রণিতা চট্টোপাধ্যায়
অধিকাংশ পাঠকের কাছে সব চিনেম্যানের মতো সব মহিলা কবিও আদতে একইরকম। যেন একে অন্যেরই ডপলগ্যাঙ্গার। প্রত্যেকের নিজস্ব স্বর, নিজস্ব উচ্চারণকে চিহ্নিত করার বদলে সকলকে ‘মহিলা কবি’-র খাঁচাটিতে পুরে দিতে পারলেই আপাত স্বস্তি। এক কবির সঙ্গে আর একজনকে অনায়াসে গুলিয়ে ফেলা দেখতে দেখতে এমনটাই মনে হয়েছিল নবনীতার। আর কেবল পাঠক কেন, সম্পাদকদের কাছেই বা কতটুকু গুরুত্ব ছিল সেই কবি পরিচয়ের? নবনীতা নিজেই জানিয়েছেন, কোনো গদ্য রচনার জন্য তাগাদা দিয়ে বিফল হওয়ার পর অনেক সম্পাদকের বক্তব্য ছিল, “আচ্ছা, তাহলে নাহয় একটা কবিতাই দিন?” গদ্যের সুরসিক লেখিকা এখানেই খানিক খেদের সুরে বলেছিলেন, একটি ছোট্ট কবিতার পিছনে যে আসলে আরও বেশি ভালোবাসার শ্রম থাকে, সে কথা এঁদের নজর এড়িয়েই যায়। অবশ্য, নবনীতা সংকোচে এ কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কেবল বাইরের জগতই নয়, নিজের কবিসত্তাটিকে কখনো কখনো হেলাফেলা করেছেন তিনিও। বিশেষত প্রথমবার বিদেশে যাওয়া, তারপরেই বিয়ে, দাম্পত্য আর মাতৃত্বের স্বাদ, পড়াশোনায় যাযাবর হাঁসেদের মতো বাসা বাঁধা, সব মিলিয়ে জীবনের উচ্ছ্বাসে কবিতা ভেসে গিয়েছিল। তিনি লিখছেন, “এতই নেমকহারাম আমি যে, জীবন আর কবিতার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বললে প্রত্যেকবারই বলবো- জীবন চাই। যদিও বেশ জানি জীবন বিশ্বাসঘাতক, শেষ আশ্রয় কবিতাই। কবিতা ঠকায় না।” (প্রথম প্রত্যয়/ নটী নবনীতা) আর তাই হয়তো, কবিতার সঙ্গে মনে মনে একরকম বোঝাপড়া ছিল তাঁর। নিত্যদিনের যোগাযোগ থাক বা না থাক, অন্তর্লীন এক আদানপ্রদান শুশ্রূষা জোগাত তাঁর ক্ষতচিহ্নগুলিতে। ‘মনের মানুষ’ কবিতায় যার খোঁজ জেগে ওঠে, সে কি কোনো ব্যক্তিমানুষ, নাকি সে তাঁর অন্দরের এই সত্তাই?
মনে মনে সারাদিন দেখা, মনে মনে নিত্য সহবাস
সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকি, সারাদিন কথা বলি…
খুব ঝগড়া, খুব যত্ন, মনে মনে আদর টাদর
সারাদিন সারারাত আজীবন নিখিল বিস্তার—
মনে মনে মনের মানুষ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
যা কিছু শূন্যতা, অন্তরে তাকে পূর্ণ করে পাওয়ার এই আয়োজনকে বৈষ্ণব কবিরা বলেছিলেন ভাবসম্মিলন। আর নবনীতা হয়ত একেই বলেন তাঁর প্রথম প্রত্যয়। সব না-পাওয়ার রং পেরিয়ে এই সঙ্গই তাঁকে পৌঁছে দেয় দারুচিনি দ্বীপের ভিতরের সেই সবুজ ঘাসের দেশে। তাই কবিতার অক্ষরে বারবার যাওয়ার কথা বলেন তিনি—
বাড়িটি হয়ে গেল দুঃখ রং
বাড়িতে ফিরবো না, নাও ফেরাও
অন্য দেশে বও, মন-পবন। (দুঃখ রঙের বাড়ি)
সে যাওয়া হয়ত নিজের মনের ভিতরের সেই ‘আমি’-র কাছেই। সবার চোখের আড়ালে, একান্ত গোপনে যার ঘরবসত। তাঁর স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, “বহির্ভুবনে আমার যে ভূমিকা, তার সঙ্গে আমার অন্তর্লোকের ভূমিকাটির প্রায়ই যোগ থাকে না।” আর এই স্বীকারোক্তিই বোধহয় ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়,
