“দেউচা-পাঁচামি সিঙ্গুর হবে না” — মুখ্যমন্ত্রীর এই বাক্যটি ঋগ্বৈদিক ব্যঞ্জনায় পূর্ণ। সামান্য কথা এবং আপাত অর্থের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বৃহত্তর এক সত্য। তিনি বোঝাতে চান, সিঙ্গুরে যেমন জবরদস্তি করে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, দেউচাতে তা হবে না। সুতরাং হয়ত তিনি আরও বোঝাতে চান যে, সিঙ্গুরে যে ধরণের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তা-ও এখানে হবে না। কিন্তু সিঙ্গুর তো শুধুমাত্র জবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ ছিল না, শুধুমাত্র একটা আঞ্চলিক প্রতিরোধমাত্রও ছিল না। সিঙ্গুর ছিল, প্রকৃত প্রস্তাবে তিন দশকের একটা অপ্রতিরোধ্য জমানাকে পালটে দেবার সূচনাবিন্দু। এই রাজনৈতিক গুরুত্বই সিঙ্গুরকে সিঙ্গুর করে তুলেছিল।

দেউচা-পাঁচামি আসন্ন দিনগুলিতে পশ্চিমবঙ্গে একটা বড় লড়াইয়ের ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। কয়লাখনি করতে গেলে জবরদস্তি ওখানে সরকারকে করতেই হবে। সে আপনি জমি অধিগ্রহণ করুন অথবা কিনুন। সে জবরদস্তির প্রাথমিক কার্যপ্রকরণ ইতিমধ্যে শুরু হয়েও গেছে। বাইক বাহিনী দাপাচ্ছে, সঙ্গে পুলিস নিয়ে গ্রামে গ্রামে মাইকিং করছে সরকারি কর্তারা। মানুষকে বোঝানোর জন্য জেলায় সক্রিয় সামাজিক সংগঠনের হর্তাকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি হয়েছে ‘নাগরিক কমিটি’। অর্থাৎ, সরকারি জগদম্বার এক হাতে রাইফেল আর অন্য হাতে বাইবেল — উভয়ই ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সুতরাং জবরদস্তি সরকারকে করতেই হবে। একথা সরকারও জানে। তাই তার প্রস্তুতিও চলছে। আদিবাসীদের একটা বড় অংশ জমি দেবেন না। ভূমিহীন ক্ষেতমজুর এবং জমির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু জমি নেই — এমন পরিবারগুলো শেষতক লড়াই দেবে। পাথর খাদানকে কেন্দ্র করে যে অর্থনীতিটা এখানে চলছে, তার সাথে যুক্ত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে কয়লাখনিকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে সরিয়ে আনাটা কঠিন কাজ। এই ধরণের যে কোনো রূপান্তর এতই বহুমাত্রিক ও সংবেদনশীল পদক্ষেপ দাবি করে, যে সময়ে সময়ে তা একেবারেই অসম্ভব কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে অতীতের জনগণপন্থী সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলোও অনেক সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। অমন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত বিরোধগুলি অবিরোধমূলক দ্বন্দ্ব — এই জ্ঞান করেও তাদের বিরোধমূলক দ্বন্দ্বের কর্মপদ্ধতির মধ্যে ঢুকে যেতে হয়েছে। আর বুর্জোয়া সরকারগুলোর তো কথাই নেই। তারা যেহেতু মর্মগতভাবেই জনবিরোধী, সেহেতু বলপ্রয়োগই তাদের মূল কর্মপদ্ধতি হয়ে ওঠে। সুতরাং, দেউচা-পাঁচামিতে জবরদস্তি সরকারকে করতেই হবে।

আর যেখানেই জবরদস্তি, সেখানেই প্রতিরোধ। অন্যান্য শর্ত এক থাকলে তা-ও ঘটবে। কিন্তু দেউচা-পাঁচামির লড়াই খুব সম্ভবত জমানা পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু হয়ে উঠতে পারবে না। এই অর্থে, এবং একমাত্র এই অর্থেই দেউচা-পাঁচামি সিঙ্গুর হবে না। কেন একথা বলছি? আসুন, সংক্ষেপে একবার দেখে নিই।

