যোশীমঠে যা ঘটেছে তা এখন সকলেরই কমবেশি জানা। প্রায় সাড়ে ছশো বাড়ি, রাস্তা, মন্দিরে ফাটল এবং ধসের পর গোটা শহরটাকে বিপজ্জনক ও বসবাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। হিমালয়ের কোনো অখ্যাত গ্রামে এ ঘটনা ঘটলে হয়ত তা এরকম সাড়া ফেলত না। কিন্তু যোশীমঠ হল বদ্রীনাথ, হেমকুণ্ড সাহেব, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এবং আউলি স্কি রিসর্ট যাওয়ার প্রবেশদ্বার। তার উপর এর কাছেই স্পর্শকাতর চীন-ভারত সীমান্ত। অর্থাৎ ধর্ম (হিন্দু ও শিখ), পর্যটন, ট্রেকার এবং রাজনীতির চতুঃস্পর্শ। ফলে যাদের আমরা জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বলি তারাও এই নিয়ে বেশ আলোড়িত।
সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই খুললেই জানা যায় যে হিমালয় হল ভঙ্গিল পর্বত। সমুদ্র থেকে উঠেছে, এখনও বাড়ছে, দুটো মহাদেশিয় প্লেটের ঠোকাঠুকি তার নিচে চলছে। হিমালয় পর্বতমালা ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডের উত্তরে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার জুড়ে থেকে উত্তরে তিব্বত থেকে আসা ঠাণ্ডা শুকনো হাওয়াকে আটকায়, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুকে এদিকেই আটকে রেখে ভারত ভূখণ্ডকে বৃষ্টিস্নাত করে রাখে। হিমালয়ের দক্ষিণে থাকা ভারতীয় প্লেট ক্রমশই তিব্বতের প্লেটের তলায় ঢুকে তাকে এত উঁচু করে তুলেছে যে সেখানকার বাতাস গ্রীষ্মকালে চারপাশের চেয়ে বেশি গরম তথা হালকা হয়ে উপরে ওঠে এবং সেই জায়গা পূরণ করতে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে জল ভরা বাতাস ছুটে আসে, জন্ম নেয় মৌসুমি বায়ু। প্রচুর বৃষ্টিপাত, তুষার, গভীর নদীখাত, বরফ গলা জলে পুষ্ট নদী, এসবের কারণে এই হিমালয় অঞ্চলে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতে রয়েছে বিপুল বৈচিত্র্য। গোটা উপমহাদেশের সম্পদ এই হিমালয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এত কথা আমাদের জানা থাকা সত্ত্বেও ফের বলতে হয় মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, যোশীমঠ আজ যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন তা ঠিক কতখানি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ফল তা বোঝার জন্য।
২০১৩ সালে কেদারনাথে যা ঘটেছে তা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে শুরু হলেও, ফলাফল এত মর্মান্তিক হয়েছিল কারণ কেদারনাথ আর শুধু তীর্থক্ষেত্র নেই। কেবল পায়ে হেঁটে যেতে সক্ষম মানুষের ভিড় হয় না সেখানে। জায়গাটা হয়ে উঠেছিল এক পুরোপুরি পরিকল্পনাবিহীন ব্যবসাস্থল ও পর্যটনকেন্দ্র। ফলে বিপর্যয়ের ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় কয়েকশো গুণ। আমাদের কি মনে আছে, মনে থাকে সে কথা? এমন নয় যে যোশীমঠ বিপদসংকেত দেয়নি। ধৌলিগঙ্গা-ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা চলছিল, পাহাড়ের নিচে সুড়ঙ্গ কাটা হচ্ছিল, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, চারধাম মহাসড়ক প্রকল্প, সবকিছুই রমরমিয়ে চলছিল।
