নীতা মণ্ডল

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক। রাঢ়বঙ্গের একটি ক্ষুদ্র গ্রাম লাভপুর। গ্রামটি জমিদার প্রধান। ছোট, বড় নানা মাপের জমিদার। তাঁদেরই মধ্যে হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় একজন ক্ষুদ্র জমিদার। বসতবাড়ির সামান্য দূরে তাঁর কাছারিবাড়ি অর্থাৎ বৈঠকখানা (পরবর্তীকালে যে বাড়ির নামকরণ হবে ধাত্রীদেবতা)। বাড়ি সংলগ্ন একটি বড় পুকুর – নাম শালপুকুর। আজও লাভপুরে গেলে ধাত্রীদেবতার অদূরে শালপুকুরকে স্বনামেই দেখতে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে বড় পুকুর বা দীঘির পাড়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বড় বড় মহীরুহ এবং তালগাছ শোভিত বাগান। শালপুকুরও ব্যতিক্রম নয়। পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি অশ্বত্থ গাছের পাশে ছোট মাটির ঘরে বাস করে একজন বিধবা মেয়ে। মেয়েটির নাম স্বর্ণ। সংসারে সে স্বজনহীনা, নিঃসঙ্গ। মা-বাবা তো নেইই, স্বামীও তাকে নিঃসন্তান অবস্থায় ফেলে অকালে বিদায় নিয়েছে। মেয়েটি জাতিতে গন্ধবণিক। উপার্জনের জন্য বেনেদের বিধবা মেয়েটি গ্রামের হাট থেকে তরিতরকারি, পান ইত্যাদি কিনে দরজায় দরজায় ফেরি করে বেড়ায়। অবশ্য আপন গ্রামের চেয়ে প্রতিবেশী গ্রামগুলিতেই বেশি যায় সে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

হরিদাসের গৃহে পাচিকার কাজ করে গ্রামেরই এক ব্রাহ্মণকন্যা। মেয়েটির বালকপুত্র অবিনাশ সর্বদা তার মায়ের সঙ্গে হরিদাসের গৃহেই পড়ে থাকে। তার কারণ হরিদাসের শিশুপুত্র তারাশঙ্কর তাকে ছাড়তে চায় না। বয়সে বেশ খানিকটা ছোট হলে কী হবে, “অবিনাশদাদা” তার খেলার সাথী। যখন তখন গল্প শোনার বায়না করে অবিনাশদাদার কাছে। অবিনাশের স্কুল যাবার সময় হলে তারাশঙ্কর তার গলা আঁকড়ে ধরে। অবিনাশের মাকে সে ডাকে, “দাদার মা”।

হঠাৎ একদিন অবিনাশ অসুখে পড়ল। জ্বরে বেহুঁশ। শয্যাশায়ী। গ্রামে রটে গেল অবিনাশকে ডাইনীতে খেয়েছে। খবর পাঠানো হল গোঁসাইবাবার কাছে। গোঁসাইবাবা একজন সন্ন্যাসী। তাঁর আর এক নাম রামজী সাধু। অন্য কোনো প্রদেশ থেকে এসে উঠেছিলেন গ্রামের দেবীমন্দির ফুল্লরাতলায়। পরে হরিদাসের সঙ্গে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সাধুর পরামর্শেই হরিদাস গ্রামের বাইরে তারামায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারামায়ের উপাসনা করার বছর খানেকের মধ্যেই তাঁর পুত্র তারাশঙ্করের জন্ম। তারাশঙ্করের প্রতি গোঁসাইবাবার গভীর স্নেহ। নিয়মিত তিনি এই শিশুটিকে গল্প শোনাতে আসেন। সেদিন অবিনাশকে ঝাড়তে অর্থাৎ ডাইনীর প্রকোপ থেকে মুক্ত করতে যাবার সময় তারাশঙ্করকে কোলে নিয়েই গেলেন রামজী সাধু। প্রবল হুঙ্কারের সঙ্গে দুর্বোধ্য সব মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। অবিনাশকে প্রশ্ন করলেন “তুই কে?”

