খবরটা একটু বিচলিত করেছে বটে! কলকাতা ময়দানের বাৎসরিক ছুটির সময়টুকুও কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কী এই ছুটি? নীচের লিঙ্কগুলো দেখা যাক।

অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে কলকাতার ময়দান এলাকায় সব রকমের খেলাধুলা বন্ধ থাকে। এ আমাদের অজানা নয়। শুধু খেলা নয়, সব রকমের ‘অ্যাক্টিভিটি’-ও বন্ধ থাকে ওই সময়টায়। এমনকী দলবদ্ধ প্রাতর্ভ্রমণও তখন চলে না। কড়া নজরদারি চলে সামরিক বাহিনীর। নিঝুম, নিস্তব্ধ ময়দান। ক্লাবের টেন্টগুলো জনহীন! ক্যান্টিন সব বন্ধ। আসলে ময়দানের ক্লাব-টেন্টগুলো সম্বচ্ছর চালিয়ে রাখে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের একদল মানুষ। কয়েক প্রজন্ম ধরে এরা কলকাতা ময়দানকে লালনপালন করে আসছে। প্রধানত ওড়িশার যাজপুর এলাকার লোক এরা। ময়দানের নিয়মকানুন, ক্লাব চালানোর যাবতীয় পয়জার এদের নখদর্পণে। আবার মাঠ তৈরি, পিচ তৈরির কৃৎকৌশলও এদের আয়ত্তে। তো, যা বলছিলাম, অক্টোবরের এই সময়টায় এনারা সব ‘দেশে’ চলে যান। শুনশান ময়দান!

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

যখন আইএফএ শিল্ডের চমকদার দিন ছিল, মনে পড়ছে, শিল্ড শেষ করতে হত সেপ্টেম্বরের মধ্যে। ততদিনে পুজো-পুজো ভাব এসে গেছে— জানতাম শিল্ডের খেলা দিয়েই সে-বছরের ফুটবল পর্বের ইতি। অবশ্য সময়সীমানা ময়দানি এই সামরিক আইনের দিকেই তাকিয়ে। ১৯৭০— শিল্ড ফাইনাল— ইরানের প্যাস্ ক্লাব ও ইস্টবেঙ্গল— চূড়ান্ত মুহূর্তে  স্বপন (চিংড়ি) সেনগুপ্তের পাস থেকে গোল করলেন শেষ সময়ের বদলি খেলোয়াড় পরিমল (জংলা) দে, ছিনিয়ে আনলেন আইএফএ শিল্ড। দিনটা ছিল সেপ্টেম্বর ২৫। তখনও মাঠে যাবার বয়সকাল হয়নি। তবে ভাল্ভ রেডিও-য় সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের ধারাবিবরণী এখনও কানে লেগে রয়েছে বইকী!

কথা হচ্ছিল ময়দানি শাটডাউন নিয়ে। ভাগ্যিস ভারতীয় সেনার নিয়ন্ত্রণে আছে ময়দান, নয়তো কবে রেসকোর্স বুজিয়ে উঠে যেত ‘মহালক্ষ্মী আবাসন’! এই কর্তৃত্বেরই অনুশীলন ওই দিন-পনেরোয়। যেমন ভাড়াটে রাখা হয় এগারো মাসের চুক্তিতে, বছর ঘুরলে-পরে নাকি ভাড়াটের দাবি এসে যাবে— অনেকটা তেমনই। অক্টোবরের ওই প্রথমার্ধে কলকাতা ময়দানে সেনাবাহিনীর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। এখন আর হয় না, আগে যেটা হত— ওই সময়কালে সেনা-আধিকারিকদের উপস্থিতিতে প্রতিটি টেন্টের ও গ্যালারির একটা-করে কাঠ বা ছাউনির কোনও অংশ খুলে ফেলতে হত। অর্থাৎ প্রতীকী ‘ডিসম্যান্টলমেন্ট’! এমনিতেই নিয়ম, টেন্ট বা গ্যালারি হবে অস্হায়ী উপকরণে— কাঠ, বাঁশ, ত্রিপল, কাপড় প্রভৃতি। মনে আছে, সত্তরের দশকে নিয়মের বিস্তর বাধা পেরিয়ে তবেই মোহনবাগান মাঠের কংক্রিট গ্যালারি হতে পেরেছিল।

