৪ জানুয়ারি এবং ১৪ জানুয়ারি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দুটি উল্লেখযোগ্য তারিখ। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মারা গেছিলেন। ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইলিয়াসের বেড়ে ওঠা পূর্ববঙ্গে, বাংলাদেশের লেখক তিনি। মহাশ্বেতা পশ্চিমবঙ্গের লেখক। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ভাষা নতুন অভিমুখ পেয়েছে এই দুই সাহিত্যিকের নিরলস অনুশীলনে। মহাশ্বেতাকে চিঠি লিখেছিলেন ইলিয়াস। ১৯৯৬ সালে। মহাশ্বেতা নির্দ্বিধায় ইলিয়াসকে দুই বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বলে মেনে নিচ্ছেন। ঘোষণা করছেন, তাঁর থেকেও অনেক বেশি সাংঘাতিক লেখক ইলিয়াস। বাংলা সাহিত্যের নতুন ভাষা ইলিয়াসের সাহিত্যে খুঁজে পাচ্ছেন মহাশ্বেতা, যে ভাষায় বারুদ জমা রয়েছে। শহুরে পরিসরের যাবতীয় রাস্তার ভাষা, বস্তির ভাষা, ধুলো ময়লা মাখা ভাষা, শ্রমে মেশা ভাষা জীবন্ত হয়ে উঠছে কুশীলবদের নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে। একই আখ্যানের চালচিত্রে অশ্লীল উচ্চশ্রেণির ছ্যাবলামি, নোংরামি, ক্ষমতার ভাষা চিত্রিত হচ্ছে। কথকের ভাষা ছুরির মত চলে যাচ্ছে, টিপ্পনি কাটছে, ব্যাঙ্গাত্মক শব্দবন্ধে সুখপাঠের আমেজ নড়িয়ে দিচ্ছে। মহাশ্বেতার লেখায় অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন ইলিয়াস, তাঁর চিঠিতে উৎসাহ পাচ্ছেন। ইলিয়াস চিঠিতে মহাশ্বেতার গল্পের প্রোটাগনিস্ট এককড়ির উল্লেখ করছেন বারবার – এককড়ি মহাস্থানগড়ে ঘোরে। ইলিয়াস শুরু করেছিলেন তাঁর তৃতীয় উপন্যাসের খসড়া, মহাস্থানগড়-বগুড়ার পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কে খুঁজতে চাওয়া। ইলিয়াস ওই চিঠি লেখার সাড়ে চার মাসের মধ্যে চিরবিদায় নেন। মহাশ্বেতা ইলিয়াসকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছিলেন উপর্যুক্ত অকুণ্ঠ প্রশংসাবাক্যে।

#

পাঠক মূলত মধ্যশ্রেণির ভদ্রজন। অধিকাংশ লেখকও তাই। বাংলা সাহিত্যের জগৎ এঁদের প্রত্যক্ষ আদানপ্রদানের দ্বারা নির্মিত। সেই জগতে নিজেদের বৃত্তের উদযাপন হবে, তা স্বাভাবিক। যে বৃত্তে এঁদের নিয়ত যাপন, যে বৃত্তে এঁদের আদানপ্রদান, যে বৃত্তের মান্য প্রমিত ভাষা বচনে প্রবহমান, যে বৃত্তের সুখ-দুঃখ-ব্যর্থতা-আকাঙ্ক্ষা নিয়মিত জড়িয়ে থাকছে, সেই বৃত্তের যাবৎ সংস্কৃতি অধিকাংশ লেখকের লেখার উৎসবিন্দু। সেই বৃত্তের পাঠকের প্রত্যাশাও তাই। এমনকি, কুশীলবরা ঠিক কীভাবে ভাববে, কী আচরণ করবে, কোন ভাষায় কথা বলবে, কী কী আকাঙ্ক্ষা করবে, সেগুলিও এই বৃত্তের চাওয়া পাওয়া, নীতি-মূল্যবোধ দিয়ে মাপা হয়। তা অন্যায় নয়, খারাপ কিছু নয়। কিন্তু, এই সাহিত্যদর্শনে সীমাবদ্ধতা প্রচুর। সবটা বাস্তব এতে দেখা যায় না। সব স্বর শোনা যায় না। কোনো কোনো লেখককে তাই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে যেতে হয়, যাতে বৃত্তের বাইরের পরিসর সাহিত্যে উদযাপিত হতে পারে। অশ্রুত স্বর অনভ্যস্ত কানে পৌঁছতে পারে। অবস্থানগত নৈর্ব্যক্তিকতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আত্মীকরণের অনুশীলন প্রয়োজনীয়। নিজের