সোহম দাস
বিদায়ী মুহূর্তের রেশ মিলিয়ে আসছে ক্রমশ। গত ২৭ সেপ্টেম্বর, বুধবার, কলকাতার নগর-মানচিত্র থেকে যে মানুষটি হারিয়ে গেলেন, তাঁর মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পর এই লেখা লিখছি। এই সময়টুকুর মধ্যে আরও নানাবিধ ঘটনা ঘটে গিয়েছে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং অন্যত্র। নেহাত ছেলেমানুষের মতই সেসব ঘটনার সঙ্গে খুঁজতে গিয়েছি তাঁর চলে যাওয়ার অসম্ভব সংযোগ।
সৌম্যেন্দু রায় যেদিন চলে গেলেন, সেদিন আমি ছিলাম সেবাগ্রামে। মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা থেকে আট কিলোমিটার দূরে বাপু-প্রতিষ্ঠিত সেখানকার আশ্রম। সেবাগ্রাম নামটা তাঁরই দেওয়া। ১৯৩৬ সালে যমুনালাল বাজাজের আমন্ত্রণে যখন এখানে এসেছিলেন, তখন জায়গাটার নাম ছিল সেওগাঁও। চতুর্দিকে মাঠ আর জঙ্গল, মহাত্মা গান্ধীর কুটিরে প্রায়ই ঢুকে পড়ত সাপ। সেসব কাহিনির প্রমাণস্বরূপ আজও তাঁর অফিসঘরে টাইপরাইটারটির পাশেই রাখা আছে সাপ ধরার লাঠি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
প্রায় নব্বই বছর বয়স হয়ে এসেছে আশ্রমের, চারপাশের পরিবেশে খুব বড়সড় বদল আসেনি। মূল দ্বার দিয়ে ঢুকে খাদি ভাণ্ডারগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে এসে সোজা পড়বে আদি নিবাস কুঠি। সেখানে হাজিরা খাতায় নাম সই। বিশেষ কাজে এসেছি বলে আগে থেকে জানানো ছিল। তখন মধ্যাহ্নভোজনের সময়। সম্পাদকের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন সাদা সালোয়ার কামিজ পরিহিত বেনজি। মাটির ঘরের সামনে মাটির দাওয়া, সামনের দিকটায় পাথরের গাঁথুনি, ফলে বেশ ঠান্ডা। সেখানে বসে যাই অপেক্ষার জন্য, কালো রঙের শালখুঁটিতে হেলান দিয়ে। আর ঠিক সেইসময়েই ফোনটা আসে।
ফোন করছেন অরিন্দমদা, উত্তরপাড়ার জীবনস্মৃতি আর্কাইভের কর্ণধার অরিন্দম সাহা সরদার। ‘হ্যালো’-র পর দ্বিতীয় কথাটিই হল “সৌম্যেন্দু রায় মারা গেছেন, জানো!” গলায় উদ্বেগমিশ্রিত যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি।
এর পরের কয়েক ঘন্টা জুড়ে ফোনপর্বের এক শূন্যতা-সিরিজ। কলকাতা দূরদর্শনের অনিন্দ্য রায়, যাঁর সূত্রে সৌম্যেন্দু রায়ের কাছে যাওয়া এবং পরবর্তীতে এতকিছু, দ্বিতীয় ফোন এল তাঁর কাছ থেকে। তারপর, ক্রমশ অন্যান্য বন্ধু-পরিচিতরা, কয়েকটা মিডিয়া হাউজও। অদ্ভুতভাবে, বেশ কয়েকটা ফোনে এবং মেসেজে জানতে চাওয়া একটাই প্রশ্ন “খবরটা কি সত্যি?”
অবাক হই না এমন প্রশ্নে। এই ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে মৃত্যুও এমন এক সাধারণ পণ্যে পরিণত হয়েছে, যখন তখন যাকে তাকে নিয়ে রটে যায় বিশ্বাসযোগ্য গুজব। মননশীল মানুষের মনেও তাই প্রশ্ন জাগে, খবরটা কি সত্যি?