আসলে শুরুরও শুরু থাকে। সিঙ্গুর যতই সূচনাবিন্দু হোক না কেন, তার পেছনেও ছিল সলতে পাকানোর একটা পর্যায়। এই প্রবন্ধের লেখক যেহেতু সেই পর্যায়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল, তাই এই বিষয়ের অবতারণা কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার মত শোনাবে হয়ত। তবুও বলি। কারণ ব্যাপারটা প্রয়োজনীয়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের বাম রাজত্ব বিরোধী সংগ্রাম যখন জনমানসে বিশেষ দাগ কাটতে ব্যর্থ হল, তখন একটা পর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, রণকৌশল পাল্টাতে হবে। তাঁকে সিপিএম বা বামফ্রন্টের বিরোধী বামপন্থী শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। “লাল হঠাও দেশ বাঁচাও” জাতীয় ব্ল্যাঙ্কেট কল দিলে চলবে না। সুতরাং তিনি সেই হিসাবে পালটে নেওয়া গতিপথ ধরে চলতে শুরু করেন ২০০৪ সালের শেষ থেকেই। ২০০৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে আত্মপ্রকাশ করে নকশালপন্থীদের একটা বড় অংশের মিলিত পার্টি, যার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কমরেড কানু সান্যাল। এই পার্টির নাম দেওয়া হয় সি পি আই (এম-এল)। তার আগে পরে কিছু ছিল না। লোকে বলত নবগঠিত সি পি আই (এম-এল)। অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়াতে হয় ঐক্য সম্মেলন। এই পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির একজন নেতা, যিনি আসানসোল রানিগঞ্জ অঞ্চলে সক্রিয় ছিলেন, তাঁর সাথে সিপিএমের ওই অঞ্চলের বর্ষীয়ান নেতা, একাধিকবারের বিধায়ক ও সাংসদ এবং সেই সময়ে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত সর্বজনশ্রদ্ধেয় কমরেড হারাধন রায়ের একটা ঐক্য গড়ে উঠে। আসানসোলে এই যৌথ কাজের জন্য এবং থাকার জন্য একটা পার্টি অফিস কাম কমিউন গড়ে তোলা হয়। কমরেড হারাধন রায় সেখানেই থাকতেন। এই প্রবন্ধের লেখকও কয়েক মাস নবগঠিত সি পি আই (এম-এল)-এর কর্মী হিসাবে উক্ত কমিউনে থেকেছে। মনে রাখা দরকার, সেই সময়ে খোলামুখ কয়লাখনির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তীব্র লড়াই গড়ে তোলার বাসনাই কমরেড রায়ের মনে ছিল, যেটা তিনি সিপিএম পার্টিতে থেকে কিছুতেই করতে পারেননি। এই লড়াইয়ের সূত্রেই কমরেড রায়কে মাঝেমাঝেই কলকাতায় আসতে হত, প্রবন্ধ লেখক তাঁর সঙ্গী এবং সহায়কের ভূমিকা পালনে করত। এমনই এক দিনে ফোন করে দিনক্ষণ ঠিক করে কমরেড রায়ের সাথে দেখা করতে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তাবাহক তিনজন প্রফেসরের একটি দল। এঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন প্রখ্যাত বামপন্থী পরিবারের সন্তান এবং তৃতীয়জন এসেছিলেন দক্ষিণপন্থী পরিমন্ডল থেকে। সেটাই ছিল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বামফ্রন্ট বিরোধী সংগঠিত বামশক্তির যৌথ কাজকর্মের শুরুর শুরু। ঘটনাচক্রে খোলামুখ কয়লাখনির বিরুদ্ধে লড়াইটাই ছিল এই সূচনার অনুঘটক।