ময়দান। গড়ের মাঠ। এসপ্ল্যানেড কথাটির অর্থ গড়চত্বর, গড়ের মাঠ, দুর্গ ও নগরের মধ্যবর্তী সমতল মাঠ। উত্তরে এসপ্ল্যানেড ইস্ট (এখনকার সিধো-কানহো ডহর), দক্ষিণে এ.জে.সি. বোস রোড, পুবে চৌরঙ্গী, পশ্চিমে গঙ্গা। এই গড়-এলাকার কতকগুলি নিজস্বতা ছিল। পরিখা-র জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল গড়ের মাঠ। নদীতলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা এই সব নালায় গঙ্গার জল খেলা করত। জোয়ারের সময়ে তো জল উপচে পড়ার মতো! গঙ্গার জল ঢুকত বোধহয় গোয়ালিয়র ঘাটের পাশ দিয়ে, কেল্লার পশ্চিম দিকের  সেন্ট জর্জেস গেট হয়ে। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই সব পরিখার ভূমিকা থাকত। খেলার মাঠে, টিকিটের লাইনে অশান্তি তো হতই। ব্রিটিশ আমলে সুনির্মিত এইসব নালা চওড়ায় ছিল ঠিক ততটা, যাতে মানুষে লাফ দিয়ে পেরোতে পারবে না, কিন্তু ঘোড়পুলিশ বা সেনা-র ঘোড়া টপকে যাবে। দুর্ভাগ্য, নালাগুলির অস্তিত্ব এখন আর নেই। ‘উন্নয়ন’-এর জঠরে চলে গেছে! রেসকোর্স-কে ঘিরে রাখা পরিখা-টি অদৃশ্য হয়েছে এ. জে. সি. বোস রোড চওড়া করার যজ্ঞে। এমনি ভাবে পুরোটাই আজ প্রায় অদৃশ্য। রাজভবনকে বেষ্টন করে-থাকা নালার আজ কী দুর্দশা! ইট দিয়ে আধবোজা করে ভাগাড় করা হয়েছে। তবে রাজভবনের পুরোটায় কিন্তু নালা নেই, আছে শুধু গড়-এলাকায়। আকাশবাণী ভবনের ঠিক আগে, হেমন্ত বসু-র মূর্তি বরাবর এই পরিখা শুরু, আর শেষ এসপ্ল্যানেড ইস্ট-এর উল্টোদিকে। নালা দেখেই হদিশ করা যায় গড়-এলাকা কোত্থেকে শুরু। এই এ.জে. সি.-রই শেষ প্রান্তের একটি কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে আমার চাকুরিজীবনের শুরু। বলা যাক চাকুরির প্রথম টেবিলের কথা। সম্মুখে যাকে বলে স্পেক্টাক্যুলার দৃশ্য— উন্মুক্ত  রেসকোর্স, তার ওপারে দূরে ট্রামের যাতায়াত, যেন টয় ট্রাম! শনিবারের ঘোড়দৌড় নিজের চেয়ারে বসেই দেখতাম। একবার প্রধানমন্ত্রী রেসকোর্সে নামবেন হেলিকপ্টার থেকে। ইন্দিরা গান্ধী। অফিসের ছাদ থেকে আমরা পরিষ্কার দেখেছিলাম সেই পর্ব।

ঘোড়পুলিশের কথা বলছিলাম। মাউন্টেড পুলিশ। কলকাতা পুলিশের  অংশ। চৌরঙ্গীর এস. এন. ব্যানার্জি রোড দিয়ে ঢুকে দু’ কদম এগোলেই বাঁ হাতে কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের সদর দপ্তর। ১৮৪০-এ এই পুলিশদলের শুরু। প্রায় দু’ শতকের ঐতিহ্য! কলকাতা ময়দানের সজাগ প্রহরী। এ-প্রসঙ্গে মনে আসে আন্তর্জাতিক মানের চিত্রশিল্পী প্রয়াত সুনীল দাশের কথা। এই বাহিনীর ঘোড়াদের সঙ্গে দিনের পর দিন দিবারাত্র কাটিয়ে, তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ স্টাডি করতেন। ঘোড়া এঁকেই রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছিলেন। পুরস্কারের অর্থে ঘোড়াদের আর ঘোড়পুলিশ বাহিনীকে ভোজ খাইয়েছিলেন।