২৭ সেপ্টেম্বর সারাদিন আর কোনো কাজ হয়নি আমাদের। শুধু তিনি চলে গিয়েছেন বলে নয়, কাজ করার প্রয়োজনীয় রসদও ছিল না সেদিন। ঘটনাচক্রেই একখানা ছুটি পাওয়া গেল কাজ থেকে। পাওয়া গেল তাঁকে নিয়ে স্মৃতি রোমন্থনের কিছু নিজস্ব মুহূর্ত। কলকাতা থেকে ১,২০০ কিলোমিটার দূরের শান্ত সেবাগ্রামের স্নিগ্ধ, সবুজ ছায়াবীথি সেসব মুহূর্তকে আশ্রয় দিল সযত্নে।
আদি নিবাস কুঠির মাটির দেওয়ালের গোল গর্তে চড়াই পরিবারের বাস। নির্ভয়ে তারা ঢুকে পড়ে সে গর্তে, তাদের কিচিমিচির সুর তৈরি করে মনোরম সাউন্ডস্কেপ। কুঠির সামনেই একটা মহানিম। শুনলাম, বাপু আসার আগে থেকেই সে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখানে। একশোর বেশি বয়স পার হয়েছে, অথচ এখনো কী সতেজ তার আত্মপ্রকাশ। নিমগাছটি থেকে ডানদিকে এগোলে নির্দিষ্ট দূরত্বে পাশাপাশি তিনটি গাছ – প্রথমে বিনোবা ভাবের হাতে পোঁতা অশ্বত্থ, তারপর বা ওরফে কস্তুরবা গান্ধীর হাতে পোঁতা বকুল, শেষে আরও একটি অশ্বত্থ, এটি বাপুর নিজের হাতে পোঁতা। এই শেষ অশ্বত্থের গায়েই বাপু কুঠির বেড়া। কুঠির সামনে ঘেরা চৌকো স্থানটিতে রোজ সন্ধে নামার মুহূর্তে প্রার্থনা হয়, সর্বধর্মের ঈশ্বরচিন্তার স্থান সেখানে।
বৃষ্টি আসবে আসবে করছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি আশ্রম থেকে কিছু দূরে, রাস্তার ধারে। দাঁড়িয়ে দেখছি ক্ষেতভরা কচি ধান। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে তারা। মেঘ ডাকছে মাথার উপর। বৃষ্টি নিয়ে কত গল্পই রায় স্যার বলেছেন বিভিন্ন সময়ে। লিখেছেনও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথ্যচিত্রের সময়ে নিমতিতায় বর্ষণস্নাত পদ্মায় নেমে গিয়েছিলেন তিনি আর সত্যজিৎ রায়। তিনকন্যা ছবির ‘সমাপ্তি’ অংশের শুটিংয়ে অপূর্ব-বেশী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নৌকা থেকে নামতে গিয়ে পিছলে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যের জন্য কাদার দরকার ছিল, কয়েকদিনের শুকনো আবহাওয়াকে সরিয়ে রাতে হঠাৎ নেমে এসেছিল বৃষ্টি। সদগতি-র সময়েও অমন বৃষ্টি। মধ্যপ্রদেশে শুটিং চলছিল সেপ্টেম্বরে। রায় স্যার চিন্তিত ছিলেন, এসব জায়গায় এমন অসময়ের বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। শুটিংয়ের মধ্যেই না আবার থেমে যায়, তাহলে কন্টিনিউয়িটির দফা গয়া, অত টাকার ফিল্ম নষ্ট! অদ্ভুতভাবে সে বৃষ্টি থেমেছিল পরিচালক ‘কাট’ বলার এক মুহূর্ত পরেই। আবার বৃষ্টির নামার আগের এই মেঘলা আলোই কতভাবে হয়ে উঠেছে বিষণ্ণতার বার্তাবহ। সে দর্শনও যে ক্যামেরার কাজের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল ভীষণভাবে। ‘পোস্টমাস্টার’-এর আলোই তো ছিল মেঘলা, শহুরে পোস্টমাস্টার আর গাঁয়ের উচ্ছ্বলা রতনের বিচ্ছেদবেদনার গল্পকে পর্দায় বলতে যা তৈরি করেছিলেন সদ্য স্বাধীন চিত্রগ্রাহক হিসাবে হাতে খড়ি হওয়া সৌম্যেন্দু।
