পাঁচ দশক আগেকার কথা। ১৯৭১। তখন এ বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা আর হানাহানির সময়কাল। আমাদের তখন কিশোরবেলা। চারপাশে দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি আমাদের দ্রুত ‘বড়’ করে তুলছে। কাগজে খেলার খবরের পাশাপাশি রাজনৈতিক খবর পড়তেও বেশ আগ্রহ গজিয়েছে। আগের বছর, মানে ১৯৭০ সালে স্কুলে হাফ ইয়ার্লি, অ্যানুয়াল কোনো পরীক্ষাই হতে পারেনি। সরাসরি পরের ক্লাসে। ‘মন্থর বিকেলে শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি’র মতো পথেঘাটে সোডার বোতল ছোড়াছুড়িও স্বাভাবিক ও ছন্দোময় হয়ে উঠেছে। কাছাকাছি ‘পেটো’ পড়লে ত্রস্ত হই, কিন্তু চমকে উঠি না। এধার ওধার থেকে খুনের খবর আসে। আঁধার নামলে সিআরপির রুট মার্চ কিংবা কুম্বিং অপারেশনে বাড়িতে ঢুকে মাঝরাতে পুলিশের খানাতল্লাশি তখন নগরজীবনের অঙ্গ।
ঠিক এই সময়েই স্বাধীন বাংলার উত্তাল হিল্লোল! পাক বাহিনীর বর্বরতার ছবি কাগজে কাগজে, হত্যালীলার বিবরণ। ২৫ মার্চ থেকে গণহত্যা শুরু। গুলিতে হত্যা, বেয়নেটে খুঁচিয়ে হত্যা — কত যে প্রকার! ইয়াহিয়া খান একটা আস্ত জল্লাদ, এমন একটা ছবি মনে আঁকা হয়ে গেছে। অনেক পরে শিল্পী কামরুল হাসান চিত্রিত জল্লাদের (জানোয়ার) পোস্টারটি দেখে অবাক হই। মনে আঁকা ছবির সঙ্গে প্রায় মিলে যাচ্ছে!
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।


সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড
১ অগস্ট নিউ ইয়র্কে, ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডনে সংগঠিত হল এক সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণ: কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। দুনিয়া-কাঁপানো বিটলস্ দলের গান, সাথে রবিশঙ্কর-আলি আকবর-আল্লারাখা। ধনবাদী পশ্চিম জাগছে! শরণার্থীদের জন্য সাহায্য আসছে।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

জয় বাংলা, বাংলার জয়
এবার আসি ৩ ডিসেম্বরের কথায়। পাকিস্তান বিমানবাহিনী হামলা শুরু করেছিল পাঞ্জাব, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে। পরপর বোমা ফেলল আগ্রা, আম্বালা, যোধপুরে। আর পুবদিকে আগরতলায় বোমা পড়ল।
ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতায়। খবর পেয়েই দ্রুত ফিরলেন রাজধানী। ই এম বাইপাস তখন চিন্তার অগম্য। বিমানবন্দর থেকে শহরের কেন্দ্রে পৌঁছতে গণ্যমান্যদের রুট ছিল ভিআইপি রোড-কাঁকুড়গাছি-মানিকতলা-বিবেকানন্দ রোড-গিরিশ পার্ক-সেন্ট্রাল (চিত্তরঞ্জন) অ্যাভিনিউ-এসপ্ল্যানেড-রাজভবন।
সন্ধের দিকে আচমকা রটে গেল — কর্মসূচি বাতিল করে ইন্দিরা দিল্লি ফিরছেন। গলির মোড়ে, বিবেকানন্দ রোডে আমরা সব দাঁড়িয়ে গেলাম। একটি বড় জিপ, পিছনটা খোলা, সেখানে চেয়ারে বসে থমথমে মুখে একটা কাগজ পড়ছেন তিনি। মুখে আপতিত আলো। যাত্রা-অভিমুখের উল্টো দিক করে বসে। একদম একা। গভীর অভিনিবেশে কাগজ পড়তে পড়তে চলে গেলেন। অভ্যাস মত কোনো হাত নাড়া ইত্যাদি নয়। তাঁর সেই থমথমে রাঙা মুখ আজও চোখে ভাসছে। দিল্লি পৌঁছে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন ও জাতির উদ্দেশে বেতার-ভাষণ দিলেন।
শ্রীমতী গান্ধীর বেতার-ভাষণ: ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গন। শোনা গেল, পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসছে! কী হয়, কী হয়! রসিকজনের রটনা কিনা জানা নেই, তবে ছড়িয়ে গেল যে আমাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম নাকি অক্লেশে বলেছেন: আমাদেরও আইএনএস বিক্রান্ত্ আছে! বিক্রান্ত্ ছিল তখন ভারতের একমাত্র এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। তবে সপ্তম নৌবহরের কাছে নস্যি! তার ঠিক আগেই ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি হয়ে গেছে। ফলে সোভিয়েতের নৌবহর দাঁড়িয়ে পড়ল ভারত মহাসাগরে! উত্তেজক পরিস্থিতি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সপ্তম নৌবহর আসেনি। তবে বিক্রান্ত্ কিন্তু খুলনা থেকে চট্টগ্রাম অবধি নাগাড়ে জলটহল দিয়ে গেছে। সেই বিক্রান্ত্-কে বছর আষ্টেক আগে লোহার দরে বেচে দেওয়া হল। কেউ চোখের জল ফেলেছিল কি?