সামাজিক অবস্থানকে প্রতিস্পর্ধা জানানো এবং সেই সামাজিক অবস্থান থেকে সবকিছুকে বিচার করতে চাওয়ার মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ। অমূল্য আব্রাহামের মত এক কথক একটা সাঁকো বেঁধে দেয়। ওপারে গিয়ে অপরদের কিছুটা জানা বোঝার। কিন্তু সে যে এপারের লোক, সে যে উপরিল্লিখিত ওই বৃত্তের প্রতিনিধি, তা সে ভোলে না। কিন্তু সেই বৃত্তস্থ অবস্থানের সামাজিক সুবিধাগুলিকে মান্যতা দেয় না। তার অপারগতার কথা স্বীকার করে নেয়। “আমি যে আর কিছু করতে পারি না। আমার আঙ্গুলগুলো কি পাতলা, চামড়া কি নরম, আমি না পারি তীর ছুঁড়তে, না পারি বলোয়া চালাতে। আমি শুধু এইটুকুই পারি। বাকি জীবনটা বুঝতে চেষ্টা করতে।” কথক বিরসার মুখ দিয়ে অমূল্য সম্পর্কে ‘দিকু’ উচ্চারণ করিয়ে নেয়। ‘দিকু’ শুধু তো সম্বোধনমাত্র নয়, তা ঘৃণা-ক্রোধমিশ্রিত সম্বোধন। অমূল্য তা উপলব্ধি করে। মহাশ্বেতা আখ্যানপাঠককেও তা উপলব্ধি করান। মহাশ্বেতা তথাকথিত ‘দিকু’ সমাজের লেখিকা হয়েও তাঁর রাজনৈতিক চেতনা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সহমর্মিতার অবস্থান থেকে আদিবাসী সমাজের গভীরতা স্পর্শ করে আখ্যান রচনা করেছেন – এক্ষেত্রে তাঁকে নিজের দিকুসমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাহ্বান জানাতে হয়েছে। আখ্যানের বহুমাত্রিক স্বরে উচ্চবর্গীয় সমাজের আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করে বর্গচ্যুত (de-elite) হতে হয়েছে। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও তিনি না-আদিবাসী। কখনও অমূল্য আব্রাহামের বয়ানে কখনও কালী সাঁতরার বয়ানে তা প্রকাশ পায়। “সে বসাইয়ের কথা বসাই হয়ে বুঝতে পারবে না। কেননা সে আদিবাসী নয়”। লেখক মহাশ্বেতাকে এই না-সত্তাটিকে চিহ্নিত করতে হয়েছে – কারণ আদিবাসী হয়ে জন্মানোর পরের বঞ্চনাবোধের শরিক “আপার-কাস্ট্‌ কোনো বর্ণহিন্দু হতে পারে না।” এবং অমূল্য আব্রাহাম জানে সে বিরসাইট না, তাই বিরসাইটদের মধ্যে বহিরাগত থেকেও সে তাদের অন্তঃস্থলের প্রোথিত বিশ্বাসের কাহিনি খুঁজতে চায়। কালী বা অমূল্যরা মূল প্রোটাগনিস্টের স্বরে সঙ্গত দেয়, তাঁদের দ্রোহচিন্তায় যুক্তি-তথ্য আরোপ করে পাঠকের কাছে তাঁদের (মূল প্রোটাগনিস্টদের) বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। মহাশ্বেতা দেবী না-আদিবাসী হয়েও আদিবাসীদের স্বর বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন ভদ্রলোক উচ্চবর্গীয় পাঠকসমাজের সামনে। লেভি স্ট্রাউস ইঙ্গিত করেছিলেন যে, কোনও জনজাতির রাজনৈতিক দাবি, ভূমির দাবি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জনজাতিটির বহির্জগতে তাদের সম্পর্কে ছড়ানো প্রথা-ঐতিহ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করা এবং জনজাতিটির অন্তর্জগতে ব্যাপ্ত নিজেদের প্রথা-ঐতিহ্য সংগ্রহের মধ্যে তফাত রয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের অন্তর্জগত থেকে উপন্যাসের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। নিজের সামাজিক অবস্থান এবং শ্রেণিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে করতে “বাবুশিক্ষায় সাঁওতাল মুতে দেয়” এমন