জলের অনেক নীচে খেলা করি, শর্তহীন, একা
সেইখানে পৌঁছবে না খাজনালোভী সমাজ পেয়াদা
জলের অনেক নীচে সৌজন্যের দুঃখ সুখ নেই
কবিতায় গিয়ে যেন খুলে যাচ্ছে ভিতরমনের চোরকুঠুরি। সরে যাচ্ছে সব আবরণ। সামাজিকতার শর্ত বজায় রেখে ক্ষত গোপনের প্রয়োজন থাকছে না আর। সেই সাজিয়ে তোলা, বানিয়ে তোলা পরিসরটিকেই প্রত্যাখ্যান করছে এই পংক্তিগুলি,
হৃৎপিণ্ড কোনোদিন ছিল কি ছিল না—
কৈফিয়ৎ অদরকারি। সব কিছু পেয়েছিলে, যা-কিছু
আমার বুকে ছিল। বিনা প্রত্যাশায় আমি
নিরাকার প্রিয়মন্যতায় পকেট ভরিয়ে নিয়ে
এইবারে দ্বীপে চলে যাব। (দ্বীপান্তরী)
গদ্যে যিনি ক্ষুরধার তর্কে, শানিত যুক্তিতে মুখর, কবিতায় তাঁর ফেরার পালা। যা কিছু বিনিয়োগের প্রাপ্তি ঘটেনি কোনো, নিজের সেইসব অংশগুলিকে কুড়িয়ে আনার আয়োজন। যা দিয়ে রচিত হবে অন্যতর এক ভুবন, একান্ত নিজস্ব এক দ্বীপ। “সব আলো ফিরে দাও, সব রং, সকল উত্তাপ/ আমি সব বেঁধে নিয়ে আরেক আকাশে যাব আজ”, এ ঘোষণাও তাঁরই। কিন্তু নবনীতার এ ঘোষণা যতখানি উচ্চকিত, তার চেয়ে অনেক বেশি স্থিতধী। না, কবিতার ব্যাখ্যায় কবির ব্যক্তিগত জীবনের অনুষঙ্গকে টেনে আনা একরকম অবান্তর বলেই মনে হয়। কিন্তু এটুকু বলা যেতেই পারে, যে, এ উচ্চারণ এক আত্মস্থ মানুষের। তাঁর চলে যাওয়ার ঘোষণায় অল্প একটু বেদনা লেগে রয়েছে, কিন্তু দ্বন্দ্বের কোনো ছাপ নেই। জীবনের যা কিছু অসংগতি, তার উপরে পরম মমতায় সামঞ্জস্যের আস্তরণ বিছিয়ে দিয়েছে কবিতাই, এমন এক প্রত্যয় ছিল কবি নবনীতা দেবসেনের। তাই কবিতায় লগ্ন হয়ে থাকা তাঁর কাছে অবাঞ্ছিত জীবন থেকে মুখ ফেরানো নয়, বরং নিজের জীবন-আসক্তির সঙ্গেই কবিতাকে জুড়ে নিয়েছেন তিনি। বেকার ছেলে আর ব্যর্থ প্রেমিকের পদ্য লেখার প্রাচীন প্রবাদ অরণ্যে যতই জনপ্রিয় হোক, নবনীতার নিজস্ব গহিনে তার প্রতি সপাট প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কিছু নেই — “শুনি, কবিতা নাকি পলায়ন। অথচ আমি তো দেখি কবিতাই স্থিতি। আমার জীবনের প্রথমতম প্রত্যয়। পায়ের তলা থেকে যতবারই মাটি কেড়ে নিয়েছে জীবন, ঠেলে দিয়েছে একটা হিম-হিম অন্ধকার গর্তে, কবিতা ততবার এসে হাত ধরেছে, টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে শক্ত জমির ওপরে। আলোয়, উষ্ণতায়।” আসলে, কবির ব্যক্তিগত দিনলিপিকে বাদ দিলেও, কবিতার টেক্সটকে বুঝে নিতে চাইলে সবচেয়ে ভালো রেফারেন্স হয়ে উঠতে পারে কবির নিজস্ব লেখালিখির ভুবনটিই। আর তাই, এ লেখায় বারেবারেই ফিরে যেতে হবে নবনীতার বিভিন্ন লেখার কাছেই।
