প্রতীপ নাগ
দেউচা-পাঁচামি এখন সংবাদের শিরোনামে। বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতের এগারোটি মৌজার প্রায় ১১.২২২ একর জমি (প্রায় ১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা) জুড়ে দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা আর দেউচা-পাঁচামি কয়লা ব্লক। যেখানে মজুত কয়লার পরিমাণ, বলা হচ্ছে, প্রায় ২০২৫ মিলিয়ন টন। এই প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩৫,০০০ কোটি টাকা আর পুনর্বাসনের জন্য আরও ১০,০০০ কোটি টাকা। তবে জিওলজিকাল সার্ভের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, মাল ফেলা এবং ট্রেঞ্চ কাটার জন্য জমি লাগবে আরও বেশি।
দেউচা-পাঁচামির এই প্রকল্প হলে একুশ হাজারের বেশি মানুষ উচ্ছেদ হবেন, যাদের মধ্যে ৯,০৩৪ জন আদিবাসী আর ৩,৬০১ জন দলিত সম্প্রদায়ের। সংখ্যালঘু মুসলিম সহ অন্য মানুষও আছেন; ৪,৩১৪টি বাড়ি ভাঙা হবে। সাঁওতালদের জীবনচর্যা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর ধর্মাচরণ শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মত নয়। তাদের একটা যৌথ লোকজীবন আছে। ধ্বংস হবে তাদের লোকজীবনের অন্যতম অংশ মাঝি থান আর জোহার থান। এই অঞ্চলে আছে মৌবেলিয়া রিজার্ভ ফরেস্ট। তারও ক্ষতি হবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ইতিমধ্যেই বীরভূমের এই অঞ্চল পাথর খাদানের দূষণে দূষিত। পাথর খাদান স্থানীয় মানুষের কোনো আর্থিক উন্নতি ঘটায়নি। উপরন্তু ক্ষতি করেছে তাঁদের চাষবাস ও সংস্কৃতির। পাথর খাদানের শ্রমিকরা সিলিকোসিসের মারণরোগে আক্রান্ত হন। খনিজ ছাড় সুবিধা আইন, ১৯৬০ এবং খনিজ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন, ১৯৮৮-র ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসারে খাদান বুজিয়ে ফেলা সংক্রান্ত বিধি, বনাধিকার আইন ২০০৬, ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী (The Right to Fair Compensation and Transparency in Land Acquisition, Rehabilitation and Resettlement Act, 2013) পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাবের মূল্যায়ন এখন পর্যন্ত দেউচা-পাঁচামিতে মানা হয়নি বা সর্বসমক্ষে আনা হয়নি। খনন-উত্তর জমি, জলের মান উন্নয়ন, বায়ুর মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার উপরিভাগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। “এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক” থেকে রাজ্য সরকার যেনতেন প্রকারেণ কয়লা উত্তোলন করতে সচেষ্ট।
প্রথমে ইস্টার্ন কোলফিল্ডকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হলেও এই প্রকল্প লাভজনক নয় বলে তারা কোন উদ্যোগ নেয়নি। পরবর্তীকালে ২০১৮ সালে রাজ্য সরকার এই দায়িত্ব ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (WBPDCL)-কে দিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৯ মার্চ সংসদে প্রশান্ত কুমার মজুমদার ও নৃপেন্দ্রনাথ রায়ের প্রশ্নের উত্তরে (প্রশ্ন নং ২০৭৮) কয়লা দপ্তরের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, এই প্রকল্প লাভজনক নয় বলে কোল ইন্ডিয়া এতে থাকবে না।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, দেউচা-পাঁচামিতে কয়লার স্তর রয়েছে ব্যাসল্ট পাথর বা আগ্নেয় শিলার অনেক নিচে। এই প্রায় ২২৫ থেকে ২৪৫ মিটার পুরু পাথরের স্তর কেটে এবং তা তুলে ফেলে তার নীচ থেকে কয়লা উত্তোলন বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ। ব্যাসল্ট পাথরের ঠিক উপরে রয়েছে টপ সয়েল, যাকে আমরা মাটি বলি। ব্যাসল্ট পাথরের নীচে চারটি স্তরে কয়লা আছে। কয়লার স্তরগুলির মধ্যে আছে পাথরের স্তর।
