টানা কয়েকদিন কলেজ স্ট্রিটে কলেজ সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে, বিভিন্ন দাবিতে স্বাস্থ্যভবনে নার্সরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন আর তারও বহুবছর আগে থেকে স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আদালতে মামলা দায়ের চলছে। ফলে আজ মন্ত্রী সান্ত্রীদের রাতের ঘুম উড়েছে। এখন তো সকলেই দেখতে পাচ্ছেন, নিয়োগে লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন হয়েছে। কেউ পরীক্ষা না দিয়েই চাকরি পেয়েছে, কেউ পাশ না করেও। কেউ বাবার হাত ধরে, কেউ কোনো দাদার হাতে কয়েক লক্ষ টাকা গুঁজে দিয়ে চাকরি পেয়েছে। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এই দুর্নীতি চলেছে। কাল যদি প্রাথমিক স্কুল স্তরে নিয়োগেও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়, খুব জোর দিয়ে বলতে পারি, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গে যেমন মেধার অভাব নেই তেমন বর্তমান সরকারের নেতা মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ, গোষ্ঠী নেতা, অঞ্চল নেতা, পাড়ার নেতাদের লোভেরও শেষ নেই। সেই লোভের বলি হতে হয়েছে আমাদের, অর্থাৎ কয়েক হাজার ছেলেমেয়েকে। আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি, পড়াশোনা করেছি, তাদের চাকরির যোগ্য হয়ে উঠতেই কেটে গেছে কুড়ি বছর। পশ্চিমবঙ্গের এক অন্ধকার সময়ে আমরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০% নম্বর লেখা মার্কশিট হাতে পথে নেমেছি। অথচ চোখের সামনে চাকরি পেতে দেখলাম কাদের? না যাদের অনেক টাকা, কিন্তু যোগ্যতা কম।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তবে আমি এজন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দোষ দিই না। পূর্বতন সরকারের ‘অপশাসন’ থেকে মুক্তি পেতে আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসী ‘সততার প্রতীক’ মাননীয় মমতা ব্যানার্জির হাতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে দিয়েছিলেন। প্রতিদানে তিনি আমদের করের টাকায় ক্লাবগুলোকে অনুদান দিয়ে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালু করে, আরও অনেক ‘শ্রী’ উপঢৌকন হিসাবে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীকে ভুলিয়ে রাখছেন। যতদিন এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলবে, ততদিন এইসব দুর্নীতি অনাচারও চলতে থাকবে। সমাজের উপরতলা খুশি, নীচতলাও ভাতায় আহ্লাদিত। ব্যাস! ভোটব্যাঙ্ক সম্পর্কে নিশ্চিন্ত। শুধু মরছে, মরবে একমাত্র মধ্যবিত্ত। যাদের টাকার জোর নেই, ক্ষমতার লম্বা হাত নেই, শুধু ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে “পড়াশোনা করতে হয় না হলে কেউ ভাল বলে না।” বোঝানো হয়েছে, “চাকরি করে সংসারের হাল ধরতে হবে। এটা তোমার দায়িত্ব।” মধ্যবিত্ত ঘরের সেই সন্তান নাক মুখ গুঁজে কুড়ি বছর ধরে পড়াশোনা করে যখন চাকরির লাইনে দাঁড়াল, দেখল চাকরির জন্য না পড়লেও চলে, দরকার শুধু অর্থ আর ক্ষমতা।
আমার বাবা একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করতেন। দুদিন আগে টিভির খবর দেখে বিষণ্ণভাবে বললেন “ভাগ্যিস রিটায়ার করে গেছি। না হলে আজ কোন মুখ নিয়ে বাচ্চাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম?” বাবার কথা শুনে আমার মনে হল, সত্যিই তো। কী বলব ছাত্রদের? এতদিন যে দিদিমণি ওদের পড়িয়েছেন, তিনি নিজেই অসদুপায় অবলম্বন করে চাকরি পেয়েছেন। এই ঘটনা কিশোর মনে কী প্রভাব ফেলবে তার কোনো ঠিক আছে? চিরকাল দেখে এসেছি কুখ্যাত গুন্ডা বা অন্ধকার জগতের লোকেরা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়। স্কুল সার্ভিস কমিশনের কৃপায় আমরা সকন্যা মন্ত্রীকে ট্রেন থেকে পালাতে দেখছি। অবস্থা সঙ্গীন বুঝে শেষ অব্দি আত্মসমর্পণ করলে বিচারকের কথায় সেই মন্ত্রীকে কীভাবে জামাই আদরে পুলিশ সিবিআই দপ্তরে নিয়ে যাচ্ছে, তা-ও দেখছি। আবার সেই মন্ত্রী নিজের এলাকায় পৌঁছলে ফুল মালা দিয়ে তাঁকে বরণ করার দৃশ্যও দেখছি। ইতিমধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান চিত্তরঞ্জন মণ্ডল দুঃখের সঙ্গে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেছেন। পরিষ্কার জানিয়েছেন তাঁকে কেন ২০১৩ সালে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
এগারো বছরে মাত্র দুটো স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা হয়েছে। ছ বছর ধরে অপেক্ষা করে একটা পরীক্ষাও দিতে পারিনি। আন্দোলন করছি দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে, পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে ঘরে ফিরছি। রোজই ভাবছি একটা ভাল খবর পাব, কিন্তু দিনশেষে হাতে রয়ে যাচ্ছে পেন্সিল। নতুন বিজ্ঞাপন চেয়ে হয়ত আমরা আবার পথে নামব, স্বচ্ছ নিয়োগের দাবি জানাব। আশা রাখব আমাদের নেতা মন্ত্রীরা একদিন সংশোধিত হয়ে নব উদ্যমে কাজে নামবেন, আবার একটা এসএসসি পরীক্ষা হবে, শুধু মেধার নিরিখে নিয়োগ হবে, আমরা মাথা উঁচু করে একঘর ছাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারব “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।”
আরো পড়ুন শিক্ষক দিবসের প্রশ্ন: শিক্ষকদের বাঁচাবে কে?
সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের অপপ্রয়াস বন্ধ করা দরকার। শুধু বাংলা, বাংলা করে চিৎকার করলে আদতে বাংলার কোন লাভ হয় না। গাছের শিকড় আর জাতির শিক্ষা যত মজবুত হয় তার উন্নতি তত অপ্রতিরোধ্য হয়। দুর্নীতির এই জাল ছিঁড়ে আলোর পথে যাত্রা করতে হবে বর্তমান ও ভাবী প্রজন্মের জন্য।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।