যুদ্ধ চলছে। ফেনি, আখাউড়া, ঝিনাইদহ, হিলি, বয়রা, ঝিকরগাছা ইত্যাদি নামগুলো ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিচ্ছি। পালাতে গিয়ে পাক-সেনারা সেতু, রেলপথ, ভবন সব নষ্ট করে দিচ্ছে। পদ্মার ওপরে সুবিখ্যাত সারা (হার্ডিঞ্জ) ব্রিজের একটা গার্ডার ধ্বংস করা হল। বয়োজ্যেষ্ঠরা হায়-হায় করে উঠলেন। এরই মধ্যে এক সকালে কাগজে বিশাল হেডিং — পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খান গুলিতে নিহত! পরে জানা গেল, ভুয়ো খবর। কলকাতায় ব্ল্যাক-আউট চলছে। সন্ধের পর বাইরে কুপকুপে অন্ধকার। ঘরের মধ্যে আলো না-ঠিকরানো বিশেষ ল্যাম্পশেড। একচিলতে আলোও বাইরে গেলে পুলিশে সতর্ক করে যায়। আকাশে প্লেনের আওয়াজে হামলার আশঙ্কা। টালা ট্যাঙ্ক, হাওড়া ও বালি ব্রিজ নাকি ‘দুশমনের’ পয়লা নিশানা!
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়। যুদ্ধ শেষ। জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সারা দেশে উচ্ছ্বাস। এ বাংলায় অন্য এক উন্মাদনা। দেয়ালে দেয়ালে লিখন। দুই দেশের জাতীয় পতাকার ছবি। তবে তখন কিন্তু বাংলাদেশের পতাকা আঁকা ছিল বেশ ঝঞ্ঝাটের! কারণ মধ্যিখানে ছিল সে দেশের মানচিত্র। নিখুঁত বাংলাদেশ আঁকা বেশ কষ্টসাধ্য। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামের আগে জুড়ে গেল বিশেষণ ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’, যা এ-বাংলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরবর্তী কয়েক বছর ব্যবহৃত হয়েছে।
আরো পড়ুন বিপন্ন সংখ্যালঘু বনাম আওয়ামী রাজনীতি
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এ বাংলার শিল্প, সাহিত্যেও দাগ রেখে গেছে। কিছু ঘটনা তো প্রবাদ। কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির রামগড়ে চায়ের দোকানে বসে কাগজের অভাবে সিগারেটের ফয়েলে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গান লেখা “শোনো একটি মুজিবরের থেকে…”, সেদিনই অংশুমান রায়ের সুরারোপ ও পরিবেশন। সলিল চৌধুরী মান্না দেকে দিয়ে গাওয়ালেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, সুরে দেবব্রত বিশ্বাস রেকর্ড করলেন দুটি গান — “ঐ তারা চলে দলে দলে” আর “শোনো বাংলার জনসমুদ্রে জোয়ারের হুঙ্কার”। এর মধ্যে আবার প্রথম গানটির শেষভাগে আবহ-সুর উত্তীর্ণ হয়েছিল ইন্টারন্যাশনালের সুরে! আরও অনেক কিছু তখন সৃষ্টি হয়েছে। ওই সময়ে শিল্পী, অভিনেতাদের উদ্যোগ কিছুটা ধরা রয়েছে ঋত্বিক ঘটকের ডকু-ছবি ‘দুর্বার গতি পদ্মা’-য়। গান, কবিতা ও অন্যান্য সৃষ্টিতে মাতোয়ারা হয়েছিল মানুষ। আজ ইচ্ছে করলে সেসবের আস্বাদ নেওয়া যায়। বৈদ্যুতিন তথ্যভাণ্ডার এখন অতি সমৃদ্ধ। শুধু একটি গানের হদিশ পেতে ব্যর্থ হয়েছি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘পারাপার’ :
আমরা যেন বাংলা দেশের
চোখের দুটি তারা।
মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে—
থাকুক গে পাহারা।
দুয়োরে খিল
টান দিয়ে তাই
খুলে দিলাম জানলা।
ওপারে যে বাংলাদেশ
এপারেও সেই বাংলা।।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।