নয়ন পাঠক
সম্প্রতি ফেসবুকে একজনের পোস্ট দেখে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির একটি দৃশ্য মনে পড়ে গেল। এক কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছে শূন্য পদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, কয়েকশো যুবক এসেছে ইন্টারভিউ দিতে, ছবির নায়কও তাদের মধ্যে একজন। অসহ্য গরমে বসার জায়গায় ফ্যান খারাপ, বসার যথেষ্ট জায়গাও দেওয়া হয়নি। একজন অসুস্থ হয়ে পড়ার পর সেকথা ইন্টারভিউ বোর্ডকে বলতে গেলে পাত্তা দেওয়া হয় না। কয়েকজনের ইন্টারভিউ নেওয়ার পর ঘোষণা করা হয় মধ্যাহ্নভোজনের জন্য ইন্টারভিউ আধ ঘন্টা বন্ধ থাকবে। কলেজের ডিগ্রি হাতে চাকরির আশায় আসা নায়ক উত্তেজিত হয়ে ইন্টারভিউয়ের ঘরে ঢুকে পড়ে ভাঙচুর আরম্ভ করে।
ফেসবুকে আমার দেখা পোস্টের সঙ্গে সিনেমার পার্থক্য এখানেই, যে ফেসবুকে দেখা চাকরি প্রার্থীরা সবাই পাশ করা এমবিবিএস ডাক্তার। ডাক্তার হয়ে তারা এমন কিছু উদ্ধার করেনি যে এই পরিচিত দৃশ্যের সঙ্গে অবস্থাটা মিলে গেলে রে রে করে উঠতে হবে। গোটা সমাজের সংকট যে তাদের উপরেও প্রভাব ফেলবে তা-ও সত্যি। কিন্তু প্রশ্ন তুলতেই হয় যখন এর সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন আরেকটি দৃশ্য চোখে পড়ে। যখন দেখতে পাওয়া যায় কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নেই, বা একজন ডাক্তার সারাদিন ধরে রোগী দেখেও সবাইকে পরিষেবা দিতে পারছেন না, যখন দেখা যায় বিনা চিকিৎসায়, প্রশিক্ষিত ডাক্তারের অভাবে রোগী মারা যায়। এই পরস্পরবিরোধী ঘটনাগুলো কী করে ঘটে চলে?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
১৯৪৬ সালের ভোরে কমিটি প্রদত্ত মডেল অনুযায়ী আমাদের দেশে সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা ত্রিস্তরীয় হয়েছে। পরবর্তীকালে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হলেও ওই মডেলের মূল কাঠামো বজায় রাখা হয়েছে। আমাদের দেশ ছাড়াও অন্য অনেক দেশেই এই মডেল বলবৎ আছে। এই মডেলে সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয় – প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা বা মহকুমা হাসপাতাল এবং টারশিয়ারি সেন্টার বা মেডিকাল কলেজ হাসপাতাল বা রেফারাল সেন্টার। বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোই সাধারণ গরীব মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল। ন্যূনতম ও জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা, প্রসব ও প্রসূতির চিকিৎসা এবং শিশুদের টিকা সহ কিছু নির্দিষ্ট পরিষেবা এলাকার মানুষের এই কেন্দ্রগুলো থেকে পাওয়ার কথা। এই পরিষেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র পিছু স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা নির্দিষ্ট রয়েছে সরকারি স্বাস্থ্য কার্যক্রমগুলোতে। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পদে স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ চলে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো বেহাল দশায় রয়েছে। পরিকাঠামোর অভাব, বিশেষত ডাক্তার ও নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে অনেক কেন্দ্র কার্যত বন্ধ। কোথাও কোথাও রোগীর সংখ্যার তুলনায় পরিষেবা প্রদানকারীর সংখ্যা এতই কম, যে রোগীর চাপ ও পরিকাঠামোর খামতির ফলে যাঁরা আছেন তাঁরাও পরিষেবা দিয়ে উঠতে পারেন না। সরকার বলে, ডাক্তার ও নার্সের অপ্রতুলতার কারণ হল ডাক্তারদের গ্রামে গিয়ে কাজ করতে অনীহা। আসল পরিস্থিতি কী?
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ২০১৮ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের রাজ্যে গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার (জিডিএমও) পদে ৬৪.৪% পদ খালি। অন্যদিকে মহকুমা ও জেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ক্ষেত্রে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের ৯২% পদ খালি। জেনারেল ফিজিশিয়ান রয়েছেন মাত্র ১২.৪%। অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের সংখ্যাও তথৈবচ। এ তো শুধু ডাক্তারদের হিসাব। স্টাফ নার্স, এএনএম, ফার্মাসিস্ট, টেকনিশিয়ান – কোনো ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি আলাদা নয়। এর পিছনে সরকারের দেখানো কারণ আগেই বলেছি, কিন্তু তা দিয়ে এর ব্যাখ্যা হয় না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ২০১৮-১৯ সালের এক সমীক্ষা বলছে রাজ্যের শহরাঞ্চলে সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে ডাক্তার-রোগী অনুপাত ১:১৩০০। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ১:১০০০ অনুপাতের চেয়ে খুব খারাপ নয়। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এই অনুপাত ১:৪০০০ বা তার বেশি। সরকার বলছে পাস করা ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চায় না। যদি ধরে নিই কথাটা সত্যি, তাহলে কেন যেতে চায় না?
