প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহিকে ফের ছ বছরের জন্য কারারুদ্ধ করা হল। ২০১০ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে পানাহির পিছনে লেগে আছে ইরান সরকার। এবারের গ্রেপ্তারের পর তাঁর স্ত্রী তহেরে সঈদি বলেছেন, কোনো শমন ছাড়া এই গ্রেপ্তার একরকম অপহরণ। যদিও আদালত বলেছে, আগে একাধিকবার পানাহিকে গ্রেপ্তার করা হলেও, কোনওবারই তিনি গ্রেপ্তারের মেয়াদ পূরণ করেননি, এবার মেয়াদ পূর্ণ করতেই হবে। যুক্তিটা শুনলে মনে হয় চোর-পুলিস খেলা চলছে। পানাহি আজকের দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী, তাঁর সঙ্গে এই স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে শুধু কান চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ নয়, সারা বিশ্বের সিনেমা দর্শকরা সোচ্চার হয়েছেন।
অবশ্য ইরানে এমন ঘটনা প্রথম ঘটল বা একমাত্র পানাহিকেই বারবার রাষ্ট্রের কোপে পড়তে হচ্ছে তা অবশ্য নয়। ইরানের আরও এক ঝাঁক শিল্পীর এই অবস্থা। বস্তুত, ১২ জুলাই পানাহিকে আটক করা হয় তখন, যখন তিনি কয়েকদিন আগে গ্রেপ্তার হওয়া দুই চলচ্চিত্র পরিচালক মহম্মদ রসুলফ আর মোস্তাফা আল আহমেদের খবর নিতে গিয়েছিলেন। এই শিল্পীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা “propaganda against the establishment”, অর্থাৎ ক্ষমতার বা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রচার চালান। ইরানে এটা গুরুতর অপরাধ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
মনে পড়ছে, আগেরবার যখন পানাহিকে গৃহবন্দি করে চিত্রনাট্য লেখার উপরেও কুড়ি বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক সেমিনারে নবারুণ ভট্টাচার্যকে আমন্ত্রণ জানান। নবারুণ সেই সভায় বলেছিলেন, খুন নানা ভাবে করা যায়। আন্তোনিও গ্রামশির জেলে বসে প্রিজন নোটবুক লেখার কথাও বলেছিলেন তিনি। পানাহিও সেবার বাড়িতে আটক থেকেও ফোনে দিস ইস নট আ ফিল্ম ছবিটা তৈরি করে পেন ড্রাইভে সেভ করে কেকের মধ্যে ভরে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তা থেকে সারা পৃথিবী জানতে পারে কী অত্যাচার চলছে তাঁর উপর। এবারেও কান অবিলম্বে তাঁর মুক্তি দাবি করেছে। তাঁর মুক্তির দাবিতে সরব সারা দুনিয়ার সমস্ত মুক্তিকামী চলচ্চিত্র তথা শিল্পমহল।
নবারুণ সেই সভায় ঋত্বিক ঘটকের স্মরণসভার উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাঁর বাবা বিজন ভট্টাচার্য সেই সভায় বলেছিলেন, ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে। এবং এই খুন নানাভাবে করা যায়। বিজনবাবু তারপর কান্নায় ভেঙে পড়েন বলে জানিয়েছিলেন সেদিনকার আরেক বক্তা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। পানাহির গ্রেপ্তারির কথা শুনে সেসব মনে না পড়ে উপায় নেই।
বাকস্বাধীনতার পক্ষে এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়। আমাদের দেশেও নির্দিষ্ট ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার জন্য বিপদে পড়ছেন বহু মানুষ। কদিন আগেই ফিল্মের পোস্টারে কালীর বেশধারী অভিনেত্রীকে ধূমপানরত অবস্থায় দেখানোর জন্য এফআইআর হল পরিচালক লীনা মণিমেকলাইয়ের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক মহম্মদ জুবেরকে তো এমন কৌশলে একের পর এক অভিযোগ দায়ের করে আটক রাখা হয়েছে, যে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তার কিছুদিন আগে আমাদের রাজ্যের একাধিক জায়গায় ফেসবুক লাইভে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের দায়ে এফআইআর দায়ের হল রোদ্দুর রায়ের নামে, তারপর এ রাজ্যের পুলিস তাঁকে গ্রেপ্তার করে আনল সুদূর গোয়া থেকে। বেশ কিছুদিন হাজতবাস করে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। এই আবহেই এল পানাহির গ্রেপ্তারির খবর।
আরো পড়ুন ঋত্বিক কুমার ঘটক, তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো
গোটা দুনিয়াটাই এখন দখলদারদের হাতে। কিন্তু এমনটা কয়েক বছর আগেও ছিল না। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে কথা হত নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি যখন এডওয়ার্ড স্নোডেন আমেরিকার খবরদারি ফাঁস করে দেওয়ায় খুশি হয়েছিলেন, তখন স্নোডেনকে নিয়ে কলকাতায় খুব বেশি লোক ভাবত না। কলকাতায় না হোক, এখনো পৃথিবীতে ব্যাঙ্কসি, স্ল্যাভয় জিজেক, নোয়ম চমস্কিদের মত কিছু প্রতিবাদী আছেন। কিন্তু সে প্রতিবাদই বা কদিন টিকবে দুনিয়া জোড়া সুবিধাবাদের ঝড়ে?
পানাহির বাড়ির সামনে জ্বলে ওঠা সেই আগুনের ছবি মনে পড়ে, যা তাঁকে বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করার বার্তা দিতে জ্বালানো হয়েছিল। হয়ত কিছুদিন হেনস্থা করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে এবারেও। অথবা কারাগারেই পচে মরবেন পানাহি। কিন্তু সাদা বেলুন বা ট্যাক্সি ড্রাইভারের গল্প থেকে যাবে। কে বলতে পারে, পানাহি হয়ত আবার জেলখানায় বসেই আরও একটা ছবি বানাবেন। নাম হবে, দিস ইজ নট আ ফিল্ম: পার্ট টু।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।