নবনীতা দেবসেন যখন লেখালিখির জগতে পা রাখছেন, তার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই সেই দুনিয়ায় এক নিরন্তর ভাঙচুর হয়ে চলেছিল। তিনের দশকে রবীন্দ্র-প্রভাবকে অস্বীকার করে যখন নিজস্ব অভিজ্ঞান খুঁজে পেতে চাইলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ, এবং সর্বোপরি জীবনানন্দ দাশ, তখন থেকেই সেই ভাঙাগড়ার সূত্রপাত। দেশের অন্দরে স্বাধীনতার লড়াই আর দুর্ভিক্ষ-অনাহার-মৃত্যুর ছবি, অন্যদিকে দেশের বাইরে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের দগদগে ঘা আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির বদলে যাওয়া সমীকরণ, নবনীতার লিখতে আসার আগেই গোটা পৃথিবীর রং বদলে গিয়েছিল। এর সঙ্গে চিন্তার জগতে ঝড় তুলেছিল ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্ব আর মার্কসের সামাজিক সমানাধিকারের ধারণা। এর পাশাপাশিই, এই সমানাধিকারের জগতে নিজেদের অবস্থানটিকে চিনে নিতে চাইছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ কিংবা সিমোন দ্য বোভোয়ারা। যেখান থেকে তৈরি হয়েছিল এক নতুন ডিসকোর্স, নারীবাদ বলে যাকে চিহ্নিত করবে বিশ্ব। নবনীতার সচেতন কবিতাযাপনের একদিকে রয়েছে এই পটভূমি, আরেক দিকে তাঁর কবিতাবিশ্বকে আরেকভাবে নির্মাণ করেছে তাঁর ব্যক্তিগত পরিসর। কেমন ছিল সেই অন্দরের ছবি? কবিদম্পতি নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণী দেবীর সন্তান নবনীতা নিজের কবিতা লেখার প্রসঙ্গে বলছেন, “এক কবির গর্ভে আরেক কবির ঔরসে আমার জন্ম। অক্ষরের জগৎটাই যার ভিটেমাটি, ঘরসংসার, সে আর কবিতা লিখবে না কেন? যেমন আমার গাছে-চড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, কাগজের নৌকো গড়া, তেমনিই আমার কবিতা লেখা। কবিতা আমার জীবনে আক্ষরিক অর্থেই সহজ।” হ্যাঁ, সহজভাবেই এই যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর কৈশোরে, বছর বারো বয়সে ভারতবর্ষ পত্রিকার পাতায়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের হাতে বাছাই হয়ে নবনীতার কবিতা একের পর এক ছাপা হয় পূর্বাশা, উত্তরা, একক, শতভিষা, এমনকি দেশ পত্রিকাতেও। ষোলো বছর বয়সে লেখা ‘রাতের রেলগাড়ি’ কবিতার নাম মা বদলে করেছিলেন ‘চলচ্চিত্ত’। প্রেমেন্দ্র মিত্রের বেছে দেওয়া সেই কবিতা দেশ থেকে মনোনীত হওয়ার সংবাদ এসেছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত নীল পোস্টকার্ডে। আর কবিতা পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর হাতে নবনীতার কবিতার খাতা পৌঁছায় তাঁর পাড়ার বন্ধু, বু.ব-র ছোট মেয়ে রুমির হাত দিয়ে। অতঃপর সেখানে বসেই দুটি কবিতা কপি করে দেওয়ার নির্দেশ এবং এইভাবেই কবিতা পত্রিকায় নবনীতার আত্মপ্রকাশ। কিন্তু সবকিছুই কি এতখানি সহজ ছিল কবির নিজের কাছেও? ছিল না যে, সে কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন নবনীতা, “এতৎসত্ত্বেও একটি কবিতা লিখতে আমার সময় লাগে অনেক। পরিশ্রম হয় প্রচুর। কবিতা কষ্টসাধ্য। সুখদা নয় মোটেই, স্বয়মাগতা হলেও না।” আর এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার নেপথ্যে থাকা নির্মাণের ভাষ্য। নবনীতার কৌশল এখানেই যে, সেই কারুকৃতিকে তিনি গোপন করে রাখতে জানেন। তাঁর কবিতা সরল, কিন্তু তরল নয় আদপেও।
এসো ভালোবাসা, বোসো এইখানে সোফাতে—
চা খাবে? পাখাটা বন্ধ করে দি? জানলা?