তৎকালীন তৃণমূল কংগ্রেসের একটা সুবিধা ছিল। দলটার কোনো ‘ইতিহাস’ ছিল না। সে কখনো রাজত্ব করেনি, সরকার গড়েনি। ফলে সে কী করতে পারে আর কী করতে পারে না, তা নিয়ে ভবিষ্যৎ কল্পনার জায়গা তখনো খোলা ছিল। দলটার কোনো নীতিগত অবস্থানও ছিল না। সুতরাং, স্বচ্ছন্দে সে নিজেকে বামপন্থী বলে দাবি করতে পারত, আজকে যে দাবি করলে ঘোড়াতেও হাসবে। তখন কিন্তু লোকে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, সিপিএমের বাম দিকে থাকা বাম শক্তির সাথে সে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে, এতদিনকার বাম সরকার তখন চোখের সামনে ডানপন্থী হচ্ছিল। নয়া উদারবাদী মডেলকে আঁকড়ে ধরে তীব্র গতিতে সে তখন একের পর এক তথাকথিত উন্নয়ন আর শিল্পায়নের প্রকল্প হাতে নিয়ে ফেলেছে। যার প্রত্যেকটার সাথে জড়িত ছিল উচ্ছেদ আর জবরদস্তি। সেই সময়টাই ছিল অন্যরকম, যখন বাম ক্রমশ ডান হচ্ছিল আর ডান হয়ে উঠছিল বাম। মূলধারার রাজনীতিতে এই রূপান্তর ঘটছিল, যার অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল বামের ডানে পরিবর্তনের কারণে তিতিবিরক্ত নকশালপন্থীরা। ফলে ২০০৬ সালের বিরাট বিজয়ের ফলে তৈরি হওয়া আত্মগর্ব আর ঔদ্ধত্যে ভরপুর বামফ্রন্ট সহসা যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল তা অতি দ্রুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভরাট করে ফেলেন। ফলে অচিরেই সিঙ্গুরের লড়াইটা নন্দীগ্রাম হয়ে এবং তৎকালে চলা অনেকগুলো স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের সহযোগিতায় একটা রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে তোলার সূচনাবিন্দু হিসাবে দেখা দেয়। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে তা প্রথম প্রমাণিত হয় এবং ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে দেওয়াল লিখন একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০১১ সালে কী হতে যাচ্ছে তা গর্বান্ধ সিপিএম নেতৃত্ব ছাড়া বাকি সবাই জানত।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তা নয়। এই মুহূর্তে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী কোনো রাজনৈতিক শক্তি ময়দানে উপস্থিত নেই। বিজেপির তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রথমত, দেউচা-পাঁচামি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। এই প্রকল্পের বিরোধিতা করার প্রশ্নই বিজেপির নেই। সম্প্রতি বিজেপি নেতা মোহিত রায়ের একটি বৃহৎ সংবাদপত্রের পাতায় উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ (আনন্দবাজার পত্রিকা/ ১০ ডিসেম্বর, ২০২১) নিশ্চয়ই অনেকেই খেয়াল করেছেন। সেখানে দেউচা প্রসঙ্গে তিনি পরিষ্কারই বলেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন রোখার উৎসাহ যেন জনগণের জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদির পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। সকলেই জানেন, এর অর্থ হল জলবায়ু পরিবর্তন রোখার উৎসাহ যেন পুঁজির সুপার প্রফিটের পথে কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। জনগণের নামেই তো সকল অন্যায় এ জগতে চলে।

প্রকৃতপক্ষে, মোহিতবাবু কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কথারই প্রতিধ্বনি নিজ কন্ঠে ধারণ করেছেন। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কয়লাখনিগুলোকে ব্যাপকভাবে বেসরকারি মালিকানার হাতে তুলে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। গত বছর জুন মাসে কোভিড পরিস্থিতির মাঝখানে কেন্দ্রীয় সরকার ৪১টি কয়লা ব্লক বেসরকারিকরণ করেছে। যুক্তি হল বিনিয়োগ আসবে, কর্মসংস্থান বাড়বে ইত্যাদি। যা যা বলে দেশ লুঠ চলে আর কি। সম্প্রতি গ্লাসগোর পরিবেশ সম্মেলনে অন্য সব রাষ্ট্রনেতার মত মোদীও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলেন, কিন্তু কাজে তাঁরা চলছেন একেবারেই উলটো পথে। প্রকৃতপক্ষে বিশুদ্ধ বাতাস এবং পুঁজির মুনাফা — এই দুইয়ের মধ্যে কোনো একটা বেছে নেবার সময় মানবজাতির সামনে যতই নিকটবর্তী হচ্ছে, ততই মোদীরা আরও উগ্র আরও হিংস্রভাবে তথাকথিত উন্নয়নের নামে শ্রম এবং প্রকৃতির উপর আক্রমণ হানছেন। এমতাবস্থায় রাজ্য বিজেপি কী করে দেউচা-বিরোধী অবস্থান নেবে?