অবিনাশের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, সে “স্বর্ণ ডাইনী”।

কেন স্বর্ণ অবিনাশকে খেতে গেল এই প্রশ্নের উত্তরে অবিনাশ বলল, ঘরের সামনে দিয়ে অবিনাশকে বড় বড় আম হাতে যেতে দেখে তার লোভ হয়েছিল। সে মেয়েমানুষ, তাই লজ্জায় চাইতে পারেনি। অতএব আম না পেয়ে অবিনাশকেই খেয়েছে।

মন্ত্র তন্ত্র, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব পার করে অবিনাশের উপর সরষের ছিটে মারা হয়, করা হয় নানা তুকতাক। জল ভর্তি মাটির কলসী দাঁতে তুলে নিয়ে যেতে বলা হয়। সেই কলসী অবিনাশের দাঁত থেকে খসে পড়ে ভেঙে যায়, অবিনাশও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে। এই ঘটনাগুলিই সম্ভবত ডাইনীর বিতাড়িত হওয়ার ইঙ্গিত। এরপর অবিনাশ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে ঘটনা সেখানেই থেমে থাকে না। স্বর্ণ মার খায় গ্রামবাসীদের হাতে। সে যে ডাইনী একথা এতদিন ফিসফাস শব্দে বাতাসে ভেসে বেড়ালেও এবার সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। স্বর্ণের নাম হয়ে যায় সনা ডাইনী।

সেদিনের ঘটনা তারাশঙ্করের শিশুমনে গভীর ছাপ ফেলে। ডাইনী আতঙ্ক তার মনে বদ্ধমূল হয়ে উঠে। স্বর্ণের সামান্য কুঁজো, শুকনো কাঠির মতো চেহারা আর নরুনে চেরা ছোট ছোট চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে পড়লে মনে হয়, ওই চোখ বুঝি তার বুকের ভেতর ঢুকে হৃৎপিণ্ডটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

পিসিমা শৈলজাদেবী তারাশঙ্করকে বিশেষভাবে সাবধান করে দেন। বলেন, স্বর্ণের কাছে আছে ডাইনী মন্ত্র। সে যদি একবার সেই মন্ত্র স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে দিয়ে বলে “তোকে দিলাম”। অমনি যাকে বলল, সে ডাইনী হয়ে যাবে আর স্বর্ণ তার ডাইনী জীবন থেকে মুক্তি পাবে।

কাজেই পথে আসতে যেতে স্বর্ণকে দেখলেও তার সঙ্গে কথা বলার সাহস হত না তারাশঙ্করের।

এর বেশ কয়েক বছর পরের কথা। কিশোর তারাশঙ্কর লক্ষ করল, স্বর্ণ তাদের বাড়িতে আসছে। তারাশঙ্করের মা স্বর্ণকে ঠাকুরঝি সম্বোধন করছেন। ফুল্লরাতলায় আসা যাওয়ার পথে স্বর্ণের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। হয়ত সেইজন্যেই সাহস করে তরকারি ও পান নিয়ে বাড়িতে আসে স্বর্ণ।

মাকে তারাশঙ্কর তার ভয়ের কথা বলতে তিনি বলেন “সত্যি বলে আমার মনে হয় না। ও তোমার কোনও অনিষ্ট করবে কেন? ও আমাকে ভালবাসে। তোমাদেরও ভালবাসে।

এছাড়া স্বর্ণকে দিয়ে কারও কোনও অনিষ্ট হয়েছে কি?”

