সে যুগে যখন দৃশ্য ছিল না, আকাশবাণী মারফত আমরা ক্রিকেটের রিলে শুনতাম। তখন ধারাভাষ্যকার কমল ভট্টাচার্যের একটি প্রিয় বাক্য ছিল “নয় নয় করতে করতে বোরদে নব্বই রান করে ফেলেছেন।” সেভাবে বাংলা উপন্যাসের বয়সও নেহাত কম হল না। অন্য আখ্যান বা কিস্তিবন্দি বর্ণনা জাতীয় লেখার কথা বাদ দিয়ে যদি উপন্যাস বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি তার কথা ভাবি, তাহলেও দেখব বাংলা উপন্যাস দেড়শো বছর পার করে দিয়েছে। কারণ আমাদের প্রথম উপন্যাস বলতে ধরা হয়, আগামীকাল যাঁর জন্মদিন, সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসকে। আজ যদি বাংলা উপন্যাসের কথা ভাবতে বসি, তাহলে দেখব সংখ্যায় সে কাচ্চাবাচ্চাসহ পৃথুলা গৃহিণীর মত। বস্তুত এত লেখা হচ্ছে, যে অনেকসময় আমার বইমেলা-ফেরত বাঙালিকে দেখে চিন্তা হয়। তারা প্রায় সকলেই তো খুব বেশি হলে ১,৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানে এলইডি টিভি, ওয়াশিং মেশিন এবং ফ্রিজ বাদ দিলে তার ঘরে কতটুকু জায়গা, যে সে বই সাজাবে? ওর মধ্যেই আবার তাকে ছবি সাজাতে হয়, কম্পিউটার টেবিল রাখতে হয় এবং আরও নানা জিনিস নিয়ে আপডেটেড থাকতে হয়। ফলে এত বই কে লেখে, কোথায় যায়, কী তার ব্যবহার – সে বিষয়ে আমার ধাঁধা ফুরনোর নয়।
বই থেকে আলোচনাটা নির্দিষ্ট করে বাংলা উপন্যাসে নিয়ে এলে তো আরও চমৎকার। বঙ্কিমবাবুর উপন্যাসের ভিত্তি ছিল “এ জীবন লইয়া কী করিব? কী করিতে হয়?” আজ বাংলা উপন্যাস সেই যুগ, সেই প্রশ্ন থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। এখন তা বড়জোর শ্রুতিকথা। অর্থাৎ হাতে যদি কিছু অবসর থাকে, তাহলে অন্যের লেখা গল্প শোনা যায়। কিন্তু সেই গল্পের কোনো সাহিত্যিক/দার্শনিক অস্তিত্ব আছে কিনা, কেউ তা পড়ে কিনা – সেসব গৌণ হয়ে গেছে। গতবছরই যেমন দেখলাম, পত্রিকাগুলির শারদ সংখ্যা প্রকাশের এক সপ্তাহ বা দশদিন পরেই সমস্ত সংখ্যা বিনামূল্যে লোকের কম্পিউটারে বা মোবাইলে এসে গেছে। কেউ পড়তে চাইলে পড়তে পারে, আবার না পড়তে চাইলে সমূলে উৎপাটন করতেও পারে। কিন্তু তাতে পত্রিকা প্রকাশকের কিছু এসে যায় না। তাহলে এই মোটা মোটা পত্রিকায় উপন্যাসগুলি প্রকাশ করা হয়েছিল কেন? কারণটা প্রায় পুরোপুরি বাণিজ্যিক। অর্থাৎ পুজোর মরসুমে সর্বভারতীয় কোম্পানিগুলি বেশকিছু টাকা বিজ্ঞাপন খাতে খরচ করে, সেই টাকা নিজেদের ট্যাঁকে টেনে আনতেই এই পত্রিকাগুলি প্রকাশ করা। লেখক, প্রকাশক বা সম্পাদক – কেউই হয়ত আশা করেন না যে ওইসব লেখা আদৌ পড়া হবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
অথচ একটা সময়ে বাংলা উপন্যাস প্রবল আলোচনার বিষয় ছিল। নেহাত আদ্যিকালের কথা নয়। মৃণাল সেনের শতবর্ষ চলছে। তাঁরই ইন্টারভিউ ছবিতে ইন্টারভিউয়ের দৃশ্যেই সংলাপ ছিল “বিবর পড়েছেন? বাই সমরেশ বোস?” আসলে গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি বিবর বাঙালি সমাজে রীতিমত আলোচ্য ছিল। আমরা বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখে পড়েছি, কারণ আমরা তখন স্কুলে এবং বাঙালি তখনো এতটা উত্তরাধুনিক হয়ে ওঠেনি যে বাপ-কাকারা ছেলেমেয়েদের পুজোর ছুটির সময়ে বিবর পড়তে দেবেন। কিন্তু বড়রা প্রায় সকলেই পড়েছেন। মনে আছে, আমাদের যখন সবে গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ একবার শারদ পত্রিকায় প্রকাশিত হল। সে উপন্যাস পড়ে আমাদের অনেকদিন বুক চিনচিন করেছিল রাসবিহারীর মোড়ে দাঁড়িয়ে। মনে হত, যমুনা আমাদেরই হাত ধরে স্বর্গে নিয়ে যাবে। এই মনে হওয়া কিন্তু সাহিত্যের মনে হওয়া নয়, সাহিত্য উপচে পড়ে মনে হওয়া। এমন শেষ কবে ঘটেছে কোনো বাংলা উপন্যাস নিয়ে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। অথচ এমনটা ঘটত এবং এখনো ঘটে। যেমন বছর কয়েক আগে দিল্লিতে এক সর্বভারতীয় আলোচনা চক্রে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে দেখেছিলাম, উত্তর ভারতের লেখকরা অনেকেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ঈর্ষা করেন। কেন না তিনি আজও বোম্বাই ঘরানার সিনেমার সবচেয়ে বড় মডেল। সোজা কথায়, শরৎচন্দ্রকে বাজার চায় এবং বাজার খায়। কতদিন আগেকার একজন লেখক! তিনি বড় লেখক হিসাবে আজকাল বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বও পান না। কিন্তু তাঁর ক্রাফটসম্যানশিপ, নৈপুণ্য এমন পর্যায়ের যে হিন্দি সিনেমার শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারও এই লেখকের একাধিক লেখাকে এদিক ওদিক করে চিত্রনাট্য উপস্থিত করেন। বস্তুত বিমল রায়, হৃষীকেশ মুখার্জি, গুলজার, সঞ্জয় লীলা বনশালী, প্রদীপ সরকার, অনুরাগ কাশ্যপ প্রমুখদের ধরলে শরৎচন্দ্র হিন্দি সিনেমার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘরানা হয়ে উঠেছেন। অথচ আমাদের লেখকরা সিনেমার ভাবী চিত্রনাট্য হিসাবেই লিখতে চান, বাক্যবিন্যাসও সেইরকম। শুধু সিনেমা হয়ে ওঠে না আর।
শরৎচন্দ্রকে বাদ দিয়ে যদি আমাদের আদি পিতা বঙ্কিমচন্দ্রের দিকে তাকাই, যদি চন্দ্রশেখর উপন্যাসের কথা ভাবি, তাহলে শৈবলিনীর ডিলিরিয়াম আমাকে স্তম্ভিত করে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তখন দিকচক্রবালে কোথাও নেই। কিন্তু একজন কাশ্যপগোত্রীয় বাঙালি ব্রাহ্মণ এক তরুণীর যৌন অবদমন কী অসামান্য দক্ষতায় চিত্রিত করেন! আবার তিনি যখন রোহিনীর কথা লেখেন (কৃষ্ণকান্তের উইল), রাজসিংহ লেখেন, তার যে ঐতিহাসিক মাপ তা দেখে হতবাক হয়ে যাই। বিষবৃক্ষে বাসনার যে দগ্ধাবশেষ ছড়িয়ে থাকে নগেন্দ্র দত্তের উদ্যানে তা ঈশ্বরেরও বিস্ময়। উপলব্ধি করি যে এ শুধু “বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় লুঠ করিয়া লইল” – এতেই সীমাবদ্ধ নয়। গল্পের স্তর ছাড়িয়ে দার্শনিক জিজ্ঞাসা কপালকুণ্ডলা বা অন্যান্য উপন্যাসে এমন পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, যে আমাদের উপন্যাস কেন আন্তর্জাতিক মানের বলে পরিগণিত হবে না এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে কেন ‘বাংলার স্কট’ হয়ে খুশি থাকতে হবে, তিনি ওয়াল্টার স্কটের চেয়ে অনেক বড় লেখক হওয়া সত্ত্বেও – তা আমার সঙ্গত প্রশ্ন বলেই মনে হয়।
বঙ্কিমবাবু উপন্যাসের মধ্যে যে অস্তিত্ব জিজ্ঞাসা এনেছেন তাতে কপালকুণ্ডলাকে নেহাত উইলিয়াম শেক্সপিয়রের দ্য টেম্পেস্ট নাটকের বঙ্গীয় সংস্করণ বলা চলে না। বঙ্কিম জীবনবোধের সন্ধান করেছেন উপন্যাসে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ, যাঁর সম্পর্কে প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে তিনি যতখানি কবি বা গীতিকার কিম্বা সুরকার, ততখানি ঔপন্যাসিক নন – তাঁর বিষয়েও আমরা বলতে পারি যে যখন তিনি উপন্যাসে গুরুতর মনোযোগ দেন তখন তা অন্য উচ্চতা পায়।