২০১৮ সালের ৮ জুন দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন কাগজের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া এনার্জি ফোরামে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি পোল্যান্ডে আধুনিক প্রযুক্তি জানতে গিয়েছিলেন এবং স্থির হয়েছে উপরের স্তর তুলে নয়, মাটির নীচ দিয়েই খনন হবে।
জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে, এখানকার কয়লার স্তর দেশের আর সব জায়গার থেকে আলাদা। তাই দু বিলিয়ন টন কয়লা থাকলেও আজকের প্রযুক্তি দিয়ে উপর থেকে বা মাটির তলা দিয়ে, কোনোভাবেই খনন সহজ নয়।
খোলামুখ কয়লাখনি হবে বলে যে গল্প বলা হচ্ছে, তা অবাস্তব। শস্তায় বিদ্যুতের প্রতিশ্রুতিও আসলে ভাঁওতা। বিদ্যুৎ নিগমের খনিগুলির হাতে আগামী তিরিশ বছরের জন্য পর্যাপ্ত কয়লা আছে। ব্যাসল্টের জন্য বোর হোল ড্রিল খুবই ব্যয়সাধ্য। তাছাড়া এই ধরণের বিস্ফোরণে বারুদের মাত্রা, শব্দ, গ্যাস সবটাই মাত্রাহীন। ফলে আশপাশের বাড়িঘরের অবস্থা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। ভূগর্ভস্থ জলেরই বা কী হবে?
খোলা মুখ কয়লাখনির অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। পশ্চিম বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বর ব্লকের খোট্টাডিহি ও সোনপুর বাজারি খোলামুখ কয়লাখনির উপর ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে এসপিএম (বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ)-এর মাত্রা যথাক্রমে ২৬৭.৪ ও ২৭৪.৯। যা নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় অনেক বেশি।
পিপলস কালেকটিভ ইন্ডিয়া ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার চারটি প্রত্যন্ত এলাকার গ্রাম, যেগুলি সেন্ট্রাল কোলফিল্ড এবং টাটা স্টিলের খোলামুখ কোলিয়ারি ও সংশ্লিষ্ট শিল্পের তিন কিলোমিটারের মধ্যে, একটি সমীক্ষা করেছে। ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসক ও গবেষকদের দল ২৩৫৩ জনের উপর সমীক্ষা করেন। তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধানত দশটি রোগ হয়। যথা – ব্রঙ্কাইটিস (হাঁপানি সহ); সিওপিডি/নিশ্বাসের সমস্যা; যক্ষা; চর্মরোগ (কালো/সাদা দাগ, চুলকানি, আলসার); চুলের সমস্যা (পতন/হ্রাস, বিবর্ণতা); চোখ (জল পড়া ও লাল), পা/পায়ের পাতা ফাটা এবং ঘা; কোমরে ব্যথা, বাত এবং পেটের অসুখ। এই এলাকার বায়ু, জল, মাটি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে মারাত্মক দূষণ। বায়ু দূষণ (পিএম ২.৫) এমন পর্যায়ে যে ভারতীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকার সীমা অতিক্রম করেছে। বাতাসে যে পরিমাণ ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও সিলিকন পাওয়া গেছে তা-ও স্বাস্থ্য নির্দেশিকায় নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি। মাটিতে যে পরিমাণ ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে, তা পরিবেশ রক্ষায় নির্দেশিত কানাডিয় মৃত্তিকা নির্দেশিকার মাত্রা অতিক্রম করেছে। বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ও নিকেল পাওয়া গেছে পলিতে, ফলে জলের প্রাণিদের অস্তিত্ব বিপন্ন। অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে জলে, যা ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশিত মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
