সৌরীন ভট্টাচার্য বাংলায় গ্রামশি চর্চার ইতিহাস লিখতে বসে বলেছিলেন, এমনিতে মার্কসবাদ চর্চায় প্রবল উৎসাহী বাম-বাঙালি যদি কোনো প্রথম শ্রেণির মার্কসবাদী তাত্ত্বিককে দীর্ঘকাল উপেক্ষা করে থাকে, তাহলে তিনি হলেন আন্তোনিও গ্রামশি। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ। বিংশ শতকের তিনের দশক থেকেই বাংলা ভাষায় মার্কসবাদ চর্চার ক্ষেত্রে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। পরবর্তীকালে কিছুটা ভাঁটার টান লক্ষ্য করা গেলেও চার ও পাঁচের দশকে যথেষ্ট আলোচনা ও চর্চা হয়েছে স্তালিন এবং মাওয়ের লেখাপত্র নিয়েও। এমনকি বাংলা ভাষায় মূলধারার মার্কসবাদী চর্চায় বহুলাংশে ব্রাত্য থাকলেও ট্রটস্কি ও তাঁর মতবাদ নিয়ে চর্চা একেবারেই হয়নি এমন নয়।

সেই তুলনায় মাতৃভাষায় গ্রামশিকে নিয়ে পড়ার সুযোগের জন্য বাঙালিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। রমাঁ রলাঁ রচিত গ্রামশি সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ ১৯৪৬ সালে অনুবাদ করেন সরোজ দত্ত। তবে এটি কোনো মৌলিক লেখা ছিল না। গ্রামশির কোনো বই, সে বাংলায় হোক কি ইংরেজিতে, তখনো বাঙালির হাতে আসেনি। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শেষ অবধি। ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই ভারতের পাঠকরা প্রথম গ্রামশির রচনার সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদে পরিচিত হন লুইস মার্ক সম্পাদিত দ্য মডার্ন প্রিন্স অ্যান্ড আদার রাইটিংস-এর মাধ্যমে। সৌরীন ভট্টাচার্যের মতে ভবানী সেন পরিচয় পত্রিকায় এই বইয়ের যে সমালোচনা লেখেন, সেটিই বাংলা ভাষায় গ্রামশি বিষয়ে প্রথম মৌলিক লেখা। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেইনস্ট্রিম পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘দ্য থটস অফ গ্রামসি’ নামে অধ্যাপক সুশোভন সরকারের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ। এই লেখাটিতেই গ্রামশির জীবন ও চিন্তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ছিল। এরপর থেকে ক্ষীণ ধারায় হলেও বাংলায় গ্রামশি চর্চা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে চর্চা বাড়লেও গ্রামশি এই কালপর্বে সীমাবদ্ধ হয়ে রইলেন মুষ্টিমেয় পণ্ডিত মানুষের বিদ্যায়তনিক আলোচনার মধ্যেই। মার্কসবাদ নিয়ে জানতে আগ্রহী সাধারণ বাঙালির কাছে তিনি রয়ে গেলেন কার্যত অজানাই। এর মূল কারণ ছিল গ্রামশিকে নিয়ে ভাল বাংলা বইয়ের অভাব।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই অভাব পূরণ করতেই আশির দশকের শেষে এগিয়ে এলেন মার্কসবাদী চিন্তক এবং দ্য মার্কসিস্ট রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক অজিত রায়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পার্ল পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত আন্তোনিও গ্রামসি – জীবন ও তত্ত্ব। অজিত রায় মার্কসবাদী তত্ত্বে সুপণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু এই গ্রন্থকে তিনি তাঁর সেই পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করেননি। দ্য মার্কসিস্ট রিভিউ অথবা ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় তিনি যাঁদের উদ্দেশ্য করে লিখতেন, তাঁদের উদ্দেশে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেননি। গ্রন্থের ভূমিকাতেই বলেছেন “গ্রামসির সঙ্গে বাংলাভাষী মার্ক্সবাদী কর্মীর প্রাথমিক পরিচয়ের সীমিত উদ্দেশ্যই এই প্রচেষ্টার প্রেরণা, গ্রামসি সম্পর্কে এ দেশে (প্রধানত ইংরেজিতে) যে মূল্যবান আলোচনা চলছে, তাতে অংশগ্রহণ নয়। বিজ্ঞ পাঠককে যদি এই প্রয়াস নিরাশ করে, এই লেখকের কাছে তা একটুও অপ্রত্যাশিত হবে না।”

ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠা জুড়ে গ্রন্থের মূল বক্তব্য লেখক তুলে ধরেছেন দুটি ভাগে। প্রথম ভাগে রয়েছে গ্রামশির একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী (‘জীবন কথা: জন্ম-পরিণতি-মৃত্যু’) আর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে গ্রামশির চিন্তাধারার আলোচনা (‘গ্রামসির তাত্ত্বিক চিন্তা’)। প্রথম ভাগে ৪৪ পাতায় গ্রামশির যে সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখক তুলে ধরেছেন, তাতে আলাদা করে কোনো অভিনবত্ব নেই। তবে সহজ সরল ভাষায় গ্রামশির জন্ম, দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা, রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি গঠন, ফ্যাসিবাদী আমলে কারাবাস এবং মৃত্যুর বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর সুদৃঢ় নৈতিক চরিত্রও লেখক এই অংশে তুলে ধরেছেন। কিভাবে গ্রামশি কারাগারে বসে তাঁর বিখ্যাত ডায়রি লিখলেন, আছে তার বিবরণও। গ্রন্থের মূল আকর্ষণ হল এর প্রায় পঞ্চাশ পাতার দ্বিতীয় ভাগ। গ্রামশি তাঁর মতবাদ তুলে ধরেছিলেন ইতালির ঐতিহাসিক, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে। লেখক অত্যন্ত নিপুণভাবে সেই প্রেক্ষিতটুকু একেবারেই বাদ দিয়ে, কোথাও কোথাও যেখানে একান্ত প্রয়োজনীয় সেখানে স্বল্প কথায় উল্লেখ করে সহজ বাংলায় গ্রামশির চিন্তাধারার মূল কথাগুলি ছেঁকে নিয়ে পাঠকের সামনে সাজিয়ে দিয়েছেন। এ অত্যন্ত দুরুহ কাজ। ‘আধিপত্য’ কাকে বলে ? ‘জৈবিক বুদ্ধিজীবী’ কী? বিভিন্ন শ্রেণি কীভাবে ‘ঐতিহাসিক ব্লক’ গঠন করে ? কাকেই বা বলে ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’? ‘অবস্থায়ী’ ও ‘চলিষ্ণু’ সংগ্রাম কী এবং তা কীভাবে পরিচালনা করতে হয়? গ্রামশির চিন্তা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পেতে হলে একজন পাঠকের যে মূলগত প্রশ্নগুলির উত্তর জানা প্রয়োজন, সবকটিই অজিত রায় সরল গদ্যে তুলে ধরেছেন। জীবন ও তত্ত্ব – এই দুই অংশ ছাড়াও পরিশিষ্ট হিসাবে গ্রন্থটিতে সংযোজিত হয়েছে শক্তি রাহার অনুবাদে গ্রামশির ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার নিয়ে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আলেজান্দ্রো নাটার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার।

আরো পড়ুন গণতন্ত্র বনাম গেরুয়া ভারত: দোলাচলহীন দার্ঢ্যের উচ্চারণ

লেখক সূচনাতেই বলেছেন, এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য হল মার্কসবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে গ্রামশি ও তাঁর চিন্তা সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে তোলা। সেদিক দিয়ে এই গ্রন্থ সার্থক। লেখকের ভাষা অত্যন্ত সহজ। বিশেষ করে গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে গ্রামশির অনেক জটিল ও কঠিন তত্ত্বকে তিনি যেভাবে সহজ ভাষায় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন তা গ্রামশির ভাবনার উপর তাঁর অসাধারণ দখলেরই পরিচায়ক। গ্রামশির জীবন নিয়ে বর্তমানে বাংলায় বেশ কয়েকটি ভালো বই আছে। প্রচুর পত্রপত্রিকাতেও তাঁর জীবন নিয়ে বাংলায় লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু যে সরল ভাষায় রায় গ্রামশির তত্ত্ব এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন তা সত্যিই তুলনারহিত। গ্রামশির তত্ত্বের গভীরতর আলোচনার অভাব এবং লেখকের সচেতনভাবেই পাদটীকার ব্যবহার পরিত্যাগের কারণে হয়ত পণ্ডিতদের কাছে এই গ্রন্থ খুব উৎকৃষ্ট মনে হবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গ্রামশিকে নিয়ে বিদ্যায়তনিক গ্রন্থ লেখা লেখকের উদ্দেশ্য ছিল না। ছিল গ্রামশি ভাবনাকে বাংলা ভাষায় সাধারণ মার্কসবাদী রাজনৈতিক কর্মী ও মার্কসবাদ নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী পাঠকদের নাগালে নিয়ে আসা। সে কাজে তিনি সম্পূর্ণ সফল।

দুঃখের বিষয়, অত্যন্ত জরুরি হলেও দীর্ঘদিন ধরেই এই গ্রন্থের মুদ্রণ বন্ধ হয়ে ছিল। আনন্দের বিষয়, অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য এবং অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্তের সম্পাদনায় নতুন ভূমিকা সহ সেরিবানের প্রকাশনায় আবার আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে অজিত রায়ের আন্তোনিও গ্রামসি: জীবন ও তত্ত্ব। সেই উপলক্ষে আগামী ১৬ জানুয়ারি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দ হলে সেরিবান ও সেন্টার ফর মার্কসিয়ান স্টাডির উদ্যোগে ‘গ্রামশি আজ’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়েছে। এই গ্রন্থের পুনঃপ্রকাশ যদি সহজপাঠ্য ভাষায় গ্রামশির চিন্তাকে বাংলার মার্কসবাদী চর্চায় উৎসাহী মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারে, তাহলেই লেখকের কাঙ্খিত উদ্দেশ্য সাধিত হবে, এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

*এই লেখায় বইয়ের নাম এবং উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে পুরনো বানান ‘গ্রামসি’ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.