ভাষাপ্রয়োগে সংশয় রাখেননি কোনো। “মুণ্ডা কেনও দিকুদের মতো ভাত খাবে না?” প্রশ্নের তীক্ষ্ণতা পাঠকের অবস্থানগত নির্লিপ্তিতে আঘাত করে। ভব্যসভ্য সামাজিক চালচলনের প্রত্যাশার গণ্ডিতে সাহিত্যকে সীমাবদ্ধ, স্তিমিত রাখার হিসেব ওলোটপালট করেন মহাশ্বেতা – বস্তুত উচ্চবর্গ নির্মিত অমন গণ্ডিকেই প্রত্যাখ্যান করে পাঠকের প্রত্যাশার গণ্ডি উন্মুক্ত করে দেন। মহাশ্বেতার ‘অগ্নিগর্ভ’-র প্রোটাগনিস্টরা বেঠবেগার, ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষক – তাঁর কাহিনিগুলি মূলত বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের পশিমাঞ্চলের পটভূমি নির্ভর – উচ্চবর্ণের ও উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে অসন্তোষ-দ্রোহ কাহিনিগুলিকে অভিমুখ দেয়। নিজের সামাজিক ও শ্রেণি অবস্থানকে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে দেশের ব্যাপক মানুষের সংগ্রামের দ্বান্দ্বিক পরিসরকে আখ্যানস্থ করলেন মহাশ্বেতা। প্রগতিবাদী সাহিত্যের বিবর্তন ঘটিয়ে নির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থায় সমকালীন নির্দিষ্ট সমাজ-দ্বন্দ্বগুলিকে আখ্যানে প্রতিফলিত করলেন এবং নতুন দ্বন্দ্বে উত্তীর্ণ করলেন তিনি। শ্রেণিসংগ্রামের ব্যাপক ও জটিল রূপভাষ্যের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী সাহিত্যের এক রূপরেখা দিতে চাইলেন। বসাই টুডু, দোপ্‌দি মেঝেনরা সংসদীয় বামপন্থার পথকে প্রত্যাখ্যান তো করলই, বীরু পাঠকের নকশালি পথকেও পুরো গ্রহণ করল না। ভূমিহীন আদিবাসী ক্ষেতমজুরের হক আদায়ে যতটুকু আইনের পথকে ব্যবহার করা যায়, ততটুকু করল; আর, যতটুকু আইনের পথ উচ্চবর্গের ট্যাঁকে গোঁজা, তার জন্য শ্রেণিশত্রু খতমের পথ নিল। কিন্তু, নকশালি নেতৃত্বের মধ্যশ্রেণির বাবুদের মাথায় চড়তে দিল না। সহানুভূতিশীল হয়েও কালী বসাইদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কথক আর্থসামাজিক শোষণ থেকে উদ্ভূত “সূর্যসমান ক্রোধ” প্রতিটি অনুচ্ছেদের মধ্যে রেখে দেন, সন্তর্পণে, পাঠকের জন্য।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিজে মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত হয়েও মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে বৃহত্তর জনগণকে দেখতে চাইলেন না। সহানুভূতিশীল মধ্যবিত্তের দ্বারা নির্মিত, সহমর্মী মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে দেখা এবং মধ্যবিত্ত দ্বারা প্রশংসিত সাহিত্য-দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে দাঁড়িয়ে ইলিয়াস প্রচলিত কাঠামো ভাঙতে উদ্যোগী হলেন। ইলিয়াসের আখ্যানে নির্মিত জগৎ ভাল না খারাপ, তাঁর নির্মিত নিম্নবর্গীয় কুশীলবদের সামাজিক নীতিবোধ মার্জিত নাকি অমার্জিত, সেসব অবান্তর। কিন্তু, পাঠকের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ-রুচি-নৈতিকতা তাতে আহত হয় বারবার। নিপীড়িতদের প্রতি আলগা পিরীত দেখানোর মানসিকতা ধাক্কা খায়। যে দুটি উপাদানকে ইলিয়াস কঠোরভাবে বর্জন করলেন, তা হচ্ছে মধ্যবিত্তের সাহিত্যভাষা এবং মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। ইলিয়াস কখনোই তমিজ বা খিজিরের শ্রেণিভুক্ত ছিলেন না। চেংটু, আলিবক্স, বৈকুণ্ঠ বৈরাগী, কেরামত আলিরা ব্যক্তি ইলিয়াসের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের থেকে নিম্নকোটির বাসিন্দা। অথচ, তারা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। ইলিয়াস তাঁদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের যথাসম্ভব বাস্তবিক উপস্থাপনা করলেন নিজবৃত্তের অবস্থানজনিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁদের শ্রেণিচেতনা-চিন্তাভাবনা-আবেগের স্তরভেদ বুঝতে চেয়ে। ইলিয়াস মধ্যবিত্তের সাহিত্যের নিজস্ব শব্দভান্ডার ত্যাগ করে নতুন শব্দভাণ্ডার গড়ে তুলতে ব্রতী ছিলেন। সেই নতুন শব্দভাণ্ডার সাহিত্যে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব পেল কিনা, সেটা বিচার্য না। তাদের অন্তর্ভুক্তির পরিসর বিচার্য এবং শব্দগুলির প্রায়োগিক পরিসর বিচার্য। এই শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যে খিস্তি আছে, আটপৌরে শব্দ আছে, পাড়া বা গলির লব্জ, শহুরে প্রবাদ-প্রবচন, গেঁয়ো প্রবাদ আছে, মুদ্রাদোষে বেরনো শব্দ আছে এবং প্রচলিত সাহিত্যধর্মী শব্দ আছে। ইলিয়াসের আখ্যানের ভাষা খিস্তিপ্রবণ, যৌনগন্ধী, অশ্লীল – এমন অভিযোগ উঠেছে অনেকসময়। মধ্যবিত্ত, শহুরে, রুচিশীল, ভদ্রলোকরা কি বাস্তব জীবনে খিস্তি দেন না বা অপশব্দ প্রয়োগ করে কথা বলেন না? বলেন। কিন্তু, সাহিত্যভাষাকে তার থেকে আলাদা রাখেন বা খুব সন্তর্পণে মেপে সংলাপভুক্ত করেন। ইলিয়াস ভাষাপ্রয়োগে এই রাখঢাক রাখলেন না। ‘অশ্লীল’ শব্দ ব্যবহারকে শহুরে জীবনযাত্রা, দৈনন্দিন যাপনসংগ্রামের ফলে উদ্ভূত স্বভাবের অংশ হিসাবে দেখলেন। ইলিয়াস সরাসরি তাদের ভাষা গ্রহণ করেছিলেন, যারা মধ্যবিত্তের সমস্ত সংস্কৃতি থেকে দূরে থেকে নিজেরাই নিজেদের দেখানোর দায়িত্ব নিচ্ছে। এই কুশীলবদের কাছে মধ্যবিত্ত-ভদ্রলোক সংস্কৃতি বহনের দায় নেই। খিজির তাই নির্ভার হয়ে মিলিটারির প্রতি “মায়েরে বাপ”, রহমতউল্লার প্রতি “চুতমারানি” ইত্যাদি ‘অশালীন’ ভাষাপ্রয়োগ করে প্রতিরোধ উদযাপন করে। চেংটু-আলিবক্স-করমালিরা তাত্ত্বিক কমিউনিস্ট আনোয়ারের তত্ত্বানুগত মূল্যবোধ এড়িয়ে নিজেদের শোষণমুক্তির উচ্চকিত পথ বেছে নেয়। ইলিয়াস লেখকের অবস্থানগত নৈর্ব্যক্তিকতায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন বলেই ১৯৬৯-এর জাতীয় গণঅভ্যুত্থান নিয়ে গদগদ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েননি। শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের প্রশ্নগুলি তাদের নিজেদের স্বরে ঘোষিত হয়েছে, তাদের ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ার ট্র্যাজেডি আইয়ুববিরোধী একদেশদর্শী আখ্যানপ্রবণতায় ফাটল ধরাতে চেয়েছে। ইলিয়াস একাধিকবার আক্ষেপ করেছেন আন্দোলনের রাশ জাতীয়তাবাদী মধ্যবিত্তের হাতে চলে গেছিল বলে। ইলিয়াস ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে ‘গ্লোরিফাই’ করতে চাননি। নিজে শহুরে বৃত্তের প্রতিনিধি হয়েও জাতীয়তাবাদী নির্মাণের আবেগে গা ভাসিয়ে নিম্নবিত্ত-নির্বিত্তের জীবনযাপনকে ভুলে যাননি। বৃহত্তর জনজীবনের শোষণ, বঞ্চনা, ক্ষোভ নিয়ে