শুধু পুলিশ নয়, ময়দানে ঘোড়সেনাদেরও নিয়মিত টহলদারি হত। এখনও হয় নিশ্চয়ই। মনে পড়ছে, ইস্টার্ন কম্যান্ডের অধিনায়ক থাকাকালীন জেনারেল এ. এস. বৈদ্য ঘোড়ায় চড়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে একদিন শুনলেন ব্রিগেড-এর কোনায় (রামমোহনের মূর্তি সংলগ্ন) সংরক্ষিত পাকিস্তানি প্যাটন ট্যাঙ্ক থেকে ভেসে-আসা এক আর্তনাদ! এক অত্যুৎসাহী ট্যাঙ্কের ভিতরে নেমে বেকায়দায় আটকে পড়েছেন! জেনারেল তাকে উদ্ধার করেছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর কড়া পর্যবেক্ষণে থাকত ময়দান। এখান থেকেই তিনি ভারতের ‘চিফ অব আর্মি স্টাফ’ হয়েছিলেন। কলকাতা থেকে বিদায়লগ্নে একটি দুর্দান্ত ফেনোমেনন বলেছিলেন তিনি— আজও স্মরণে থেকে গেছে। বুঝিয়েছিলেন কলকাতার বিশেষত্ব— “কোনও ঠিকানা খুঁজতে গেলে বম্বেওয়ালাদের শোনার সময় নেই, দিল্লিতে ইচ্ছাকৃত ভুল বলবে, ম্যাড্রাসে বলে দেবে মাত্র, কিন্তু কলকাতায়!— শুধু বলবে না, সঙ্গে গিয়ে পৌঁছে পর্যন্ত দিয়ে আসবে।”

দেশের সেনাপ্রধান হওয়ার পরে তো সেই ‘অপারেশন ব্লু স্টার’! তারপর অবসর-জীবন শুরু করলেন পুণে-য়। অবশেষে ব্লু স্টারের ‘বদলা’য় নিহত হলেন জেনারেল অরুণ শ্রীধর বৈদ্য।

খুব মনে পড়ে, বছর-দশেক বয়স যখন, ময়দানে এক শীতের দ্বিপ্রহরে ছোটদের একটি স্পোর্টস-এর অনুষ্ঠানে আমাকে দিয়ে প্রধান অতিথিকে মালা পরানো হয়েছিল। তাঁকে আমি প্রণামও করেছিলাম। আর কেউ নন, বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়— বি. ডি. চ্যাটার্জি, ময়দানের এক মহীরুহ। পরে তাঁকে বুঝেছি। প্রথম চাকুরিজীবনে মিনিবাসে নিত্যযাত্রী ছিলাম। ময়দানের শেষপ্রান্ত থেকে কখনোসখনো সেই বাসে উঠতেন শ্রদ্ধেয় কোচ অচ্যুত ব্যানার্জি। তুলসীদাস বলরাম একবার আমাদের বাসে উঠলেন! নিত্য সহযাত্রীদের মধ্যে কী উত্তেজনা!

কলকাতার ফুটবলে উদ্বোধিত হয়েছিলাম সত্যি বলতে কী, ওই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের উপর্যুপরি পঞ্চ-লিগ-জয়-যাত্রা’য়। কোচ পি. কে. ব্যানার্জির তখন ঝলমলে সময়। আর সেই সময়কালে ভরসন্ধ্যায় কলকাতার অলিতে-গলিতে কাঁধে করে ফিল্ম-প্রোজেক্টর বয়ে এনে সমকালীন বিশ্ব-ফুটবলের সঙ্গে তরুণদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অমল দত্ত!