দ্বিতীয়ত, অন্যান্য রাজনৈতিক কার্যকারণে বিজেপি জনগণের সংগ্রামের নেতার ভূমিকায় অভিনয় করার অবস্থায় বর্তমানে নেই। সেটা শুধু এই কারণে নয় যে, সদ্য সদ্য রাজ্য নির্বাচনে তাদের বিরাট পরাজয় ঘটেছে। মনে রাখতে হবে, ২০০৬ সালেও তৃণমূলের বিরাট পরাজয় ঘটেছিল এবং বামফ্রন্ট অভূতপূর্ব বিজয় পেয়েছিল। কিন্তু চাকা ঘোরার পথে তা বাধা তো হয়ইনি, উলটে তার ঠিক পর থেকেই বামফ্রন্টের অভূতপূর্ব পতন এবং তৃণমূলের অভূতপূর্ব উত্থান শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ২০১৪ থেকে তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন রাজ্যে তাদের প্রশাসনের অভিজ্ঞতা, সম্প্রতি দেশজোড়া কৃষক আন্দোলনের সামনে তাদের ভেঙে পড়া এবং বাংলায় তাদের আদ্যন্ত ভুল রাজনীতি ও সাংগঠনিক বিপর্যয় সে সম্ভাবনা মাটি করেছে।

অন্যদিকে বাম শক্তির অবস্থা কী? সংগঠিত বাম শক্তির মধ্যে সবথেকে বড় হল সিপিএম, যারা কিনা এই নয়াউদারবাদী ‘উন্নয়ন’ মডেল রাজ্যে চালাতে গিয়েই গদিচ্যুত। ২০১১ থেকে তাদের ক্রমাগত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক-নির্বাচনী বিপর্যয় শুধু যে অব্যাহত আছে তাই নয়, তা ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। তবুও তারা সেখান থেকে তেমন করে শিক্ষা নিতে রাজি হচ্ছে না। উলটে বুদ্ধবাবুর ঐ নয়া উদারবাদী রাস্তাই যে সঠিক ছিল, তারই প্রমাণ দিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেউচা-পাঁচামি নিয়ে ঝঞ্জাট অতি সম্প্রতি নতুন করে শুরু হওয়ামাত্র সুজন চক্রবর্তী মন্তব্য করলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জবাব দিতে হবে, কেন দেউচার খনি প্রকল্প দশ বছর আগেই হয়নি! একই সাথে যদিও তাঁরা আবার এই প্রকল্প নিয়ে ‘রাজনীতি করার’ চেষ্টা চালাচ্ছেন, সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য। দুদিন আগে গণশক্তিতে সিপিএম নেতা গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি দুটি কিস্তিতে দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পের মারাত্মক বিপদের দিকগুলো নিয়ে একটি তথ্যবহুল এবং সবিস্তার লেখা (‘খোলামুখ খনির নামে লুটেরা পুঁজির কারবার’/ গণশক্তি/ ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর) লেখেন। লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখুন ওই লেখায় কী রয়েছে:

“দেউচা-পাঁচামির খোলামুখ খনি প্রকল্পের সমস্যাগুলিকে তুলে ধরার অর্থ কিন্তু এই প্রকল্পের বিরোধিতা করা নয়। কোনও মুমূর্ষু রোগীর বড় অপারেশনের আগে সেই হাসপাতালের ডাক্তারবাবু সহ হাসপাতালের উপরিকাঠামো নিয়ে রোগীর সুহৃদবৃন্দ ভাবনা করেন। রোগীর বাঁচার স্বার্থেই তা করেন। এই চিন্তা কিন্তু রোগীকে মেরে ফেলা বা তার অপারেশনের বিরোধিতার জন্য নয়। এখানে তো প্রকৃতির উপর বড় অপারেশন হবে? ভাবব না! আমরা তো প্রকৃতির আত্মীয় — প্রকৃতির সন্তান!”