লিখতে গেলে সহানুভূতি এবং করুণার আবেগবাষ্পে প্রকৃত বাস্তব ঢাকা পড়ে যায়। ইলিয়াস নিজবৃত্তের সেই মোহ কাটিয়ে উঠছেন। তাই খিজিরের চেতনাপ্রবাহে শ্রমের ভাষা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। চেনা পাঠ পরিসর থেকে আলাদা সে ভাষা। রিকশার বডি, চেসিস, অন্য রিকশা, ট্রাককে কাটিয়ে রাজপথে বেদম দৌড় তার সুখের মুহূর্তে, মৃত্যুর মুহূর্তে তার ভাবনায় মিশে যাচ্ছে। এই ভাষা খুঁজে পাওয়াকেই ‘সাহিত্যসাধনা’ বলে। মহাশ্বেতা দেবীর মতো আদিবাসী জগৎ ইলিয়াসের সাহিত্যের মূল উপজীব্য নয়, শহুরে জগৎ ও গ্রামীণ জগতের না-অচেনা পরিসরকে তিনি আখ্যানপট হিসাবে বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু, সেই আখ্যানপটের বহুস্তরীয় জগতের প্রতিটি উপাদানকে সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত করছেন। অকিঞ্চিৎকর কুশীলবরা সেই বহুস্তরের প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র হয়ে উঠছে। উপন্যাসের বিকল্প পথ বেরিয়ে আসছে। ফলে, পাঠক উপন্যাসের সেই নতুন পথের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে।

#

এই অনুশীলন কি সহজ? চাইলেই যে কেউ করে ফেলতে পারে? না। কারণ, এই অনুশীলনে নিজের বৃত্তকে, নিজের স্বস্তিক্ষেত্রকে এবং নিজের যাপনরেখাকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। লেখার মধ্যে দিয়ে সেই অনুশীলনের পরীক্ষানিরীক্ষাকে নিরন্তর চালিয়ে যেতে হয়। কান পেতে থাকতে হয় সমাজকথিত ‘অপর’-এর সংস্কৃতিতে। মহাশ্বেতা দেবীর ধৌলি দুসাদ সম্প্রদায়ের নারী – শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ তিন বৈষম্য দ্বারা শোষিত। ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে গণিকাবৃত্তি বেছে নেয় পেশা হিসাবে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে এবং পুরুষতান্ত্রিক ‘নারীত্ব-নির্মাণ’-কে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে বসে। তার দেহের উপর, তার চেতনার উপর উচ্চবর্গের যাবতীয় শোষণের গিঁট আলগা হতে থাকে – ধৌলির স্বর তীক্ষ্ণ হতে থাকে। এমনকি নিজের শেকড় নিজের বাসভূমি ছেড়ে যেতেও দ্বিধাহীন সে। যে নৈতিকতা, মূল্যবোধ দিয়ে ‘ধৌলি’দের মাপামাপিতে অভ্যস্ত সমাজ, সেই মূল্যবোধ-ফোধ ঠাট্টায় কেঁপে ওঠে। ধৌলির প্রত্যাখ্যানের ভাষায় মিসরিলালের ‘ম্যানিপুলেটিভ প্রেম’-এর খোঁয়ারি ভেঙে যায়। এই মহাশ্বেতারই অন্য এক নির্মাণ সুজাতা কলকাতা শহরের ভদ্রবৃত্তের ঘিনঘিনে দ্বিচারিতা খুঁজে পেয়েছিলেন ব্রতীর মৃত্যুর পরে। “সমুর শরীরে তেইশটা আঘাত ছিল, বিজিতের শরীরে ষোলটা। লালটুর নাড়ির পাক খুলে লালটুকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে কোনও পৈশাচিকতা নেই” বাক্যত্রয় লেখার পরে এবং শেষ বাক্যের কথকসুলভ শ্লেষবাচনের পরে আসল পৈশাচিকতার দিকে নির্দেশ করে কথক। কলকাতার বুদ্ধিজীবী কবি লেখকরা এই রাষ্ট্রীয় মারণযজ্ঞ সম্পর্কে শয়তানি নীরবতা পালন করেছিল। তুলনায় ‘সেফ’ খেলা পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধকালীন খানসেনাদের পৈশাচিকতা নিয়ে সাহিত্য করা। আরও ‘সেফ খেলা’ রাষ্ট্রের নারকীয় সন্ত্রাসকে জনগণের প্রতিরোধের ‘বীভৎসতা’ দিয়ে গুলিয়ে দেওয়া। সুজাতার উত্তরণ মা-স্ত্রী ইত্যাদি পরিচয়ের সমাজনির্মিত সূত্রগুলি কাটতে কাটতে রাজনৈতিক হয়ে ওঠা। এতটা প্রবল রাজনৈতিক, যাতে শ্রেণিশোষণ আর পুরুষতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানের দার্ঢ্য প্রতিষ্ঠা করা যায়।