ধরা যাক যোগাযোগ উপন্যাসের কথা। এখানে বৈবাহিক ধর্ষণ এবং নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্পর্কে যে মন্তব্য আমরা পাই তা তো এক মৌল দৃষ্টিভঙ্গি। এই উপন্যাসের শেষে তিনি আপস রফা করেন ঠিকই এবং তাতে লেখাটির শিল্পগুণ হয়ত ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু আমি কথা বলছি তাঁর দুঃসাহস নিয়ে। যে সময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ওসব নিয়ে ভাবতে পেরেছেন তা চমৎকৃত করে। এই ভাবনার প্রক্রিয়া চতুরঙ্গ উপন্যাসেও খেয়াল করার মত। যদি দামিনী চরিত্রটাকে দেখি, গুহার সেই আদিম কেশদাম তবেই বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথের তিমিরযাত্রা কী মর্মান্তিক; বা যদি চার অধ্যায়-কে শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের সহিংস ধারাবিরোধী লেখা হিসাবে না ভাবি, তাহলে শেষ পাতায় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে মৃত্যু এবং যৌনতাকে দ্বৈরথে অবতীর্ণ করান তা থেকেই বুঝতে পারব যে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নেহাত কাহিনি নয়। নেহাত আখ্যান নয়। তাঁর হাতে এইসব আখ্যান এমন গভীরে শিকড় বিস্তার করেছে যা হয়ত তাঁর কাব্যে বা গানেও সম্ভব হয়নি।
এই একই কথা নানাভাবে শরৎবাবু সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তাঁকে আজকাল যতটা হেলাফেলা করা হয়, ততটা হেলাফেলার যোগ্য লেখক তিনি নন। হলে তাঁর উপন্যাসগুলো এতদিন টিকত না। চরিত্রহীন, শেষ প্রশ্ন, এমনকি শ্রীকান্ত – এসব লেখার কারিগরী অতুলনীয়। স্রেফ এই নৈপুণ্যের জন্যেই বাঙালি হিসাবে গর্ব হয় ভেবে যে তিনি আমার ভাষায় লিখেছেন।
আমরা যে বিখ্যাত তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলি, তাঁরা স্রেফ ভারে নয়, ধারেও মারাত্মক। ভাবতে অবাক লাগে না, যে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ১৯৩৬ সালে পুতুলনাচের ইতিকথা এবং তারও আগে দিবারাত্রির কাব্য লিখেছেন? নিষ্ঠুরতার যদি কোনো জ্যামিতি থাকে, তাহলে দ্বিতীয় উপন্যাসটির নায়ক হেরম্বই সেই জ্যামিতি। আনন্দের যে নৃত্য দিয়ে উপন্যাস শেষ হয়, তা কতখানি দুঃসাহস থাকলে একজন সবে কুড়ি পার হওয়া লেখক ভাবতে পারেন! আর পুতুলনাচের ইতিকথা? বিশ শতকের সবচেয়ে স্মরণীয় যে উপন্যাস বলে বিশ্ববাসী যেগুলোকে জানে, যেমন জেমস জয়েসের ইউলিসিস বা ফ্রানৎজ কাফকার দ্য ট্রায়াল; গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশো বছর; থমাস মান, হর্হে লুই বর্হেস বা কার্লোস ফুয়েন্তেসের যেসব লেখার কথা আমাদের মনে পড়ে, সেইসব লেখার পাশে মাণিকবাবুর ওই রচনা অনায়াসে দাঁড়াতে পারে। সগৌরবে আমরা বলতেই পারি, ফরিদপুর জেলার বাজিতপুরের গাওদিয়া গ্রামে যেদিন শশী ডাক্তার অবতরণ করে সেদিনই বাংলা উপন্যাসে নাগরিকতার সূচনা হয়। সে ডাক্তার রিউ বা সার্ত্রর নায়কদের সমগোত্রীয় কিনা সেটা প্রশ্ন নয়। কিন্তু সমগ্র প্রাচ্যে এত আধুনিক নায়ক অদ্যাবধি আর দেখা যায়নি।

