জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। সালটা ছিল ১৯৯৬, যখন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পুরোদমে কর্মরত। আমাদের পৃথিবী থেকে বিলিয়ন মাইল দূরে ছায়াপথগুলি দেখে আমাদের মহাজাগতিক ইতিহাস এবং মহাবিশ্বের উৎস অন্বেষণ করার উপায় হিসাবে নাসা সেই সময়ে এই অত্যাধুনিক প্রজন্মের JWST তৈরি করার প্রস্তাব দেয়। একে প্রকৃতপক্ষে হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল পৃথিবীর কক্ষপথে কাজ শুরু করে। চলুন, JWST-র এই জয়যাত্রার সঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করা যাক।

james webb telescope
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। ছবি: নাসা

আমাদের কাছে রীতিমত বিস্ময়কর হিসাবে ধরা দিয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের রেকর্ড করা মহাবিশ্বের সর্বশেষ চিত্রটি। পিছন ফিরে তাকালে ভাবতে অবাক লাগে, যে বনে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো সেই আদিম গুহাবাসী মানুষ, একটু একটু করে বুদ্ধির অস্ত্রে শান দিয়ে আজ কোথায় পৌঁছে গিয়েছে। বিজ্ঞানের নিয়মতান্ত্রিক পথেই তা সম্ভব হয়েছে। আসলে অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার এবং অদেখাকে দেখার ইচ্ছে আমাদের সকলের মধ্যেই কমবেশি বর্তমান। আর হবে না-ই বা কেন? আমার আপনার শরীরে যে কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), নাইট্রোজেন (N), লোহা (Fe) ইত্যাদি মৌল আছে সেগুলো তৈরি হয়েছিল কোনো না কোনো তারার মৃত্যুজনিত বিস্ফোরণের পর। “আমরা নক্ষত্রের সন্তান” – জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের এই বিখ্যাত উক্তিই যেন আমাদের এই অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

স্কুল বা কলেজ জীবনে মোমবাতির শিখার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়ার পাকামিই হোক বা শীতের রাত্রে কোথাও আগুন পোহানো, এটা পরিষ্কার যে আগুনের পাশে বা উপরে হাত রাখলেই আমরা উষ্ণতা অনুভব করি, যদিও সরাসরি আগুনের সাথে কোনো সংযোগ হয় না। এর মূলে আছে অবলোহিত বিকিরণ (infrared radiation), যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। কোনো বস্তু যত উষ্ণ হবে, তত বেশি ইনফ্রারেড/অবলোহিত বিকিরণ হবে।

আমরা অনেকেই হয়ত জানি, সূর্যের আলো পৃথিবীর উপর এসে পড়লে তার মধ্যে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত আলো বায়ুমণ্ডলের গ্রীনহাউজ গ্যাসে (যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি) আটকে গিয়ে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে তোলে। কিন্তু মজার কথা, এসব দৃশ্যমান নয়, অর্থাৎ আমাদের মধ্যে দেখার অনুভূতি তৈরি করে না (আমরা দৃশ্যমান বর্ণালীতে যে রঙগুলি দেখি, ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো যেহেতু তার চেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন, তাই এটি আমাদের চোখের ফটোরিসেপ্টরগুলিকে সক্রিয় করতে পারে না)। JWST-র কাজ মূলত এই অবলোহিত আলোকরশ্মিকে ঘিরেই। অবলোহিত আলোকরশ্মির নানা দিক পর্যালোচনা করে যে বস্তু থেকে এটি আসছে তার অনেক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ধারণা করা সম্ভব। আর সে কাজই করতে শুরু করেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।

একটা প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনার মনে জেগেছে, যে এই টেলিস্কোপ যখন এত দূরের ছবিই তুলতে পারছে, তাহলে সেটা ভূপৃষ্ঠ থেকেই করা গেল না কেন? পৃথিবীর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন? ভূপৃষ্ঠ থেকেই ছবি তোলা গেলে তো কিছুটা খরচ কমানো যেত বা কক্ষপথে স্থাপনের জটিল গণনা কিছুটা কমানো যেত। একটু আগেই বলেছি, অবলোহিত আলো বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে এসে তার কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্পে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই JWST পৃথিবীতে নয়, বরং পৃথিবীর বাইরে, যেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড আর জলীয় বাষ্প নেই, সেখানে রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ মূলত দৃশ্যমান বর্ণালী বা visible light spectrum দেখে আসছে (মূলত বলা হল, কারণ স্বল্প পরিমাণ অবলোহিত ও অতিবেগুনী রশ্মিও হাবল দেখতে পায়)। তাকে মহাকাশে রাখার কারণ, ভূপৃষ্ঠ থেকে টেলিস্কোপগুলিকে বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে দেখতে হয়। বায়ুমণ্ডল দৃশ্যমান বর্ণালীর বাইরে বিভিন্ন ধরণের আলো শোষণ করে থাকে, এই কারণেই অনেক স্পেস টেলিস্কোপ মিশন মাটিতে না থেকে মহাকাশ থেকে করা হয়। তবে টেলিস্কোপকে মহাকাশে স্থাপন করার ক্ষেত্রেও সেখানকার পরিবেশ অনুযায়ী যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

