ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ, এবারে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পালা। ফেরার পালা তাদের, যাদের একমাসব্যাপী বিনোদনে গা ভাসানোর অস্বাভাবিক বিলাসিতা করা সম্ভব। কিন্তু যাদের পক্ষে সম্ভব নয়, সম্ভব হয়নি, তাদেরই একজন হয়ত বিলকিস বানো। গত ১৩ মে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর ১১জন ধর্ষক এবং তাঁর পরিবারের সাতজন সদস্যের হত্যাকারীদের কারাবাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মুক্ত করে দিয়ে প্রায় মানবতার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেন বলা যায়। তবে যেহেতু হাল ছাড়া বিলকিস বানোদের স্বভাব নয়, তাই এই আগাম মুক্তির সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানো হয় আদালতে। গত ১৬ ডিসেম্বর সেই আবেদনও খারিজের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, গুজরাট সরকার ইতিমধ্যেই ওই অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার কারণ জানাতে অস্বীকার করেছে।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন, বিলকিসরা যাবে কোথায়? বিলকিস তো আর একজন নন, ভারতে তাঁর মত হাজার হাজার মহিলা ধর্মীয় হানাহানি, সামাজিক ওলট-পালটের আবহে ধর্ষিত হন। তাঁরা কী করে প্রতিকার পাবেন? আজকের ভারতে এই প্রশ্নের সদুত্তর কারোর কাছে নেই।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আজকের ভারতবর্ষ কেন বলছি? কারণ বিলকিসের জীবনে ঘটে যাওয়া ওই মর্মান্তিক ঘটনার সময় এবং ওই অপরাধীদের মুক্তির সময়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় বিজেপি, যারা তাদের সংখ্যাগুরু প্রীতি এবং সংখ্যালঘু বিরোধিতা সম্পর্কে সোচ্চার। বিজেপি সঙ্ঘ পরিবারের অংশ আর সেই পরিবারের আদর্শ যে হিন্দুত্ববাদ, তার প্রাণপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর সিক্স গ্লোরিয়াস ইপকস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি বইতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলেছেন মুসলমান মহিলাদের ধর্ষণ করা যুক্তিযুক্ত। শুধু তাই নয়, বিশেষ ক্ষেত্রে তা না করা কাপুরুষতার প্রমাণ। অর্থাৎ ধর্ষণ সাভারকরের মতে রাজনৈতিক অস্ত্রবিশেষ।

এই সাভারকরের অনুসারীদের শাসনকালে দেশের পরিস্থিতি যে ক্রমশ নারীদের প্রতিকূল হবে, সেকথা বলাই বাহুল্য। যে দেশে এমনিতেই প্রতিদিন নারীর যৌন হেনস্থার ঘটনা বেড়ে চলছে, সেখানে দাঙ্গার সময়ে গণধর্ষণের মত অপরাধের জন্য দণ্ডিতরা যদি কোনো যথাযথ যুক্তি ছাড়াই মুক্তি পায়, সে দেশে মেয়ে হিসাবে ন্যায়বিচারের আশায় বুক বাঁধি কোন সাহসে?
আজকের ভারতবর্ষে একজন নারী হিসাবে নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে চলি, ওই ১১ জনের তো মুক্তি হল, বিলকিসদের মুক্তি কোথায়? ভাবতে গেলে রাগ হয় না, ক্ষোভে ফেটে পড়ি না, চিৎকার করতেও ইচ্ছে করে না। স্রেফ হতাশ লাগে। দোষীদের মুক্তির পর তাদের মালা পরিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়ে যাঁরা বরণ করে নিলেন যে মহিলারা, তাঁদের অন্তরে কি কোনো বিলকিস নেই? তাঁরা কি ভেবে দেখেননি বিলকিসের পরিণতি তাঁদেরও হতে পারত? ধর্ষণের অপরাধ বীরত্ব বলে স্বীকৃত হয়ে গেলে ভবিষ্যতেও হতে পারে ভেবেও কি তাঁদের বুক কাঁপেনি মালা পরানোর সময়ে?
আরো পড়ুন বিলকিস বানো: ছাত্রীর সঙ্গে অসমাপ্ত আলোচনা
আরও অদ্ভুত লাগে, যখন ভেবে দেখি এই যুক্তিহীন মুক্তির তারিখের কথা – ১৫ আগস্ট, ২০২২। ভারত সেদিন ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ উদযাপন করছিল, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পতাকা উত্তোলনের পরে নারী জাগরণ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন দেশের রাজধানীতে। ঠিক সেইসময় বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করা হচ্ছিল, সিলমোহর পড়ছিল। কী নিষ্ঠুর সমাপতন, তাই না?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।