অনিকেত চ্যাটার্জি
“জানেন, সলমন খানকে সাপে কামড়েছে?”
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এই বাক্যটা দিয়েই ইউটিউবে অনেক ভিডিও, ইনস্টাগ্রামে অনেক রিল, ফেসবুকে অনেক পোস্ট শুরু হচ্ছে। আপনার মনোযোগ পাওয়ার জন্য। কিন্তু দেশের রাজধানীতে রেসিডেন্ট ডাক্তাররা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট (NEET) পিজি কাউন্সেলিং এগিয়ে আনার জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের লাঠি খেয়ে গ্রেফতার হয়েছেন — এই খবরটা জানানোর জন্য ‘ক্লিকবেট’ ব্যবহার করতে হচ্ছে। কারণ সবাই জানে করোনা শেষ হয়ে গেছে, ‘করোনা ওয়ারিয়র’ ডাক্তাররা এখন মার খেল না গ্রেফতার হলে, তাতে কারোর কিছু যায় আসে না।
একটু পড়ে দেখবেন, দেশের রেসিডেন্ট ডাক্তাররা কেন প্রায় সারা দেশ জুড়ে আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন। কারা এই রেসিডেন্ট ডাক্তার? কেন তারা মার খেল? কী তাদের আন্দোলন?
ভারতবর্ষে এখন ডাক্তারি পড়তে গেলে একটিই পরীক্ষা দিতে হয়, তার নাম নীট। এই নীট পরীক্ষা ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার চালু করে এবং এই পরীক্ষা চালু হওয়ায় রাজ্যে রাজ্যে যে প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলো চালু ছিল সেগুলো বাতিলের দলে চলে যায়। এমবিবিএস পাঠক্রমে ডাক্তারি পড়ার এটাই একমাত্র রাস্তা হয়ে ওঠে। কিন্তু “ডাক্তারি পড়ছে মানে লাইফ সেট”, “ডাক্তারি পড়ছে মানে অনেক পয়সা” এগুলো আসলে মিথ। সত্যিটা হল — এখন এমবিবিএস ডিগ্রির মানে দাঁড়িয়েছে “স্রেফ এমবিবিএস” বা “পাতি এমবিবিএস”। অর্থাৎ ঘরের লোক থেকে শুরু করে পাড়ার দোকানদার — সবাই জিজ্ঞেস করে “বাবা, কীসের ডাক্তার হবে?” অর্থাৎ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হতেই হবে। কোনো এক শাখার বিশেষজ্ঞ হতেই হবে। নইলে রোগী পাত্তা দেয় না, বাকি সমাজও দেগে দেয় পাতি এমবিবিএস বলে। এমবিবিএস পাশ করে ‘জেনারেল ফিজিসিয়ান’ হয়ে ওঠার তেমন কোনো গুরুত্ব এখন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাতেও দেওয়া হয় না। সরকার এমবিবিএসদের ন্যূনতম মাইনের চাকরি দিয়ে ছুঁড়ে দেয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে। এখন অবশ্য ওই সামান্য চাকরিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ডাক্তারি পড়ার পর বিশেষজ্ঞ হতে গেলে, মানে এমডি/এমএস ডিগ্রি অর্জন করতে গেলে নীট-পিজি পরীক্ষা দিতে হয়। প্রায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী প্রতি বছর এই পরীক্ষা দেন। এই পরীক্ষা দিয়েই তাঁরা বিভিন্ন মেডিকাল কলেজেগুলোতে মেডিসিন, সার্জারি, গায়নকোলজি, পেডিয়াট্রিক্স, অর্থোপেডিক্স এইসব বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করতে ঢোকেন।
এই ডাক্তাররাই রেসিডেন্ট ডাক্তার। আপনি কোনো মেডিক্যাল কলেজ বা টার্শিয়ারি সরকারি/বেসরকারি হাসপাতালে কঠিন রোগের চিকিৎসা বা অপারেশন করাতে গেলে আউটডোরে/ওয়ার্ডে/এমার্জেন্সিতে যে ডাক্তার আপনাকে প্রথম দেখেন, তিনি একজন রেসিডেন্ট ডাক্তার। আরও ভাল করে বলতে গেলে, প্রথম বর্ষের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট জুনিয়র ডাক্তার। এঁরাই সারাবছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে হাসপাতালগুলোকে সচল রাখেন। কোনো মেডিকাল কলেজে ফার্স্ট ইয়ার পিজিটি বা সব পিজিটিরা কাজ করা বন্ধ করে দেওয়া মানে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়া, চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
তা কী এমন ঘটল দিল্লিতে, যার জন্য গোটা দেশের রেসিডেন্ট ডাক্তাররা প্রতিবাদে-প্রতিরোধে রাস্তায় নামছেন, এমনকি সিজ ওয়ার্ক করারও ডাক উঠছে? যখন এই লেখা লিখছি ততক্ষণে কলকাতা মেডিকাল কলেজ, নীলরতন সরকার, ন্যাশনাল মেডিকাল কলেজ, বাঁকুড়া মেডিকাল কলেজ সহ পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো মেডিকাল কলেজের পিজিটিরা ওপিডি সহ সব ইলেক্টিভ প্রসিডিওর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, শুধুমাত্র এমার্জেন্সি পরিষেবা চালু থাকছে।
এই যে নীট-পিজি পরীক্ষা, যার মাধ্যমে বছর বছর নতুন রেসিডেন্টরা ভর্তি হয়, সেটা হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। প্রতি বছর জানুয়ারিতেই এই পরীক্ষা হয়, আর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ নতুন ফার্স্ট ইয়ার রেসিডেন্টরা ডিউটিতে ঢোকে, আগের ইয়ারের রেসিডেন্টরা অমানুষিক ডিউটির পরিশ্রম থেকে একটু রেহাই পায়। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে করোনার দোহাই দিয়ে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল এপ্রিল পর্যন্ত। এপ্রিলের পরীক্ষার তিন দিন আগে (ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা তখনো মাত্র ৪০,০০০) অ্যাডমিট কার্ড প্রকাশের পরেও আবার পিছিয়ে দেওয়া হয়। শেষমেষ পরীক্ষা নেওয়া হয় সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ। কোনোভাবেই এত গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা, যাতে দেড় লক্ষ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেন গোটা ভারত জুড়ে, সেটা কোভিড বিধি মেনে করা গেল না? শুধু কি সরকারের অপদার্থতা, নাকি কিছুটা উদাসীনতাও ছিল?