কী বোঝা গেল? দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পের কল্যাণে অপারেশন টেবিলে উঠেছে প্রকৃতি। আর প্রকৃতির সন্তান গৌরাঙ্গবাবু অপারেশনের বিরোধী নন! তিনি শুধু দেখতে চান যাতে করে অপারেশনটা ঠিকঠাক হয়। তিনি বা তাঁর দল এটা বলার মত জায়গাতেই নেই, যে দেউচা-পাঁচামির মত প্রকল্পগুলোই হল আসল রোগ যা শুধু প্রকৃতির ধ্বংসই ডেকে আনছে না, বহু মানুষকে তাঁদের জমি, জীবিকা, পরিবেশ থেকে উচ্ছেদ করছে। সুতরাং অবিলম্বে দেউচা-পাঁচামি বন্ধ করো। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা সরকারকে টাইট দেবার জন্য বিভিন্ন ধরণের বিরোধিতা চালিয়ে যাবেন। এই রাজনৈতিক দ্বিচারিতার স্বরূপ জনগণের কাছে আজ এতটাই উন্মোচিত হয়ে গেছে, যে যতদিন না তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক অপারেশনটা আগে করবেন, তাঁদের নিজেদের মুমূর্ষু সংগঠন তথা রাজনৈতিক ভবিষ্যতের আরোগ্য লাভের বিশেষ সম্ভাবনা নেই। সুতরাং, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও দেউচা-পাঁচামি সিঙ্গুর হয়ে উঠবে এ ভয় নেই।

এখন দেখা যাক, বামফ্রন্টের বাইরের বাম শক্তির বর্তমান অবস্থা কী? এখানে প্রধানত নকশালপন্থীরাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি তাঁদের নিয়েই আলোচনা করব। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের একটা মূলগত বিষয় মাথায় রাখতে হবে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় যখন নতুন পার্টি গড়ে ওঠে, তখন তাদের মূল স্লোগান ছিল সংশোধনবাদ এবং নয়া সংশোধনবাদের বিরোধিতা করো, পরাস্ত করো এবং চূর্ণ করো। কিন্তু সংশোধনবাদকে তাঁরা কোনোদিনই সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি। আজ মূলগতভাবে বিপ্লবী শক্তি সিপিএম-সিপিআইয়ের থেকে মূল রাজনীতিতে নিজেদের তফাত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা ভেবে নিয়েছেন, কমিউনিস্ট রাজনীতির কৌশলগত প্রশ্নে সংশোধনবাদের সঙ্গে তফাত করাটাই যথেষ্ট। সংশোধনবাদ বুঝি বা নিহিত আছে কৌশলের প্রশ্নে, নীতিগত প্রশ্নে নয়। নির্বাচনে যাব কি যাব না, সরকার গড়ব কি গড়ব না, দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ করব, নাকি একটা লম্বা সময় ধরে গণআন্দোলন গড়ে তুলব, পার্টিকে মূলগতভাবে গোপন রাখব নাকি খোলা রাখব, অন্যান্য পার্টিগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখব কি রাখব না — এই ধরণের প্রশ্নগুলোই তাঁদের কাছে সংশোধনবাদ থেকে নিজেদের আলাদা করার জায়গা। স্ট্র‍্যাটেজিক প্রশ্নগুলো নিয়ে চলতি কমিউনিস্ট বা বামপন্থী রাজনীতির উপর তাঁরা মোটের উপর সন্তুষ্ট। তাই উন্নয়ন ভাবনার প্রশ্নে সিপিএমের সঙ্গে অধিকাংশ নকশালপন্থী গোষ্ঠীর মূলগত তফাত নেই। বুর্জোয়া উন্নয়নের গতিপথ (trajectory) থেকে কমিউনিস্ট উন্নয়নের গতিপথ যে মূলগতভাবেই আলাদা, সে বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। তাহলে এখানে প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসে, তা হল, সিঙ্গুরে তাঁরা বামফ্রন্টের বিরোধিতা করেছিলেন কেন?