দু’জনের কোচিং-ই দেখতে যেতাম সাতসকালে। দু’জনারই বাহন ছিল স্কুটার। আমাদের বাড়ির খুব কাছে ছিল পি.কে.-র শ্বশুরালয়। ডা. প্রতাপ মজুমদার, জ্ঞান মজুমদারদের (এখন বোরিয়া মজুমদার) বাড়ি। সেটি আবার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও শ্বশুরালয়। প্রায়ই দেখতাম পি. কে.-কে। তার স্কুটারের নম্বরটাও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রসূনকেও মাঝেমধ্যে আসতে দেখতাম। আর, অমল দত্তদের আদি বাড়ি তারাসুন্দরী পার্কের পিছনে।

কলকাতার ফুটবলে আমার দেখা সেরার সেরা দু’জন— সুধীর কর্মকার ও মহম্মদ হাবিব। কাছাকাছি অনেকেই হয়তো আসবেন, কিন্তু এরা অনন্য। আবার সবচেয়ে ভদ্র, পরিশীলিত দুজন— শ্যামল ঘোষ ও সুরজিৎ সেনগুপ্ত। অন্য রাজ্যের ফুটবলারদের মধ্যে আমার কাছে সেরা ইন্দর সিং। তখন বাংলার ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা ময়দান। টিকিটের দাম ছিল ৬০ প. (মাঠের লম্বালম্বি) আর ১ টা. ১০ প. (আড়াআড়ি)। কাঠের গ্যালারি। টিকিট ফুরিয়ে গেলে বা লাইনে মারপিটের পরিস্থিতি হলে অন্য ভাবে উঁকিঝুঁকি মারতে হত। মোহনবাগান মাঠের ‌র‌্যামপার্টের (এই শব্দটিও গড়-সংক্রান্ত, অর্থ : দুর্গপ্রাকার) দিকে পজিশন নিতে পারলে কষ্ট করেও কিছুটা দেখা যেত। ও-দিকটায় আবার পেরিস্কোপ ভাড়া পাওয়া যেত, পাঁচ মিনিটের হিসেবে। পৃথিবীর আর-কোথাও কি মাঠের বাইরে থেকে খেলা দেখার জন্যে পেরিস্কোপের ব্যবহার হত? আমার জানা নেই।

’৭০-এর দশকের শেষ দিকে ময়দানে ভিন্ রাজ্যের একঝাঁক ফুটবলার আনা হয়। ইস্টবেঙ্গলে। হরজিন্দার-মনজিৎ-গুরদেব সিং। কলকাতার এঁটেল কাদামাটিতে এরা সুবিধে করে উঠতে পারলেন না। অনেক ফ্যাক্টর থাকে— সামাজিক পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন অভ্যাস, ভাষা। তবু রক্ষণে গুরদেব কিছুটা খেললেন। আর, বেশ ভালো খেলেছিলেন কর্ণাটক থেকে আসা লিঙ্কম্যান দেবরাজ। নাইজিরিয়ান ছাত্র ডেভিড উইলিয়ামসের খেলা বেশ মনে আছে। এরপর আসে ইরানি ছাত্রত্রয়— মাজিদ বিসকার, জামশেদ নাসিরি, মহম্মদ খাবাজি। অনেক নামই মনে পড়ে। মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব থেকে না-নড়া লতিফুদ্দিন, অশোক চক্রবর্তী, মহীদুল ইসলাম, অন্য বড় দলের ডাক উপেক্ষা করেছেন। বুদ্ধিমান স্কোরার ছিলেন বটে সাবির আলি! এ-জন্যেই বোধহয় চিরিচ মিলোভান তাকে এত পছন্দ করতেন! প্রায়ই দেখতাম লোটাস সিনেমার ক্রসিংয়ের পেট্রল পাম্পটায় আড্ডা মারতে। ’৮০-র দশকে রক্ষণভাগে উজ্জ্বল শ্যামল ব্যানার্জি। ১৯৭৮-এ সন্তোষ ট্রফির আসর বসেছিল কলকাতায়। ময়দানে। যুবভারতী তখনও হয়নি। মোহনবাগান মাঠে সদ্য ফ্লাডলাইটের আলো বসেছে। মেম্বার গ্যালারির একটা সিজন টিকিট পেয়েছিলাম। কলেজ-শেষে খেলা দেখতে যেতাম। কেরলের এক প্লেয়ারের খেলা মাঠ মাতিয়ে তুলল। এখনও মনে পড়লে ভালো লাগে। মহম্মদ নাজিব। প্রিমিয়ার টায়ার্স-এ খেলতেন। পরে কলকাতায় খেলতে আসেন, মহামেডানে। কিন্তু সেই খেলার ধারেকাছেও নয়।