দেউচা-পাঁচামি অঞ্চলে খোলামুখ কয়লাখনি তৈরি হলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বীরভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। লক্ষ লক্ষ বছরে সৃষ্টি হওয়া টপ সয়েল চিরতরে হারিয়ে এই অঞ্চল বর্জ্য পাহাড়ে, মরুভূমি সদৃশ এলাকায় পরিণত হবে। জমির উর্বরতা নষ্ট হবে। খোলামুখ কয়লাখনি হলে কয়েকশো মিটার নীচের মাটি উপরে চলে আসবে আর উপরের মাটি নীচে চলে যাবে। এই অঞ্চল বন্ধ্যা হয়ে যাবে। শুধু ধ্বস নয়, এর ফলে স্থলজ ও জলজ জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি হবে। বর্ষার সময়েই মাটির স্তূপ ধুয়ে গিয়ে ভরাট হবে ঐ অঞ্চলের নদনদীর তলদেশ, ডেকে আনবে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা। সেই মাটির স্তূপ থেকে ভূগর্ভস্থ জল প্রবাহের ব্যাঘাত ঘটিয়ে শুধু ওই এলাকার নয়, এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজ-বনজ উৎপাদন ও নদী-পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে। এলাকার প্রাকৃতিক ভূ-গর্ভস্থ জলের উপরেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। খোলামুখ কয়লাখনি থেকে দূরবর্তী অঞ্চলেও কুয়ো, টিউবওয়েলের জল শুকিয়ে যাবে; প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক জলস্তরের পরিবর্তন ঘটবে, যেমন জামুরিয়াসহ আসানসোল-রানীগঞ্জ অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানী, যা বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে কার্বন নিঃসরণের ৮০ শতাংশ উৎস হল কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস। এর ফলে নির্গত গ্রীনহাউস গ্যাস পৃথিবীর তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। ফলে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের এবং বিভিন্ন পর্বতমালায় সঞ্চিত বরফ; সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৩০ সালে সুন্দরবন আর কলকাতা শহরের একাংশ সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির কারণে জলের তলায় চলে যাবে।
সম্প্রতি গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত COP 26 সম্মেলনে দাবি উঠেছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে শূন্য করে ফেলতে হবে। সারা বিশ্বে আওয়াজ উঠছে জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গ্লাসগোতে বলেছেন, ২০৭০ সালের মধ্যে দেশে কার্বন নিঃসরণ শূন্য কর ফেলবেন। এই রাজ্যে বর্তমানে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। অনেক ক্ষেত্রে এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হচ্ছে। তাহলে আগামী তিরিশ বছরের জন্য পর্যাপ্ত কয়লা মজুত থাকা সত্ত্বেও, নতুন করে কয়লাখনি কাদের স্বার্থে?
যাঁরা বলছেন দেউচা-পাঁচামিতে কয়লাখনি তৈরি হলে এই রাজ্যে শিল্পের বান ডাকবে, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, সাম্প্রতিককালে কটি শিল্পোদ্যোগ গড়ে উঠেছে এ রাজ্যে? আসল উদ্দেশ্য জমির টপ সয়েল নষ্ট করে হলেও ব্যাসল্ট পাথরের ব্যবসা করা। যার ফলে একদিকে মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা হারাবে, পরিবেশ ধ্বংস হবে আর অন্যদিকে চলবে লুঠের ভাগ-বাঁটোয়ারা। আর থাকবে পুনর্বাসন প্যাকেজ নিয়ে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি।