চিহ্ন উপন্যাসের চিন্তামণির কথা, সেই উপন্যাসের ভাষার কথাও যদি ভাবি। অথবা পদ্মানদীর মাঝি-র “ইয়া আল্লা, নামানো আকাশের তলে কী দীনা এই পৃথিবী!” কমল মজুমদারের ভীষণ প্রিয় এই পংক্তি, কারণ লেখার মধ্যে দার্শনিক জিজ্ঞাসা। মাণিকবাবু কিন্তু পদ্মানদীর মাঝির বাস্তবতা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। এ উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম নয়। তিনি যা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন তা হল মানুষের চিরন্তন অস্তিত্ব জিজ্ঞাসা এবং মানুষের যাত্রা। কিন্তু সেখানে কৃতিত্বের কথা এই, যে পদ্মানদীর মাঝিরা যে গরিব বোঝাতে ‘দীন’ না বলে ‘দীনা’ বলে, সেই কথাটিও উনি ভোলেননি। এই অনুপুঙ্খে নজর অথচ আদিগন্ত বিস্তার – এ জিনিস বাংলা উপন্যাসে একদিন সম্ভব ছিল। খুনী যেমন আমাকে দস্তয়েভস্কির কাছে নিয়ে যায়। মানুষ কেন খুন করে? তাকে অপরাধের দিকে নিয়ে যায় কোন কোন জিনিস? এইসব মৌল জিজ্ঞাসাই মাণিকবাবুকে নক্ষত্রে পরিণত করে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান্য আদর্শবাদী উপন্যাসের কথা বাদ দিয়ে যদি স্রেফ কবি উপন্যাসটাই ফিরে পড়ি, তাহলে সেখানে প্রশ্ন পাই “হায়, জীবন এত ছোট কেনে?” এসব জিজ্ঞাসা বাংলা উপন্যাস কতদিন হল ভুলে গেছে! বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যা করেছেন তারই বা তুলনা কই? তাঁর কলমে একজন গ্রাম্য মাস্টার ইছামতীর পাড় দিয়ে হেঁটে গেলেই ইতিহাস তৈরি হয়। আজকাল তো খুব গ্রাম্য ইতিহাস, প্রান্তিক ইতিহাসের কথা বলা হয়। বিভূতিভূষণ কিন্তু একবারও ভাবতে চাননি তিনি ইতিহাসকে স্পর্শ করবেন। সেই কারণেই ইতিহাস এগিয়ে এসে তাঁর গলায় মালা পরিয়েছে। তিনি যখন আদর্শ হিন্দু হোটেলে বসেছেন, যখন গ্রামের পথে বৃষ্টি দেখেছেন, সে দেখা এত সুদূরপ্রসারী দেখা যে তা উপন্যাস ছাড়া অন্য কোনো পরিসরে অসম্ভব। শরৎচন্দ্র আর বিভূতিভূষণকে পাশাপাশি রেখে পড়লে একটা মজার ব্যাপার চোখে পড়ে। শরৎবাবুর লেখা, রচনা প্রণালীর দিক থেকে, জড়োয়ার গয়নার মত নিখুঁত। অন্যদিকে বিভূতিবাবু স্বেচ্ছাকৃত নড়বড়ে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রথম দু-তিন পাতা পড়লে মনেই হবে না যে উনি বাংলা গদ্য লিখতে জানেন। তারপর আপনাকে আষাঢ়ের নীলাঞ্জনছায়ার ঘনঘোর নেমে এসে জড়িয়ে ধরবে।
এই ছিল আমাদের উপন্যাস। আমরা ভাল উপন্যাস খুব বেশি সংখ্যায় যে লিখেছি তা নয়, কিন্তু কম লিখিনি। চারের দশকের লেখকরা তত উপন্যাস লেখেননি যত ছোটগল্প লিখেছেন। কিন্তু তার মধ্যেও কমলকুমার বেশকিছু অন্যরকম কাজ করেছেন। একেবারে শেষ বয়সে মণীন্দ্র গুপ্ত নেংটি নামে একখানা উপন্যাস লেখেন। সেখানে পরাবাস্তবতা নিয়ে যে ভাবনাচিন্তা করেছেন এবং উপন্যাসের যে নতুন অবস্থান খুঁজে পাওয়া গেছে তা সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করতে হয়।
এছাড়াও আছেন সমরেশ বসু। তাঁর উপন্যাসগুলি তাঁর ছোটগল্পগুলির মানের নয়। কিন্তু আজকাল যাঁরা উপন্যাসের নামে ইতিহাস লেখেন, তাঁরা খেয়াল করতে পারেন যে উত্তরঙ্গ, জগদ্দল এবং বিটি রোডের ধারে ছাড়া বাংলার চটকল শিল্পের কোনো ইতিবৃত্ত লেখা যায় না। বিবর বা স্বীকারোক্তি-র অসামান্য গদ্যের কথা ছেড়েই দিলাম। আমরা আজকাল শুধু দেখি নাই ফিরে উপন্যাসে রামকিঙ্করের মেড ইজি পেতে চাই, কিন্তু আসলে সমরেশবাবুর মূল কাজ ওটা নয়। রামকিঙ্করকে তিনি বাইরে থেকে দেখেছেন, প্রস্তুত হয়েছিলেন তাঁর জীবনী লেখার জন্য। কিন্তু যেগুলো তিনি বাইরে থেকে লেখেননি, ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন, সেগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি মাণিকবাবুর উত্তরসূরী। জটিলতাহীন উত্তরসূরী, কিন্তু জীবনকে ওইরকম অনুপুঙ্খে দেখা। সুবোধ ঘোষ, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর পরাহত। এমনকি ‘পপুলার’ বলে নাক কোঁচকালেও বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম দেশ পত্রিকার কপাল ফিরিয়েছিল। আজকাল যাঁরা তান্ত্রিক গোয়েন্দা গল্প লেখেন পরিত্রাণের আশায়, তাঁদের জানাই অবধূতের উদ্ধারণপুরের ঘাট রীতিমত কাড়াকাড়ি করে পড়া হত। নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব বাজার কাঁপিয়েছে। শারদ সংখ্যায় মতি নন্দী, দেবেশ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা সমরেশ মজুমদার যা লিখতেন তা বাঙালির ঘরে পৌঁছে যেত। আর আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতির কাছে তো বাঙালিনী মানবীচর্চাকারিণীরা হাঁটু ভেঙে দ। যদি লক্ষ্য হয় নাম ছাপানো, তবে নাম করা সত্যিই মুশকিল। আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম তো আমি ইচ্ছে করেই করলাম না কারণ এই লেখকের কতিপয় উপন্যাস ও আখ্যানমঞ্জরী না থাকলে কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশনা ব্যবসারই হয়ত নাভিশ্বাস উঠত।
আরো পড়ুন মহাশ্বেতা ও ইলিয়াস: প্রমিত সাহিত্যের প্রতিস্পর্ধী স্বর
আসলে আমাদের উপন্যাসের দুর্গতি আরম্ভ হল সাতের দশকে। যখন থেকে আমরা ভাবলাম শরৎকাল এলেই আমাদের বহুপ্রসবিনী হতে হবে। একজন বাঙালি লেখক গড়ে দশটা উপন্যাস লেখেন একেক বছরে। এ তো অভাবনীয়। আমাকে একজন লেখক, যিনি পেশায় রাইটার্স বিল্ডিংসের আমলা ছিলেন, বলেছিলেন “এখন দুহাতে লিখছি।” দুহাতে কী করে লেখা যায় তা আমার বোধগম্য হয় না, কিন্তু সেই লেখক সত্যিই প্রচুর লিখেছেন এবং পুরস্কারও পেয়েছেন। তবে সেসব লেখা কেউ মনে রেখেছে বলে তো মনে হয় না। শেষ যে বাঙালি ঔপন্যাসিক আমাদের মনের দরজায় কড়া নেড়েছেন, তিনি তো আমাদের বন্ধু ও সহকর্মী নবারুণ ভট্টাচার্য।
নবারুণের হারবার্ট বা কাঙাল মালসাট আদৌ তাঁর গলফগ্রীনের বাড়ির আশপাশের বাস্তবতা নয়। যখন রাজেন্দ্র রোডে বাবা বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে থাকতেন এবং ঋত্বিক ঘটকের সাহচর্য পেতেন, তখন কলকাতার ভিতরের যে কলকাতা তার নিম্ন মধ্যবিত্তের অন্ত্রসমূহ তিনি দেখতে পেতেন। সেসব দেখার ফলে উৎপন্ন রাগের প্রকাশ হিসাবে ওই উপন্যাসগুলো রচিত। নবারুণ দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে বড় পত্রিকায় না লিখেও জনপ্রিয় হওয়া যায়, সময়ের নাড়ি টিপে ধরা যায়। হয়ত নবারুণের সীমাবদ্ধতা এই যে তিনি নাগরিক। তিনি বড়জোর কলকাতার মফস্বলের ইতিবৃত্ত লেখেন, গ্রামের কথা লিখতে পারেন না। কিন্তু গ্রামের কথা লেখার জন্য বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্কর তো দশকে দশকে জন্ম নেবেন না আর সেই প্রতিভা সকলের থাকেও না। আমাদের উপন্যাসের আজকের সমস্যা অন্য।
