নিত্য নন্দ
পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ কী? সকলেই হয়ত এক বাক্যে বলবে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন। কিন্তু এই লেখক বলছেন ভুল, একেবারেই ভুল! পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া শুরু হয়েছে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগেই! এই কথাটা যে শুধুমাত্র এই লেখক বলেছেন তা নয়। এমনকি সবার আগে বলেছেন এমনও নয়। সেই কোন ১৯৫৪ সালে স্বাধীনতার মাত্র সাত বছর পরেই কেউ একজন বিখ্যাত ইকোনমিক উইকলি (বর্তমানে ইকোনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলি) পত্রিকায় সাবধান করেছিলেন মূলত দেশভাগ ও তার থেকে উদ্ভূত সমস্যার কারণে পশ্চিমবঙ্গের অর্থব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে এবং তার ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে চলেছে। কিন্তু দেশের ভাগ্যনির্মাতারা সেই সাবধানবাণীকে উপেক্ষা করে এমন সব নীতি গ্রহণ করেন যে পশ্চিমবঙ্গের অর্থ্যব্যবস্থায় স্থিরতা রাখাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। ধরেই নেওয়া হয় যে পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিকভাবে একটি উন্নত রাজ্য তাই তার জন্য বিশেষ কিছুই করার দরকার নেই। বরং পশ্চিমবঙ্গকে অগ্রাহ্য করে অন্যান্য রাজ্যের প্রয়োজনের দিকে নজর দেওয়া দরকার।
কিন্তু ইকোনমিক উইকলি পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে সাবধানবাণী সত্যি প্রমাণিত হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান স্বাধীনতার সময়ে এক নম্বরে থাকলেও সেখান থেকে নেমে আসতে বেশি সময় লাগেনি। কারণ অনেক উদ্বাস্তু হাজির হলেও সেই অনুযায়ী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়েনি। তাই মাথাপিছু আয় এক ধাপে অনেকটাই নেমে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলাদা করে ভাবনাচিন্তাও বিশেষ হয়নি। তাই মানুষের মনে গেঁথে যায় এক ভ্রান্ত ধারণা, যে পশ্চিমবঙ্গের অর্থব্যবস্থা বা শিল্পক্ষেত্রে মন্দার কারণ মূলত শ্রমিক আন্দোলন। কারণ গণমাধ্যম চলে নিজের খেয়ালে, সেখানে গভীর বিচার বিশ্লেষণের জায়গা খুব কম। তবে ঠিক নিজের খেয়ালে চলে তা-ও নয়। গণমাধ্যমকে পিছন থেকে যারা চালায়, মূলত তাদের খেয়ালে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গকে অনেক মূল্য চোকাতে হয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গে অর্থব্যবস্থার পশ্চাদগতির মূল কারণগুলো কী সেটা বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এমনকি বর্তমান পুস্তকটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যথোচিত গুরুত্ব পেলে হয়ত সমস্যা কিছুটা লাঘব হত। কিন্তু এতদিনে সমস্যা অনেকটা বেড়ে গেছে এবং সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতটাও অনেকটা বদলে গেছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
লেখক শুরু করেছেন প্রাক-ব্রিটিশ যুগে বাংলা কেমন সম্পদশালী ছিল এবং কীভাবে ব্রিটিশ লুন্ঠনের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক অবনয়ন শুরু হয় এবং বাংলার বিশিল্পায়ন হয় তার বর্ণনা দিয়ে। এগুলো অবশ্যই বহুচর্চিত বিষয়। এমনকি বাংলার সম্পদ লুঠ করে যেভাবে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবিস্তারে কাজে লাগানো হয়েছিল তা নিয়েও অনেক চর্চা হয়েছে। তবে লেখক একটা বিষয়ের অবতারণা করেছেন যেটা সেই অর্থে চর্চিত নয়। সেটা হল কীভাবে ব্রিটিশ আমলেই বোম্বাই আর মাদ্রাজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে বাংলার সম্পদ ব্যবহার করা হয়। তবে বাঙালিদের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের কারণে বাঙালি ব্যবসায়ীরা বাংলাতেই পিছিয়ে পড়ে এমন যুক্তি হয়ত খুব পোক্ত নয়। কারণ ব্রিটিশ শাসনের অনেক আগেই বাংলার ব্যবসা ক্ষেত্রে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা – বিশেষ করে মাড়োয়ারি বা রাজস্থানীরা জাঁকিয়ে বসেছিল। এটা হয়ত শুরু হয়েছিল মোগল যুগে, মোগল শাসকদের সাথে রাজস্থানের স্থানীয় রাজাদের সুসম্পর্কের হাত ধরে। তবে ব্রিটিশ যুগে বাংলার জমিদার শ্রেণি অনেকাংশেই দেশের ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। তবে হয়ত কিছুটা ব্রিটিশ উৎসাহে অথবা কিছুটা নিজেদের ইচ্ছায়, এই জমিদার শ্রেণি প্রচুর অর্থসম্পদের অধিকারী হয়েও ব্যবসা বাণিজ্যের পথে সেভাবে পা না বাড়িয়ে বিলাসিতায় মত্ত থেকেছে।