শরীর গতিক ভালো তো? চাকরিবাকরি?
তারপর? বড়ো শীত পড়ে গেল অকালে।
একান্ত আটপৌরে সুর। কোনো আত্মীয় বা বান্ধবের মতোই কুশলসংবাদ জেনে নেওয়া। আর সেই আন্তরিক আলাপচারিতার সূত্র ধরেই এই কবিতার যাত্রা আরও গভীরের দিকে। আসলে গদ্যের মতই, নবনীতার কবিতাকেও অনেক সময়েই ঘিরে থাকে এক অন্তরঙ্গ আলাপনের আবহ। অথচ সেই ছদ্মবেশের আড়াল সরালেই তাঁর কবিতা উড়াল দেয় অন্যতর এক মাত্রায়।
কে অন্যের ঘর ভাঙতে জানে?
এমন নিটোল মুক্তো
ঘরের মতন
এত অভঙ্গুর সত্য
স্পর্শ করে এত শক্তি কার ধমনিতে।
কে অন্যের ঘর গড়তে জানে?
যার যার নিভৃত কুঠুরি
তরঙ্গে তরঙ্গে গড়ি রেশমি
একান্ত স্বগত
পোকার মতো একা
অবিকল্প
স্বয়ংকেন্দ্রিক।
সেই ব্যক্তিগত ঘর যদি ভেঙে যায়—
নিশ্চয় নিজের হাতে শাবল চালিয়ে
খিলেন ভেঙেছো। খিলেনের চাবির পাথর
যে গড়েছে, শুধু তার চেনা।
নতুবা, পিত্তের দোষ দিয়ো।
অন্যে-পরে পারে না এসব।
আর পারে, কেবল দেবতা। (অভঙ্গুর)
আসলে নবনীতার কবিতায় আক্ষরিক অর্থ অনেক সময়ই রেড হেরিংয়ের মতো। কবিতার শিরোনামে, কিংবা অক্ষরে অক্ষরে আপাত চোখে যে অর্থ ধরা পড়ে, তার অন্তরালে রয়ে যায় অন্যরকম এক সম্ভাবনা। যেমন ধরা যাক রক্তে আমি রাজপুত্র কাব্যগ্রন্থের ‘ম্যাজিকওয়ালা: ২৫ বৈশাখ ১৩৯৫’ কবিতাটি।
কেউ যে কখনো কাউকে রূপনারায়ণ
দেখাবে, এটাতে আর আশ্চর্য কি আছে
কেউ তো কখনো কাউকে রূপনারায়ণ
দেখাবেই যতদিন পৃথিবীতে রূপনারায়ণ
এমন নামের কোনো মুগ্ধ নদ আছে…
তুমি যে সবার আলো সমস্ত ম্যাজিক
একাই দেখিয়ে গেছো, অবাক আমাকে—
রূপনারানের কূলে সেই থেকে জেগে বসে আছি
একা একা খেলা করি মেঘ-ছেঁড়া আলোর প্রবাসে।
এ কবিতার শিরোনামে পঁচিশে বৈশাখের অনুষঙ্গ থাকলেও, তাকে ছাপিয়ে এক আশ্চর্য উচ্চারণে পৌঁছে গিয়েছে এই পংক্তিগুলি। একইরকম অলীক এক সম্ভাবনাকে ধারণ করে রয়েছে তুমি মনস্থির করো বইয়ের ‘উৎসর্গপত্র’। ছোট ছোট আঁচড়ে এই বইয়ের সমস্ত শরীর জুড়ে অনুভূতি বুনেছেন নবনীতা, যার শেষ গন্তব্য ওই উৎসর্গের পাতায়—
এইখানে দস্তখত করি
এই কালো মেঘের তলায়।
এই চিঠি তোমাকে আমার।
অর্থাৎ, এই পাঠের সূচনায় কোনও প্রস্তুতির অবকাশ দিচ্ছেন না তিনি। কিন্তু যাত্রার শেষে এক বিন্দু মুক্তোর মতো ঘনিয়ে উঠছে সমগ্র অনুভূতির সারাৎসারটুকু, আর সেখান থেকেই শুরু হতে পারে এক উজান-যাত্রা। যেখানে শেষ, সেখান থেকেই যে ফিরে পড়ার সূচনা, সেই অনুভবের অভিজ্ঞান হয়ে থাকছে ওই শেষ অক্ষরগুলি।