একটু একটু করে পতন শুরু হয় বৃষ্টিফোঁটার। আমি আর দাঁড়াই না, এগোতে থাকি যাত্রী নিবাসের দিকে। এটাও সেপ্টেম্বর। জায়গাটা কেবল মধ্যপ্রদেশ না হয়ে মহারাষ্ট্র। কেমন মিলে যাচ্ছে সবকিছু আজ। রাস্তার ধারে অন্নপূর্ণা প্রাকৃতিক ভোজনালয়। সেখানে দিনশ’জ আইসক্রিমের বোর্ড, লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা রঙে কার্সিভ ফন্টে লেখা ব্র্যান্ডের নাম, তলায় ‘Since 1932’। প্রতিষ্ঠার বছরটা দেখে আরও একবার দাঁড়াই। ওই বছরেই যে উত্তর কলকাতার গ্রে স্ট্রিটে জন্ম সৌম্যেন্দু রায়ের। তারিখটা ছিল ৭ ফেব্রুয়ারি।
ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছিল মধ্যপ্রদেশের এক ক্ষুদ্র নেটিভ স্টেট ধরমজয়গড়ে। সেখানে ওঁর বাবা কণককুমার রায় রাজ-এস্টেটের লিয়াজঁ অফিসার ছিলেন। সেখানকার রানি ছিলেন বিধবা। রাজার হাঁকডাক-শূন্য রাজবাড়িতে রাজা সাজতেন সৌম্যেন্দু নিজেই, একথা বলেছেন ওঁর বোন। দরবার হলের উচ্চ আসনে যেখানে একসময় রাজা বসতেন, সেই উচ্চ আসনই ছিল শিশু সৌম্যেন্দু আর তার সঙ্গীদের খেলার জায়গা।
তারপর, ১৯৪২ সালে কলকাতায় চলে আসা, তীর্থপতি ইন্সটিটিউশনে স্কুলজীবন শুরু। সেবছরই শুরু হয়েছে দেশব্যাপী এক গণআন্দোলন। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ওঁর মেজদা। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার মেজদা কি গান্ধীবাদী ছিলেন? উত্তর দিয়েছিলেন, না, সুভাষপন্থী।
১৪৮ নম্বর রাসবিহারী এভিনিউতে বিশাল বাড়ি ছিল সৌম্যেন্দু রায়দের পরিবারের, যৌথ পরিবারে মানুষ হয়েছিলেন সকলে। কিশোর চোখ দিয়ে রক্তাক্ত চারের দশককে প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিশোর সৌম্যেন্দু।
১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর প্রথম ক্যামেরা হাতে পাওয়া, বড়দি উপহার দিয়েছিলেন। ১৯০০ সালে বাজারে আসা কোডাক ব্রাউনি সিরিজের কোনো একটা মডেল। স্কুলের বন্ধু অসিত রাহা ধরিয়ে দিয়েছিলেন ছবি তোলার নেশা। সেই অসিতের দাদার স্টুডিওতে গিয়েই ডেভেলপ করতেন সেসব ছবি। ক্যামেরার সঙ্গে সেই তাঁর মন দেওয়া-নেওয়া শুরু, সে দেওয়া-নেওয়া চলল পরবর্তী প্রায় সাড়ে সাত দশক।
ওঁর বাড়িতে গেলে এসব গল্প হত। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চলত ওঁর বই বা সিডি ঘাঁটা, কখনো সঙ্গে কেউ থাকলে বা অন্য কোনো কারণে ওঁর ছবি তোলা। ছবির জন্য প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। ইজিচেয়ারে যেখানে বসতেন, সেখানেই ঠিক মাথার উপরে টাঙানো থাকত একটা আলো। ছবি তোলার সময় হলেই নির্দেশ দিতেন, জানালার পর্দা দিয়ে বাইরের আলোটা ঢাকো, মাথার উপরের আলোটা জ্বালাও। শিক্ষক সৌম্যেন্দু বেরিয়ে আসতেন তখন। উপভোগ করতাম এই নির্দেশ পালন। ক্যামেরা সবসময়ে থাকত না, মোবাইলেই ছবি তোলা হয়েছে বেশি। তোলার পর ওঁকে ছবিটা দেখাতাম, দেখে শুধু একবার বলতেন, ভাল হয়েছে। ব্যাস, আর কিছু নয়। একদিন মজা করে বলেই ফেললাম, স্যার ভাবেন, কী দিনকাল পড়ল! একটা ক্লিকেই ছবি। আমার কথা শুনে হাসলেন মুচকে।