ক্রিকেট লিগের প্রায় পুরোটাই ছিল খোলা মাঠে। এক্কেবারে মতি নন্দী-র ‘ননীদা নট আউট’-এর পরিবেশ। মোহন, ইস্ট-এর পাশাপাশি স্পোর্টিং ইউনিয়ন, কালীঘাট ছিল জবরদস্ত টিম। আমাদের ক্রিকেট-বোধের উন্মেষ ১৯৬৯-এর বিল লরি-র অস্ট্রেলিয়া টিমের সফরের সময়ে। ’৬৭ থেকে একঝাঁক নতুন খেলোয়াড় ভারতীয় দলে এলেন। বাংলা থেকে সুব্রত গুহ, অম্বর রায়, অশোক গান্দোত্রা। দুর্ভাগ্য, গোপাল বসু, সমর চক্রবর্তী, বরুণ বর্মণ, সম্বরণ ব্যানার্জি, অমিতাভ রায়েদের কাছে টেস্ট ক্রিকেটের দরজাটা কিছুতেই খুলল না। তবে ক্লাব-ক্রিকেটে বেশ কিছু ভালো খেলা হত।

১৯৭৫। ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় বসল আন্তর্জাতিক টেবল টেনিস প্রতিযোগিতার আসর। কয়েক মাসের লাগাতার প্রচেষ্টায়  ইডেন গার্ডেন্সের একাংশে রেকর্ড সময়ে তৈরি হয়েছে ‘নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম’। অবশ্যই প্রশংসা প্রাপ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং কলকাতার নয়া রূপকার, পূর্তমন্ত্রী ভোলানাথ সেনের। এই আসরের অভিঘাতে গোটা রাজ্যে, জেলায়-জেলায় এই ইনডোর গেমটির বিপুল তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরুষদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন হাঙ্গেরির ইস্তভান জনিয়ার, ফাইনালে সুইডেনের স্টিপানচিজ-কে হারিয়ে।

এখন তো বৃহৎ, আরও বৃহতের পথে ক্রীড়াজগৎ। মোটা স্পনসরশিপ আগেই ছিল ক্রিকেটে, এখন ফুটবলেও বাণিজ্যের দুরন্ত হাতছানি। আন্তর্জাতিক ফুটবল কর্তারা হয়তো বৃহৎ পুঁজিগুলোর সঙ্গে বসে ছকে-নিয়েছেন ১৩০ কোটির দেশে ফুটবলের বিপুল বাণিজ্যিক বিস্ফোরণের হিসাবটি! মাঝখান থেকে শুকিয়ে গেছে কলকাতার হকি!

বসন্তবিলাপ

কলকাতা ময়দানের বসন্তদিন মানেই ছিল হকির মরশুম। গোটা ময়দান ফুলে-ফুলে রঙিন। দিন ছিল বটে! বেটন কাপে যোগ দিতে মুখিয়ে থাকত দেশের সেরা দলগুলো। মোহনবাগান, ই. রেল, রেঞ্জার্স, গ্রিয়ার— এ-সব ছিল জোরদার দল। আমি নিজেও হকিটা খারাপ খেলতাম না, অন্তত বন্ধুরা তা-ই বলত। একটা স্টিক ছিল, ৩৩ ইঞ্চির, টিআরএম ব্র্যান্ডের— তিলকরাজ মহাজনের কোম্পানি, স্পোর্টস উপকরণের। তখনকার কলকাতা লিগের নামী প্লেয়াররা ছিলেন ইক্রামুর-ইনামুর দু’ ভাই, গোবিন্দা, শিব দত্তা, চাঁদ, সমর মুখার্জি, গুরবক্স সিং, ভেস পেজ, জেনিংস্ ভাইয়েরা। ধ্যানচাঁদের ছেলেরা অশোককুমার, রাজকুমারেরাও কলকাতা লিগে খেলেছেন। অশোককুমার পরে এয়ারলাইন্সে যান। গুরবক্স সিং অনেক বয়স অব্দিই খেলে গেছেন। একবার বিএসএফ-এর টিম বেটন খেলতে ট্রেন থেকে নেমে সোজা চলে এল বিবেকানন্দ রোডের ওয়াইএমসিএ-তে। আমাদের খেলার জায়গা সেটা। তখন কিশোরবেলা। হাঁ করে দেখছি দেশের বিখ্যাত খেলোয়াড়দের! সকলেই প্রায় শিখ পাঞ্জাবি— দু’টো বড় ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা। তারা এলেন, হোল্ড-অল খুলে যে যার মতো মাটিতে চাদর পেতে বিছানা করে নিলেন! এই ব্যবস্থাতেই তারা খুশি। তখন হকি লিগের দৈনিক নির্ঘন্ট প্রতিটি কাগজ ছাপত। এখন কলকাতার হকি আর কাগজে তেমন গুরুত্ব পায় না।