আজকাল যেমন থিমভিত্তিক পুজো চালু হয়েছে, তেমন থিমভিত্তিক উপন্যাসও চালু হয়েছে। কারোর থিম রূপান্তরকামীদের সমস্যা, কারোর থিম লবণহ্রদের সমস্যা, কারোর থিম ভূমি সংস্কারের সমস্যা। এগুলো সহজে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত আখ্যানের মত। যেভাবে লোকে গল্পে রামায়ণ পড়ে শোনাত আগে, সেভাবে গল্পে সমস্যা শোনাচ্ছে। কেউ কেউ টেলিসিরিয়ালের কথাও মাথায় রাখছে। এগুলো উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধের সম্প্রসারণ, উপন্যাস নয়। এসবের লেখকরা শিল্পী নন। এঁরা একেকটা বিষয় ধরেন, সে বিষয়ে কিছু লেখাপড়া করেন, তারপর একখানা আখ্যান লিখে ফেলেন। যেন সরকারি ফাইল বেঁধে ফেলা হল। আমার ধারণা আরও সর্বনাশের দুয়ার খুলে গেছে আমেরিকান উপন্যাসকে নকল করার প্রবণতা এসে যাওয়ায়। অর্থাৎ আমেরিকান প্রকাশকরা যেমন হঠাৎ কাউকে দক্ষিণ আটলান্টিকে পাঠিয়ে দেয় যাতে সে দূর দ্বীপে বসে কিছু সার্ভে ইত্যাদি করে একখানা উপন্যাস লেখে। তেমনভাবেই বাঙালি ঔপন্যাসিক হঠাৎ গোয়ায় বা আসামে বসে একেকটি সন্তান প্রসব করছেন। এমনকি সেদিক থেকে ভাবলে কী করে বাঙালি উদ্বাস্তু বিপর্যয়ের কথা ভুলে যায়? নারায়ণ সান্যালের দীর্ঘদিন বাদে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি লেখা ছাড়া আমাদের তো তেমন কোনো সম্পদ নেই সেই জগতে! সোনাগাছির বিখ্যাত পল্লীটি বিষয়ে চারের দশকে রমেশ সেনের কাজল ছাড়া আর কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টাই চোখে পড়েনি কেন?
উপন্যাস যে তথ্যের সমাহার নয় তা বঙ্কিমবাবু থেকে নবারুণ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বহু লেখক বহুবার প্রমাণ করেছেন। পদ্মা নদী বিষয়ে উৎসাহী কোনো পাঠকের মাণিকবাবুর পদ্মানদীর মাঝি পড়ে কোনো লাভ হবে না। লাভ তাঁর যিনি মানবচরিত্র সম্পর্কে উৎসাহী। পুতুলনাচের ইতিকথার যে বাস্তবতা, তা ফরিদপুর জেলার বাস্তবতা কিনা তা নিয়ে কিন্তু গভীর সন্দেহ আছে। বস্তুত মাণিকবাবু ফরিদপুর হল না ঢাকা হল তা নিয়ে চিন্তাই করতেন না। যেহেতু তিনি চেতনার অন্দরে ঢুকে যেতে পারতেন, সেহেতু তাঁর কাছে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাস্তবতা বা ফরিদপুরের বাস্তবতা – কোনোটাই দূরের গ্রহ ছিল না। এক ধরনের verticality এবং horizontality মাণিকবাবুতে মিশে আছে।
তারাশঙ্করবাবুও যখন উপন্যাস লিখেছেন তখন নেহাত একটা সমাজের বদলে যাওয়ার কথা লেখেননি। তাঁর হাঁসুলিবাঁকের উপকথা বা নসুবালানেহাতই সামন্ততন্ত্র বা লিঙ্গ সঙ্কটের কথা ভেবে লেখা নয়। আরেকজনের কথা এতক্ষণ না বলা পাপই হয়েছে, তিনি হলেন সতীনাথ ভাদুড়ি এবং তাঁর ঢোঁড়াই চরিত মানস। আজকাল নিম্নবর্গীয় মানুষদের নিয়ে যেসব লেখালিখি হয় সতীনাথ তার চেয়ে অনেক উচ্চস্তরের প্রতিভায়, শেক্সপিয়ারতুল্য প্রতিভায়, একজন গ্রাম্য অতিসাধারণ মানুষের আধুনিক হয়ে যাওয়া বিবৃত করেছেন। বস্তুত ও বই না পড়লে আধুনিক অন্ত্যজ ভারতের হৃদয়বৃত্তির কথা জানা যায় না। এ এক ভারত আবিষ্কার।