সিঙ্গুরে এঁরা বামফ্রন্টের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ বামফ্রন্ট জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের উপর জবরদস্তি করে প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়েছিল। নন্দীগ্রামে সরকার গুলি চালিয়েছিল, হত্যা করেছিল। গোটা রাজ্য জুড়ে সেই সময়ে সরকার জনতার উপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালিয়েছিল। এই কারণে, একমাত্র এই কারণেই তাঁরা বামফ্রন্টের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বামফ্রন্ট যদি এই সমস্ত প্রকল্পগুলো কোনো এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় জনগণকে বুঝিয়ে, তাঁদের সম্মতি নিয়ে, সঙ্গে নিয়ে করতে পারত — তাহলে খুব সম্ভবত নকশালপন্থীদের বলার কিছু থাকত না। তাঁরা কথা খুঁজে পেতেন না।

দেউচাতেও যদি জনগণের উপর দমনপীড়ন না চলে, যদি জবরদস্তি না করা হয়, যদি একটা অবিশ্বাস্য ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ দেওয়া হয়, যদি দেওয়ানগঞ্জ, দেউচার মত উৎখাত হয়ে যাওয়া গ্রামগুলো অন্যত্র বসিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের জীবিকার পর্যাপ্ত সংস্থান করেই, আর জনগণও হাসিমুখে তা মেনে নেন, তাহলে নকশালপন্থীদের কিছুই বলার থাকবে না। আর যদি তা না হয়, যদি জবরদস্তি হয়, দমনপীড়নের মধ্যে দিয়ে মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হয় তবে অবশ্যই তাঁরা বিরোধিতায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু তার জন্যে তো অপেক্ষা করতে হবে। ঘটনা কীভাবে এগোয় তা দেখতে হবে। তারপর তাঁরা ঠিক করবেন, কী করণীয়। সুতরাং অধিকাংশ নকশালপন্থী সংগঠন বুক ঠুকে বলতেই পারছে না, দেউচা-পাঁচামি বন্ধ করো, কয়লাখনি চাই না।

খোলামুখ কয়লাখনি চাই না বলতে গেলেই তাঁদের মাথায় আসছে, তাহলে কি বন্ধমুখ কয়লাখনি ঠিক আছে? যদি বলা যায় খোলা বন্ধ কিছুই চাই না, তাহলে মাথায় আসছে, কয়লা পুড়িয়েই আমাদের দেশে ৮০% বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কয়লা বন্ধ করে আমরা কি অন্ধকারে বসে থাকব? তাঁরা বুঝতেই পারছেন না, কয়লাখনির বিরোধিতা করার অর্থ এই নয়, যে এখুনি সব কয়লাখনিতে শাটার ফেলে দিতে হবে। এই তো গ্লাসগোতে মোদী বলে এলেন, আর দশ বছরের মধ্যে ভারত কয়লা-নির্ভর শক্তি উৎপাদন ৫০%-তে নামিয়ে আনবে। সেটা কীভাবে সম্ভব, যদি না এখুনি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, নতুন করে আর কয়লাখনি খুলব না? মোদী এক দিকে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, অন্য দিকে একের পর এক নতুন খনি খুলছেন। এই স্ববিরোধিতাকে উন্মোচন করে নতুন কয়লাখনি চালু না করার জন্যে কেন তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে না? বিশেষ করে যখন দেউচার মতো একটা ইস্যু আমাদের সামনে রয়েছে? যখন বিশেষ থেকে সাধারণে পৌঁছনোর, ফলত জনচেতনায় জনবোধ্য আকারে শুধু উচ্ছেদ নয়, সামগ্রিকভাবে প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসের প্রশ্নটিকে স্পষ্টাকারে হাজির করা সম্ভব, আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব?