এই প্রসঙ্গেই বলে রাখা ভাল, ডিজিটাল ফর্ম্যাটের এমন সর্বগ্রাসিতা, সেলুলয়েডের প্রায় উধাও হয়ে যাওয়া, এসব ওঁর প্রজন্মের কাছে অকল্পনীয় ছিল ঠিকই, তবে সৌম্যেন্দু কিন্তু একথাও বলতে দ্বিধা করেননি যে ডিজিটালে আরও ভাল কাজ সম্ভব।
বছর দুয়েক আগে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন কিনতে চাইলেন। ওঁর ছবি দেখিয়ে ওঁকে প্রশ্ন করতাম, সেই দেখে শখ হয়েছিল, ফোনে পুরনো ছবি দেখবেন। একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, কল্পনা ছবিটা দেখা যাবে? ইউটিউবে চালিয়ে দিলাম, কিছুক্ষণ দেখে মন্তব্য – খুব ভাল একটা ছবি। ক্যামেরার কাজটা কোনো এক বিদেশি করেছিলেন বোধহয়।
আসলে এই মনোভাবের পিছনে কাজ করত এক সহজ যুক্তি। ওঁরা যখন কাজ শুরু করেছেন, সেইসময় সীমাবদ্ধতার কারণেই এটা-সেটা উপকরণ দিয়ে আলোর ব্যবস্থা করে নিতে হত। সেখানে আজ যখন প্রায় সবকিছুই হাতের নাগালে আছে, তখন তো কাজের মান এমনিই ভালো হওয়া উচিত।
সেই জায়গা থেকেই বুঝি বর্তমানকালের শিল্পগত নিম্নগামিতা ওঁকে কষ্ট দিত।
তাঁর সঙ্গে কাটানো অমূল্য মুহূর্তগুলোকে এক সূত্রে বাঁধতে গিয়ে দেখছি, আসলে প্রতিটি মুহূর্তই একে অপরের সঙ্গে আপনা থেকেই কেমন বেঁধে রয়েছে। সেই কারণেই আরও যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেন তিনি, ধরা দিয়েও বুঝি অধরা থেকে যাচ্ছেন আমার কাছে।
এই মুহূর্তে যেমন মনে পড়ছে ওঁর বই পড়ার কথা। সম্প্রতি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন নরওয়ের জন ফসে। বিয়র্নস্টিয়ের্নে বিয়র্নসন, ন্যুট হামসুন এবং সিগ্রিড উন্ডসেটের পর জন হলেন চতুর্থ নরওয়েজিয়ান সাহিত্যিক, যিনি এই পুরস্কার পেলেন। এই প্রসঙ্গে ফেসবুকে বাংলার একজন বেশ জনপ্রিয় ‘লেখক ও পাঠক’ লিখলেন, প্রতিবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের নাম ঘোষিত হয়, আর নিজেকে অশিক্ষিত মনে হয়।
রসিকতা হিসাবেই নেওয়া যায় উপরের কথাটাকে। কিন্তু আসলে এই মনোভাব বর্তমান সভ্যতার দান। বই পড়ার ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা চলে আসা। কত বই পড়ছি, কী বই পড়ছি, নিয়মিত হারে সে বার্তা বন্ধুসমাজকে জানানো। আজকের সময়ে তা থেকে বিরত থাকা কঠিন সত্যিই এবং মাঝেমধ্যে বইয়ের কথা প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ায় অন্যায়ও কিছু নেই। সমস্যা এই প্রতিযোগিতার মনোভাবে।
এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী পৃথিবী জুড়ে, তাদের কত সহস্র ভাষা, সে ভাষায় লেখা হচ্ছে কত না সাহিত্য! প্রতি বছর নোবেল, বুকার বা পুলিৎজার পান হাতে গোনা কয়েকজন। তার বাইরে এই যে বিপুল অংশ থেকে গেল, সে খবরও তো আমরা পাচ্ছি না, বৈজ্ঞানিকভাবেই তা অসম্ভব। যা পড়ব, তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশিই অপঠিত থেকে যাবে, এই সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া এখানে কিছু করার নেই। নতুনের সন্ধানের চেষ্টা ভাল অবশ্যই, কিন্তু সেখানে যান্ত্রিক চটকদারি থাকলে সেই অন্বেষণ হয়ে উঠবে রসকষহীন, মেকি।
এখানেই সৌম্যেন্দু রায়দের মত মননশীল মানুষদের প্রয়োজন হয়। তাঁর তিনখানা ঘর জুড়ে থাকা বিবিধ বইয়ের সম্ভার, সে সংগ্রহের বিষয়বৈচিত্র্য দেখলে অবাক হতে হয়। গীতা, পুরাণ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বাংলার চিরায়ত সাহিত্য। বঙ্কিম রচনাবলী, বিভূতিভূষণ রচনাবলী, সুবোধ ঘোষের শ্রেষ্ঠ গল্প, শরদিন্দু অমনিবাস। কালজয়ী সব গোয়েন্দাকাহিনির বই। সঙ্গে ইতিহাস – ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাস, কলকাতার নগরেতিহাস, চলচ্চিত্রের ইতিহাস। ওই সংগ্রহের কিছু-কিছু হয়ত না পড়াও ছিল, তেমনটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পড়তেন যে খুঁটিয়ে, সেকথা ভাবনার গভীরতা দিয়েই বুঝিয়ে গিয়েছেন। আলাদা করে লোককে ডেকে বলার দরকার পড়েনি।
আমাকে একবার কলকাতার উপরেই কোনো একটা বই দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু শারীরিক সীমাবদ্ধতায় বইটা আর খুঁজে রাখতে পারেননি, আমাকেই তাঁর শোওয়ার ঘরে গিয়ে খুঁজতে বলেন। আমিও খুঁজে পাইনি, বদলে পেয়ে যাই অন্য একটা বই। প্রাক্তন ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট-কর্নেল নাইজেল কলেটের লেখা দ্য বুচার অফ অমৃতসর। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড যার হাতে ঘটেছিল, সেই রেজিনাল্ড ডায়ার বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র। রূপা পাবলিকেশনের বইটা বাইরে তাঁর বসার ঘরে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করি, কবে কিনেছিলেন বইটা? উত্তর দেন, ২০০৫-০৬ হবে। যেই শুনলেন, বইটা অনেকদিন ধরে পড়ার ইচ্ছে, সটান বলে দিলেন, নিয়ে যাও, পড়বে।
একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এত যে ইতিহাস পড়েন, এই চর্চা ক্যামেরার কাজে সাহায্য করেছিল? উত্তর এল, ইতিহাস পড়তে ভাল লাগে, তাই ইতিহাস পড়ি। ক্যামেরার কাজে ওভাবে সাহায্য করেছিল কিনা জানি না।
এই অকপট সারল্যই ভাল লাগত বারবার।
অকপটতার পরিচয় অন্যভাবেও পেয়েছি। ২০২১ সালে সত্যজিতের শতবার্ষিকী হল। তাঁর গুটিকয়েক সহযোদ্ধাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে তখন বেঁচে আছেন রায় স্যার। অতএব ছোট-মেজ-সেজ-বড় নানা জায়গা থেকে সাক্ষাৎকারের হিড়িক। বিষয়, ওই সত্যজিৎ রায়। একদিন বললেন, ১৯৯২ সাল থেকে একই কথা বলে যাচ্ছি। আর কত বলব!