পূরণ সহায়। বন্ধু হরিশরণের ডাকে পিরথায় আসা এক সাংবাদিক। কিন্তু, পিরথার আদিবাসীরা কিছুতেই ‘স্টোরি’ হয়ে ওঠে না। ক্ষমতা কাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন চলতে থাকে তাঁদের ধ্বংস করার; ব্লক আধিকারিকের রিপোর্টে তাঁদের অনাহার, দারিদ্র্যের রিপোর্ট পেশ করে। ‘অগ্নিগর্ভ’-র আখ্যানগুলিতেও এমন অনপনেয় দূরত্ব থেকে যায়। সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের, সরকারি নথির সঙ্গে জোতদারের নথির, সরকারি প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবিক প্রয়োগের। ‘জল’ গল্পের কথক জানেন তাঁর নৈতিকতা, ইচ্ছে এবং ডোম-দুসাদ-চামার কুশীলবদের বাস্তবের মধ্যে দূরত্ব প্রচুর। কথক সেই দূরত্ব পাঠকের সামনে উন্মোচন করেন আঙ্গিক, বিষয়বস্তু ও ভাষার মধ্যে দিয়ে। প্রাথমিক ইস্কুলশিক্ষক জিতেন মাইতির ‘দেশ’-এর ধারণা এবং মঘাই ডোম ধুরাদের ‘দেশ’-এর ধারণা আলাদা। জিতেন মাইতির বোধগম্যতায় প্রকৃতির সুজলাং সুফলাং ছবির সঙ্গে মঘাই ধুরাদের রুক্ষ জলহীন ক্লিষ্ট প্রকৃতির বাস্তবতায় যোজন দূরত্ব। “আজন্ম ন্যাড়া জিতেন মাইতি শিক্ষা-প্রসারণে বিফল-সংগ্রামী। মঘাই জলের ব্যাপারে বিফল-সংগ্রামী। জিতেন মাইতির সংগ্রামটি মডার্ন ম্যান সৃষ্ট। মঘাইয়ের সংগ্রাম প্রাগৈতিহাসিক।” আর, এই অনপনেয় দূরত্বের পরিধি বোঝাতেই জিতেন মাইতির আধুনিকতার সঙ্গে মঘাইয়ের অনাধুনিক রীতি-নীতির সংঘাত ঘটে। মিথ ও মুখফেরতা বিশ্বাস এক না-আধুনিক ভাষাকল্প গড়ে তুলে আখ্যানের কালস্থানিকতাকে ভদ্রলোকি পরিসর থেকে দূরে নিয়ে যায়। ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী কাঠামোয় সন্তোষ পূজারীরা মঘাই ডোমেদের ব্যবহার করে নেয়, তাদের মিথ-বিশ্বাস-লৌকিকতাকে নিংড়ে নেয়। দোপ্‌দি, দুলনা, ধুরাদের প্রতিরোধকে “সন্ত্রাসবাদী”, “নকশালি”, “ডিসেনটিং এলিমেন্টস”, “লং সাসপিশাস্‌ ক্যারেক্টার” বলে চিহ্নিত করে নেয় রাষ্ট্র। পিরথায় বালক বিখিয়া অদ্ভুত উড়ন্ত পাখির ছবি আঁকে। টেরোড্যাকটিল এসে পড়ে পিরথায়। মিথ ওতপ্রোত মিশে থাকে। মূলবাসী জনজাতির বিশ্বাস, সংস্কার বর্তমান সময়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিন্দু তৈরি করতে চায়। পিরথা হয়ে ওঠে আসল ভারতবর্ষের প্রতিরূপ। নিম্নতল থেকে উঠে আসা ইতিহাসে মূলবাসী জনজাতির আর্থরাজনৈতিক পরাজয়ের ইতিহাস এবং বর্তমানের অসহায়তা সমান্তরালে এগোতে থাকে। টেরোড্যাকটিল ও মূলবাসী সমাজ অভিন্ন হয়ে ওঠে – মিথ এখানে প্রতিরোধের হাতিয়ার। প্রতিরোধ টিকবে না, প্রবল ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র জিতবে, তাদের মতাদর্শগত প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তবু, বেঁচে থাকা ভুলে যাওয়া যায় না। বেঁচে থাকতে গেলে হেরে যাওয়ার আগে অবধি প্রতিরোধ জারি রাখতে হয়। মিথ ইতিহাসের চেনা পাঠকে প্রতিস্পর্ধা জানাতে পারে। বিদেশি