এরপর অবধারিত প্রশ্ন হল, অবলোহিত আলোকরশ্মি ধরার কাজটাই বা করতে হল কেন? যেখানে হাবল টেলিস্কোপ দৃশ্যমান আলোর সাহায্যে ছবি নিয়ে থাকে, সেখানে অবলোহিত আলোকের বাড়তি সুবিধা কী?

এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের যা বুঝতে হবে, তা হল প্রতিটি বস্তুকে আমরা দেখি কীভাবে? কোনো বস্তুর উপর আলো পড়লে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়ে, তখন আমরা সেই বস্তুটি দেখতে পাই। আর বস্তুর রং নির্ভর করে তার উপর কোন রংয়ের আলো পড়ছে এবং শোষিত হচ্ছে তার উপর। তাই অন্ধকারে আমরা খালি চোখে কিছুই দেখতে পাই না। কিন্তু এমন ক্যামেরা বা চশমা সম্পর্কে আমরা অনেকেই নিশ্চয়ই জানি, যা রাতের অন্ধকারেও ছবি তুলতে পারে। তা কীভাবে সম্ভব হয়? এই অবলোহিত আলো ব্যবহার করেই তা ঘটে। আসলে প্রতিটি বস্তুরই কিছুটা উষ্ণতা রয়েছে (আমরা মোটামুটি বলতে পারি কোনো বস্তুর উষ্ণতা সর্বনিম্ন -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে)। আর আগেই আলোচনা করা হয়েছে, যে কোনো উষ্ণ বস্তু থেকে নির্গত হয় অবলোহিত আলোক তরঙ্গ, যা বিশ্লেষণ করে ওই বস্তুটি সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি। হলিউডের বিখ্যাত প্রিডেটর ছবিটি মনে করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

যাই হোক, অবলোহিত আলোর এই বিশেষত্ব JWST-তে ব্যবহার করার পিছনেও কারণ আছে। আমরা ছোটবেলায় বিজ্ঞানে ডপলার এফেক্ট সম্পর্কে পড়েছি। একবার ঝালিয়ে নিতে সেই চেনা উদাহরণ মনে করা যাক। একজন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে শুনতে পাচ্ছে দূর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে আসছে। অ্যাম্বুলেন্স যত কাছে আসতে থাকল ততই তার শব্দের তীব্রতা বাড়তে থাকল এবং তাকে পার করে যখন চলে গেল, ধীরে ধীরে সাইরেনের তীব্রতাও কমে গেল। এই ঘটনাটিকেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ডপলার এফেক্ট। এখানে আসলে শব্দতরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হ্রাস, বৃদ্ধি ঘটছে। শব্দ যখন ব্যক্তিটির কাছে আসছিল তখন তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হচ্ছিল আর তীব্রতা বাড়ছিল। যখন তাকে পেরিয়ে চলে গেল তখন তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় শব্দের তীব্রতা কমছিল। অর্থাৎ আমাদের থেকে যা যত দূরে অবস্থিত তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত বেশি।

ঠিক একই ঘটনা ঘটে মহাজাগতিক বস্তুর ক্ষেত্রে। আমরা অনেকেই জানি, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, অর্থাৎ সবকিছু খুব ধীরগতিতে হলেও ক্রমাগত একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই জন্য যে বস্তু টেলিস্কোপ থেকে যত দূরে অবস্থিত সেই বস্তু থেকে নির্গত অবলোহিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত বেশি। সুতরাং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিশ্লেষণ কোনো বস্তু থেকে আমাদের দূরত্ব মাপতে সাহায্য করে।