সত্যজিতের প্রতি মুগ্ধ ছিলেন, আজীবন তাঁকে শিক্ষকের আসন দিয়েছেন, একথা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু সত্যজিতের ইউনিট যে তিনি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, এবং তা একটা অন্যায়ের প্রতিবাদে, তা অনেকেই জানেন, যদিও তিনি নিজে কোনোদিন এ বিষয়ে কোথাও কোনো কথা বলেননি। এমনকি ক্যামেরা চালানোর ক্ষেত্রে সত্যজিতের ছবিতে স্বাধীনতা না পাওয়া নিয়েও তাঁর সঙ্গত ক্ষোভ ছিল। যাঁরাই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, তাঁরাই সেকথা কোনো না কোনোভাবে আঁচ করতে পেরেছেন। কিন্তু দিনের শেষে গুরুর প্রতি প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করতে তাঁর কোনো কুণ্ঠাবোধ ছিল না। একইসঙ্গে সবসময়ে উচ্চারণ করতেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও সুব্রত মিত্রের নাম।
আসলে জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর বসার ঘরের জানালাটার মত – মুক্ত, প্রসারিত।
ওই জানালাটা দিয়ে দেখা যায় দক্ষিণ কলকাতাকে। সকালে বা সন্ধ্যায় যখনই যেতাম, তার ধারে একবার গিয়ে দাঁড়াতাম। দুই ভিন্ন সময়ে তার রূপও যেত বদলে। দেখতে কেমন অস্বস্তি হত, যেন জোর করে বাড়ানো হয়েছে শহরকে। যখন নিজে চলাফেরা করতে পারতেন, তখন হয়ত একা একা এই জানালার পাশে এসে বসতেন বই বা পাইপ নিয়ে। দেখতেন। তাঁর দেখা কলকাতাও কত বদলে গিয়েছিল। রাসবিহারী এভিনিউয়ে ওঁদের বাড়িটা ভেঙে অ্যাপার্টমেন্ট উঠেছিল, ফাঁকা বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন শেষবারের মত। এ শহর থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছিল সেলুলয়েড, সে পরিবর্তন-যন্ত্রণাও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল অসহায় সাক্ষীর মত।
সেই কারণেই বুঝি ইতিহাস সংরক্ষণের গুরুত্বটা অনুভব করতেন। জীবনস্মৃতি আর্কাইভের নেপথ্য উস্কানি তো তাঁরই ছিল। অযত্নে পড়ে থাকা পথের পাঁচালী-র মিচেল ক্যামেরাটা রূপকলা কেন্দ্রে নিয়ে আসা, তার পিছনেও তো তাঁরই উর্বর ইতিহাসচেতনা। আবার, এই চেতনা ছিল বলেই নতুন প্রজন্মের কে কী ভাবছে, সেকথা জানতে চাইতেন। তাঁকে দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখেছেন যাঁরা, তাঁদের মুখেই শুনেছি, দেশবিদেশের খবরাখবর সম্পর্কে কতখানি নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখতেন। এই প্রবণতা না থাকলে, উনি যে ক্যামেরায় বেশি কাজ করেছেন, সেই অ্যারিফ্লেক্স যে ‘অ্যালেক্সা’ নামের একটা ডিজিট্যাল ক্যামেরা বাজারে এনেছে, ৮৯ বছর বয়সে এসে সে খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করতেন না। এই প্রবণতা না থাকলে ওঁর চেয়ে বাষট্টি বছরের ছোট এক অনভিজ্ঞ তরুণকে অনায়াসে ফোনে বলতে পারতেন না, তোমার অপেক্ষায় থাকি। তোমার থেকে কত কিছু জানব, শিখব!