এরপর তারাশঙ্করের মনের ভয় কেটে যায়। সে স্বর্ণকে বোঝার চেষ্টা করে। পথে যেতে আসতে দাওয়ায় ঠেস দিয়ে আকাশের পানে চেয়ে বসে থাকা নিঃসঙ্গ মানুষটিকে দেখে নিজের মনে বেদনা অনুভব করে। তারাশঙ্কর লক্ষ করে, গ্রামে গ্রামান্তরে ডাইনী বদনাম অনেকের আছে। কিন্তু স্বর্ণ ডাইনীর নামে যত কলঙ্ক, তেমন আর কারও নামে নেই। তাই গোটা পৃথিবীতে তার আপনজন বলে কেউ নেই। সারাটা জীবন তাই স্বর্ণ একটা দুর্বিষহ একাকিত্বে কাটাতে বাধ্য হয়।

 

স্বর্ণকে নিয়ে তারাশঙ্কর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মোট তিনটি গল্প রচনা করেছিলেন। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ‘ডাইনীর বাঁশি’ শিরোনামে ভারতবর্ষ পত্রিকার ১৩৪০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায়। পরের দুটি গল্পেরই শিরোনাম ‘ডাইনী’। একটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ সালে প্রবাসী পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায়। শেষ গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে মৌচাক পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায়।

‘ডাইনীর বাঁশি’ গল্প নির্মাণের উল্লেখ পাওয়া যায় আমার সাহিত্য জীবন রচনায়। “বাড়ি ফিরলাম। ফিরে আবার বসলাম কাগজ কলম নিয়ে। লিখলাম ‘ডাইনীর বাঁশী’ বলে একটি গল্প। এ গল্পটি সত্যকার একটি ভাল গল্প। আমাদের গ্রামে ছিল গন্ধ বণিকদের মেয়ে – নিঃসন্তান বিধবা – স্বর্ণ; লোকে বলত সে ডাইনী। সনা ডাইনী! আমাদের বৈঠকখানা বাড়ির সংলগ্ন শাল-পুকুরের উত্তরপূর্ব কোণে অশ্বত্থতলায় ছিল তার বাড়ি। গল্প শেষ করে কিরণকে শোনালাম। কিরণ লাফ দিয়ে উঠল। নিয়ে গেল ‘বঙ্গশ্রী’ আপিসে। সজনীকান্তকে শোনালে। সজনীকান্ত কিন্তু গল্পটি নিলেন না। বললেন, ওঁর লেখা মাঘ মাসে বেরিয়েছে, এখন অন্ততঃ পাঁচ মাস আগে আর ওঁর লেখা যাবে না।’

গল্পটি সাবিত্রীপ্রসন্ন দিয়ে আসেন ভারতবর্ষ পত্রিকায়। বৈশাখ মাসে সেখানে প্রকাশিত হয়। ‘ডাইনীর বাঁশী’ গল্পটি পরে ‘ছলনাময়ী’ গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। তারাশঙ্কর ‘ছলনাময়ী’ এবং ‘রাইকমল’ বই দুটি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। এরপর যখন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় তখন রবীন্দ্রনাথ ‘ডাইনীর বাঁশী’ গল্পটির প্রশংসা করেছিলেন। এ ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ তারাশঙ্কর দিয়েছেন আমার সাহিত্য জীবন বইতে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “গল্পটি খুব ভাল লেগেছে আমার।

… কলকাতার একজন বড় পণ্ডিত সাহিত্যিক এই গল্পটির কথা শুনে কী বললেন জান? উইচক্র্যাফট নিয়ে বাংলা গল্প! এ নিশ্চয় ইউরোপের গল্প। ওদের দেশের গল্প পড়ে লিখেছে।”

তারাশঙ্কর একথা শুনে রবীন্দ্রনাথের কথার মধ্যেই বলে উঠেছিলেন “না-না। স্বর্ণ ডাইনী যে আমাদের পাড়ায় থাকে। এখনও আছে। আমাদেরই কাছারি বাড়ির সামনের পুকুরের ইশানকোণে তার বাড়ি।”