সাম্প্রদায়িক

ময়দানকে তথা কলকাতার খেলাধুলাকে জিয়ন্ত রাখতে দুই সম্প্রদায়ের উল্লেখ করতেই হয়। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং পার্সি। ময়দানের দু’টি ক্লাব এদের, যথাক্রমে রেঞ্জার্স ক্লাব ও পার্সি ক্লাব। কলকাতার হকির বসন্তদিন ধরে রেখেছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। জেনিংস্ ভাইয়েরা, ডা. ভেস পেজ— এরা তো উজ্জ্বল উদাহরণ। জেনিংস্ পরিবারের ছেলেদের হকি প্র্যাকটিস করতে দেখতাম সেন্ট জেভিয়ার’স্-এর মাঠে। এন্টালি এ. সি.-র হকি টিমেরও উত্থান ঘটেছিল। এই দলের অধিকাংশই ছিল এই সম্প্রদায়ের। লেসলি ক্লডিয়াসের ছেলেরাও এখানে খেলতেন। এখন তো অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা কলকাতার ডোডোপাখি! বিলুপ্তপ্রায়। উত্তরপ্রজন্ম সব অস্ট্রেলিয়ায় বা বিদেশে থিতু। এ-দেশে তাদের আর পিছুটান নেই।

অগ্নি-উপাসকেরা অবশ্য আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ। প্রবাদ : শিখ ট্রাম-কন্ডাক্টর যেমন বিরল— গরিব পার্সি-ও। নিজেদের পেশা সামলে খেলায় যথেষ্ট সময় দেন এরা। ১৯৭১-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারতীয় ক্রিকেট দলের দ্বিতীয় উইকেটকিপার ছিলেন কলকাতার রুসি জিজিভাই (অনেকে জিজিবয়-ও বলেন)। অজিত ওয়াড়েকরের নেতৃত্বে সেই টিমের প্রথম উইকেটকিপার ছিলেন পি. কৃষ্ণমূর্তি— টেস্টগুলোতে তিনিই খেলেছিলেন। জিজিভাই অন্য ক’টি ম্যাচে। উল্লেখ্য, সেই সময়ে দেশের নক্ষত্র উইকেটরক্ষক ফারুখ ইঞ্জিনিয়র-ও ছিলেন পার্সি। জিজিভাই টেবিল টেনিসটাও দারুণ খেলতেন। তাকে দু’টোই খেলতে দেখেছি। ময়দানের বর্ণময় চরিত্র। এই প্রসঙ্গে আরও দুই সুপরিচিত পার্সি টেবিল টেনিস খেলোয়াড়কে মনে পড়ছে— জাল ভানিয়া (Zal M. Vania) আর এইচ. জে. কাপাডিয়া। তবে পার্সিদের এখনকার প্রজন্ম কি খেলাকে জীবনের অঙ্গ করে নিতে পারছে?