আরো পড়ুন আমাদের যা জীবন: চোমান হার্দির কবিতা
আসলে কেবল ব্যক্তিগত বিচ্ছেদ আর বেদনার সূত্র দিয়ে নবনীতার কবিতার সামগ্রিকতাকে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। তাঁর কবিতার ভাষা একক, কিন্তু এককের ভাষা নয়। একান্ত অনুভব থেকে তার উত্তরণ ঘটে গিয়েছে সামগ্রিকে। ধরা যাক ‘লায়নটেমারকে’ কবিতাটি। যে কবিতা শুরু হচ্ছে সার্কাসের পর্দা ওঠার সাসপেন্সকে ধরে রেখে, পরতে পরতে উন্মোচিত হয়ে তা এসে পৌঁছে যাচ্ছে এমন এক পরিণতিতে, যা শান্ত কিন্তু অমোঘ।
মনে থাকবে না? বাঃ! যতগুলো
চাবুকের দাগ, যত কালশিটে, সব
বাদামি চামড়ার নিচে ঢাকা।
খুব মনে আছে।
একবার সপাৎ শুনলে, দুইপায়ে খাড়া।
দু’থাবায় ভিক্ষে চাওয়া। সপাৎ-সপাৎ
শুনলে কেশর-টেশরশুদ্ধ শানের মেঝেয়
গড়াগড়ি, গড়াগড়ি, শীত-গ্রীষ্ম
নেই। তিনবার সপাৎ শুনলে? নির্দ্বিধায়
আগুনের ব্যূহের ফাঁদেও
চমৎকার ঝাঁপ দিই। আবার?
আবার-
মল্লিকা সেনগুপ্ত এই কবিতার আহত কোণঠাসা সিংহটিকে দেখছেন প্রতি রাতে মার খাওয়া মেয়েদের প্রতীক হিসাবে, যার মনে আছে “কানে কানে নেশাতুর আদুরে সপাৎ”। কিন্তু কবিতার শেষের পংক্তিগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে আর-এক কবি, রাকা দাশগুপ্ত মনে করছেন, কেবল কোনো একজন মেয়ে নয়, এ কবিতা হয়ে উঠতে পারে যে কোনো মানুষেরই কথন। “…রিংমাস্টার,/ ভুলিনি কিছুই। মনে নেই/ শুধু পূর্বনাম। মনে নেই/ অরণ্য কেমন?” এ তো অভিমানের কথা, যেখানে মিশে আছে অনেক দীর্ঘশ্বাস। উচ্চকিত ঘোষণা নেই, কিন্তু প্রতিটি অপমান মনে করে রাখাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এই পংক্তিগুলি।
তা বলে কখনো কি চড়া মাত্রায় পৌঁছয় না তাঁর স্বর? সেখানে অপমানের প্রত্যুত্তর দিতে নবনীতা হাতে তুলে নেন বিদ্রুপের শানিত আয়ুধ। কোথাও হয়ত মা রাধারাণী দেবীর শেখানো কাব্যকৌশল মনে রয়ে যায়, যে, কবিতা আসলে বক্তৃতা নয়, ব্যঞ্জনা। তাই সবকিছু বলে দেওয়ার ভোঁতা অস্ত্র নয়, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের আড়াল থেকে ঝিলিক দিয়ে ওঠে নবনীতার তীব্র শ্লেষ।
পুতনা তোমার সত্যি
কোনো দোষ ছিল না কখনো।
তুমি শুধু ভাড়া করা সামান্যা দানবী।
কী ক’রে জানবে তুমি, দেবশিশুদের
আকণ্ঠ রক্তে তৃষ্ণা?