তবে এই অবলোহিত আলো ব্যবহারের আরেকটি কারণ রয়েছে। আমরা জানি মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুতে গ্যাস এবং প্রচুর ধূলিকণা রয়েছে, যার দরুন দৃশ্যমান আলো অনেকসময়েই বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ফলে অনেক দূরের এবং সুদূর অতীতের তারাদের সম্পর্কে ঠিকঠাক তথ্য পাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু অবলোহিত আলো এই গ্যাস ও ধুলোর বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম।

অতীত দেখার কথা যখন বলাই হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই অতীত দেখা মানে কী? বোঝার সুবিধার জন্য কিছু উদাহরণ নেওয়া যাক।

১) ক্রিকেট বা বেসবল মাঠে গিয়ে খেলা দেখার সময়ে একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছি আমরা। ব্যাট বলকে আঘাত করতে দেখার কিছুক্ষণ পরে আমরা সেই আওয়াজ শুনতে পাই। বা বিদ্যুৎ চমকাতে আমরা আগে দেখি, তার একটু পরে শুনতে পাই মেঘের ডাক। কিন্তু কেন? কারণটি খুব সহজ। শব্দের উৎস থেকে আমাদের কাছে শব্দ এসে পৌঁছতে কিছুটা সময় লাগে। সেইজন্য আমরা খানিকক্ষণ পরে শব্দটি শুনি। কিন্তু শুধু শব্দ নয়, আলোর ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটে। আলোর উৎস থেকে আলো আসতেও সময়ের প্রয়োজন হয়। কতদূর থেকে আসছে, তার উপর নির্ভর করে কত সময় লাগবে। অর্থাৎ যত দূর থেকে আসবে, আলো এসে পৌঁছতে তত বেশি সময় লাগবে। যেমন চাঁদ থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে যত সময় লাগে (১.৩৩ সেকেন্ড), সূর্যের থেকে আলো আসতে তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে (আট মিনিটের মত)। কেন না আমাদের কারো অজানা নয়, যে পৃথিবী থেকে সূর্য, চাঁদের তুলনায় অনেক অনেক দূরে অবস্থিত। আলোর যাত্রার এই ধর্ম দিয়ে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ বুঝতে এবার অন্য একটি উদাহরণে আসা যাক।

২) মনে করা যাক, অন্ধকারে খ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ব্যক্তির সামনে ৩০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে ক স্থানে একটি বিস্ফোরণ ঘটল। খ স্থানের লোকটির পিছনে ৯০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে গ স্থানে আরেকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমরা জানি, আলোর বেগ সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। তাহলে, খ স্থানে থাকা লোকটি বিস্ফোরণের ১০ সেকেন্ড পরে ঘটনাটি দেখতে পাবে এবং গ স্থানের লোকটি ৪০ সেকেন্ড পর দেখবে (কারণ ক এবং গ স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১২০ লক্ষ কিলোমিটার)।

এই ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে:

ঘটনাটি যখন ঘটছে তখন ক স্থানে বর্তমান কাল এবং তা খ স্থান থেকে ১০ সেকেন্ড (ভবিষ্যৎ) ও গ স্থান থেকে ৪০ সেকেন্ড পরে (খ স্থানের সাপেক্ষে আরও ৩০ সেকেন্ড ভবিষ্যৎ) দেখা যাবে। অর্থাৎ যখন খ স্থানের লোকটি ঘটনাটি দেখতে পাবে, তখন ক স্থানে ঘটনাটি ১০ সেকেন্ড অতীত হয়ে গেছে এবং গ স্থানের লোকটি তখনো ঘটনাটি দেখতে পায়নি, ভবিষ্যতে (আরও ৩০ সেকেন্ড পরে) দেখতে পাবে। সবশেষে গ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যখন ঘটনাটি দেখবে, তখন ঘটনাটি ক স্থানে ৪০ সেকেন্ড এবং খ স্থানের লোকটির কাছে ৩০ সেকেন্ড অতীত হয়ে গেছে।