পাতাল-কাহিনি

ময়দানে পুব দিকটা নিয়েও বলার থাকে। সেই সত্তরের দশকের গোড়ার দিক থেকে আশির মাঝ অব্দি চৌরঙ্গীর দিকটা ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল পাতাল রেলের দীর্ঘকালীন কাজের জেরে। সুবিশাল গহ্বর, সুউচ্চ ক্রেন, যত্রতত্র ছোটখাটো পাহাড়— সব মিলিয়ে সে এক বিপর্যস্ত চৌরঙ্গী ও আশপাশ! আমরা দেখেছি, খাস কলকাতার হৃৎপিণ্ড চৌরঙ্গীতে, ময়দানের বুকে ঢেউ-খেলানো উঁচুনিচু প্রান্তরে পত্তন হল সাঁওতাল পল্লির। পাতাল রেলের নির্মাণ-শ্রমিকদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। তখন ‘পরিযায়ী’ শব্দটি অচেনা ছিল। তাই দিলাম না। আঁধার নামলে-পরে বেজে উঠত দ্রিমি-দ্রিমি মাদল! তখন এনজিও ব্যাপারটা ছিল না, থাকলে তাদের কল্যাণে কিছু কাজ  নিশ্চয়ই হত, শ্রমিক-সন্তানরা কিছুটা লেখাপড়া করতে পারত। অবশ্য সরকারি প্রকল্পও এখন বেশ কিছু। শরতে কাশবন দেখতে আমরা চৌরঙ্গীতে যেতাম, পাতাল রেলের কোনও বিস্তীর্ণ খাদে বা প্রান্তরে।

এমনি ভাবেই পাতাল রেলের কাজ চলতে-চলতে ময়দানের জঠর থেকে উত্থিত হয়েছিল একটি পূর্ণাঙ্গ নরকঙ্কাল, হাত-দু’টো জং-ধরা হ্যান্ডকাফে বদ্ধ! কাগজে বেরিয়েছিল খবরটা। কিন্তু তারপর সব নিশ্চুপ। কার কঙ্কাল? ভাবিয়েছে। উত্তাল সত্তরে নিখোঁজ কোনও কবির? স্বাধীনতার কোনও বিপ্লবী সেনানীর? উত্তর মেলেনি।

প্রস্থান

তারিখটা আজ নির্ণয় করাই যায়। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭। ভোররাতে ফার্স্ট ট্রাম ধরে মোহনবাগান মাঠে বড় ম্যাচের টিকিটের লাইন দিতে গিয়েছি। তা-ও দাঁড়ালাম অনেক পিছনে। যারা বোঝার বুঝবেন— তখন লাইন রাখতে পারাই ছিল কঠিন কাজ। নানা কায়দায় লাইন ভেঙে দেবার অপচেষ্টা! গল্পগাছা করে সুজনদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়েই যায়। তেমনই চলছে। অবশেষে টিকিট কাউন্টার খুলল। লাইন তো এগোয়-ই না! ধাক্কাধাক্কি বাড়ছে। ঘোড়পুলিশ ও-ধারের লাইনে লাঠিচার্জ করে গেল! এরই মধ্যে সকালের কাগজটা হাতে-হাতে চলে এসেছে। শিরোনাম : উদয়শঙ্করের প্রয়াণ। নিজেকে নিঃসঙ্গ, চারপাশটা জনহীন মনে হতে লাগল। বাড়ির কথা মনে হল। বাবার কথা, চির-আধুনিক এই আইকনের তন্নিষ্ঠ অনুরাগী। আমাদের বাড়িতে একটি ফ্রেমে নৃত্যরত উদয়শঙ্করের দু’টি দুরন্ত ছবি ঝুলত। ক্লাস থ্রি-ফোর তখন, বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন উদয়শঙ্করের শেষপর্বের সৃষ্টি ‘শঙ্করস্কোপ’-এ, মহাজাতি সদনে। বলতে দ্বিধাহীন, আজ পর্যন্ত এ-জীবনের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা এই ‘শঙ্করস্কোপ’। এই সমস্ত কিছু আচ্ছন্ন,  অবশ করে দিচ্ছে আমায়। লাইন-কোলাহল-ঘোড়পুলিশ-গালিগালাজ সব মুছে যাচ্ছে। কখন যেন লাইন ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছি! কানে ভেসে আসছে— “ও ভাই, কোথায় যাচ্ছ! লাইন রাখা কিন্তু মুশকিল।…”

চলে এসেছিলাম। ফিরিনি।

ছবি ঋণ : Wikimedia

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.