সদ্যোজাত দেবতার ঠোঁটে
তীব্রতর বিষ! (পুতনার প্রতি)
স্পষ্টতই, এ কবিতা নারীর কবিতা। নারীর জবাব হয়ে ওঠার ভাষ্য। পৌরাণিক অনুষঙ্গকে এখানে নবনীতা ব্যবহার করেছেন পৌরাণিক দেবতার দৈবী মহিমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা হিংস্রতার মুখোশ খুলে দিতে, যে হিংস্রতা একান্তভাবেই ‘দেবতাসুলভ’ ধারণাটির পরিপন্থী। দেবতার রূপকের আড়ালে তাঁর নিশানা এখানে পিতৃতন্ত্রের দিকেই। তবে, নবনীতার কবিতায় তাঁর নিজস্ব এক নারী-স্বর আছে ঠিকই, কিন্তু সেই স্বরকে কেবল নারীবাদের আভিধানিক সংজ্ঞাতেও ধরা যাবে না। কৃত্তিবাস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নবনীতা দেবসেন স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন নারীবাদ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব রাজনীতিকে। জানিয়েছিলেন, “নারীবাদ আমার কাছে আলাদা কোনও ভাবনা নয়। আমার নিজের বিশ্বাস, মেয়েদের এবং পুরুষদের- উভয়েরই চোখ এই পুরুষতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দিয়ে তৈরি।… আমি তাই বলি যে নারীবাদ মেয়েদের ব্যাপার নয়, নারীবাদ বুদ্ধিজীবী মানুষের ব্যাপার।” এই সাক্ষাৎকারেই খুলে গিয়েছিল নারীবাদ সম্পর্কে তাঁর তাত্ত্বিক ধারণার অভিমুখ, যা বারেবারে তাঁর কবিতার নেপথ্যেও কাজ করে গিয়েছে। সেখানে তাঁর প্রতিবাদের অভিমুখ পিতৃতন্ত্রের দিকে, যে তন্ত্র আসলে যে কোনো ক্ষমতাকেন্দ্রেরই প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই ভাবনার নিরিখেই দেখা নেওয়া যাক ‘এসো, খোকাবাবু’ কবিতাটি—
এসো, খোকাবাবু
এই নাও, আমার মস্ত নীল বেলুনটা, এই হলদে তারা আঁকা
নীল বেলুনটা আমি তোমাকেই দিলুম।
তুমি তাতে আলপিন ফুটিয়ে দিয়ে ঝোড়ো হাসি হেসে ওঠো
আমি দেখি
এই নাও, বাদামী বাতাসার ঠোঙা আমার এই
মাটিজলের শরীর আমি হরির লুট দিলুম। কুড়িয়ে নিয়ে
মুখে পুরে দাও, কিংবা টালমাটাল পায়ে গুঁড়াও
আমি দেখি
এসো, খোকাবাবু
এই নাও, আমার সবুজ রঙের মার্বেলটা
আমার শস্যশ্যামলা মার্বেলটা
আমি তোমাকে দিলুম
তুমি খেলতে খেলতে ঢুকিয়ে দাও
যে কোনো গর্তে
এই কবিতা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো নারীবাদের কথা বলে, বলে পিতৃতন্ত্রের দায়হীন অসংযমের কথাও। কিন্তু তলিয়ে দেখলে তার ভিতর থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বহুস্তরীয় ব্যঞ্জনা। সম্প্রতি যশোধরা রায়চৌধুরী এ কবিতাকে পড়তে চেয়েছেন যোশীমঠের ভাঙনের প্রেক্ষিতে। হয়ত নিজের ক্ষমতাকে বারবার ঝালিয়ে নিতেই, যে কোনো কিছুকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায় ক্ষমতা। তা সে পরিবারের পরিসরে থাকা পিতৃতন্ত্র হোক, কি পুঁজির আধিপত্যই হোক কিংবা রাষ্ট্রের শক্তি। এই প্রেক্ষিতে ভাবলে আলোচ্য কবিতাটির গণ্ডি বেড়ে যায় আরও অনেকখানি। রাষ্ট্রের মত সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে ‘খোকা’-সুলভ দায়িত্বহীন নিষ্ঠুরতাকে মিলিয়ে দিয়ে নবনীতা সমস্ত প্রতিবাদকে কেন্দ্রীভূত করে তোলেন ওই ‘খোকাবাবু’ সম্বোধনটিতে।
আসলে গদ্যের স্পষ্টতায় যে বোধ সম্পূর্ণ আত্মপ্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ছিল, সেইসব না-বলা কথাদের কবিতায় খুঁজেছেন নবনীতা দেবসেন। কবিতার মধ্যে দিয়েই তিনি সেই পথ খুঁজেছেন, যা তাঁকে সমস্তরকম আড়াল সরিয়ে ‘আমি’ হয়ে উঠবার সুযোগ দেবে। কবিতাই তাই তাঁর ‘রাজার বাড়ি’, তাঁর অপরাজিত আয়ুধও।
নিবন্ধকার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক, পেশায় সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।