তাঁর এই অনুসন্ধিৎসা, ইতিহাসচর্চার বৈজ্ঞানিক মন, এসবের সঙ্গে আরও একটা বিষয় দিব্যি খাপ খেয়ে যেত। সেটা মানুষের প্রতি ওঁর অকুণ্ঠ ভালবাসা। ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পর অনেকেই যেতে চাইতেন, অনুমতি চাইতে গিয়ে কখনো ‘না’ শুনিনি। যে কোনো মানুষের জন্য দরজা সর্বদা খোলা। আসলে যে প্রজন্মের মানুষ ছিলেন তিনি, যাঁদের দেখেছেন, পেয়েছেন বড় কাছ থেকে, তাঁদের শিখিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলোকে জীবনে ধারণ করেছিলেন।
তাঁর বইতেই রয়েছে, মলিনা দেবী, সন্ধ্যারাণী বা অনুভা গুপ্তদের কাছে কী অসম্ভব সহোদর-স্নেহ পেয়েছেন আউটডোরে। সত্যজিতের ইউনিট নিয়ে বলতে গিয়ে তো বারবারই বলতেন, এই প্রথম দেখলাম আর্টিস্ট আর টেকনিশিয়ানে কোনও ব্যারিয়ার নেই। সবাই একটা পরিবারের মত। পরিচালক তপন সিংহকে দেখেছেন, এইচএমআই লাইটের ভাড়া প্রযোজক না দিলে নিজেই নিজের পারিশ্রমিক থেকে দিয়ে দিতে রাজি।
মনে আছে, ২০১৯ সালে যখন ওঁর কাছে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হচ্ছে, ওঁর সেই কয়েক কিলোগ্রাম ভরের ফটো অ্যালবাম থেকে ছবি তোলার কাজে, তখন সদ্য একটা স্কলারশিপ পেয়েছি ঝুমুর গান নিয়ে কাজ করার উপরে। যে সংস্থা সেই স্কলারশিপ দিয়েছিল, সেই সংস্থা ওঁর একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিল সত্যজিৎ সম্পর্কে। প্রাপ্তির খবরটা কথায় কথায় জানালাম ওঁকে। বললেন, তাই নাকি? বাঃ।
সঙ্গে ছোট্টো সংযোজন – মানুষের কাছে যাবে, মানুষের সঙ্গে মিশবে। দেখবে, খুব ভাল লাগবে।
পরে বলেছেন, কত মধুর সব স্মৃতি জমেছিল আউটডোর শুটিংয়ে। বিশ্বায়ন এসে সমস্ত কেমন গুলিয়ে দিল। আক্ষেপ করতেন, পরের দিকে দেখছি, সকলে টাকা চাইছে।
তবে দু-একটা এমন কথা ছাড়া আলাদাভাবে কোনো উপদেশ কখনো দেননি। আসলে যা দিতেন, তা হল অদ্ভুত স্নেহের প্রশ্রয়। মানুষের ভাল দিকটুকুর প্রশংসা করে যে তাকে অনেক কিছু শেখানো যায়, এই বোধ তাঁর ছিল। বয়সের কারণে ও শারীরিক কারণে খুব বেশি বকুনি আমি খাইনি, তাঁর ছাত্রছাত্রীরা বোধহয় সেসব একটু-আধটু খেয়ে থাকবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওঁর কিছু বিশেষ অবস্থান হয়ত অনেককে ব্যথিতও করেছে, কিন্তু স্মৃতিচারণা করতে বসলে আনন্দানুভূতির মুহূর্ত এত বেশি ভিড় করে আসে যে সেসব বকুনি বা তাঁর দিক থেকে আসা কোনো অপ্রিয় ব্যবহার আনন্দের আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে যায়।
চৌরঙ্গী পত্রিকার সৌম্যেন্দু রায় বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদ উন্মোচনের দিনটাই যদি ভাবি। ২০২২ সালের মার্চ মাস, কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গের কারণে কলকাতা বইমেলা পিছিয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যায় গিয়েছি ওঁর ঘরে, ওঁর হাত দিয়েই প্রচ্ছদটা উন্মোচিত হল। তারপর কিছুক্ষণ আড্ডা। আমি এবং পত্রিকার সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মুখোমুখি বসেছি। সন্ধ্যায় স্যার একটু বেশিই ঝিমিয়ে থাকতেন, মধ্যাহ্নভোজ-পরবর্তী ওষুধের প্রভাবে। তার মধ্যেই আমাদের কথার মাঝে এসে পড়তেন সহজভাবে। মাঝেমধ্যে দুপক্ষই হয়ে যেত নীরব। সে মুহূর্তগুলোও অদ্ভুত অনুভূতি বয়ে আনত। কারণ জানি, কিছুক্ষণ পরে উনি নিজেই কিছু বলতে চাইবেন। সেই অপেক্ষাগুলোর জন্যেও বারেবারে যাওয়া।
সেদিন যোগব্যায়াম, স্বাস্থ্যচর্চা, উচ্চতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় শুভঙ্করদা তুললেন মিস প্রিয়ংবদা-র প্রসঙ্গ। মিস প্রিয়ংবদা সেজে যাওয়া রামের (ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়) চেহারা দেখে নায়িকা ডলির (লিলি চক্রবর্তী) প্রাচীনপন্থী মামা (হরিধন মুখোপাধ্যায়) মন্তব্য করছেন, বেশ, বাড়ন্ত গড়ন দেখছি। তাতে প্রিয়ংবদাবেশী রামের উত্তর, পাঞ্জাবে মানুষ তো!
ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করেই শুয়েছিলেন স্যার। প্রিয়ম্বদার উত্তরের দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল, সঙ্গে স্বর্গীয় হাসিটা খেলে গেল মুখ জুড়ে। ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, এর চেয়ে ভাল সিনেমা আর বুঝি হয় না।
আরো পড়ুন সিনেমার বিশ্বকর্মা: বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও রবি চট্টোপাধ্যায়
২০২৩ সালের বইমেলার কিছু আগেও গিয়েছিলাম ওঁর কাছে। ততদিনে কথা আরও বন্ধ হয়ে এসেছে। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের পাঠানো আমন্ত্রণের চিঠিটা পড়ে রয়েছে সোফায়। খামটাও খোলা হয়নি। একথা-সেকথার পর জিজ্ঞাসা (বেশ কষ্ট করেই), এর মধ্যে কলেজ স্ট্রিট যাবে? ইতিবাচক উত্তর পাওয়ায় একটা আবদার করলেন – একটা ডিকশনারি দরকার। কফি হাউজের ওপরতলায় চক্রবর্তী-মুখার্জির দোকানে পাবে।
শুধরে দিলাম ওঁকে। ওটা চক্রবর্তী-চ্যাটার্জি। কিন্তু কীসের ডিকশনারি? উত্তর দিলেন – চেম্বার্সের ক্রসওয়ার্ড ডিকশনারি। লাল মলাটের। মাঝেমধ্যে শব্দ খুঁজে পাই না, তখন ডিকশনারি থাকলে সুবিধা হয়।
পাঠককে মনে করাই, যেদিন একথা বলছেন, ততদিনে আর্থ্রাইটিস-আক্রান্ত হাতটার নড়াচড়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ওষুধের প্রভাবে চোখ প্রায় খুলে রাখতেই পারেন না, বাকশক্তিও ক্ষীণ। বইটা শেষ পর্যন্ত আর পাইনি কোথাও।
সেদিনের পর থেকে আরও খানিক এগিয়ে আসি। কয়েক মাস আগে, জুনের শেষদিকে গিয়েছি ওঁর কাছে। ভরাট মুখশ্রী আর নেই, শরীরের নড়াচড়া বন্ধ, কথাও প্রায় পুরোপুরি বন্ধ, শুধু ঠোঁট নড়ছে। তার মধ্যেও ‘চা খাবে?’ বলার চেষ্টা। আমাদের কথায় সাড়া দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা। কিন্তু পারছেন না আর। শরীরের কাছে হেরে যাচ্ছে মন। উঠে আসছি এক ঘন্টা পরে, আবার যাওয়ার ঠুনকো প্রতিশ্রুতি দিয়ে (জানিয়ে রাখি, যাওয়া হয়নি আর)।
দেখলাম এবার বেশ সজোরেই নড়ে উঠল ঠোঁটটা, কিছু শব্দও স্পষ্ট হল। এই কয়েক বছরে ওঁর সঙ্গে কাটানোর অভিজ্ঞতায় বুঝে গেলাম, কী বলছেন।
ক্ষমা চাইছিলেন সৌম্যেন্দু রায়, উত্তরপ্রজন্মের কাছে – ‘সরি, কথা বলতে পারলাম না।’
নিবন্ধকার পত্রিকা সম্পাদক, চৌরঙ্গী পত্রিকার সৌম্যেন্দু রায় সংখ্যা করেছেন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।