স্বাধীনতার পরে পরেই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবনয়ন শুরু হয়ে যায়। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রাজস্ব বন্টনের ক্ষেত্রে এমন সব নিয়ম তৈরি করে যাতে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্য বঞ্চিত হয়। সেই সময় চা ও পাট ছিল দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল ও প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। কিন্তু দেশের অর্থব্যবস্থায় এমন উল্লেখযোগ্য অবদান থাকা সত্ত্বেও এসবের ফল বা রপ্তানির অর্থ মূলত ব্যবহার হতে থাকে দেশের অন্যান্য অংশের শিল্পায়নে। লেখকের মতে ব্রিটিশ শাসনে যেমন বাংলা ব্রিটিশ শিল্পদ্রব্যের উপাদানের উৎস তথা তৈরি দ্রব্যের বাজার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, স্বাধীনতার পরে তেমনি বাংলা তথা সমগ্র পূর্বাঞ্চল পশ্চিম তথা উত্তর-পশ্চিম ভারতের শিল্পায়নের উপাদান সরবরাহকারী এবং প্রস্তুত দ্রব্যের বাজার হিসেবেই পরিগণিত হতে থাকে। এই ব্যাপারে সব থেকে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল রেলের মাশুল সমতা নীতি। এই নীতি লৌহ ইস্পাত বা কয়লার ক্ষেত্রে গৃহীত হলেও, পশ্চিমবঙ্গ বারবার দাবি করা সত্বেও তুলা বা তৈলবীজের মত উপাদানের ক্ষেত্রে গ্রহণ করানো যায়নি।
দেশভাগের ফলে পাটবস্ত্রের কারখানাগুলো ভারতে থেকে গেলেও, পাট উৎপাদনকারী এলাকাগুলো চলে যায় পাকিস্তানে। আবার স্বাধীনতার সময় থেকেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক না হওয়ায় দেশীয় পাটশিল্পের অস্তিত্ব নিয়েই অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের ধান উৎপাদন কমিয়ে পাটচাষে মনোযোগী হতে আহ্বান জানায়। এর বড় কারণ অবশ্য, পাট তখন অন্যতম রপ্তানি দ্রব্য। পাকিস্তান থেকে পাট আমদানি করলে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যেত। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় পাট চাষ করতে গিয়ে বাংলায় খাদ্যশস্যের ঘাটতি দেখা দিলেই সেটা পূরণ করা হবে। পাট ও ধানের মধ্যে এক ধরনের মূল্য সমতা রাখার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি। এমনকি পাটবস্ত্রের রপ্তানি ধাক্কা খাবে – এই অজুহাতে পাটের দাম যথোপযুক্ত হারে বাড়ানো হয়নি। অথচ পাটবস্ত্রের রপ্তানিতে শুল্ক বসাতে কোনো অসুবিধা দেখা দেয়নি। আবার তুলা বস্ত্রের ক্ষেত্রে গৃহীত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন নীতি। বস্ত্রশিল্পের অবস্থা ভাল না থাকা সত্ত্বেও তুলার দাম নিয়মিত বাড়ানো হতে থাকে। অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চলের তুলা উৎপাদক চাষি আর পূর্বাঞ্চলের পাট উৎপাদক চাষির মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা হয়।
পূর্ব, পশ্চিমের বৈষম্য অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা দেয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন সরকারি তথ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে কেন্দ্রীয় সরকার ছিল যতটা দরাজ, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে ততটাই উদাসীন ও কৃপণ। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ কেন্দ্রীয় সরকার বছর দুয়েকের মধ্যেই সম্পূর্ণ করে ফেলে। তারপর নেহরু-লিয়াকত চুক্তির ধুয়ো তুলে কার্যত পুনর্বাসনের কাজ বন্ধ করে দেয়। ততদিনে পশ্চিমের পুনর্বাসন শেষের পথে, কিন্তু পূর্বের পুনর্বাসনের কাজ শুরুই হয়নি। পূর্বের উদ্বাস্তুদের জন্য সামান্য কিছু সাহায্য দেওয়া হয়। ওটুকুতে তাদের দিন গুজরান করাও অসম্ভব ছিল। চুক্তিতে যা-ই থাক না কেন, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছিল না এবং উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি যে নেই, তা কার্যত অগ্রাহ্য করা হয়। ততদিনে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের প্রায় সবাই ভারতে চলে এসেছে এবং পুনর্বাসন পেয়েছে। ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলিমদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে বন্টন করার যে নীতি নেওয়া হয়েছিল, সেখানেও করা হয় চরম বৈষম্য। শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত রাজ্যগুলোতে ফেলে যাওয়া মুসলিমদের সম্পত্তি পূর্বের উদ্বাস্তুদের মধ্যে বন্টন করা হয়। কিন্তু পশ্চিমের উদ্বাস্তুদের মধ্যে বন্টন করা হয় প্রায় সারা ভারতে মুসলিমদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি। আর সেভাবে পুনর্বাসন না হওয়ায় পূর্বের উদ্বাস্তুদের সম্পূর্ণ দায় এসে পড়ে মূলত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা – এই তিনটি রাজ্যের ঘাড়ে। লেখক এ ব্যাপারে আর্য-অনার্য বৈষম্যের তত্ত্ব খাড়া করেছেন। অর্থাৎ পশ্চিমের উদ্বাস্তুরা আর্য গোষ্ঠীভুক্ত ও পূর্বের উদ্বাস্তুরা অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত এবং ভারতের শাসককুল মূলত আর্য গোষ্ঠীভুক্ত, তাই এই বৈষম্য। সেটা তর্কসাপেক্ষ। তবে হয়ত পশ্চিমের উদ্বাস্তুরা দিল্লি বা তার আশেপাশে এসে জড়ো হওয়ায় সেটা কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম বা ত্রিপুরার সমস্যা কেন্দ্রের শাসকদের থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সেভাবে গুরুত্ব পায়নি।
ব্যাপক সংখ্যায় উদ্বাস্তু আসার ফলে পশ্চিমবঙ্গে দরকার ছিল কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছিল তার ঠিক উল্টো। তবে কর্মসংস্থানের সমস্যা যত না ছিল বাংলার, তার থেকে অনেক বেশি ছিল বাঙালির। ব্রিটিশ আমলে বাঙালিরা বৈপ্লবিক কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ায় যেমন সরকারি ক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য হতে থাকে, তেমনি বেসরকারি সংস্থার মালিকরাও – যারা মূলত ছিল অবাঙালি – বাঙালিদের এড়িয়ে যেতে থাকে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইত না কর্মচারীরা বৈপ্লবিক কাজকর্মে লিপ্ত হোক আর তা নিয়ে তারা সমস্যায় পড়ুক। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রবণতা স্বাধীনতার পরেও চালু থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থায় বাঙালির অনুপাত কমতে থাকে। যে কোনো দেশে কর্মসংস্থানের একটা বড় উৎস হল সামরিক বাহিনী। সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ যে শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাই নয়, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সৈনিকরা বাড়িতে অনেক টাকা পাঠায়, যা দিয়ে ওই এলাকার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন হয়। কিন্তু ভারত দীর্ঘকাল ধরে সামরিক জাতিবাদের ধুয়ো তুলে প্রধানত উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য থেকেই সামরিক বাহিনীতে ভর্তি করে। এর ফলে অন্যান্য অনেক অঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্বাঞ্চল ভীষণভাবে বঞ্চিত হয়। জগজীবন রাম প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হওয়ার আগে এই নীতিকে সেভাবে প্রশ্নও করা হয়নি। তিনি এই নীতির পরিবর্তন করার চেষ্টা করলেও সেভাবে সফল হননি।
ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বাংলা এক সময় অগ্রণী ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলার গুরুত্ব কমতে থাকে। জওহরলাল নেহরুকে উদ্ধৃত করে লেখক দাবি করেছেন, বাঙালিরা বুদ্ধিনির্ভর পেশায় যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করলেও শিল্প, বাণিজ্য ক্ষেত্রে সেভাবে এগিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু রাজনীতিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ তথা শিল্প বাণিজ্যের গুরুত্ব বাড়তে থাকায় বাঙালিরা নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে থাকে। পরোক্ষভাবে লেখক দাবি করেছেন, জাতীয় কংগ্রেস থেকে সুভাষচন্দ্র বসুকে বিদায় নিতে হয়েছিল আসলে ব্যবসায়ী শ্রেণির সমর্থন তাঁর প্রতি না থেকে মহাত্মা গান্ধীর প্রতি থাকার কারণে। ব্যবসায়ীরা সুভাষের চরমপন্থায় আস্থা না রেখে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে আস্থা রাখবেন সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক।
