কবীর চট্টোপাধ্যায়
কলকাতার যে বেসরকারি স্কুলে আমি মাস্টারি করি, সেখানে ক্লাস নাইনের ছাত্রদের এই শীতকালে শান্তিনিকেতন ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে। ক্লাস টিচার হিসেবে এই পরিকল্পনার জন্য সেদিন ছাত্রদের থেকে টিকিটের টাকা সংগ্রহ করছিলাম (বাকি খরচটা স্কুলই দেয়)। সেদিন সবে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গী অর্পিতা দেবীর বাড়িতে ইডি হানা দিয়েছে, কুড়ি কোটি টাকার নোটের ব্রেকিং নিউজ নিয়ে তখন স্টাফরুম সরগরম। আমারই এক ছাত্র, যার বয়স তেরো কি চোদ্দ, আমার কাছে টাকা জমা দেবার সময়ে ফিক করে হেসে বলল “হে হে, স্যার, এই টাকাটাও আপনি চুরি করে নিন। শিক্ষামন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়!”
এই রসিকতা শুনে ক্লাসরুমের অনেকেরই মুখে তখন মুচকি হাসি, আমিও কাষ্ঠহাসি হেসে তাকে বেঞ্চে ফেরত পাঠালাম। কিন্তু সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই রসিকতা আমার মাথায় ঘুরতে লাগল। তাহলে কি ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে শিক্ষাক্ষেত্রে চুরি এখন এতটাই স্বাভাবিক? শিক্ষক বা শিক্ষামন্ত্রী মানেই চুরি হবে? দুর্নীতি হবে? সেটা কি এখন হাসিরই খোরাক?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আমার বন্ধু এবং শিক্ষকস্থানীয় শিল্পী রূপম ইসলাম (ঘটনাচক্রে যিনি নিজেও পেশাদার জীবন শুরু করেছিলেন স্কুলমাস্টারি করে) একবার বলেছিলেন “সবাই নিজের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই পৃথিবীটাকে মাপে, তাতে ক্ষতির কিছু নেই।” নিজের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই যদি এই সময়টাকে মাপার চেষ্টা করি, তবে বেশ কতকগুলো তিক্ত সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের এসএসসি বা টেট কেলেঙ্কারি এবং আমার ব্যক্তিগত জীবন – এর যোগসূত্রটা ঠিক কোথায়? আমি পেশায় স্কুলমাস্টার, বিদেশ থেকে শিশুসাহিত্যে গবেষণা করে এসে বেসরকারি স্কুলেই আগে চাকরি পেয়েছি এবং স্বাভাবিকভাবেই ঢুকে পড়েছি। ছাত্রদের নিয়ে সত্যিই চমৎকার মাস্টারির জীবন কাটছে, তবে বেসরকারি না হয়ে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে আনন্দ পেতাম। পৃথিবীর ইতিহাস দেখিয়েছে, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা যে সব দেশে বা রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানে শিক্ষার বৈষম্য কম এবং শিক্ষার সমাজের সব স্তরের ছাত্রদের কাছেই পৌঁছে যাবার ক্ষমতা বেশি। বিশেষ করে আমার মত কেউ, যার বিদ্যায়তনিক জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে বাংলা ভাষায় শিশুপাঠ্য বই ও শিশুসাহিত্য নিয়ে গবেষণা করা, তার পক্ষে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকার মূল্য অপরিসীম।
কিন্তু তা করতে পারছি না, এবং একটু সিনিকাল শুনতে লাগলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, অদূর ভবিষ্যতেও পারব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। শুধু এই মুহূর্তের এসএসসি বা টেট আন্দোলনের নিরিখে এ কথা বলছি না, বিশেষ করে যেখানে পালটা যুক্তি আসতেই পারে, কেন? অভিষেক বন্দোপাধ্যায় তো ‘মানবিকভাবে’ জানিয়েছেন, মেধা তালিকায় থাকলে চাকরির কথা ‘বিবেচনা’ করা হবে। আসলে এই আন্দোলনটি, যার মূলে আছে ২০১৫-১৬ সাল নাগাদ শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিতে প্যানেল তৈরি না করার এবং নিয়োগের স্বচ্ছতা না রাখার চূড়ান্ত দুর্নীতি, একটি উপসর্গমাত্র। অসুখ অনেক গভীরে। বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে টার্গেট করে শিকড়ে পচন ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। এই পচন কেবল উটকো দুর্নীতির ফসল নয়, তৃণমূলের মতাদর্শ মেনেই এই পচন। এই কথাগুলো কেবলই একজন নবীন শিক্ষকের ব্যক্তিগত হা-হুতাশ বলে মনে হতে পারে, তাই একটু তথ্যের দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা প্রাক্তন সরকারের আমলে শুরু হবার পর থেকে প্রত্যেক বছরই হত। ২০১০ সালে যে পরীক্ষার নোটিস বেরোয়, ২০১১ সালে সেই পরীক্ষা হয়নি। তবে ৩৪ বছরের সরকার পরিবর্তনের যে ডামাডোল, তার মধ্যে পরীক্ষা যে হবে না, তা অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে ২০১০ সালের নোটিস অনুসারে পরীক্ষা হবার পর, ২০১৩ সালে আবার নোটিস বেরনো বন্ধ থাকে। এই সময় প্রশাসনকে প্রশ্ন করা হলে শিক্ষামন্ত্রী সেই বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) উক্তিটি করেন “এসএসসি কি দুর্গাপুজো যে প্রত্যেক বছর করতে হবে?” নতুন প্রশাসন যে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু অবজ্ঞার চোখে দেখছেন তা-ই নয়, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় বলেই মনে করছেন না, এই অশনি সংকেত কিন্তু বিচক্ষণ মানুষের চোখ এড়িয়ে যায়নি।
এরপরে ২০১৪ সালে পাল্টাল এসএসসি পরীক্ষার নিয়ম। সংক্ষেপে, দুটি ক্যাটেগরি থেকে তিনটি ক্যাটেগরিতে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এবং আপার প্রাইমারি বা উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষকদের (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি) টেট পরীক্ষা নেবার নির্দেশিকা জারি করা হয়। এর উপরের শ্রেণির শিক্ষকদের জন্য ধার্য হয় ৫৫ নম্বরের লিখিত এসএসসি পরীক্ষা, ৩৫ নম্বর অ্যাকাডেমিক নম্বর এবং ১০ নম্বরের ইন্টারভিউ। ২০১৪ সালে টেট পরীক্ষা হয়, কিন্তু মেধা তালিকায় নাম উঠলেও ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা হয়নি। হ্যাঁ, টেটের সার্টিফিকেট সাত বছর পর্যন্ত ইন্টারভিউয়ের জন্য স্বীকৃত নথি বটে, তবে এখানেও একটা গোলযোগের আভাস থেকে গিয়েছিল।
২০১৫ সালে প্রশাসন তিনটি পরীক্ষাই অবশেষে নেন, কিন্তু ২০১৬ সালে সেই পরীক্ষার ভিত্তিতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য যেসব নিয়োগ হয়, তাতেই পাওয়া যায় অবিশ্বাস্য রকমের স্বচ্ছতার অভাব এবং দুর্নীতির গন্ধ। শিক্ষকদের কোনো প্যানেলের ভিত্তিতে ইন্টারভিউয়ে ডাকা হয়নি, বরং ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় – তুমি নির্বাচিত বা নির্বাচিত নও। এই দুর্নীতির বিরূদ্ধে যে আন্দোলন, তারই ৫০০ দিন আমরা এই কিছুদিন আগে পেরিয়ে এলাম। কারণ সেই সময়ে চাকরিপ্রার্থীরা স্পষ্ট দেখতে পান, খুবই কাছাকাছি নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও কেউ ডাক পেয়েছেন, কেউ পাননি। গোলমাল বুঝেই তাঁরা মামলা করেন। সেই মামলাতেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ধরা পড়েছে।
নিয়োগ কি তার মানে হয়নি? হয়েছে। তবে যেহেতু প্যানেল ছিল না, ঠিক কতজন কিসের ভিত্তিতে নিযুক্ত হয়েছেন তার কোনো খবর পাওয়া গেল না। ওদিকে ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সরকার বুক ফুলিয়ে চাকরির আশ্বাস দিলেও ভোটে জিতে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। এরপর ২০১৯ সালে সেই ২০১৫ সালের আপার প্রাইমারির ফলাফল অবশেষে প্রকাশিত হল। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে যাঁরা টেট পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেছিলেন, তাঁদের অবশেষে ইন্টারভিউতে ডাকা হল।
সব ভাল যার শেষ ভাল? না, তা হল না। এতদিন পরে ইন্টারভিউতে ডেকেছেন বলে প্রশাসন নিজেই জানালেন “আপনাদের মধ্যে অনেকে হয়ত সেই পাঁচ বছর আগের সার্টিফিকেট হারিয়ে ফেলেছেন। আপনারা নতুন করে আমাদের ওয়েবসাইটে রেজিস্টার করুন, এখান থেকে সার্টিফিকেট পাবেন।” এই নতুন সার্টিফিকেট ডাউনলোড করে দেখা গেল নম্বর দেওয়া নেই, শুধু লেখা আছে “পাশ করেছেন।” ফলে এবারও ইন্টারভিউয়ের পরে নিয়োগে কোন স্বচ্ছতা ছিল না। এই সময়ে তথ্যের অধিকার আইন ইত্যাদি অনুযায়ী মামলা করেন অনেকেই, এবং লক্ষাধিক মামলার পর সরকার নিয়োগ আটকে দেন।