উচ্চবর্গের পছন্দসই লিখিত ইতিহাসের বিরুদ্ধে মৌখিক সাহিত্য হাজির করতে পারে। দেশি উচ্চবর্গের চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসের বিপ্রতীপে মুখফেরতা কাহিনির প্রতিরোধ গড়তে পারে। মহাশ্বেতার সঙ্গে ইলিয়াসের সাহিত্যনীতিগত মিল মিথ আর মুখফেরতা কাহিনির ব্যবহারে। দুজনেই এমন এক সময়ে সাহিত্য রচনা করছেন যখন আধুনিকতার আতিশয্য, যখন প্রযুক্তি-বিজ্ঞানগত প্রগতি অনেকদূর। দ্বান্দ্বিকতা এই যে, মানুষ তবু বিশ্বাস আর সংস্কারে ভরসা রাখে। অন্যতর দ্বন্দ্বে উচ্চবর্গের মিথবিশ্বাস নিম্নবর্গের মিথবিশ্বাসকে হ্যাটা করতে থাকে। ইলিয়াস ১৯৯৬ সালে লেখেন উপমহাদেশের সবচেয়ে সংকটময় সময়ের দলিল – ১৯৪৬-৪৭-৪৮ আর আঠার শতকের শেষভাগের মধ্যে ‘ভূতুড়ে’ আদানপ্রদান চলতে থাকে। প্রতিরোধেরও। বৈকুণ্ঠ বৈরাগী, কেষ্ট পাল, কেরামত আলিরা পাকুড়গাছের বিশ্বাস আর মুনসির ভূত আর ভবানী সন্ন্যাসীর মিথ আর পাওনা শোলোকের বিশ্বাসে ভর করে উচ্চবর্গের চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসের পাল্টা প্রস্তাব হাজির করে। ইলিয়াসের খোয়াবনামা। চিলেকোঠার সেপাই-তে আধুনিকমনস্ক, যুক্তিবাদী আনোয়ার বৈরাগীর ভিটের সামনে গিয়ে তত্ত্বের খেই হারিয়ে ফেলে। ইলিয়াস জোর করে আধুনিকতা চাপিয়ে দেননি জালাল মাস্টারদের ওপর। তাঁদের মিথে প্রতিরোধ থেকে যায় আর ভীতু যান্ত্রিক যুক্তিবাদের থেকে তা শোষণমুক্তির সংগ্রামে বেশি কার্যকরী হয়ে ওঠে।

আরো পড়ুন স্বর্ণ ডাইনী: তারাশঙ্করের জীবন থেকে তুলে আনা চরিত্র

মহাশ্বেতা দেবী মিথের জগৎ গড়ে তোলেন। বসাই তার ষষ্ঠবার মৃত্যু পেরিয়েও বেঁচে উঠতে পারে। বিরসা ঘোষণা করে দেন যে, “মানুষ হয়ে ফিরে আসব হে আমি, নতুন ধরতি গড়ে নিব… যে মুণ্ডাটা ফের উলগুলানের কথা বলবে, তারে আমি বলে চিনে নিবি”। শিবন, সালীরা তাদের আজন্মলালিত মিথবিশ্বাস এবং অলৌকিক-অসম্ভবে বিশ্বাস থেকে বিরসার ছাই জঙ্গলে উড়িয়ে দেয়। তাঁদের প্রত্নচৈতন্যে, বসাই টুডুর সহযোদ্ধা সাঁওতালদের প্রত্নচৈতন্যে ‘নায়ক আদিরূপ’ বারবার ফিরে আসে। তবে, আদিরূপধর্মী চিত্র-প্রতীক নিশ্চল হয়ে থাকে না তথা মিথ-বিশ্বাস-মগ্নচৈতন্য অভিমুখহীন থাকে না। মুণ্ডাদের বহুযুগব্যাপী শোষিত হওয়া, তাদের অনাহার, তাদের আর্থরাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নায়ক-আদিরূপের (Hero-archetype) প্রতীকগুলিকে প্রতিরোধের প্রতীকে রূপান্তরিত করে। মহাশ্বেতা বিরসাকে ‘মডার্ন ম্যান’ হিসাবে দেখছেন। তার অরণ্যচেতনার সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল এবং দ্রোহপদ্ধতিতে মুখফেরতা আখ্যানবিশ্বের মিশেল তাকে ‘মডার্ন ম্যান’ করে তুলেছে বলে মহাশ্বেতার বিশ্বাস। বিরসা যে ভাষায় কথা বলে মুণ্ডা জনজাতির মানুষের মনে দ্রোহসঞ্চার করে, সেই ভাষা ‘ধরতি আবা’ বা বিশ্বপিতার ভাষা – মিথের সঙ্গে রাজনৈতিক ভাষ্য মিলে যায়। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক আখ্যান হয়েই সীমাবদ্ধ থাকে না, ব্যক্তিসত্তা কীভাবে সময়ের গতিপথে আত্মবিনির্মাণ করে নেয়, তারও হদিশ দেয়। বিরসার মধ্যে যখন ‘ভগবানত্ব’ সঞ্চারিত হয় তথা নিপীড়িত জনজাতির মুক্তিপথের উদগাতা হয়ে ওঠে সে, তখন প্রতিরোধের বয়ান তার একক বাচন থাকে না; তা সামূহিক বাচন হয়ে ওঠে।