জঙ্গলের উপর এবং হাজার হাজার বছর ধরে চাষবাসের উপর নির্ভরশীল এই অঞ্চলের মানুষদের জন্য নাকি ‘বিশেষ’ ও ‘সেরা’ প্যাকেজের ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এই প্যাকেজে বলা হয়েছে, যাদের জমি আছে তারা বিঘা প্রতি পাবে ১০-১৩ লক্ষ টাকা, ৫.৫ লক্ষ টাকা পাবে স্থানান্তরের জন্য এবং ৬০০ স্কোয়ার ফুট ঘর পুনর্বাসন কলোনিতে। এছাড়াও জমিহারা প্রত্যেকটি পরিবারের একজন রাজ্য পুলিশের জুনিয়র কনস্টেবল পদে চাকরি পাবে – এই সংখ্যাটি ৪,৯৪২। বর্তমানে ক্রাশারে কর্মরত প্রায় ৩,০০০ শ্রমিক মাসে ১০,০০০ টাকা করে পাবেন এক বছরের জন্য। আর ১৬০ জন কৃষি শ্রমিক এককালীন ৫০,০০০ টাকা আর নরেগা প্রকল্পে মোট ৫০০ দিনের কাজ পাবেন। আরও বলা হয়েছে, সরকারি খাস জমিতে প্রথমে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এই অঞ্চলে তিন ধরনের জমি আছে – সরকারি খাস জমি, রায়তি জমি আর বনভূমি। যেসব মানুষ সরকারি খাস জমিতে বসবাস, চাষাবাদ করেন, তাঁদের কথা প্যাকেজে উল্লেখ করা হয়নি।
প্রথম কথা, ১০-১৩ লক্ষ টাকায় কতদিন চলবে? পাঁচজনের পরিবার হলে, পরিবারের একজন চাকরি পেলে, বাকিরা কোথায় যাবে? তাদের দীর্ঘকালীন জীবিকা যে চাষবাস, কয়লাখনি হলে তা তো নষ্ট হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, জঙ্গলের সাথে আদিবাসী জীবন সম্পৃক্ত। ছশো স্কোয়ার ফুটের ঘর তাদের বসবাসের অযোগ্য।
তৃতীয়ত, আদিবাসীরা বাস্তুচ্যুত হলে তাদের সংস্কৃতি, লোকজীবন, কৃষ্টি, ধর্ম তো ধ্বংস হবেই, কী হবে ওই অঞ্চলের মন্দির, মসজিদ, গির্জা আর কবরস্থানের? কী হবে হাসপাতালের?
চতুর্থত, এই প্যাকেজে ভূমিহীন কৃষক, ভাগচাষী, বর্গাদার, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে একটি শব্দও নেই। তাদের জীবিকার কী ব্যবস্থা হবে? তারা কি তাদের জীবনধারার পূর্বের বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতি বজায় রাখতে পারবে?
পঞ্চমত, আদিবাসীদের পারম্পরিক পশুচারণ ভূমির কী হবে?
ষষ্ঠত, প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ১৬০ জন কৃষি শ্রমিক আছেন, এ কথা হাস্যকর।
সপ্তমত, ক্রাশারের শ্রমিকদের এককালীন ৫০,০০০ টাকা আর এক বছরের জন্য ১০,০০০ না হয় দেওয়া হল। তাদের বাকি জীবন কীভাবে চলবে?
উন্নয়ন মানে কী? উন্নয়নের মানে যদি হয় শিল্পের নামে সাধারণ মানুষকে, খনি বা বড় বাঁধ তৈরি করতে আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ আর পরিবেশ দূষণ বা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করা, তাহলে সেই উন্নয়ন আমরা চাই না। বস্তিবাসী বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে, জলাভূমি বুজিয়ে শহরে বড় বড় বহুতল, শপিং মল নির্মাণ; গাছ কেটে, নয়ানজুলি বুজিয়ে রাস্তা চওড়া করা বা ফ্লাইওভার তৈরি করা যদি বিকাশের সংজ্ঞা হয়, তবে সেই বিকাশের আমরা বিরোধী। আমাদের কাছে উন্নয়নের মানে সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের জন্যও দুবেলা পেট ভর্তি খাবার, দু হাতে কাজ, সর্বোন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর বাসস্থান। কিন্তু সরকার প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলির থেকে আসলে লাভবান হয় পুঁজিপতিরা।
পুঁজিবাদী বিকাশের নিজস্ব গতিতেই নগরায়ন হচ্ছে। বিশেষত, ১৯৯১ সালের পরে এ দেশে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে। আর এই নগরায়নের হাত ধরেই এসেছে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স এবং বিপুল পরিমাণে এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহার। ভারতের জনসংখ্যার ১৫%, যারা এই নয়া উদারবাদ থেকে কমবেশি লাভবান, তারাই বড় পুঁজির লক্ষ্য। এদের ভোগের জন্য চাই বাড়তি বিদ্যুৎ। আজ প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে, এই বাড়তি বিদ্যুৎ ব্যবহার কাদের স্বার্থে? এত শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার কি যুক্তিযুক্ত? বিশ্ব উষ্ণায়ন আর জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারিগর জীবাশ্ম জ্বালানি। ইতিমধ্যেই সুন্দরবনসহ দুই ২৪ পরগণা ও পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠের জলস্তর বেড়ে জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার বিপদসীমায় দাঁড়িয়ে। জলবায়ু সংকটের ধাক্কা বারবার আমরা প্রত্যক্ষ করছি ঘনঘন সামুদ্রিক ঝড়ের মধ্যে দিয়ে। ভারতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রবল বৈষম্য আছে – গ্রাম আর শহরের মধ্যে, শ্রমজীবি মানুষের সাথে অল্পসংখ্যক বিত্তশালীর ও সচ্ছল মধ্যবিত্তের।