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর দিকে তাকালে দেখব, দিন দিন সেখানকার পরিকাঠামো তলানিতে ঠেকেছে। ভোটের সময় বা অন্যান্য সময়ে সরকারি প্রচারে মানুষকে যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তার অনেককিছুই এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে অমিল। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ পরিষেবা দেওয়া, কিন্তু তাদের ইচ্ছে থাকলেও প্রাণদায়ী ওষুধ থেকে শুরু করে শয্যা সংখ্যা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদির সরবরাহ — সবই কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু এই সরকার নয়, আগের সরকারের আমল থেকেই শুরু হয়েছে। এখন এই প্রবণতা আরও প্রকট। পরিষেবা পাওয়ার আশা নিয়ে রোগীরা আসছে অথচ পরিষেবা পাচ্ছে না, সব রাগ গিয়ে পড়ছে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর। রাজ্যে ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যকর্মী নিগ্রহের অধিকাংশ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এবং গ্রামাঞ্চলে। সুতরাং নিরাপত্তার অভাব স্পষ্ট। অন্যদিকে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে খবর নিলে জানা যাবে, মাস মাইনে থেকে শুরু করে বাসস্থান বা কোয়ার্টার, নির্দিষ্ট পদে থাকা সরকারি চাকুরেদের যা যা প্রাপ্য, তাঁরা অনেক সময়েই তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতসব অসুবিধা ভুলে শুধুমাত্র মানুষের সেবাকে ব্রত করে যেসব চিকিৎসক ও নার্স কাজ করতে চাইছেন, তাঁদের অবস্থা কী?
এই মুহূর্তে রাজ্যে কয়েকশো সদ্য পাশ করা ডাক্তার কর্মহীন। গত দুবছর ধরে জিডিএমও পদে নিয়োগ নেই। প্রয়োজনের তুলনায় পদের সংখ্যা কম, এবং সেই পদগুলোর মধ্যেও অনেকগুলো শূন্য পড়ে আছে। সম্প্রতি জিডিএমও নিয়োগে চূড়ান্ত দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে প্যানেল প্রকাশ করতে লেগে গেছে একটা গোটা বছর। তাই সদ্য এমবিবিএস পাশ করা চিকিৎসকরা হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। বিভিন্ন হাসপাতালে এবং চুক্তিভিত্তিক কয়েকটা পদের জন্য চার-পাঁচশো আবেদনপত্র জমা পড়ছে। সেখানেও চলছে স্বজনপোষণ। স্থায়ী পদে নিয়োগও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ নিয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারি অবহেলা প্রকট। তিন বছরের বন্ড পিরিয়ড রাখা হলেও পাস করার পর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়োগপত্র পেতে সময় লাগছে ছমাস থেকে এক বছর। এই সময় তাঁরা অন্য কোথাও কাজও করতে পারছেন না। আর ডাক্তারের সংখ্যা কম এই অজুহাতে নার্সদের তিন সপ্তাহ ট্রেনিং দিয়ে ডাক্তার (সিএইচও) তৈরির জগাখিচুড়ি প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে নার্স নিয়োগও দুবছর ধরে বন্ধ। পাস করা নার্সরা বসে আছেন। শেষ প্রকাশিত নিয়োগের প্যানেল চূড়ান্ত গরমিল, ফলে নার্সরাও রাস্তার আন্দোলনে নেমে পড়েছেন।
আরো পড়ুন কী নিয়ে লড়ছেন ভারতের রেসিডেন্ট ডাক্তাররা?
পাশাপাশি মেডিকাল শিক্ষায় সামগ্রিক বেসরকারিকরণের পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তারের সংখ্যা কম দেখিয়ে খোলা হচ্ছে অসংখ্য পরিকাঠামোহীন বেসরকারি মেডিকাল কলেজ। এমনকি নতুন সরকারি মেডিকাল কলেজগুলোর পরিকাঠামোও সুবিধার নয়। মেডিকাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়াকে সরিয়ে মেডিকাল শিক্ষার মাথায় বসানো ন্যাশনাল মেডিকাল কমিশন সরকারের বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়িত করতেই তৎপর। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০২০-র আদলেই এমবিবিএস পাঠক্রমেও ‘কম্পিটেন্সি বেসড কারিকুলাম’-এর নামে চলছে মেডিকাল টেকনোক্র্যাট তৈরির চেষ্টা। চিকিৎসা শিক্ষার নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে সামগ্রিক ডাক্তার হওয়ার পথ বন্ধ করে চলছে চটজলদি নীতি নৈতিকতাহীন, স্বল্পশিক্ষিত টেকনোক্র্যাট তৈরি। আর হিপোক্র্যাটিক ওথের বদলে চরক শপথ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসা মিশিয়ে ঘটছে মেডিকাল শিক্ষার গৈরিকীকরণ।
স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার। কেন্দ্র, রাজ্য – দুই সরকারই সেই অধিকার মানুষের থেকে কেড়ে নিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সরকারি হাসপাতাল বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দিয়ে, জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাড়িয়ে, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ, ইমপ্ল্যান্টের সরবরাহ বন্ধ করে, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমিয়ে, স্বাস্থ্যসাথী ও আয়ুষ্মান ভারতের নামে চলছে মানুষের চোখে ধুলো দেওয়া।
ইতিহাস বলছে অধিকার কেউ কাউকে এমনি এমনি দেয়নি। লড়াইয়ের পথে অর্জিত স্বাস্থ্যের অধিকার পুনরুদ্ধারে সাধারণ মানুষ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের একত্রিত হয়ে লড়াইয়ে নামা দরকার।
নিবন্ধকার পেশায় চিকিৎসক। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।