#

এই লেখাটা লিখছি সেই ‘বাবু’দের প্রমিত ভাষায়। বাবুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে। বাবুদের এঁচে দেওয়া তত্ত্ব দ্বারা খিজির, তমিজ, বসাই, ধৌলি, পিরথাদের নির্মাণ কতটা ‘ঠিক’ হল, তার বিচার করছি। আখ্যানে তারা কতটা ঠিক, নীতিমাফিক তা নিয়ে নিজের স্বস্তিক্ষেত্রে বসে দু লাইন লিখছি। হাড্ডি খিজির হয়তো স্ক্রু-ড্রাইভার আর প্লায়ার হাতে দাঁড়িয়ে বলবে, ওসব তত্ত্বের মায়েরে বাপ। বসাই টুডু এসে হিসাব চাইবে এখনো কেন আদিবাসী ক্ষেতমজুরদের ওপর শোষণ শেষ হল না। তার “রগচটা”, “হিংস্র ভঙ্গিতে বাতাসের গলা মোচড়ানো” ভঙ্গিতে প্রশ্ন করবে। তবু জানি। তারা বলবে না। ওটাই পাঠকের স্বস্তিক্ষেত্র। লিখিয়ের স্বস্তিক্ষেত্র। ওরা কাল্পনিক পরিসরে থাকাই ভাল, ওদের গনগনে আঁচ বইয়ের নিরাপদ দূরত্ব থেকে নেওয়াই ভাল। ‘ওদের’ উপরে তৈরি হওয়া শোষণকাঠামো যাতে নিরন্তর থাকে, তার জন্য সম্মতি দিচ্ছি আমরাই। কখনও যৌথবাহিনী ডেকে, কখনও ইউএপিএ দিয়ে, কখনও আইন বানিয়ে বসাইদের এনকাউন্টার করাচ্ছি, দোপ্‌দিদের ধরিয়ে দিচ্ছি, শম্ভ সিংদের হাপিশ করে দিচ্ছি। ‘ওরা’ রেগে উঠলে, অ্যাকশন নিলে আমাদের প্রমিত ভাষায় ঠিক-ভুল বিচারে বসছি। আমাদের তুলতুলে নীতি-মূল্যবোধে, বিকৃত আধুনিকতায় ‘ওদের’ অগ্রসরতা, ওদের সংস্কৃতি সাজিয়ে নিচ্ছি। এটাই মূলস্রোত। এটাই আমাদের এঁচে নেওয়া সাহিত্যের মূলধারা। ওইজন্যেই মহাশ্বেতা, ইলিয়াসদের মত সাহিত্যিকদের প্রয়োজন হয়। উপমহাদেশের প্রখর বাস্তবতায় শ্রেণিশোষণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বৈষম্যের শোষণকাঠামো। এটিকে চিনতে না পারলে সৎ বিপ্লব চেষ্টায় গলদ থাকে। এই ভাষা আত্মীকরণ না করলে সাহিত্যের ভাষা রুগ্ন হয়ে যায়। ধর্মবিদীর্ণ উপমহাদেশের ধর্মগ্রন্থ খোয়াবনামা। আর্থসামাজিক বৈষম্যের ভারতকোষ ‘অগ্নিগর্ভ’। ভারতকে চিনতে গেলে এবং অধুনা বাংলাদেশের নির্মাণ বুঝতে গেলে এই দুজনের লেখা অবশ্যপাঠ্য।

ইলিয়াসের সঙ্গে মহাশ্বেতার একটা বড় তফাত প্রকাশিত লেখার পরিমাণে। স্বল্পায়ু ইলিয়াস মাত্র দুটি উপন্যাস এবং বাইশটি গল্প লিখেছিলেন। গ্রন্থিত। মহাশ্বেতা দেবীর সম্পূর্ণ গ্রন্থিত লেখা বোধহয় কুড়িটি রচনাবলীতে রয়েছে। কিন্তু, মহাশ্বেতা বিরল উদাহরণ, যিনি গুণগত ও পরিমাণগত সামঞ্জস্য দারুণভাবে বজায় রেখেছেন। মহাশ্বেতার এত লেখা কিন্তু ‘বাজে লেখা’ বলে কোনোটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করার ধক এঁদের দুজনেরই ছিল। তর্কের খাতিরে বলা যায় যে, আরো অনেকেরই সেই জোর ছিল। কিন্তু, তর্কের মীমাংসায় পৌঁছলে সাহিত্যে এঁদের ধকটা আরেকটু বেশিই চোখে পড়ে। বিশ্বসাহিত্যের ‘সেরা’ স্বীকৃতি যদি নোবেল হয়, তাহলে সেই পুরস্কার এক শতাব্দীরও বেশি সময় বাঙালি পায়নি। উপমহাদেশের কেউই পাননি। ইলিয়াস ও মহাশ্বেতার সাহিত্যের নতুন নতুন পাঠ আবিষ্কার করতে গিয়ে মনে হয়, এঁরা দুজন পেতে পারতেন। নোবেল কমিটির দুর্ভাগ্য যে তারা মহাশ্বেতা এবং ইলিয়াসের সাহিত্যব্যাপ্তি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে গেল।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।