আচ্ছা, এবার আসা যাক সূর্যের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত কোনো বস্তুর কথায়। ধরা যাক সেই বস্তু থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লাগবে আট মিনিটের অনেক বেশি। এক ঘন্টা বা এক মাস বা এক বছর কিম্বা তারও বেশি। পৃথিবীর চেয়ে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত হলে ১০০ বছর, ৫০০ বছর, ১০০০ বছর, ১০০০০ বছর, ১ কোটি বছরও লাগতে পারে। তার মানে এখন যদি কোনো আলো আমরা দেখি, যা ১৩০০ কোটি বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল, তাহলে সেই আলো ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো। অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির কাছাকাছি সময়ের সেই আলোকে আজ আমরা ধরতে পারছি। আর সেই আলো ধরে যে ছবি তুলছি, তা তো ওই ১৩০০ কোটি বছর আগেরই ছবি। ঠিক যেমন যে সূর্যকে আমরা এখন দেখছি, তা আদতে আট মিনিট আগের সূর্যের ছবি (সূর্যের যে আলো আমরা এখন দেখছি তা আট মিনিট আগের)। তবে আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, JWST-র ক্ষেত্রে এই আলো দৃশ্যমান (visible light) নয়, আসলে অবলোহিত আলো (Infrared Ray)।

সূর্য বাদে আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আবিষ্কৃত (বলা ভালো পর্যবেক্ষিত) নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরি আমাদের থেকে প্রায় ৪.৩ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ ওখান থেকে আমাদের কাছে তিন লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড বেগেও আলো এসে পৌঁছতে সময় লাগবে ৪.৩ বছর।

এবার আসা যাক আলোকবর্ষের ব্যাপারে। এটি আসলে সময়ের নয়, বরং দূরত্বের একক। আলো এক বছরে যতটা পথ অতিক্রম করে, তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। ছবি তোলা অথবা দেখার সময়ে সামনে থাকা বস্তুটির আলো চট করে আপনার, আমার চোখে বা ক্যামেরার লেন্সে এসে পড়ে বলে বিষয়টা আমরা ঠাহর করতে পারি না। কিন্তু এই আলোই যদি অনেক দূর থেকে আসত, তাহলে আলোর উৎস থেকে আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে সময়ের তফাত হতে। এক আলোকবর্ষ দূরে থাকা বস্তু থেকে আলো আসতে এক বছর সময় লাগবে।

ধরুন, আমাদের থেকে এক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি নক্ষত্র বিস্ফোরিত হল। তাহলে সেই আলোকচ্ছটা আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে এক বছর সময় নেবে। মজা হল, আমরা যখন এক বছর পরে ওই বিস্ফোরণের চিত্র দেখব, ততদিনে কিন্তু ওখানে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। সেখানে আজকের এই সময়ে কী ঘটছে, তা জানতে হলে আমাদের আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ যেন এক টাইম মেশিন। এক বছর আগের জিনিস আমরা এক বছর পরে দেখছি। ঠিক পূর্বে উল্লিখিত আট মিনিট আগের (বা অতীতের) সূর্যকে দেখার মতই।

সেগান বলেছিলেন, কোথাও না কোথাও অবিশ্বাস্য কিছু অপেক্ষা করে আছে আবিষ্কারের জন্য। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবিগুলি আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। চলে আসা যাক, ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের গ্যালাক্সি ক্লাস্টার SMACS 0723-এর ছবির প্রসঙ্গে (যা জেমস ওয়েব তুলেছে)। এই ক্লাস্টারটি ৪.৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ফলে যে ছবি তোলা হয়েছে, তা আসলে ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের একটি দৃশ্য। একটি স্ন্যাপশট, একটি মুহূর্ত বলা যায়। আজ ওখানে কী হচ্ছে তা দেখতে আমাদের আরও ৪.৬ বিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হবে।

এর সূত্র ধরে বলে রাখা ভাল, উৎসাহী পাঠকদের জন্য আগে যেমন বলা হয়েছে, আমরা অনেকেই জানি যে মহাবিশ্ব প্রতি মুহূর্তে সম্প্রসারিত হচ্ছে, আর এর নির্দিষ্ট মাত্রাও (rate) আছে। তাহলে এই সম্প্রসারণের ফলস্বরূপ দূরের গ্যালাক্সির সাথে আমাদের দূরত্বও স্থির থাকছে না। এক্ষেত্রে কসমোলজিতে ‘কোমুভিং’ এবং ‘প্রপার ডিস্ট্যান্স’ নামক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর/টার্ম রয়েছে, যা ক্রমশ বদলায়। মূলত এই দূরত্ব কোনো এক মুহূর্তে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যের দূরত্বকে বোঝায়। উক্ত ক্লাস্টারের সাথে আমাদের বর্তমানে প্রপার ডিস্ট্যান্স দাঁড়িয়েছে ৫.১২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ।

এবার বলি, কেমনভাবে কাজ করে এই টেলিস্কোপ। তাকে দেখতেই বা কেমন (অবশ্য এর ছবি হয়ত আমরা অনেকেই ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি)?

