পরিসংখ্যান বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের আর সব দেশের চাইতে এগিয়ে। না, উন্নয়নের কোনো মাপকাঠি বা মানবাধিকারের কথা হচ্ছে না। প্রসঙ্গ কোভিড-১৯ আক্রান্ত এবং করোনাজনিত মৃত্যু। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, করোনা অতিমারীতে ২৩ জানুয়ারি ২০২০ (যেদিন প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী ধরা পড়ে) থেকে ২২ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত মোট ১০ কোটি তিন লক্ষের বেশি মানুষ কোভিড পজিটিভ হয়েছেন, অর্থাৎ এটা কোভিড-১৯ কেসের সংখ্যা (অনেকে একাধিকবার পজিটিভ হয়েছেন)। কোভিড-১৯ জনিত কারণে মারা গেছেন ১০ লক্ষ ৯০ হাজার। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, যে মোট কোভিড-১৯ পজিটিভের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ভারতবর্ষ, যেখানে সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে এখন অবধি সাড়ে চার কোটি কেস ধরা পড়েছে এবং মৃতের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ৩০ হাজারের কিছু বেশি।

নিঃসন্দেহে বিভিন্ন দেশের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার প্রবণতা বা ক্ষমতা সমতুল্য নয়। কমবেশি সব দেশেই সরকারি পরিসংখ্যান খুব সম্ভবত প্রকৃত সংখ্যার থেকে কম। তবে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে এই অসামঞ্জস্য সঙ্গত কারণেই বেশি। ভারতবর্ষে সরকারি গণনা অনুযায়ী করোনা-মৃত্যু যখন মোট ৪.৮ লক্ষ ছিল, গবেষকরা অনুমান করেন যে করোনাজনিত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মৃত্যু আসলে ছিল ৪৭ লক্ষের বেশি, অর্থাৎ প্রায় দশ গুণ। বলাই বাহুল্য গাণিতিক পদ্ধতিতে নির্ণীত এই “excess deaths” এর সংখ্যা ভারতীয় সরকার বাহাদুরকে বেজায় রুষ্ট করেছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র ওই রিপোর্ট নাকচ করে ভারতীয় স্বাস্থ্য দপ্তর সরকারি পরিসংখ্যানকে নির্ভুল হিসাবে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

যাকগে, ফিরে আসি মার্কিন প্রসঙ্গে। গড়ে প্রত্যেক দিন ৬০,০০০-এর বেশি কোভিড-১৯ আক্রান্ত ধরা পড়ছে এখন, ৪০০-৫০০ জনের জীবনাবসান ঘটছে। আমেরিকার ফ্লু মরসুম এবং অন্যান্য শ্বাসপ্রশ্বাস দ্বারা সংক্রমিত অসুখ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে এবং বলা বাহুল্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার (কর্মীদের) নাভিশ্বাস উঠছে। মহাবিত্তশালী এই দেশে কেন এই হারে সংক্রমণ ও মৃত্যু? অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। অনেকেই জানেন যে টিকাকরণ বিরোধিতা আমেরিকার একটি ব্যাধি। বলা ভাল, কিছু মানুষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্য প্রচারের প্রয়াস এবং তার থেকে অনেক বেশি মানুষের “টিকা হইতে সাবধান” গোছের ভিত্তিহীন বক্তব্যের প্রতি গভীর আনুগত্য রয়েছে। সোশাল মিডিয়া যে গুজবের আঁতুড়ঘর সে তো সবার জানা। ইচ্ছাকৃত তথ্যবিকৃতি, অর্ধসত্য বা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য প্রচারের ফলেই হোক (disinformation) বা নিজের অজান্তে বিভ্রান্তিকর খবর ও গুজবে আস্থা ও প্রচারের কারণেই (misinformation) হোক, “টিকা হইতে সাবধান” মনোভাব অনেকেরই। টিকাবিমুখতা যে নিজের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষের পক্ষেও ক্ষতিকারক তা বোঝানো দুষ্কর। তদুপরি তথাকথিত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে রাজনৈতিক ইন্ধন দেওয়ার ট্র্যাডিশনও সমানে চলেছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনার টিকা বিষয়ে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষোভ –যেমন বারবার নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা; নেওয়ার পরেও কারো কারো সংক্রমণ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি। ভুলে গেলে চলবে না যে সমসাময়িক এবং ঐতিহাসিক কারণে, শোষিত সম্প্রদায়ের মানুষ – এমনকি তাঁদের পরের, আরও পরের প্রজন্ম – যে কোনো সরকারি উদ্যোগের ব্যাপারে আজও সন্দিহান, বিশেষত যেখানে স্বাস্থ্য জড়িত। অন্যদিকে, আর্থসামাজিক ও জাতিগত বৈষম্যের ভিত্তিতে অতিমারীর অসম প্রভাব স্পষ্ট। প্রয়াত পল ফার্মারের ঋণ স্বীকার করে বলাই যায়, মহামারী আসলে সামাজিক বৈষম্যের জৈবিক প্রকাশ – “biological expressions of social inequalities.