এরপর কোভিডের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ভয়ানক বিপর্যস্ত হল, ফলে জটিল পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠল। তবে দুর্নীতির যে ছকটা আমরা দেখছি, তা জাঁকিয়ে বসল। কারণ ২০২১ সালে আবার টেট ইন্টারভিউয়ে যখন ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের প্রার্থীদের ডাকা হল, তখন দেখা গেল আগেরবার ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছিলেন, অর্থাৎ স্পষ্টতই পাশ করেছিলেন, এমন অনেকেই এবার ডাক পেলেন না। ফলে আবার এঁরা মামলা করলেন। ভাসা ভাসা কথায় জানানো হল আগেরবার ভুল হয়েছিল, আসলে আপনারা পাশ করেননি। পাশ যে করেননি, তার প্রমাণ হিসাবে প্রশাসন কিন্তু কোনো তথ্য দেখাতে পারল না।
এই যে ২০১১ সাল থেকে সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম, এর থেকে বিচক্ষণ পাঠক দুটি জিনিস অনুধাবন করতে পারবেন। প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থাকে চাঁদমারি করে তার একেবারে মজ্জায় মজ্জায় দুর্নীতি ঢোকানোর পদ্ধতিটা অনেকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত (যেটা আরও ভয়ঙ্কর), এ বিষয়ে প্রশাসনের ঔদ্ধত্য এবং স্বেচ্ছাচার স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়, তাঁরা জানেন শত নির্যাতনেও শিক্ষকসমাজের এই রাজ্যে তাঁদের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। অন্তত, তাঁদের তাই বিশ্বাস। না হলে কি মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের আশ্বাস দিতে পারেন “আমার হাতে তিরিশ হাজার চাকরি আছে, শুধু বিরোধীদের মামলার জন্য দিতে পারছি না”? আবার কিছুদিন পরেই ওই সংখ্যাটি বদলে তিনি বলেন “আমার হাতে তো সতেরো হাজার চাকরি আছে”। আসলে মুখ্যমন্ত্রী সত্যি কথাই বলছেন, মাঝখানের ওই তেরো হাজার চাকরি সত্যিই এদিক ওদিক চলে গেছে। কোথায় গেছে, তার হিসেব দিতে পারবে হয়ত কোনো মন্ত্রীর ফ্ল্যাটে লুকোনো আরো, আরো নোটের তাড়া। মুখ্যমন্ত্রী ভাবছেন, এই ভয়ানক কথাটা শোনার পরেও আমরা কিছু করতে সাহস পাব না।
আরো পড়ুন পরিযায়ী হওয়াই রাজ্যের শিক্ষক, শিক্ষিকাদের ভবিষ্যৎ?
শেষ করার আগে ফিরে যাই একটু আগে যে কথাটি বলেছিলাম, সেটির কাছে। এই দুর্নীতিকে আমি মতাদর্শ বলছি কেন? দুর্নীতি কি কারোর মতাদর্শ হতে পারে? তা হয়ত পারে না, তবে দুর্নীতিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে নিজে দু পয়সা কামিয়ে নেবার পাশাপাশি সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা শেষ করে দেওয়া যায়। নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদের তা অন্যতম লক্ষ্য। কোভিড অতিমারী এবং লকডাউনের সময়ে বেসরকারি টিউশন পোর্টালগুলোকে যেভাবে বাজারে যথেচ্ছাচার করতে দেওয়া হল, তা এরই প্রমাণ। এখন কোভিড কমতির দিকে, তবুও স্রেফ “গরম বেড়েছে” বা “এখনো গরম আছে” ইত্যাদি অজুহাত দিয়ে যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী হীরক রাজার মেজাজে ইচ্ছা মত স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিলেন কয়েক মাস আগে, তা-ও একই উদ্দেশ্যের প্রমাণ। আসলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা নষ্ট করা এবং নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা – এই দুটি কাজ হাসিল করতে না পারলে তৃণমূলের মত রাজনৈতিক দলগুলো টিকতে পারবে না।
সময় কি পাল্টাবে? তা সময় নিজেই বলবে। ইতিমধ্যে মৌখিক আশ্বাস দেওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের পুলিস দিয়ে টেনে হিঁচড়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া, তাদের পক্ষ নিয়ে করা জমায়েত থেকে অভিনেতা বিমল চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করা (পরে ছেড়ে দেওয়া হয়) ইত্যাদি চলছে। হিন্দি সিনেমার একটি সংলাপ ধার করে বলতে ইচ্ছে করে – ইয়ে ডর হমকো আচ্ছা লগা।
নিবন্ধকার শিক্ষক এবং সঙ্গীতশিল্পী। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।