সুতরাং একথা বলা যেতে পারে যে বাংলা উপন্যাসের দস্তয়েভস্কি নেই, তলস্তয় নেই, স্তাঁদাল নেই। হয়ত মার্কেজ না থাকা নিয়েও আক্ষেপ করা যেতে পারে আজকের বাজারে। কিন্তু আমাদের একটা জিনিস মানতেই হবে। কমলকুমার, মতি নন্দী, এমনকি সংক্ষিপ্তভাবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের শাহরিক উপন্যাসের কথা ভাবলে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের চম্পাহাটি-নির্ভর আখ্যানগুলোর কথা ভাবলে বোঝা যায় বাঙালি তমালতালিবনরাজিনীলার কথাও ভাবতে পারে এবং ভেবেছে। কিন্তু শরৎকাল এলেই দলে দলে বহ্নিপতঙ্গের মত শারদীয় পত্রিকায় আত্মবিসর্জনের অভ্যাস বর্জন করতে না পারলে কোনো উঁচু দরের লেখাই সম্ভব নয়। শুধু উপন্যাস কেন, প্রামাণ্য কবিতাও সম্ভব নয়।
বঙ্কিমবাবু প্রশ্ন তুলেছিলেন, দেশের মঙ্গল মানে আসলে কার মঙ্গল? আমার মনেও প্রশ্ন জাগে, এত যে বাংলা উপন্যাস লেখা হয়, পড়ে কারা? আমাদের বাড়ির বাচ্চারা তো কী বই পড়েছ জিজ্ঞেস করলে সেই হ্যারি পটার বলে। আজকাল তেমন শিশুসাহিত্যই বা কে লিখছে তাহলে? যেগুলো লেখা হচ্ছে সেগুলো যে শিশুসাহিত্য তা তো সম্পাদক ঠিক করছেন, শিশুরা নয়। সুকুমার রায়ের লেখা কিন্তু শিশুরা এমনিই পড়ত, সম্পাদককে শিশুসাহিত্য বলে দেগে দিতে হত না। এখন তো সম্পাদককে নির্দিষ্ট করে দিতে হয় কোনটা মধ্যবয়স্ক নরনারীর হরমোন বিপর্যয়, কোনটা মহারাষ্ট্রের কৃষকদের দুর্দশার কাহিনি, কোনটা সমকামীদের আখ্যান। অর্থাৎ শারদীয় পত্রিকা হল গল্পের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা শপিং মল। সেখানে কিছু পণ্যদ্রব্য থাকে, সেগুলোর মানও আন্তর্জাতিক নয়। ভাবলে দুঃখ হয়, যে ভাষায় একদিন চন্দ্রশেখর লেখা হয়েছিল সেই ভাষায় আজ যা লেখা হয় তার অধিকাংশই উপন্যাস পদবাচ্য নয়। হিন্দিতে যাকে কিসসা বলে তাও নয়। এগুলো শব্দের কেচ্ছা। মাণিকবাবু কল্লোল যুগের লেখকদের লেখার আলোচনায় একবার বলেছিলেন, মধ্যবিত্ত যুবকের বিক্ষোভ বিপ্লব তৈরি করতে পারে না। আমার মনে হয় কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। কারণ যখন আমরা কাফকা, কামু, সার্ত্র বা লাতিন আমেরিকার লেখকদের পড়ি তখন মোটামুটি মধ্যবিত্ত হিসাবেই পড়ি। তার সূচনা এবং নিষ্পত্তি সুচিহ্নিত। ফলে আমরা আর আখ্যান থেকে চেতনায় প্রবেশ করতে পারছি না। আমাদের যেন মুচলেকা দেওয়া আছে যে ‘পোলিটিকালি ইনকারেক্ট’ কোনো বাক্য আমাদের কলম/কীবোর্ড থেকে নিঃসৃত হবে না।
বাংলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল কলকাতা থেকে দূরে, মফস্বলের কোনো কোনো জায়গায় বরং দু-একটি স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেয়েছি। যেমন কোচবিহারের নেহাতই অপরিচিত অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস এবং আরও কিছু পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। হয়ত এরকম তরুণ লেখক পুরুলিয়া কি বাঁকুড়া বা মালদায় আছে। তারাই বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ। বাংলা উপন্যাসের নিয়তি আর কেএমডিএ নির্ধারণ করতে পারবে না।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
সমসাময়িক মানে ই স্খলিত বা বামনত্বে আক্রান্ত এই ধারণাটি কিছুটা অযৌক্তিক এবং বোকাবোকা। এবং সঞ্জয়্বাবুর কাছে প্রত্যাশিত না। কারণ এই ধারণা গত পঞ্চাশ বছরের বাঙালি জীবনে প্রায় লোডশেডিং অর ঘামাচি র মতো স্থায়ী, অতীত মাত্রেই গৌরবজনক বা অন্তত ধরা ছোঁয়ার বাইরে এমন ভাবার কোন কারণ নেই । কিছুটা প্রশিক্ষিত অন্তত পরিশীলিত অশ্রদ্ধা ছাড়া এগোনো মুশকিল।