কারণ যাই হোক না কেন, করোনা টিকাকরণের ছবিটা মার্কিন মুলুকে এইরকম – এ দেশে ৭০ শতাংশের কিছু কমপ্রাথমিকটিকা নিয়েছেন , অর্থাৎ নিয়ম মেনে দুটি বা একটি ডোজ (Pfizer-BioNTech, Moderna, Novavax vaccine হলে দুই ডোজ, Johnson & Johnson’s Janssen vaccine হলে এক) নিয়েছেন। অন্যদিকে, আপডেটেড বুস্টার (updated [bivalent] booster) নিয়েছেন মাত্র ১৪ শতাংশ। মাস্ক ব্যবহারের রেওয়াজও আজকাল নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক মহলেও (কোনো পক্ষেরই) তেমন গরজ নেই এ ব্যাপারে। আমাদের অনেকেরই ভাবখানা “অনেক কোভিড হল, আর ভালো লাগে না। আই অ্যাম টায়ার্ড অফ কোভিড।” সমস্যা হল, আমরা ক্লান্ত বলেই যে ভাইরাসও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এমনটা ভাবার কারণ নেই। চীনকে কোভিডশূন্য রাখার উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবসম্মত ছিল তার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করা যেতেই পারে, তবে বৃহত্তর জনগণ টিকা না পাওয়া অবধি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরিণাম হাতে নাতে দেখছে সেই দেশ। আবার শুধু এক প্রস্থ টিকা দিয়েই (বা নিয়েই) ক্ষান্ত হবার অবকাশ নেই। ভাইরাস যখন বহুরূপী, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সজাগ থাকতেই হবে। আপাতত জো বাইডেন সরকারের সৌজন্যে ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি অবধি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা থাকছে। জানুয়ারিতে এই অবস্থার তিন বছর পূর্ণ হবে। এই সরকারি পদক্ষেপ/ঘোষণা স্বাস্থ্য পরিষেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়কে অনেকটা সাহায্য করে: “…The powers activated by the emergency declaration have had a vast impact on the U.S. health-care system and social safety net, allowing hospitals to act more nimbly when infections surge and keeping millions enrolled in public health insurance…”।

আরো পড়ুন কোভিড-১৯: বিপজ্জনক ওষুধ ও ইনফোডেমিকের সংকট

আশা রাখি যে এই অবস্থা আরও প্রলম্বিত হবে, কারণ ইতিমধ্যে করোনা পরিস্থিতির বিরাট উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। রাষ্ট্রপতি বাইডেন সেপ্টেম্বর মাসে অকস্মাৎ এক সাক্ষাৎকারে বলে বসেছিলেন যে অতিমারীর দিন শেষ – “pandemic is over”। এই ধরনের মন্তব্য বিপজ্জনক, কারণ করোনা ক্রমাগত জানান দিয়ে চলেছে “আমি আছি”।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.