেখে ফেলেছেন বহু মানুষ।
আরো পড়ুন কেন্দ্রীয় কর্মসূচি নয়, প্রান্তিক মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে বাম আন্দোলনে
মূলত পেশাগত নিরাপত্তার দাবি এবং আরপিএফ কর্তৃক হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের দিল্লি থেকে চাপিয়ে দেওয়া ভাষিক আগ্রাসন ও লাগাতার শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধতা এই রেল হকারদের প্রধানতম কর্মসূচি। যে রেলব্যবস্থা এতদিন ছিল তাঁদের রুজি রোজগারের একমাত্র পথ, তাঁদের ঘরবাড়ি, সেখান থেকেই আজ উন্নয়নের কালো ধোঁয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁরা উচ্চারণ করছেন এমন স্লোগান – রেলের জমি মানে আমার বাপের জমি। এহেন ক্রোধান্বিত রাজনৈতিক উচ্চারণ, বহুদিন পর বাংলার আকাশে বাতাসে ঘুরছে। ‘লাঙল যার জমি তার’ যে বাংলার স্লোগান ছিল, সেই বাংলা নিঃসন্দেহে এই শ্রেণিঘৃণাকে চিনে নেবে।
সূত্র
১. বিশ্বরাষ্ট্র নির্মাণ প্রক্রিয়া, সবুজায়ন ও নীল আর্থব্যবস্থার বিকাশ: এক নীলকন্ঠ ভারতের ইতিবৃত্ত- দীপঙ্কর দে (প্রকাশক- কলাবতী মুদ্রা)
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।