অল্প কদিন আগে চলে গেছেন বনশ্রী সেনগুপ্ত, এবার গেলেন নির্মলা মিশ্র। সমসময়ের শিল্পী তাঁরা। সময়টা গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি। বাংলা আধুনিক গানে তখন উঠে আসছেন একঝাঁক শিল্পী। মেয়েদের মধ্যে আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, ইলা বসু, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, অসীমা ভট্টাচার্য, সিপ্রা বসু, ললিতা ধরচৌধুরী প্রমুখ। একে অন্যের থেকে আলাদা। প্রত্যেকেই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে পরিচিত হয়েছেন।
তখনও ৭৮ আরপিএমের গ্রামোফোন ডিস্ক বেরুচ্ছে, পাশাপাশি আসতে শুরু করেছে ৪৫ ও ৩৩ ঘূর্ণনের ভিনাইল রেকর্ড। হচ্ছে প্রযুক্তির পরিবর্তন, আসছে শেষোক্ত রেকর্ড বাজানোর নতুন ছিমছাম যন্ত্র – আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এইচএমভির ফিয়েস্তা ও ক্যালিপ্সো। রেডিওয় অনুরোধের আসর। পাড়ায় পাড়ায় জলসা – ‘বিচিত্রানুষ্ঠান’। সেসব জলসার লিফলেটে শিল্পীদের নামের তালিকার শুরুতে যিনি, তাঁর নামের আগে লাগানো হত অধুনা বর্জিত একটি শব্দ: ‘সর্ব্বশ্রী’। ফলে আর কারও নামের আগে ‘শ্রী’ দিতে হত না।। তখন লেটারপ্রেসের যুগ। কম্পোজিটারের খাটনি একটু হলেও কমত।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সেইসব জলসা। সীমাহীন, একই সঙ্গে সময়সীমাহীন। সন্ধে থেকে শুরু করে মাঝরাত, এমনকী ভোররাতও হয়ে যেত। শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে শুনতেন। উচ্চমানের বেশ কিছু গীতিকার, সুরকারও উঠে আসছেন সেই সময়ে। শিল্পীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন কিছু বিদেশি বাদ্যানুষঙ্গে – বঙ্গো, কঙ্গো প্রভৃতি। পুজোয় শিল্পীপিছু এপিঠ ওপিঠ দুটো বা চারটে গানের জন্য গোটা বছর মুখিয়ে থাকত শ্রোতারা। এমন আবেশেই মাত হয়ে গেল সাতের দশক।
নির্মলা মিশ্র শ্রোতাদের কাছে এক অপরিহার্য শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন এই সময়েই। সে এক সুরের মায়া, এক আলাদা মায়াবী আকর্ষণ। ভোরবেলায় এক কিশোরের ঘুম ভেঙে যায় কোত্থেকে যেন ভেসে আসা গানে: “ও তোতাপাখি রে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেবো মাকে যদি এনে দাও… ঘুমিয়েছিলাম মায়ের কোলে কখন যে মা গেল চলে…”। সে ছেলে মাকে আরও আঁকড়ে ধরে শোয়। অনেক বছর বাদে এক সায়ংসাঁঝে মায়ের অন্ত্যেষ্টি সেরে ফেরার পথে হঠাৎ শোনে সেই গান। স্মৃতি ছাড়া তখন আঁকড়ে ধরার আর যে কেউ নেই।
আরো পড়ুন আমাদের সুরহীন, অকিঞ্চিৎকর জীবনের সন্ধ্যারাগ
গানের বাড়িরই মেয়ে নির্মলা। বাবা শাস্ত্রীয় সংগীতের শিল্পী, দাদা ধ্রুপদিয়া। নির্মলা মনে করতে পারতেন না কবে থেকে গানের সঙ্গে তাঁর ভাব-ভালবাসা। বোধহয় আজন্ম। শিশুকাল থেকে তালিম নেওয়া। কৈশোর থেকেই শ্রোতাদের সামনে তাক লাগানো গান। এরপর একটার পর একটা অসুখ। টাইফয়েডের আক্রমণে গান ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম। তবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর নয়। চলে এলেন লঘু সঙ্গীতে, বাংলা আধুনিক গানে। কিন্তু ভিত তখনই পোক্ত হয়ে গেছে। তাঁর গান শুনলে বোঝা যায় সেই তৈয়ার। দুরূহ বেশ কিছু গানে তিনি সাবলীলতায় উত্তীর্ণ। সুরক্ষেপণে সিদ্ধ এক মিষ্ট কণ্ঠ, সঙ্গে ঈষৎ জোয়ারি। লয়কারির দোলা লাগানো খেলায় দক্ষ। এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও মাতিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান।
রয়ে গেল নির্মলা মিশ্রের গানের সম্ভার। বেশ কিছু গান কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে চিরকালীন হয়ে থাকবে। আগামী শিল্পীরা এইসব গান বরণ করে নেবেন, উত্তরপ্রজন্মের গলায় ধ্বনিত হতে থাকবে। বাংলার মানুষের অনুভূতির সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে এই সমস্ত গান: এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না, তোমার আকাশ দুটি চোখে, ও তোতাপাখি রে, বলো তো আরশি তুমি, কাগজের ফুল বলে, আমি তো তোমার চিরদিনের, পাহাড়ে বিকেল নামে, এই বাংলার মাটিতে প্রভৃতি।
স্তিমিত হয়ে আসছে গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকের প্রভা। নির্মলা মিশ্র বাংলাকে আরেকটু শ্রীহীন করে চলে গেলেন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।