আঠারোটি ষড়ভূজাকৃতি আয়না-অংশ (mirror segment) নিয়ে তৈরী JWST-র মূল আয়নাটি (Primary Mirror) হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে প্রায় তিনগুণ প্রশস্ত এবং এর ফলে প্রায় ন গুণ বেশি ক্ষীণ বস্তু দেখতে সক্ষম।

হাবল স্পেস টেলিস্কোপের ওই ২.৪ মিটারের আয়নাটিকেই যদি JWST-র জন্য বড় করে তৈরি করা হত একইভাবে, তবে তা কক্ষপথে উৎক্ষেপণের জন্য খুব ভারি হয়ে যেত, হয়তো উৎক্ষেপন আদৌ সম্ভব হত না। JWST টিমকে আয়নাটি অনেক হালকাভাবে তৈরি করার উপায় খুঁজে বের করতে হয়েছে। অংকের হিসাবে এই আয়না প্রতি ইউনিট এলাকায় হাবলের আয়নার ভরের মাত্র এক-দশমাংশ কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী হতে হত। শেষ অব্দি তাঁরা বেরিলিয়াম দিয়ে আয়নার অংশগুলি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন, যা শক্তিশালী এবং হালকা — দুটি প্রয়োজনই পূর্ণ করে। প্রতিটি অংশের ওজন হয় প্রায় ২০ কিলোগ্রাম (৪৬ পাউন্ড)।

jwt mirror
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের আয়নার বিশ্লেষণ। ছবি: নাসা

এই মূল আয়না দিয়েই প্রধানত অবলোহিত আলোকে প্রতিফলিত করা হয় অন্য এক আয়নায় (Secondary Mirror), যা থেকে আবার কয়েক ধাপ পেরিয়ে আলো পুনর্নির্দেশিত হয়ে পড়ে সেন্সর ক্যামেরাতে। মূল যন্ত্রাংশের বিভিন্ন কার্যক্রম শেষে যা পাওয়া যায় তা হল বর্ণালী রেখা (Spectrum Line), যা আসলে এক সংকীর্ণ ফ্রিকোয়েন্সি পরিসরে আলোর নির্গমন বা শোষণের ফলে সৃষ্ট অবিচ্ছিন্ন (uniform and continuous) বর্ণালীতে অবস্থিত গাঢ় অন্ধকার বা উজ্জ্বল রেখাসমূহ; আর এই Spectrum Line বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, উক্ত আলো যে বস্তু থেকে এসেছে তার নানা বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ রং, উষ্ণতা, কেমন বা কী কী মৌল বা যৌগ দিয়ে তৈরি ইত্যাদি।

তবে এইসব কাজ করতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এমন হতে হবে, যেন অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি থাকা অন্য কোনো বস্তু থেকে অবলোহিত আলো এসে না পড়ে। টেলিস্কোপটির নিজেস্ব তাপমাত্রাও সেক্ষেত্রে বিচার্য বিষয়। এইজন্য সূর্যের আলো প্রতিরোধের বিশেষ ব্যবস্থা এবং টেলিস্কোপটি নিজেও যেন অনেক ঠান্ডা থাকে তেমন ব্যবস্থা করা হয়েছে।

JWST-র রেকর্ড করা ছবির বিশ্লেষণকারী দলের (image analysis team) প্রধান নাতালি ক্যাব্রলের বক্তব্য দিয়ে শেষ করি “…You think the large ones are awesome? Look again… There is hardly a mm of that pix that’s not covered by a dot. We are on for a wild ride! Welcome to the new universe!”

আরো পড়ুন মিমির পাইথন আর কেমব্রিজের আমি

অর্থাৎ “আপনি যদি মনে করেন ছবির উজ্জ্বল বড় বড় বিন্দুগুলোই শুধু দারুণ, তাহলে আরেকবার ভাল করে দেখুন। ছবিতে এমন এক মিলিমিটার (আসল স্কেলে) জায়গাও নেই যেখানে কোনো অনুজ্জ্বল ছোট বিন্দু নেই। আমরা এক মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া যাত্রা শুরু করেছি। এই নতুন মহাবিশ্বে আপনাকে স্বাগত।”

তথ্যসূত্র:

১) https://webb.nasa.gov/content/observatory/ote/mirrors/index.html

২) space

৩) https://graphics.reuters.com/SPACE-EXPLORATION/TELESCOPE/klvyknwbrvg/

৪) https://www.wired.com/…/the-physics-of-the-james…/amp

৫ ) jwst_first_image

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.