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আসল গোলমাল শুরু হয় এরপর। সেপ্টেম্বরের শেষে নীট পিজি ২০২১-এর ফল প্রকাশিত হয়। এতদিন ধরে হাসপাতালে গাধার মতো খেটে আসা পরিশ্রান্ত পিজিটিরা ভাবলেন এবার নতুন ছাত্রছাত্রীরা আসবে, পরীক্ষার্থীরাও ভাবলেন এতদিন অপেক্ষার পর কলেজে ভর্তি হয়ে নতুন জীবন শুরু হবে। কাকস্য পরিবেদনা। কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ নীট-পিজি পরীক্ষায় ২৭% ওবিসি ও ১০% ইডব্লিউএস সংরক্ষণ চালু করল। একে উত্তরপ্রদেশের ভোটের দিকে তাকিয়ে তোষণনীতি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এর প্রতিবাদে ডাক্তারদের কিছু গোষ্ঠীর তরফ থেকে জনস্বার্থ মামলা করা হল, নীট-পিজি কাউন্সেলিং সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন হল। এমন অদ্ভুত দেশ আমাদের, যে এর দ্রুত নিষ্পত্তি করে হাসপাতালে নতুন ডাক্তারদের নিয়োগ করার ব্যাপারে সরকার বা আদালত, কারুরই কোনো তাড়া নেই।
অক্টোবর গড়াল নভেম্বরে। সরকার বলল আরো চার সপ্তাহ লাগবে, মামলার শুনানি হবে ৬ জানুয়ারি। মানে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে খেটে মরা রেসিডেন্টরা ফার্স্ট ইয়ার হয়ে থাকতে থাকতেই ২০২২ এসে গেল। গোটা ২০২১ সালে কোনো হাসপাতালে কোনো নতুন রেসিডেন্ট ডাক্তার এল না। আর প্রায় এক বছর আট মাস ধরে দেড় লক্ষ পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হল। কেউ এই দায় স্বীকার করতে রাজি নয়। এই মুহূর্তে দেশে প্রায় ১১০০০ জন মানুষ পিছু মাত্র একজন সরকারি ডাক্তার আছেন, যেখানে অনুপাতটা হওয়া উচিত হাজার জন পিছু একজন।
নীট-পিজি কাউন্সেলিং সংক্রান্ত মামলার ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে শুনানি, দ্রুত নিষ্পত্তি এবং কাউন্সেলিং এগিয়ে আনার দাবিতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন দিল্লির হাজার হাজার জুনিয়র ডাক্তার। তাঁরা মিছিল করে যাচ্ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মান্ডব্যর বাসস্থানের দিকে। মূলত ভারতের রেসিডেন্ট ডাক্তারদের সংগঠনগুলোর যুক্ত মঞ্চ ফোরাম অফ রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের (FORDA) ডাকে এই প্রতিবাদ চলছিল। দিল্লি পুলিস আন্দোলনরত ডাক্তারদের লাঠিপেটা করে, মহিলা রেসিডেন্টদের পুরুষ পুলিসকর্মীরা মারধোর করে, কয়েক হাজার জুনিয়র ডাক্তারকে আটক করা হয়।
কেন? তাঁরা নতুন ডাক্তারদের নিয়োগ চেয়েছিলেন। করোনার সঙ্গে দেড় বছর ধরে লড়াই করা শ্রান্ত, ক্লান্ত ডাক্তাররা পিপিই কিট থেকে একটু রেহাই চেয়েছিলেন। দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ এমবিবিএস পাশ পরীক্ষার্থী আশায় বারবার বুক বাঁধছিলেন, আর সরকার ভোটের খেলা খেলতে গিয়ে তাদের জীবন জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিল। এর প্রতিবাদেই আন্দোলন চলছিল দিল্লিতে। এখন সেই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে গোটা ভারতে, প্রতিটি হাসপাতালে। ভেবে দেখুন, আপনি কোন পক্ষ নেবেন? ডাক্তারের, রোগীর, হাসপাতালের, চিকিৎসার? নাকি সরকারের, পুলিশের, লাঠির? মনে রাখবেন, নির্যাতনের সময় চুপ করে থাকা, মুখ বন্ধ রাখার অর্থ নির্যাতনকারীর পক্ষ নেওয়া।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।