মুশকিল হল যেই লড়াইয়ের একটা প্রধান ক্ষেত্রভূমি হয়ে উঠবে প্রকৃতি-পরিবেশের প্রশ্ন, নকশালপন্থীরা ভাবতে থাকবেন, আমরা এনজিও হয়ে যাচ্ছি না তো! পরিবেশ, জলবায়ু নিয়ে চেঁচায় তো তারা, আমরা চেঁচাই মানুষ নিয়ে! মানুষ নিয়ে মানে আবার মানবসভ্যতা নিয়ে নয়, বিশেষ একদল মানুষ নিয়ে, শ্রমিকশ্রেণি বা নিদেনপক্ষে মেহনতী মানুষ! তাঁরা বোধহয় মনে করেন, মানবসভ্যতা না থাকলেও শ্রেণি বহাল তবিয়তে থাকবে। সরু তারের উপর ঝুলে থাকা যে বিশেষ বাস্তুতন্ত্র জীবজগতের জন্ম দিয়েছে, তা ধ্বংস হয়ে গেলেও শ্রেণিসংগ্রাম চলতে থাকবে। মাও সে তুং কি বলে যাননি “কখনও শ্রেণি সংগ্রাম ভুলো না”?

হায়! তাঁরা যদি জানতেন, জলাশয়ে বোমা ফাটিয়ে মাছ ধরেছিলেন বলে লেনিন কীভাবে তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ কমরেডদের জেলে পোরার হুমকি দিয়েছিলেন। যদি জানতেন, লেনিনের নেতৃত্বে যে ঝাপোভেদনিক আন্দোলন বিপ্লবী রাশিয়ায় শুরু হয়েছিল, তার ফলে কীভাবে রাশিয়ার এক বিরাট ভূভাগ সমস্তরকম মানবিক হস্তক্ষেপের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের স্বার্থে। তাঁরা যদি জানতেন ১৯২১ সালের ‘On the Protection of Monuments of Nature, Gardens, and Parks’ নামের ডিক্রিটার কথা। জমি সংক্রান্ত ডিক্রি, জাতি সংক্রান্ত ডিক্রি, আত্মনিয়ন্ত্রণের ডিক্রি, জাতীয়করণের ডিক্রি ইত্যাদি তো আমরা অনেক আলোচনা করেছি, কিন্তু এই ডিক্রিটা? তাঁরা যদি কখনো মাথা ঘামাতেন কীভাবে ঝাপোভেদনিক আন্দোলন হয়ে উঠেছিল রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের এক অপরিহার্য উপাদান! বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন যদি এই প্রশ্নগুলোকে নিয়েও মাথা ঘামাত তবে শুধু রূপের দিক থেকেই নয়, মর্মবস্তুতেও তা সত্যিকারের বিপ্লবী চরিত্র লাভ করত। সংশোধনবাদের সঙ্গে পার্থক্যটা একটা সম্পূর্ণ চেহারাও পেত। অন্যদিকে এনজিও হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতেও ভুগতে হত না। আমরা বুঝতাম প্রকৃতি সংরক্ষণের লড়াইটা একটা লেনিনীয় উত্তরাধিকার।

নকশালপন্থীদের আরও অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সব সমস্যা আলোচনা করতে গেলে অনেক পাঠকেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। তাই আপাতত এখানেই শেষ করা যাক। শুধু এটুকু বুঝে নেওয়া যাক, যে দেউচা-পাঁচামি সিঙ্গুর হতে যাচ্ছে না। এর একমাত্র কারণ হল প্রকৃত রাজনৈতিক বিকল্পের অনুপস্থিতি। ফলত, আপাতত কিছুদিন রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুকূলেই থাকবে। তবে সমাজগতির নিয়মেই কোনো না কোনো কোণ থেকে সেই বিকল্প উঠে আসবেই। তার প্রস্তুতি যে একেবারেই কোথাও চলছে না এমনও নয়। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিনই রাজনীতির নামে এই ছেলে ভোলানো শত্রুমিত্র খেলা জারি থাকবে।

~মতামত ব্যক্তিগত।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।