নগরায়ন, কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, যথেচ্ছ এয়ারকন্ডিশনারের ব্যবহার, শহরগুলিতে মাত্রাতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা আমাদের বিকাশের মডেল হিসাবে দেখানো হচ্ছে। এই বিকাশ আসলে সম্মিলিত আর অসম (combined and uneven)। অন্য দিকে, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উচ্ছেদ হবে আদিবাসী, মূলনিবাসী মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন আর বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবন-জীবিকা হারাবে মৎস্যজীবী, মৌলা আর প্রান্তিক মানুষ। ব্যক্তি মালিকানা, ব্যক্তিগত মুনাফার উপর নির্ভরশীল ব্যবস্থায় সামাজিক স্বার্থ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ দেখা সম্ভব নয়। তাই পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয় শুধুমাত্র বড় বড় শহরগুলিকে কেন্দ্র করে। দূরবর্তী জেলা শহরগুলিতে না থাকে ঠিকমত বিদ্যুৎ, না পাওয়া যায় পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা বা উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা।
করোনা এবং তার ফলে লকডাউন বিধিনিষেধের ফলে মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ একদল ‘বুদ্ধিজীবী’ ত্রাণ দেওয়া শুরু করে এই প্রস্তাবিত কয়লাখনি অঞ্চলে। এঁরা একদিকে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেদের দেখাচ্ছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী হিসাবে, অন্য দিকে তৃণমূল সরকারের কৌশলী সমর্থক হিসাবে কাজ করছিলেন। এঁদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল, যা দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনির গুণাগুণ এবং সরকারি প্যাকেজ কত ভাল তা জনগণকে বোঝাবে। কমিটির মাথায় বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রগতিশীল নায়ক। ওই কমিটির সদস্যদের ওই অঞ্চলে প্রবেশ অবাধ ছিল। অথচ সমীক্ষক দল আর অন্যদের প্রবেশ নিষেধ ছিল কোভিড বিধির অজুহাতে। ইতিমধ্যে প্রতিবাদরত স্থানীয় মানুষদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
অর্থাৎ দেউচা-পাঁচামির ঘটনা এ-ও প্রমাণ করে, যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কোন দক্ষিণপন্থী জনবাদী শক্তি বা বুর্জোয়া দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমঝোতা করে জয়ী হওয়া যাবে না। একদিকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী বিজেপি, অন্যদিকে এই রাজ্যের ক্ষমতায় চরম স্বৈরতান্ত্রিক তৃণমূল আজ শ্রমিক-কৃষকের অধিকার, ধর্মঘটের অধিকারকে পদদলিত করছে। উভয়ের বিরুদ্ধে বামশক্তিগুলির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই একমাত্র পথ।
লেখক শ্রমিক আন্দোলন ও গণআন্দোলনের সংগঠক। মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
রাজনৈতিক বিকল্প নেই বলেই দেউচা-পাঁচামি সিঙ্গুর হবে না
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
এক অপূরণীয় ভয়াবহ ক্ষতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কয়লা খনির সমস্ত গতিবিধি।এই ব্যক্তিগত মুনাফার খেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নরকে পরিণত হবে।