অর্ক মুখার্জি
তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম দুর্বলতা হল ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগ করতে না পারা। ২০১১ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে বারবার এই ব্যাপারে হোঁচট খেয়েছে সরকার। মামলা থেকে অনশন – কী না হয়েছে এই নিয়ে? বর্তমান সরকারের বিজ্ঞাপনী উন্নয়নের দ্যুতি কিন্তু বিবর্ণ হয়ে পড়ে স্কুলে নিয়োগের প্রশ্নে। বহু শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতী, যাদের স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবে, সে সুযোগ পায়নি। রাজ্যে এক লক্ষের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য, দীর্ঘদিন এইসব পদে নিয়োগ হয়নি। দেশের মধ্যে শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগ না করার ক্ষেত্রে রাজ্য তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
ভারতে শিক্ষকদের শূন্য পদের করুণ অবস্থা নিয়ে ইউনেস্কো সম্প্রতি এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে মোট ১১,১৬,০০০ শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগ হয়নি। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে শিক্ষকের শূন্য পদ ৩,৩০,০০০, বিহারে ২,২০,০০০। আর পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের ১,১০,০০০ শূন্য পদে নিয়োগ হয়নি। দেশের গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ বিপজ্জনকভাবে কমে গিয়েছে বলে ইউনেস্কোর রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। সারা দেশে শিক্ষকদের মোট শূন্য পদ ১১,১৬,০০০-এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে, বলছে এই রিপোর্ট। ফলে বিশেষত রাজ্যের গ্রামের স্কুলগুলো শিক্ষকের অভাবে বেশি ধুঁকছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে এগারোবার স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) পরীক্ষার মাধ্যমে ১,১২,০০০ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। ২০১২ সালে এসএসসির মাধ্যমে একবার এবং প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের মাধ্যমে দুবার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এসএসসির মাধ্যমে ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো আটকে রয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে যখনই শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে, তখন থেকেই সরকারের ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে চাকরি প্রার্থীদের। বেনিয়ম আর দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যে কলকাতা হাইকোর্ট উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে মেধা তালিকা প্রকাশের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়। শূন্য পদ এবং যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়োগ করা হয়নি। ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরে ৪৬,০০০ এবং প্রাথমিকে ৩৭,০০০ পদ ফাঁকা ছিল। এর মধ্যে এসএসসির মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক নেওয়া হয়েছিল ৩০,০০০ এবং প্রাথমিকে ১৮,৭৯৩। প্রশ্ন হল, বাকি জায়গাগুলো খালি রাখা হল কেন? ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত নিয়োগের পরেও প্রাথমিকে ১৬,০০০ এবং মাধ্যমিকে ১৮,০০০-এর বেশি শিক্ষকের শূন্য পদ ছিল। সেইসব পদে নিয়োগ হয়নি।
রাজ্যের স্কুলগুলোতে পড়ুয়া আর শিক্ষকের অনুপাত কেমন তা জানানোর জন্য কয়েক বছর আগে রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তরকে চিঠি দেয় কেন্দ্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। ২০১৯ সালে কেন্দ্রকে দেওয়া চিঠি থেকে জানা যায়, রাজ্যের স্কুলগুলোতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে শুধুমাত্র বিজ্ঞান শাখায় অঙ্কের ৩,২১৩টি; জীববিদ্যার ২,১৭৮টি; পদার্থবিদ্যার ১,৭৯৫টি এবং রসায়নের ১,৭৮৭টি শূন্য পদ রয়েছে। গত দুবছরে বিজ্ঞান শাখায় কতজন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে, সেই তথ্যও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। সামগ্রিকভাবে স্কুলগুলোতে শিক্ষকের অভাব যে কতটা প্রকট, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ইউনেস্কোর রিপোর্টে।
স্বাভাবিকভাবেই বহু চাকরি প্রার্থী ছেলেমেয়ে এখন রাস্তায় নেমেছেন পরীক্ষার দাবিতে, আর যাঁরা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং পাস করেছিলেন কিন্তু অদ্ভুতভাবে বাদ পড়েছেন চূড়ান্ত অস্বচ্ছ তালিকা থেকে, তাঁরাও পথে নেমেছেন নিয়োগের দাবিতে। শিক্ষাব্যবস্থার উপর এর প্রভাব পড়েছে। করোনাকালে প্রায় দুবছর অধিকাংশ সময় স্কুল বন্ধ ছিল। তাই শিক্ষকের অভাব এতদিন বোঝা যায়নি। ২০২১ নভেম্বরে স্কুল খোলার পর দায়সারাভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা নিয়ে নেওয়া হল কেবলমাত্র অনলাইন ক্লাসের উপর ভিত্তি করে। একমাসেরও কম দিন অফলাইন ক্লাস হয়েছিল। এটা কোনো পরীক্ষার প্রস্তুতি হতে পারে না। তারপর আবার ওমিক্রনের কারণে স্কুল বন্ধ থাকে একমাসের মত। তারপর স্কুল খোলা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল অনেক স্কুলে অনেক বিষয়ের ক্লাস হচ্ছে না শিক্ষকের অভাবে। শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তব হল অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর প্রস্তুতির এখন মূল স্তম্ভ গৃহশিক্ষকরা, স্কুল নয়।
ছেলেমেয়েদের পড়ার বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে, গভীরে বুঝতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা অপরিহার্য। সেখানে ফাঁক থেকে গেলে বেশি নম্বর নিয়ে পাস করলেও সারাজীবন ভুগতে হয়। সরকার কি সেটাই চায়? সরকার কি ভেবে নিয়েছে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষক নিয়োগের দরকার নেই? এসএমএসের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে নিয়োগ হবে, আর ভোট এসে পড়লে ঘোষণা করে কিছু নিয়োগ বা মাঝেমধ্যে কিছু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে?
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রাজনৈতিক সুবিধা অনেক। ভেট আর ভোট – দুটোই সুনিশ্চিত। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক নিয়োগ না করলে শিক্ষকের অভাবে আস্তে আস্তে স্কুলগুলো উঠে যাবে। সরকারপোষিত স্কুলগুলোকে ছাত্রছাত্রী নেই দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে, কর্মরত শিক্ষকদের উদ্বৃত্ত দেখিয়ে বদলি শুরু হবে। ইতিমধ্যেই বেশকিছু স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, বদলির ঘটনাও ঘটেছে। শিক্ষক নিয়োগ না হলেও শিক্ষার চাহিদা থাকবেই। সুতরাং বিকল্প হিসাবে বেসরকারি স্কুল থেকে মানুষ চড়া দামে শিক্ষা কিনতে বাধ্য হবে। আজ যেমন টাকার জোরে চাকরি হচ্ছে, তেমনি টাকার জোরে শিক্ষা হবে। একদা ক্রিকেটের রাজা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা আজ পরিযায়ী ক্রিকেটার হয়ে বিভিন্ন দেশে টুয়েন্টি টুয়েন্টি খেলে রোজগার করে। আমরা যারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছেছি বা বাছব, তাদেরও তখন পরিযায়ী হতে হবে। আক্ষরিক অর্থে “খেলা হবে”।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
এসএসসি: রাত জেগে পড়াশোনা করেছিলাম কি পুলিশের মার খাব বলে?
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।