রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে দুটি আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে রাজি তৃণমূল। তার মধ্যে একটি আসন যদি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বামফ্রন্টকে ছাড়া হয় তাতে রাজ্যের শাসক দলের আপত্তি নেই। একাধিক প্রথমসারির সংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। তা নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। স্বাভাবিকভাবেই বাম এবং কংগ্রেসের দিকে উড়ে আসছে তৃণমূল সমর্থকদের কটাক্ষ।
রাজনীতিতে কটাক্ষ শুনতেই হয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একদা মহাশক্তিধর বাম দলগুলো এবং কংগ্রেসের যা হাল, তাতে প্রবল পরাক্রমশালী তৃণমূল এবং বিজেপির কাছে তাঁরা খানিকটা হাসির খোরাক হতেই পারেন। বিশেষ করে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে জয় পেয়ে তৃণমূল অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী; বাম, কংগ্রেসের ভোট আবার তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিজেপিবিরোধী জোট ইন্ডিয়াতেও বামপন্থীদের তুলনায় তৃণমূল অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রদেশ কংগ্রেসের তৃণমূলবিরোধিতাকেও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে অন্তত এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
লোকসভা নির্বাচনের আগে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, যে বাংলায় ইন্ডিয়া জোটের প্রধান নিয়ন্ত্রক তৃণমূল। জোটের বৈঠকেও সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে রাজ্যে জোটভুক্ত কোনো বিরোধী দল ক্ষমতায় আছে, সেখানে আসন বন্টনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তারাই। যেমন তামিলনাড়ুতে ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিন, ঝাড়খণ্ডে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। সেই হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী নিঃসন্দেহে তৃণমূল কংগ্রেস। গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের ফলের বিচারে সত্যিই কংগ্রেসের ভাগে দুটির বেশি আসন পড়ার কথা নয়।
কিন্তু ভোটের রাজনীতি তো কেবল পাটিগণিতের হিসাবে চলে না, সেখানে বড় ভূমিকা নেয় রসায়ন। পশ্চিমবঙ্গের দুটি সাম্প্রতিক নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। ২০১৬ সালে রাজ্যে মাত্র তিনটি বিধানসভা আসন জিতেছিল বিজেপি, ভোট পেয়েছিল দশ শতাংশের কাছাকাছি। মাত্র তিন বছর পর, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই তাদের উল্কাসম উত্থান হল। নেহাতই পাটিগণিতের হিসাবে এই উত্থান ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। যে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ভোটার ২০১৬ সালে বিজেপিকে ভোট দেননি, গত লোকসভা নির্বাচনের মোদী হাওয়া, বাম-কংগ্রেসের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে জমাট বাঁধা ক্ষোভ তাঁদের বিজেপির দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আবার ২০২১ সালে তৃণমূল যে বেশকিছু দুর্গ পুনরুদ্ধার করে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরল, তার মূলেও পাটিগণিত নয়, রসায়ন। ২০২৪ সালের নির্বাচনকেও তাই কেবল গত লোকসভা বা বিধানসভার ফলের নিরিখে বিচার করলে পুরোপুরি ঠিক হবে না, বিচার করতে হবে রসায়নের নিরিখেও। সেক্ষেত্রে তৃণমূলের এই ৪০-২ ফর্মুলাকে খানিকটা ঔদ্ধত্য বলে মনে হওয়াও অসম্ভব নয়।
সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনেও পুরোপুরি দিল্লিতে সরকার গড়া বা ফেলার ভিত্তিতে ভোট হয় না, প্রাধান্য থাকে রাজ্যস্তরের ইস্যুর। একমাত্র ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরবর্তী নির্বাচনটি (১৯৮৪) ছাড়া বাকি প্রায় সব লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। বাংলায় বামফ্রন্টের ভিত টলে যাওয়ার নেপথ্যে প্রধানতম ভূমিকা পালন করেছিল ওই ভোট। রাজ্য তখন জমি আন্দোলনে উত্তাল। তার বিপুল প্রভাব পড়েছিল ওই ভোটে। আবার ২০১৪ সালে দেশে বিপুল মোদী ঝড় চললেও বাংলায় তখনো তৃণমূল সরকারের মধুচন্দ্রিমা কাটেনি। ভোট বাড়ালেও সাফল্য পায়নি বিজেপি। ২০১৯ সালের ভোটে দেশজুড়ে মোদী হাওয়ার প্রভাব খানিকটা থাকলেও অনেক বেশি ক্রিয়াশীল ছিল তৃণমূলবিরোধী ক্ষোভ। বিশেষত ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হওয়া বিপুল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধতা।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর আড়াই বছর কেটে গিয়েছে। নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে মধ্য এবং নিম্নবিত্ত জনতার কাছে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা তলানিতে। একের পর এক নেতা, কর্মীর গ্রেফতারি তৃণমূলকে রীতিমত অস্বস্তিতে রেখেছে। বিরোধীরা বারবার ‘চোর’ বলে যে আক্রমণ করছেন, তা সাধারণ মানুষের কাছে খানিকটা প্রশ্রয় যে পাচ্ছে তা রাস্তাঘাটে কথা বললেই বোঝা যায়। আবার একথাও ঠিক, গ্রামাঞ্চলে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ তুলনামূলকভাবে কম। সেখানে ক্ষোভের নিশানায় শাসক দলের বড়, মেজ, ছোট নেতারা। একশো দিনের কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্পে লাগামছাড়া দুর্নীতি। বস্তুত, গ্রামে গ্রামে শাসকদলের সমর্থনপুষ্ট একটি ছোট অংশের ক্ষমতায়ন ঘটেছে। তারাই হয়ে উঠেছে এলাকার নিয়ন্ত্রক পাইক, বরকন্দাজ। এই অংশটিই পঞ্চায়েতে ভোট লুঠ করে তৃণমূলের দখলদারি কায়েম রেখেছে। একইসঙ্গে একথাও ঠিক, তৃণমূল সরকারের বহু জনমুখী প্রকল্পের প্রতি মানুষের সমর্থনও রয়েছে। আগের মতো সম্মোহনী শক্তি না থাকলেও এখনো বাংলার জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক মুখ মমতা ব্যানার্জি। ‘দিদি ভালো, ওঁর আশেপাশের লোকগুলো খারাপ’ – এই বয়ান এখনো শক্তিশালী। তাছাড়া মনে রাখা দরকার, বাংলায় সবসময়েই শাসক দল অন্তত ৪০% ভোট পেয়েই থাকে, বিরোধীরাও দুর্বল। ফলে অন্তত সাংগঠনিকভাবে তৃণমূল অনেকটাই এগিয়ে থেকে নির্বাচনে যাবে।
তবে রাজ্যের হিন্দু ভোটারদের মধ্যে মেরুকরণ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। এর পিছনে সংঘ পরিবারের নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা রয়েছে, যা বহু আলোচিত। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই এমন ঘটনা ঘটানো হয়। নরেন্দ্র মোদীকে হিন্দুদের নেতা হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টাও প্রবল। ধূপগুড়ির ফলাফল বিজেপির রাজবংশী ভোটের জন্য চিন্তার কারণ হলেও মতুয়া ভোট অনেকটাই অটুট। সার্বিকভাবেই রাজ্যের তফসিলি জাতি, উপজাতির ভোটের সিংহভাগ বিজেপির সঙ্গে। পঞ্চায়েতে নদীয়া সমেত কিছু এলাকায় এই ভোট বামেদের দিকে এলেও লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে হারাতে বিজেপির দিকে না যাওয়ার কোনো কারণ নেই। সংখ্যালঘু ভোটে তৃণমূলের একক আধিপত্য একেবারেই নেই। সাগরদিঘির ফল এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন (প্রবল সন্ত্রাস ও কারচুপি সত্ত্বেও) তা বুঝিয়ে দিয়েছে। রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটারদের একটা বড় অংশ বিজেপির জুজু দেখে আর তৃণমূলের দিকে ঝুঁকছেন না। তাঁরা ভরসা করছেন কংগ্রেস-বাম জোটকে, বিশেষত কংগ্রেসকে। মুর্শিদাবাদ জেলার তিনটি আসন, মালদহের দুটি আসন, উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ – এই ছটি আসনেই সংখ্যালঘু ভোট পেতে পারে রাহুল গান্ধীর দল। কারণ সংখ্যালঘুদের কাছে বিজেপিকে হারানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাহুল নিজেকে প্রশ্নাতীতভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান মুখ হিসাবে তুলে ধরেছেন। এই ছয় আসনে কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবেও অপেক্ষাকৃত সবল। এর মধ্যে মুর্শিদাবাদ আসনে সিপিএমের শক্তিও যথেষ্ট। যদি বাম-কংগ্রেস এককভাবে জোট করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ে, তাহলে তৃণমূল সমস্যায় পড়বে। আপাতত বিজেপির দখলে থাকা মালদহ উত্তর আসনেও কংগ্রেস ভাল লড়াই দেবে। লোকসভা নির্বাচনের আগে রাহুল গান্ধীর সক্রিয়তা যত বাড়বে, সংখ্যালঘু ভোট ততই তাঁর দিকে সরে আসার সম্ভাবনা বাড়বে। একচল্লিশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের আসন ডায়মন্ড হারবারেও সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে পারেন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের নেতা নওশাদ সিদ্দিকি। সেই আসনে তৃণমূলের যুবরাজ এগিয়ে থাকলেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন কি? একই কথা বলা যায় বসিরহাটের বিষয়েও। সংখ্যালঘু ভোটকে একুশ সালের হিসাবে দেখলে তৃণমূল হয়ত ভুল করবে।
আরো পড়ুন মোদী নয় তো কে? উত্তর রাহুল গান্ধী
বামেদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের জোটের কোনো আশু সম্ভাবনা নেই। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হলে লাভ মূলত তৃণমূলের। কারণ তাতে মুসলিম ভোটের বিভাজন বন্ধ হবে। এই জোট না হলে ভোট কাটাকাটিতে বিজেপি বেশকিছু আসনে এগিয়ে যেতে পারে। কাজেই কংগ্রেসকে তৃণমূলের আসন ছাড়া কোনো দয়ার দান নয়, বরং রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। তৃণমূলের সঙ্গে জোট না করলে বরং সাংগঠনিকভাবে লাভবান হবে কংগ্রেসই। নির্বাচন যেহেতু পাটিগণিত নয়, বরং রসায়নের খেলা, তাই তৃণমূলের ৪০-২ ফর্মুলাকে ঔদ্ধত্য বা ফাঁকা আওয়াজ মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।