পাঠকদের কি মনে আছে চিপকো আন্দোলনের কথা? তেহরি বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনের কথা, যে আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা? উত্তরাখণ্ডের বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক নেতাদের জোট গাছ কেটে জঙ্গল ধ্বংস করছে, তাই গাছকে জড়িয়ে ধরো, “চিপকো”। এই ছিল আন্দোলনের বাণী। তেহরিতে গঙ্গার উপর বিশালকায় বাঁধ তৈরির ফলে কয়েকশো গ্রাম ডুবে যাবে, কয়েক হাজার মানুষ ভিটেছাড়া হবে, নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হবে – এ আমরা চাই না। এই বক্তব্য নিয়ে উত্তরাখণ্ডের মানুষ তেহরি বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনে নেমেছিল। এই দুটো আন্দোলনের অভিঘাতেই শক্তিশালী হয় উত্তরাখণ্ডের পৃথক রাজ্য হয়ে ওঠার আন্দোলন। বাইরের শক্তি এসে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জঙ্গল, নদী, পাহাড় ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাই পৃথক রাজ্য চাই – এই ছিল মূল দাবি।
অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্তরাখণ্ড হল। ২০০২ সাল থেকে সব বিধানসভা নির্বাচনেই হয় কংগ্রেস নয়ত বিজেপিই জিতেছে, স্থানীয় কিছু মানুষ ঠিকাদার এবং নেতা হয়েছে। কিন্তু সর্বভারতীয় পার্টি, কেন্দ্রীয় সরকার চালিত অর্থনীতির পরিধি ছেড়ে উত্তরাখণ্ড বেরোতে পারেনি। স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রভাবশালী শ্রেণিগুলো সর্বভারতীয় কর্পোরেট রাজনীতি-অর্থনীতির অংশীদার হয়ে গেছে। তাই উত্তরাখণ্ড রাজ্য গঠিত হলেও, যে চিপকো এবং তেহরি বাঁধ-বিরোধী বিকল্প রাস্তার স্বপ্ন দেখা গেছিল, তা এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে।

প্রায় দুবছর আগে ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে এক জলোচ্ছ্বাসজনিত দুর্ঘটনায় বহু শ্রমিকের প্রাণ যায়। অধিকাংশই বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া ঠিকা শ্রমিক, যাঁদের লকডাউনের সময় আমরা মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে বা হেঁটে ঘরে ফেরার চেষ্টা করতে দেখেছি। এই ঋষিগঙ্গা প্রকল্পের কিছু কাজ বেসরকারি সংস্থা করছিল, কিছুটা করছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি)। স্থানীয় মানুষ বারবার অভিযোগ করেছেন যে প্রকল্পের নামে নির্বিচারে গাছ কাটা চলছে। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন, শুনানি দীর্ঘায়িত হয়েছে। তপোবন-বিষ্ণুগড় প্রকল্পে পরিবেশ নীতি না মানার জন্য এনটিপিসির ৫৮ লক্ষ টাকা জরিমানা হয়েছে।
সেই কবে, ১৯৭৬ সালে, কেন্দ্রীয় সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছিল যোশীমঠ খুবই সংবেদনশীল প্রাকৃতিক ভূখণ্ড। কেউ কান দেয়নি। ঋষিগঙ্গার বাঁধ ধুলিসাৎ হয়ে দুবছর আগে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুতেও সরকারের টনক নড়েনি। উপরন্তু হিন্দু তীর্থযাত্রীদের প্রিয় চারধামকে কেন্দ্র করে শস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য পাকা রাস্তার জাল বিছিয়ে তাকে আরও চওড়া করার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার জন্য যোশীমঠ এলাকায় লাগাতার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, হচ্ছে। বাঁধের জন্য মাটির নিচে সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন মাটির নিচের ভৌম জলের স্তর উন্মুক্ত হয়ে গেছে, ফলে ধস নামছে।

প্রশ্ন হল, এরই নাম কি উন্নয়ন? প্রতিপ্রশ্ন হল, তাহলে উত্তরাখণ্ডের মানুষ কি রাস্তাবিহীন, আধুনিকতাবিহীন, সুযোগসুবিধাহীন থাকবেন? তাঁদের কাজের সুযোগের কী হবে? কিংবা এই দুটো পরস্পরবিরোধী প্রশ্ন কি আসলে একটা বাইনারি তৈরি করে?