যা-ই হোক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বা দেশের নেতৃত্বের প্রশ্নে শিল্প তথা ব্যবসায়ী মহলের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র পূর্বাঞ্চলের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। সরকার যতই সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থার কথা বলুক, শিল্প ও বণিক মহল দেশের অর্থনৈতিক কর্মসূচি তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করে। তাই ওই মহলের কর্তাব্যক্তিরা যে এলাকাগুলোর সাথে একাত্মবোধ করে, সেই এলাকাগুলোই সরকারের উন্নয়ন মানচিত্রে বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। বাংলায় কোনো বড় শিল্পপতি নেই তাই বাংলা অর্থনৈতিক ব্যাপারে ব্রাত্য। সে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক বা পরিকল্পনা কমিশনের বরাদ্দের ক্ষেত্রেই হোক। কখনো কখনো কোনো বিদেশী কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ বা সম্প্রসারণ করতে চাইলে তাদের জোর করে অন্য রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণও লেখক দিয়েছেন। লেখক তথ্যপ্রমাণসহ দাবি করেছেন, পরিকল্পনা কমিশনের বিনিয়োগ পশ্চিমবঙ্গে এতটাই কম যে সেটা কোনো যুক্তিতেই সমর্থন করা যায় না।
কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশি গুরুত্ব পেলেও লেখক এই বইতে এমন বেশকিছু প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করেছেন যা শুধু কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক সম্পর্কই নয়, আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। লেখকের মতে, অনেক সাংবিধানিক-নাগরিক অধিকার খর্ব করার ব্যাপারে স্বাধীন ভারতের শাসনব্যবস্থা অনেকাংশে ব্রিটিশ ভারতকেও ছাড়িয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, এই মন্তব্য কিন্তু জরুরি অবস্থার সময় সম্পর্কে নয়। নেহরু বা কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থার কথা বললেও যখনই কোনো রাজ্যে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখনই কেন্দ্রীয় সরকার ভয়ঙ্কর সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। এ ব্যাপারে রাজ্যপালকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ কেন্দ্র যদি পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যা ও অর্থব্যবস্থার পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে সহানুভূতিশীল হত, তাহলে বামপন্থীরা সেভাবে বাড়তে পারত না। এমনকি বিধানচন্দ্র রায়ের মত ব্যক্তিত্বেরও পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা বা বঞ্চনার প্রতি কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারা এবং রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্বের পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনা নিয়ে সরব হতে না পারার কারণে কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে শুরু করে। আবার রাজ্যের বামপন্থী সরকারের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা যুবসমাজকে নকশালপন্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী সরকারের প্রতি কেন্দ্রের অসহিষ্ণুতা ছিল কেরলের তুলনায় অনেক বেশি, কারণ কেরলে সেভাবে শিল্পপতিদের চাপ ছিল না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তারা চাইছিল কোনো বামপন্থী সরকার যেন টিকতে না পারে, যদিও ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে একটি রাজ্যে প্রকৃত সমাজতন্ত্রের পথে পা বাড়ানো ছিল এক অলীক স্বপ্ন। আবার নকশাল দমনের নামে যেভাবে যুবসমাজকে বিনা বিচারে নিকেশ করা হয়েছিল, সেটা শুধু আমাদের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কলঙ্কই ছিল না, রাজ্যের প্রভূত ক্ষতিও করেছিল। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন তথা খুনের রাজনীতি শুধু নকশালরাই করেনি, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোও কম যায়নি।
যা-ই হোক, রেলের মাসুল সমতা নীতি অনেক আগেই প্রত্যাহৃত হয়েছে, লাইসেন্সিং প্রথাও আর নেই। সরকারও সেভাবে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে না। পরিকল্পনা কমিশনও এখন ইতিহাস। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্বাঞ্চলকে পিছিয়ে দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের যে নীতি বা কার্যক্রমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তার অনেককিছুই এখন ইতিহাস। তাহলে কি এই বইটির আর কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই? এটা কি শুধু পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্বাঞ্চলের বঞ্চনার ইতিহাসের একটা দলিল হয়েই থেকে যাবে? তা কিন্তু একেবারেই নয়। যতই অর্থনৈতিক সংস্কার হোক না কেন, কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্ব কিন্তু এখনও যথেষ্ট। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমলাতন্ত্র এবং শিল্প বণিক মহলের চিন্তাভাবনা বা প্রবণতায় খুব একটা তফাত হয়নি। তাই ওয়েস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর প্রায় শেষের মুখে, অথচ ইস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডোরের কাজ এগোতেই চায় না। দিল্লি-মুম্বাই শিল্প করিডরের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেও দিল্লি-কলকাতা শিল্প করিডরের কথা কেউ মুখেও আনে না। অথচ দিল্লি-কলকাতা শিল্প করিডর হলে শুধু পশ্চিমবাংলাই নয়, উপকৃত হবে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। এমনকি কিছুটা সুফল উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতেও পৌঁছবে। ওড়িশাও লাভবান হবে।
বইয়ের নামে পশ্চিমবঙ্গের কথা বলা হলেও, এ বই শুধু পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে নয়। সমগ্র পূর্বাঞ্চল তথা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে উন্নয়নের নীতি প্রণয়নে এবং কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের দর কষাকষিতে বইটা অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। অনেকদিন ধরেই বিহার তাদের জন্য একটা বিশেষ কেন্দ্রীয় প্যাকেজ চাইছে। কিন্তু নিজেদের দারিদ্র্য তথা পিছিয়ে পড়া ছাড়া এর সপক্ষে বিশেষ যুক্তি দিতে পারেনি। অথচ যদি ঐতিহাসিক বঞ্চনাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে হয়ত কিছুটা সুবিধা হতে পারে। তাছাড়া সমগ্র পূর্বাঞ্চলের পরিবহন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য স্থান ছিল। দেশভাগের ফলে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ে। সেটাকে ঠিকমত পুনর্গঠিত করা হয়নি। এর ফলে উত্তর তথা মধ্য ভারত পূর্বাঞ্চলের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রতি নির্ভরতা বাড়িয়েছে। সাধারণ পরিকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকারের এখনো অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। যদি এই রাজ্যগুলো একত্রিত হয়ে কেন্দ্রের কাছে দাবী পেশ করে কিছু আদায় করে নিতে পারে তাহলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সর্বোপরি এই রাজ্যগুলো যদি বুঝতে পারে যে তাদের ভাগ্য একই সূত্রে বাঁধা, তাহলে হয়ত রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিভেদ ভুলে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একযোগে চলতে পারে। তাতে রাজ্যগুলোর মানুষ উপকৃত হবেন।
প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রচিত ৩১টি প্রবন্ধের সংকলনের মধ্যে সুসংবদ্ধতা আশা করাটা ঠিক হবে না। তবুও বিভিন্ন অধ্যায়কে খাপছাড়া মনে হয় না, কারণ সমস্ত প্রবন্ধেরই মূলসূত্র হচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং তজ্জনিত পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্বাঞ্চলের বঞ্চনা। প্রবন্ধগুলো প্রকাশনার সময়কাল অনুযায়ী লিপিবদ্ধ না করে, বিষয়ভিত্তিকভাবে সজ্জিত হওয়ার কারণেও পাঠকের কিছুটা সুবিধা হয়েছে। প্রবন্ধগুলোর বিশ্লেষণে তাত্ত্বিক গভীরতা না পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটাই বইটিকে কিয়দংশে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। লেখকের বিশ্লেষণ বা সিদ্ধান্তের সাথে সবসময় একমত হওয়া না গেলেও যে বিশাল পরিমাণ তথ্যপ্রমাণ লেখক একত্রিত করেছেন শুধুমাত্র তার জন্যই এই বই ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে বিবেচিত হবে।
ধ্বংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ: কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে প্রতিবেদন
রণজিৎ রায়
নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা
দাম: ১৫০ টাকা
প্রবন্ধকার অর্থনীতির সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত রয়েছেন। ভারত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক ও সরকারি সংস্থার পরামর্শদাতা হিসাবে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের কাজ করেছেন। এই মুহূর্তে তিনি কাউন্সিল ফর সোশাল ডেভেলপমেন্টের ডিরেক্টর। সম্প্রতি লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই India’s Industrial Policy and Performance: Growth, competition and competitiveness।
আরো পড়ুন
সংবিধানের প্রস্তাবনা প্রতিবাদী ভারতের ‘কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম’
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।