তবে সমস্যা হল ভদ্রলোক যেহেতু সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাই কিছু ঋষিসুলভ বাচন , সত্যকথন তো রয়েছে। এনরিক ভিয়া মাতাস মনে করতেন , শিল্পে গ্রেট ওয়ার্ক আর সম্ভব না, তাই সেই শিল্পের গোপন রসাস্বাদন ই , এই স্খলিত পৃথিবীতে পাঠকের একমাত্র ভবিতব্য। ভিয়া মাতাস অসম্ভব উচ্চমানের লেখক হওয়া সত্ত্বএও, আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর বহু কাজের নিবিষ্ট পাঠক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে একমত হবার কোন প্রশ্ন নেই, শৈলীর শিক্ষানবিশী তো দূর অস্ত।
তাছাড়া প্রতিবেদনধর্মীতাটা সকলে সামলাতে পারেন না, মার্কেজ সাংবাদিকতার অতীত কে অস্বীকার তো করেন ই নি, প্রতিবেদনধর্মীতাকে রেখে দিয়ে ই বিশ্বজয় করেছেন। সেটা সবাই পারবেন না, এতে অবাক হবার কিছু নেই। গ ত শতকের ছয়ের দশক বিশেষত আটের দশকের পরবর্তী চিনুয়া আচিবে রা ও এই সর্বগ্রাসী সমসাময়িকতার তত্বায়নের হাত থেকে উপন্যাস রচনাকালে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। থিয়োরেটিকাল নানা চ্যালেঞ্জের উত্তর উপন্যাসে দিতে গিয়ে আমাদের সময়ের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়দের মধ্যেও স্বয়ং দেবেশ , রাঘব ও নবারুণ কিছু অংশত দুর্বল কাজ ও করে ফেলেছেন, এঁদের অনুসারী রা সেই অভিশাপ থেকে অনেকেই মুক্ত সব সময়ে থাকতে পারেন নি। নতুন সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র ও মানব জীবনের নতুন তাত্বিক আলোচনা যে সময়ে দানা বেঁধেছে , তখন সাহিত্যের টেক্স্ট সেই আলোচনার একটা নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে , এবং পোলিটিকাল রাইটিং এ সেটা বেশি হয়েছে, বিশেষত উপন্যাসের নাগরিকত্বের দায় তৈরীর কাজে যেসব সমস্যা হয়েছে, তার দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিটিক হিসেবে সঞ্জয়্বাবু রা এড়াতে পারেন না।
তবে (সমরেশ প্রয়ানের পরের প্রজন্ম্দের একাংশ হিসেবে আমার ও আমাদের অবিসংবাদিত হিরো) নবারুণের পরে কথাসাহিত্যে নিরীক্ষা কলকাতা শহরে কমে গেছে আর বিশুদ্ধ মফস্বলে গ্রামাঞ্চলে ভীষণ টিঁকে আছে এই ধারণাটি সে ই সাত এর দশকের গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার পরিকল্পনা অনুসারী এবং ঐতিহাসিক ভাবে সীমিত। এটুকু মেনে নিতে পারি মূল ধার নামক বিকটাকৃতি দানবের ক্ষুধা বৃদ্ধি ঘটেছে।
মনে রাখা দরকার বিশুদ্ধতার মৃত্যুকে এবং তার সম্ভাবনাকে সার্বিক ভাবে যাঁরা গ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখার যথেষ্ট কারণ আছে । আমি একেবারে হালে সাদিক হোসেন, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য, অসীম চট্টরাজ, অহনা বিশ্বাস , সব্যসাচী সান্যাল সহ অরো কজনের লেখা পড়ে যথেষ্ট উৎসাহিত। হ্যা শৈল্পিক অ্যাম্বিশনের অভাব আর সহজ যশপ্রার্থনার অভিশাপ পেরিয়েই যা হবার হবে।
সঞ্জয়বাবু স্যারের এই লেখা কে চ্যালেঞ্জ করে অনেক কিছু লেখা সম্ভব। কিন্তু যেহেতু স্যারের পায়েরকাছে বসে উনি বুড়ো.হবার.আগে আমাদের.মূলতঃ শিখতে হবে তা ই এখনি উত্তেজিত হয়ে প্রবন্ধে হাত দিচ্ছিনা 🙂 এসব লোকের আমরা নখের যোগ্য না এমনিতে। কিন্তু তর্ক আছে, সুযোগ এলে.হবে। আর বছর কুড়ি তিরিশের মধ্যে বাংলা একুশ শতকের সাহিত্য বিংশ শতকের আশ্চর্য্য নিরীক্ষা ও জীবন বাজি রাখা লেখা গুলির সমতুল্য হয়ে না ওঠার কোন কারণ নেই।