গুরুদেব তখন হেসে বলেছিলেন “আমি জানি, আমি বুঝতে পারি। তোমাকে আমি বুঝেছি। ও কথাটা তোমাকে কেন বললাম জান? বললাম আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের দেশের সঙ্গে পরিচয় কত সংকীর্ণ তাই বোঝাবার জন্য। ডাইনী মানে ওঁদের কাছে উইচক্র্যাফট। সে ইউরোপ ছাড়া এদেশে কি করে হবে। আমাদের দেশে ডাইনী এঁরা দেখেননি, জানেন না, বিশ্বাস করেন না। আমি তাই তাঁদের বললুম; বললুম, উঁহু উঁহু! এ তারাশঙ্করের চোখে দেখা। আমি যে নিজে দেখতে পাচ্ছি, গ্রীষ্মকালের দুপুরে তালগাছের মাথায় বসে চিলটা লম্বা ডাকছে, গলাটা তার ধুকধুক করছে। আর নিজের ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে স্বর্ণ ডাইনী বসে আছে আছন্নের মতো। আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি…।’

স্বর্ণকে নিয়ে তারাশঙ্করের দ্বিতীয় গল্প ‘ডাইনী’ প্রথমে প্রবাসী মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও পরে স্থান পায় বেদেনী গল্পগ্রন্থের মধ্যে। ‘ডাইনী’ গল্পে স্বর্ণের নাম বদলে সুরধনি হয়েছে। তবে দুটি গল্পই একজন সাধারণ মানবীর ডাইনী হয়ে ওঠা এবং তার পরিণতিকে আধার করে নির্মিত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে নারীকে ডাইনী বলে দাগিয়ে দেওয়া এবং তাদের ঘৃণিত জীবন বয়ে বেড়ানোর কাহিনী বিশ্বসাহিত্যে অপরিচিত ছিল না। তারাশঙ্কর তাঁর কাহিনীতে ধীরে ধীরে উন্মোচিত করলেন কীভাবে একটি অপবাদ, যার বিরুদ্ধে অপবাদ তার নিজের কাছেই বদ্ধমূল বিশ্বাসে পরিণত হয়। একজন সরল গ্রাম্য মেয়ে সমাজের নির্দয়তার শিকার হতে হতে কেমন করে মেনে নেয়, সে কুলক্ষণা ডাইনী। একটি সামাজিক কুসংস্কার একজন মানুষের সমগ্র জীবনকে কেমন বিপন্ন করে তোলে তার জ্বলন্ত বিবরণ ফুটিয়ে তুললেন গল্প দুটিতে।

অনাহারক্লিষ্ট মানুষের খাদ্য দেখে জিভে জল আসা, শিশু দেখে স্নেহাতুর বুকে জেগে ওঠা আকুলতার মতো স্বাভাবিক ঘটনাকে ‘স্বর্ণ’ ভাবতে শুরু করল, এ তার লালসা – সর্বনাশা লোভ। অন্যদিকে তার প্রতিবেশী মানুষজন গুরুভোজন করার পর ভেদবমি করলে অবলীলায় সে দোষ চাপিয়ে দিল স্বর্ণের উপর। বলল, এ স্বর্ণর কুদৃষ্টির ফল। প্রখর গ্রীষ্মে যখন কেউ বিস্তীর্ণ, রুক্ষ ‘ছাতিফাটার মাঠ’ পার হতে গিয়ে সর্দিগর্মির কবলে পড়ল অথবা তৃষ্ণায় নেতিয়ে পড়ল, সে দোষ দিল স্বর্ণের নামে। সে ডাইনী, তাই পথিকের শরীর থেকে সবটুকু রস শুষে নিয়েছে। ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে জখম হলে তারা বলল, স্বর্ণ বান মেরেছে।

মানুষের কাছে একটার পর একটা নিষ্ঠুর আঘাত পেতে পেতে একটি অতি সাধারণ মেয়ের ক্রমশ ডাইনীতে রূপান্তরের ঘটনা তারাশঙ্কর এঁকেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়। কোথাও কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেননি, দিয়েছেন কেবল আভাস আর ইঙ্গিত। ঘটনার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা আভাসগুলিই শেষপর্যন্ত ফুটিয়ে তুলেছে একটি সামগ্রিক, পরিপূর্ণ এবং অপূর্ব রেখাচিত্র।