‘সঠিক চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?’ প্রবন্ধে মাও সে তুং বলেছিলেন, এর উৎস তিনটে। ১) প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম বা উৎপাদনের সংগ্রাম, ২) রাজনৈতিক সংগ্রাম বা শ্রেণিসংগ্রাম, ৩) বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা। এগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একথা মনে রাখলে দেখা যাবে, মানুষ প্রকৃতিজাত হয়েও তার সঙ্গে সংগ্রামরত। এই সংগ্রাম তাকে অনন্যতা দিয়েছে। এখন আমরা বুঝি, বিপন্নও করেছে। কেন বিপন্ন করেছে? কারণ মুনাফা এবং লোভতাড়িত মনুষ্যসমাজ প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে একতরফা প্রাধান্য স্থাপন করতে চেয়েছে। সমাজ শ্রেণিবিভক্ত হয়েছে। যে শ্রেণি সমাজ পরিচালনা করেছে, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, মুনাফাই যখন তার প্রধান বিবেচ্য হয়ে উঠেছে তখনই মানুষ প্রাধান্য বিস্তার করতে চেয়েছে প্রকৃতির উপর। মাওই আবার ‘দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে’ নামের এক লেখায় বলেছিলেন, দ্বন্দ্বের দুটো দিকের একটি প্রধান ও অন্যটি অপ্রধান থাকে। এরা জায়গা বদল করতে পারে।
আরো পড়ুন দেউচা-পাঁচামি খোলামুখ কয়লাখনি সর্বনাশের আঁতুড় ঘর
দ্বন্দ্বও দু ধরনের – বৈরিতাপূর্ণ এবং বৈরিতাহীন। এই দু ধরনের দ্বন্দ্বও উল্টে যেতে পারে। একথা মাথায় রেখে এবং সারা বিশ্বে পুঁজিবাদ, এমনকি সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েও একথা বলা যায় যে প্রকৃতির সাথে মানুষের দ্বন্দ্বটি বৈরিতাহীন। প্রকৃতির উপর মানুষের ক্রিয়ার দূরপ্রসারী ফলাফল মাথায় না রাখলে এবং/অথবা যথেচ্ছ উৎপাদন বৃদ্ধি তথা মুনাফা চালিকাশক্তি হলে, এই বৈরিতাহীন দ্বন্দ্ব বৈরিতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। তা প্রকৃতি ও মানুষ – দুয়েরই ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। এই দ্বন্দ্বকে বৈরিতাহীন রাখতে সঠিক চিন্তাধারার দ্বিতীয় উৎস – রাজনৈতিক সংগ্রাম অর্থাৎ শ্রেণিসংগ্রাম – এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। সেক্ষেত্রে যে দ্বন্দ্বগুলো চারিত্রিকভাবে বৈরিতাপূর্ণ থাকবে, সেগুলোর সমাধান করতে হবে। কোনো নিয়ন্ত্রক শ্রেণির চালিকাশক্তি যদি মুনাফা হয়, তাহলে তাকে স্থানচ্যুত করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা বলে দেবে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর ওপর মানুষের ক্রিয়ার কী প্রতিক্রিয়া হবে।
অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতির প্রভু হবে না, কিন্তু দাসও হবে না। সে অনন্য হবে প্রকৃতির অংশ হয়েই। সে স্বাধীন হবে। আবশ্যিকতার উপলব্ধিই হল স্বাধীনতা।
কর্পোরেট-নির্ভর অর্থনীতি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিল্লিকেন্দ্রিক রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ আর যথেচ্ছ পরিবেশ ধ্বংস – এসবের থেকে বেরিয়ে বিকল্প রাস্তা খুঁজে নেওয়ার সময় কি আসেনি?
~ মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।