আরো পড়ুন গোঁড়া গোরার গোড়ার কথা

‘ডাইনী’ শিরোনামে মৌচাকে প্রকাশিত শেষ গল্পটিকে ‘ডাইনীর বাঁশী’ গল্পের উৎস বলা চলে। গল্পটি ছোটদের জন্য সহজ চলিত ভাষায় লেখা। পরে গল্পটি তারাশঙ্কর বীথিকা গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই গল্পে তারাশঙ্করের শৈশব স্মৃতি বর্ণিত হয়েছে। যা হুবহু মিলে যায় আমার কালের কথা গ্রন্থে উল্লিখিত বিবরণে। “আমার অনেক বয়স পর্যন্ত স্বর্ণ বেঁচে ছিল। আমরা স্বর্ণপিসী বলতাম। বেচারী গ্রামের ভদ্রপল্লী থেকে দূরে – জেলেপাড়ার মোড়ে একখানি ঘর বেঁধে বাস করত। সে পথে যেতে-আসতে দেখেছি, বুড়ি ঘরের মধ্যে আধো-আলোর মধ্যে বসে আছে। চুপ করে বসে আছে। কথা বড় কারও সঙ্গে বলত না। কেউ বললেও তাড়াতাড়ি দুএকটা জবাব দিয়ে ঘরে ঢুকে যেত। তার শেষকালটায় আমি বুঝেছিলাম তার বেদনা। মর্মান্তিক বেদনা ছিল তার। নিজেরও তার বিশ্বাস ছিল, সে ডাইনী। কাউকে স্নেহ করে সে মনে মনে শিউরে উঠত। কাউকে দেখে চোখে ভাল লাগলে সে সভয়ে চোখ বন্ধ করত…’

এই গল্পের শেষে ফুটে উঠেছে ‘ডাইনী’ অপবাদে কলঙ্কিত নারীর প্রতি তারাশঙ্করের সহানুভূতি। “আজ সেকালের পরিবর্তন হয়েছে। ডাইনীতে বিশ্বাস ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে আসছে। ডাইনীও আজ আর নাই বললেই হয়। অশিক্ষার গাঢ় অন্ধকারে যারা আজও ডুবে আছে তাদের মধ্যে হয়ত আছে। সেকালের ডাইনীর বিচিত্র গল্পও আজ লোকে ভুলে আসছে। এই গল্পগুলির মধ্যে শুধু অন্ধবিশ্বাসই তো নাই – আছে কত মানুষের মর্মান্তিক বেদনা। সারাটা জীবন তারা এই অপবাদের গ্লানি বহন করে চলত। নিজেরাও বিশ্বাস করে নিত এই অপবাদকে সত্যি বলে, আর ভগবানকে ডাকত স্বর্ণের মতো – আমার এ লজ্জার বোঝা নামিয়ে দাও প্রভু। এ ভয়ঙ্কর জীবনের অবসান কর। চোখের জল মুছে ফেলত কাপড়ের আঁচলে, মাটিতে কোনক্রমে এক ফোঁটা ঝরে পড়লে শিউরে উঠত, মা বসুমতীর বুক যে জ্বলে উঠবে।”

তথ্যসূত্র

১। আমার সাহিত্য জীবন, প্রথম পর্ব; পৃষ্ঠা ৮৭
২। আমার সাহিত্য জীবন, প্রথম পর্ব; পৃষ্ঠা ১২৪
৩। আমার কালের কথা, রচনাবলী, খণ্ড ১০; পৃষ্ঠা ৩৮৬
৪। ডাইনী, তারাশঙ্করের গল্পগুচ্ছ, তৃতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ১২৪

নিবন্ধকারের জন্ম ও স্কুলজীবন বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তারপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি নিয়ে পড়াশুনো। সেখান থেকেই পিএইচডি করে কলেজে শিক্ষকতা। লেখালিখি করেন ভালোবাসা থেকে। ফিকশন ও নন-ফিকশন। বীরভূমের বাস্তবতা কীভাবে তারাশঙ্করের রচনায় ধরা পড়েছে তাই নিয়ে গত কয়েকবছর ধরে অনুসন্ধান ও লেখালিখি করে চলেছেন।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.